শিং ও মাগুর মাছ চাষ কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়। আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় আমিষের প্রধান উৎস হচ্ছে মাছ। এটি একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০% আমিষের যোগান দেয় মাছ। একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ৮০ গ্রাম আমিষ জাতীয় খাবারের প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে প্রায় মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০.৫০% বা ১৫৬ লক্ষ লোক মৎস্য সেক্টর থেকে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন- মাছ চাষ, মাছ ধরা, বিক্রয় ইত্যাদি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। মাছ চাষের মাধ্যমে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। দেশে রপ্তানি আয়ের ২.৭৩% আসে মৎস্য খাত হতে। মাছ চাষ বৃদ্ধি করে এ আয় আরও বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশে অনেক পতিত পুকুর, ডোবা ও নালা রয়েছে যেখানে মাছ চাষ করা হয় না। এসব জলাশয়ে মাছ চাষ করে গ্রামের গরিব ও স্বল্প আয়ের লোকেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
এ আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- শিং ও মাগুর কোন জাতীয় মাছ তা জানতে পারবেন; শিং মাছ ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে পারবেন; কৈ মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে পারবেন; কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
(১) শিং ও মাগুর কোন জাতীয় মাছ?
শিং ও মাগুর মাছ উভয়টি সর্বভূক্ত জাতীয় মাছ এবং প্রজনন কাল বছরে একবার।
শিং ও মাগুর উভয় মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ফুলকা ছাড়াও এদের অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন নিতে পারে। এতে করে এরা অল্প অক্সিজেনযুক্ত পানিতে দীর্ঘক্ষণ বেচে থাকতে পারে। এজন্য শিং ও মাগুর মাছকে জিওল মাছ বলা হয়।
- শিং মাছ লম্বা ও কালো রং এর মাছ। এদের দেহ চাপা ও পেট গোলাকার। এদের মাথা উপরে নিচে চেপ্টা, ক্ষুদ্রাকৃতি চোখ, মাথা সম্মুখভাবে পাশ্বদেশে অবস্থিত। এদের বক্ষ পাখনায় বিষযুক্ত দুটি বড় কাটা থাকে। পৃষ্ট পাখনা অত্যন্ত ছোট এবং গায়ে কোনো আঁইশ থাকে না।
- শিং মাছের বক্ষ পাখনা বিষ গ্রন্থি যুক্ত এজন্য কাটার আঘাতে মানুষের যন্ত্রণা হয়।
- শিং মাছের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি লাল।
- মাগুর মাছের দেহ লম্বাটে সামনে অবনমিত পশ্চাতে চাপা এবং লেজ ক্রমান্বয়ে সরু। এ মাছের গায়ে কোনো আঁইশ থাকে না।
- মাগুরের মাছের দেহের রং বাদামি খয়েরি।
(২) শিং ও মাগুর মাছ চাষের সুবিধা
১। শিং ও মাগুর মাছ সুস্বাদু এবং বাজারে এদের চাহিদা বেশি।
২। ডোবা, ছোট জলাশয়, পুকুর ও খাচাতে এদের চাষ করা যায়।
৩। অন্যান্য মাছের তুলনায় কম খাদ্য লাগে।
৪। সাধারণ প্রতিকূল অবস্থায় এরা বেঁচে থাকতে পারে।
৫। হ্যাচারিতে এদের পোনা উৎপাদন করা যায়।
৬। এদের একক এবং মিশ্র চাষ করা যায়।
৭। এদের রোগ বালাই কম হয়।
(৩) শিং ও মাগুর মাছের চাষ পদ্ধতি
ক) পুকুর নির্বাচন
- শিং ও মাগুর মাছ চাষের পানির পুকুরের গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়।
- বন্যামুক্ত আয়তাকার পুকুর চাষের জন্য উপযুক্ত।
- পুকুরের আয়তন ৪০-৫০ শতাংশ হলে ভালো।
- নতুন পুকুরের চেয়ে পুরাতন পুকুরে শিং মাছ চাষ ভালো হয়।
খ) পুকুর প্রস্তুতি
- চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরটির পাড় ভাঙ্গা থাকলে মেরামত করতে হবে।
- কচুরিপানাসহ অন্যান্য জলজ আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে।
- পুকুর শুকানো হলে তলায় চুন, গোবর, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, ইউরিয়া, টিএসপি সার প্রতি শতকে নির্ধারিত হারে প্রয়োগ করতে হবে।
- মাগুর মাছ সামান্য বৃষ্টি বা বন্যা হলে প্রায়শই হেঁটে পুকুর থেকে বাইরে চলে যায়। এজন্য পুকুরের চারপাশে পাড়ের ওপর অন্তত ৩০ সে.মি. উচু করে নেটের বেষ্টনি বা ভেড়া নির্মাণ করতে হবে।
- এছাড়া নাইলনের নেট খুঁটির সাথে বেঁধে পাড়ের চার দিকে ঘিরে দিতে হবে এবং নেটের নিচের দিক মাটির কিছুটা ভিতরে দিয়ে আটকিয়ে দিতে হবে। যাতে সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি পুকুরে ঢুকতে না পারে।
গ) পোনা ছাড়া
- পুকুর প্রস্তুতির ৫-৭ দিন পর প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০টি মাগুর মাছের পোনা এবং ৩০০-৪০০টি পর্যন্ত শিং মাছের পোনা মুজত করা যেতে পারে।
- মিশ্র চাষের ক্ষেত্রের কার্পজাতীয় মাছের সাথে প্রতি শতাংশে ৫০টি পর্যন্ত শিং বা মাগুর মাছের পোনা ছাড়া যায়।
- পোনা ছাড়ার পূর্বে পোনাকে এন্টি ফাংগাস মেডিসিন বা লবণ পানিতে শোধন করতে হবে।
- সকাল বা বিকাল ঠান্ডা আবহাওয়া পুকুরের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়।
খ) খাদ্য ব্যবস্থাপনা
শিং ও মাগুর মাছকে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হয়। এদের সম্পুরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদান ও এদের মিশ্রনের হার নিচে দেওয়া হলো-
শিং ও মাগুরের সম্পূরক খাদ্য তৈরির উপাদান ও মিশ্রণ হার (%):
খাদ্য উপাদান | মিশ্রণ হার % |
ফিস মিল | ২০ |
মুরগির নাড়ি, ভূড়ি ও হাড় চূর্ণ (মিট বোন ও বোন মিল | ২০ |
সরিষার খৈল | ২০ |
চালের কুড়া | ৩০ |
গমের ভূষি | ১২ |
আটা/চিটাগুড় | ৫ |
ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ | ১ গ্রাম/কেজি |
সয়াবিন চূর্ণ | ৮ |
ভূট্টা চূর্ণ | ৫ |
শিং/মাগুর মাছের দৈহিক ওজনের সাথে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নিম্নরূপ:
মাছের গড় ওজন (গ্রাম) | দৈহিক খাদ্যের পরিমাণ (%) |
১-৩ | ১৫-২০ |
৪-১০ | ১২-১৫ |
১১-৫০ | ৮-১০ |
৫১-১০০ | ৫-৪ |
>১০০ |
গ) খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি
- সকাল ও বিকাল দিনে মোট দুই (২) বার প্রতিদিনের জন্য নির্ধারিত খাবার দিতে হবে।
- খাবারগুলো কম পানিতে মিশিয়ে ছোট বল আকারে তৈরি করে পুকুরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে দিতে হবে।
- পানির নিচে স্থাপিত ট্রেতে খাবার দেওয়া যেতে পারে।
- খাবার তৈরির ২৪ ঘন্টা আগেই খাদ্য উপকরণ সরিষার খৈল ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- বাজার থেকে কৃত্রিম খাবার কিনেও মাছকে প্রদান করা যেতে পারে। তবে বাজারের খাবার দামে কিছুটা বেশি হতে পারে।
ঘ) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
চাষ করা মাছগুলো নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না এবং মাছের মধ্যে কোনো প্রকারের রোগাক্রান্ত অবস্থা পরিলক্ষিত আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
শিং মাগুর মাছে সাধারণত কোনো রোগ হয় না। তবে শীতকালে মাঝে মাঝে ক্ষত রোগ, লেজ ও পাখনা পঁচা রোগ এবং পেট ফুলা রোগ দেওয়া যায়। এসব রোগের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিম্নরূপ-
লেজ ও পাখনা পচা রোগ: মিক্সোব্যাক্টর ও অ্যারোমোনাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রিত করে আক্রান্ত মাছগুলোকে ৩-৫ মিনিট চুবায়ে রেখে গোসল করাতে হবে। এসময় পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগে এ রোগ দূর হতে পারে।
ক্ষত রোগ: এ রোগ ছত্রাকের আক্রমণের হয়। এক্ষেত্রে মাছের মাংসপেশিগুলোতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
এ রোগের আরোগ্য লাভের জন্য পুকুরে ১-১.৫ মিটার পানির গভীরতায় প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন এবং ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হয়। এতে ২ সপ্তাহের মধ্যেই মাছগুলো আরোগ্য লাভ করে। তাছাড়া শরীতের শুরুতে উপরোক্ত হারে চুন ও লবণ প্রয়োগ করলে প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করের এবং শীতকালে এ রোগ হয় না।
পেট ফুলা রোগ: এই রোগটি ব্যাকটেরিয়াজনিত। এতে মাছে পেট ফুলে যায় ও মাছ ভারসাম্যহীনভাবে পানিতে চলাফেরা করে এবং পরিশেষে মৃত্যু ঘটে।
এক্ষেত্রে আক্রান্ত মাছের পেট থেকে খালি সিরিঞ্জ দিয়ে পানি বের করতে হয়। এক কেজি খাবারের সাথে ২০০ মিলিগ্রাম ক্লোরামফেনিকল মিশিয়ে খাওয়ালে এ সমস্যা দূর হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত পুকুরে ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ঙ) মাছ আহরণ
- সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা করা হলে ৭-১০ মাসেই শিং ও মাগুর মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হয় এবং উক্ত সময়ে শিং মাছ গড়ে ১০০-১২৫ গ্রাম ও মাগুর ১২০-১৪০ গ্রাম হয়ে থাকে।
- পুকুরে জাল টেনে আংশিক মাছ আহরণ করতে হবে। সম্পূর্ণ পুকুর শুকায়ে সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হবে।
(৪) শিং, মাগুর ও কৈ চাষের সুবিধাসমূহ
আবহমানকাল হতে বাংলাদেশে কৈ, শিং ও মাগুর মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয় মাছ হিসেবে পরিচিত। এসব মাছ খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। সুদূর অতীতে এ মাছগুলি প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের জলাশয়ে প্রচুর পাওয়া যেত। কৃত্তিম প্ৰজনন ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং চাহিদা ও বাজারদর বেশি হওয়ায় কৈ এর পাশাপাশি দেশী শিং ও মাগুর মাছের বাণিজ্যিক চাষও দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
- কৈ, শিং ও মাগুর অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর মাছ।
- অসুস্থ ও রোগমুক্তির পর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এগুলো সমাদৃত মাছ।
- অতিরিক্ত শ্বাস অঙ্গ থাকায় এরা বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে দীর্ঘ সময় ডাঙ্গায় বেঁচে থাকতে পারে।
- ৩ মাসের মধ্যে বিক্রয়যোগ্য হয়, ফলে একই জলাশয়ে বছরে ৩-৪ বার চাষ করা সম্ভব (সঠিক নার্সারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে)।
- তুলনায় চাহিদা ও বাজার মূল্য অত্যাধিক বেশি হওয়ায় এ মাছগুলোর বাণিজ্যিক চাষ দিন দিন বাড়ছে।
- আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যাপক চাহিদা আছে।
(৫) কৈ, শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি
ক) কৈ মাছের নার্সারি ও চাষ ব্যবস্থাপনা
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
- নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-৫০ শতাংশ এবং গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার।
- পুকুর শুকিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ ও প্রাণী দূর করাই উত্তম; তবে পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ১ ফুট পানির গভীরতায় ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে।
- রোটেনন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে চুন পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশ প্রতি ৫০০ গ্রাম খৈল, ১৫০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫-১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া সার পানিতে গুলে ছিটিয়ে এবং টিএসপি ও সরিষার খৈল ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- সার প্রয়োগের ৫-৬ দিন পর পুকুরের পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হলে পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে।
- নার্সারি পুকুরের চারপাশে ৩-৪ ফুট উঁচু মশারির জালের বেষ্টনী দিতে হবে। এর ফলে ব্যাঙ ও সাপ পুকুরে প্রবেশ করে পোনার ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।
- হাঁসপোকা ও ক্ষতিকারক প্লাংকটন বিনষ্ট করার জন্য রেণু পোনা মজুদের ২৪ ঘণ্টা আগে ৮-১০ মিলি সুমিথিয়ন প্রতি শতাংশে অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।
ধানী পোনা মজুদ:
নার্সারি পুকুরে ১৫-২০ দিন বয়সের ধানী পোনা প্রতি শতাংশে ৫,০০০-৬,০০০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
খ) মজুদ পুকুরে কৈ মাছের চাষ
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
- কৈ মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ মাছ চাষের জন্য ৪-৬ মাস পানি থাকে এ রকম ১৫-৫০ শতাংশের পুকুর নির্বাচন করতে হবে। তবে এর চেয়ে বড় পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায় ।
- পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- পুকুর সেচে পানি শুকিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ ও প্রাণী দূর করতে হবে।
- পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন (১ ফুট গভীরতার জন্য) প্রয়োগ করে অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ দূর করতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক।
- চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পরে পূর্বের নিয়মে সার প্রয়োগ করতে হবে।
- পোনা মজুদের পূর্বে পুকুরের চারিদিকে নাইলন জালের বেষ্টনী দিতে হবে।
- সার প্রয়োগের ৭/৮ দিন পরে পুকুরে পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা সংগ্রহ ও মজুদ:
- পুকুরে চাষের জন্য কৈ মাছের পোনা নিকটবর্তী ভাল হ্যাচারি হতে সংগ্রহ করে পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে পরিবহন করতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ০.৫-১.০ গ্রাম ওজনে সুস্থ সবল ৩০০-৪০০ টি পোনা মজুদ করতে হবে । তবে উন্নত ব্যবস্থাপনায় অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
- পোনা মজুদের সময় পোনাকে পুকুরের পানির সাথে ভালভাবে কন্ডিশনিং করে তারপর ছাড়তে হবে।
খাবার ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা:
পোনা মজুদের দিন থেকে ৩৫-৪০% আমিষ সমৃদ্ধ পিলেট খাদ্য নিম্নের ছক অনুযায়ী সকাল, দুপুর ও বিকালে পুকুরে ছিটিয়ে সরবরাহ করতে হবে।
নিম্নে কৈ মাছের খাদ্য প্রয়োগের তালিকা (প্রতি শতাংশে) উপস্থাপন করা হলো-
দিন | দৈহিক ওজন (গ্ৰাম) | খাদ্য প্রয়োগের হার (%) | প্রতি দিনের খাদ্য (গ্রাম) |
১-৯ | ১ | ২০ | ৬০ |
১০-১৯ | ৪ | ১৫ | ১৬২ |
২০-২৯ | ৭ | ১২ | ২২৭ |
৩০-৩৯ | ১২ | ১০ | ৩২৪ |
৪০-৪৯ | ২০ | ৮ | ৪৩২ |
৫০-৫৯ | ২৮ | ৭ | ৫৩০ |
৬০-৬৯ | ৩৮ | ৬ | ৬১৬ |
৭০-৭৯ | ৫২ | ৫ | ৭০২ |
৮০-৮৯ | ৬৫ | ৪.৫ | ৭৯০ |
৯০-৯৯ | ৮০ | ৪ | ৮৬৪ |
১০০-১২০ | ১০০ | ৩.৫ | ৯৪৫ |
- এছাড়াও স্থানীয়ভাবে উপকরণ সংগ্রহ করে খাদ্য তৈরি করেও পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
- পোনা মজুদের পর ৩০ দিন অন্তর অন্তর শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে ।
- কৈ মাছের পুকুরে প্রচুর প্লাংকটনের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, এই প্লাংকটন নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রতি শতাংশে মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা ১২ টি ও সিলভার কার্পের পোনা ৪ টি মজুদ করা যেতে পারে।
- প্রয়োজন মোতাবেক পুকুরে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
শীতকালীন সতর্কতা:
সাধারনত শীতকালে থাই কৈ মাছে ক্ষতরোগ দেখা দেয়। এজন্য শীতের পূর্বেই যথাসম্ভব থাই কৈ মাছের বাজারজাত করা ভাল। তবে পুকুরে যদি বাজারজাতকরণের অনুপযোগী মাছ থাকে তবে শীতকালে অবশ্যই নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
- পুকুরে গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ করতে হবে।
- প্রতি মাসে শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কৈ মাছের রোগ বালাই:
পানির গুণাগুণ মাছ চাষের উপযোগী না থাকলে কৈ মাছ সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। রোগবালাই এ মাছের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অন্তরায়। পুকুরে সংক্রামক রোগবালাই এর আক্রমণ হলে মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে, চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
রোগ প্রতিরোধ:
- সঠিক ঘনত্বে মাছ চাষ করতে হবে।
- মাঝে মাঝে হররা টেনে দিতে হবে।
- পরিমিত পরিমাণ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
- পিএইচ উপযোগী মাত্রায় রাখার জন্য প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম চুন/জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতিকার বা চিকিৎসা:
- অধিক আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম হারে পুকুরে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রতি কেজি মাছের দেহ ওজনের জন্য ৫০ মিলিগ্রাম টেট্রাসাইক্লিন খাবারের সাথে মিশিয়ে ৭ দিন খাওয়াতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ২০০-৩০০ গ্রাম লবণ পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন:
উল্লেখিত পদ্ধতিতে কৈ মাছ চাষ করলে ৪-৫ মাসের মধ্যে ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের হবে। এ সময় জাল টেনে ও পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনায় প্রতি ১০০ শতাংশে ৩,০০০-৩,৫০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়।
গ) শিং-মাগুর মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা
পুকুর প্রস্তুতকরণ পূর্বের অনুরুপ।
- সঠিক উপায়ে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করে ০৮-১০ দিন বয়সের ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ টি ধানী পোনা মজুদ করতে হবে।
- পোনা মজুদের সময় মজুদকৃত পুকুরের পানির সাথে ভালোভাবে কন্ডিশনিং করে তারপর ছাড়তে হবে।
- প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন পোনার দেহের ওজনের দ্বিগুণ হারে ২-৩ বার নার্সারি খাবার দিতে হবে। ধানী পোনা ছাড়ার ৩০-৪০ দিনের মধ্যে ২-৩ ইঞ্চি চারা/আঙ্গুলি পোনায় পরিণত হয় যা চাষের পুকুরে ব্যবহারের উপযোগী হয়।
ঘ) শিং, মাগুর মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
- শিং, মাগুর মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ মাছ চাষের জন্য ২০-৫০ শতাংশের ১.০-১.৫ মিটার গভীরতার পুকুর নির্বাচন করতে হবে।
- নিয়মানুযায়ী পুকুর প্রস্তুতি শেষ করে পুকুরের চারপাশে ৩-৪ ফুট উঁচু মশারীর জালের বেষ্টনী দিতে হবে।
- প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম খৈল, ১৫০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পুকুরের পানি সবুজ বা হালকা বাদামী হলে পুকুরে শতাংশ প্রতি ৩০০-৫০০ টি চারা পোনা মজুদ করতে হবে। সেই সঙ্গে শতাংশে ১০-১৫ টি সিলভার কার্প/কাতলা মাছের পোনা দেয়া যেতে পারে।
- পোনা ছাড়ার ঘনত্ব নির্ভর করে চাষির অভিজ্ঞতা, আর্থিক স্বচ্ছলতা, মাছ চাষির আগ্রহ, পুকুরের মাটি ও পানির গুণাগুণ এবং চাষ পদ্ধতির ওপর। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য পোনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
ঙ) শিং, মাগুর মাছ চাষের পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- দৈনিক দু’বার মাছের দেহের ওজনের ৫-৬% হারে খাবার দিতে হবে।
- তবে বাণিজ্যিকভাবে শিং মাগুর মাছের চাষের ক্ষেত্রে ৩৫-৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ পিলেট খাদ্য ব্যবহার অপরিহার্য।
- বাজারে শিং, মাগুরের আলাদা খাদ্য পাওয়া যায় অথবা পাঙ্গাস ফিড (গ্রোয়ার-১) দেয়া যেতে পারে।
- খাবার হিসেবে ফিসমিল ৩৫%, মিহি কুড়া ২০%, গমের ভূষি ১৫%, সরিষার খৈল ২৫%, চিটাগুড় ৫% বাইন্ডার হিসেবে ও ভিটামিন ০.১% একত্রে মিশিয়ে বল আকারে দেয়া যেতে পারে।
- শিং ও মাগুর মাছের চাষ পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে ৬-৭ মাসে বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়। এ সময় শিং মাছের গড় ওজন ৭৫-১০০ গ্রাম এবং মাগুর মাছের গড় ওজন ৯০-১০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানলাম।
আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন- খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ডোবা-নালায় শিং, মাগুর, পাবদা ও টেংরা মাছ এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশ বিপর্যয় ও অত্যাধিক আহরণের কারণে বর্তমানে এসব মাছের প্রাপ্যতা অনেক কমে গেছে। চাষের মাধ্যমে এদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
শিং ও মাগুর মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের ফুলকা ছাড়াও অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। ফলে এরা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। এদেরকে জিওল মাছও বলা হয়। সঠিকভাবে খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করা হলে এদের অধিক উৎপাদন সম্ভব।
[সূত্র: ওপেন স্কুল; মৎস্য অধিদপ্তর (fisheries.gov.bd); ইন বাংলা নেট কৃষি (inbangla.net/krisi]