শিম সবজি হিসেবে বাংলাদেশের সর্বত্র বাণিজ্যিকভাবে ও বসতবাড়িতে চাষাবাদ হচ্ছে। শিমে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘সি’, ও ক্যারোটিন বিদ্যমান। শিমে প্রোটিনের সমৃদ্ধতা এবং আঁশ জাতীয় উপাদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিম শীতকালীন সবজি হলেও বর্তমানে গ্রীষ্মকালে এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে।
(১) শিমের জাত সমূহ ও তাদের বৈশিষ্ট্য
ক) বারি শিম-১
‘বারি শিম-১’ নামে উফশী শিম জাতটি বাছাইয়ের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়।
- শিমের বর্ণ সবুজ।
- প্রতিটি শিম ১০-১১ সেমি লম্বা ও ২.০-২.৫ সেমি প্রশ্বস্ত।
- প্রতিটি শিমের ওজন ১০-১১ গ্রাম এবং শিমপ্রতি ৪-৫টি বীজ হয়।
- প্রতি গাছে ৪৫০-৫০০টি শিম ধরে।
- শিম পাকার পূর্ব পর্যন্ত নরম থাকে এবং খেতে সুস্বাদু।
- জাত মাঝারী আগাম।
- এ জাতটির জীবনকাল ২০০-২২০ দিন।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ২০-২২ টন ফলন পাওয়া যায়।
- জাতটি ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধী।
- বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়।
খ) বারি শিম-২
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত এ জাতটি ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়।
- প্রতিটি শিম ১০-১৩ সেমি লম্বা ও ১.৫-৩.০ সেমি প্রশ্বস্থ।
- প্রতি শিমের ওজন ৭-৮ গ্রাম।
- প্রতিটি শিমে ৪-৫টি বীজ হয়।
- প্রতিটি গাছে ৩৮০-৪০০টি শিম ধরে।
- পাকার পূর্ব পর্যন্ত ফল নরম থাকে।
- এক মৌসুমে ১৫ থেকে ১৬ বার শিম সংগ্রহ করা যায়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতটি চাষাবাদ করা যায়।
- জীবনকাল ১৯০-২১০ দিন।
- ফলন ১২-১৪ টন/হেক্টর।
গ) বারি শিম-৩ (গ্রীষ্মকালীন)
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি শিম-৩’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়।
- তাপ অসংবেদনশীল ও দিবস নিরপেক্ষ জাত।
- বছরের যে কোন সময় চাষ করা যায়।
- ফুল সাদা রঙের এবং শিম সবুজ বর্ণের।
- প্রতিটি শিমের ওজন ৬-৭ গ্রাম।
- প্রতিটি শিমে ৪-৫টি বীজ হয়।
- গাছপ্রতি ৪৫০-৫০০টি শিম ধরে এবং পাকার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত নরম থাকে।
- খেতে সুস্বাদু।
- ১২-১৪ বার শিম সংগ্রহ করা যায়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়।
- গ্রীষ্মকালে চাষ করতে হলে মার্চ মাসে এবং শীতকালের জন্য জুন মাসে বীজ বপন/চারা রোপণ করতে হয়।
- জীবনকাল ১৫০-১৮০ দিন।
- ফলন ৯-১০ টন/হেক্টর (গ্রীষ্মকালে) এবং ১৫-১৮ টন/হেক্টর (শীতকালে)।
ঘ) বারি শিম-৪
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি শিম-৪’ জাতটি মুক্তায়িত হয়েছে।
- এটি উচ্চ ফলনশীল শিমের জাত এবং দীর্ঘদিন ব্যাপী সংগ্রহ করা যায়।
- শিম কাস্তে আকৃতির।
- ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ সহনশীল জাত।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়।
- আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে এ জাতের বীজ বপন করা যায়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১৬-১৮ টন।
ঙ) বারি শিম-৫
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি শিম-৫’ জাতটি মুক্তায়িত হয়েছে।
- এ জাতের গাছ খাটো প্রকৃতির তাই মাচা ছাড়াই ছোট খুঁটি দিয়ে চাষ করা যায়।
- গাছের উচ্চতা ৩৫-৪৫ সেমি।
- প্রতি গাছে ৫০-৬০টি শিম পাওয়া যায় এবং শিম ৯-১০ সেমি লম্বা, সবুজ, নরম মাংসল, কম আঁশযুক্ত হয়ে থাকে।
- লাগানোর ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে ফুল আসতে শুরু করে এবং ৭৫-৮৫ দিন পর্যন্ত শিম সংগ্রহ করা যায়।
- সারা দেশে সবজি চাষের এলাকায় এ জাতটি চাষ করা যায়।
- বীজের হার প্রতি হেক্টরে ১২-১৫ কেজি।
- আশ্বিন মাসে বপন করে কার্তিক মাসে রোপণ করলে ফলন ভাল হয়।
- রোপণ দূরত্ব ৬০ x ৫০ সেমি।
- জীবনকাল ৭৫-৮৫ দিন।
- ফলন ১২-১৪ টন/হেক্টর।
চ) বারি শিম-৬
- বাছাই প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত এ জাতের শিম লম্বা, নলডক ধরনের।
- পডগুলো খুব লম্বা, ২০-২২ সেমি লম্বা ও ১.৭৫-২.২৫ সেমি প্রশ্বস্থ।
- পডগুলো কাস্তে আকৃতির, নরম মাংসল ও আঁশ বিহীন।
- গাছপ্রতি পডের সংখ্যা ২৫০-৩০০টি।
- বীজ সামান্য চ্যাপ্টা, কুচকানো কালচে বাদামী রঙের।
- জাতটি বাংলাদেশের সকল এলাকায় চাষাবাদ উপযোগী।
- জীবনকাল ২২০-২৫০ দিন।
- ফলন ১৭-২০ টন/হেক্টর।
ছ) বারি শিম-৭ (গ্রীষ্মকালীন)
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘বারি শিম-৭’ জাতটি অবমুক্ত করা হয়।
- ‘বারি শিম-৭’ একটি উচ্চ ফলনশীল গ্রীষ্মকালীন জাত, উচ্চ তাপমাত্রায় ফুল ও ফল ধারণে সক্ষম এবং সারা দেশে চাষ উপযোগী।
- প্রতি গাছে ৪০০-৫০০টি শিম পাওয়া যায় এবং শিম ৮-১০ সেমি লম্বা, সবুজ, নরম মাংসল, কম আঁশযুক্ত হয়ে থাকে।
- কিনারাসহ পুরো ফলের ত্বক সবুজ বর্ণ বিশিষ্ট।
- ফলন ১২-১৩ টন/হেক্টর।
জ) বারি শিম-৮
বারি শিম-৮ একটি উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন জাত, সারা দেশে চাষ উপযোগী।
- এটি অন্যান্য চাষযোগ্য শিমের তুলনায় ২০-৩০ দিন আগে সংগ্রহ করা যায়।
- শিম নরম, মাংসল ও আঁশ কম।
- শিম সবুজ লম্বা, কিছুটা বাকানো।
- বীজ আকারে বড়।
- হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২০-২২ টন/হেক্টর।
- পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়।
ঝ) বারি শিম-৯ (খাইস্যা)
- জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বড় ও পুষ্ট বীজ; বীজ গোলাকার এবং রং সাদাটে।
- ১০০ টি বীজের গড় ওজন ১৩০ গ্রাম এবং ১০০ কেজি শিম থেকে প্রায় ৪৯ কেজি ভক্ষণযোগ্য বীজ (খাইস্যা) পওয়া যায়।
- গাছের কান্ড সরু, নলাকার ও সবুজ বর্ণের এবং প্রধান কান্ড কিছুটা দীর্ঘ হওয়ার পরই শাখা- প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
- কান্ডে কোন আকর্ষী নেই তাই বাউনী পেচিয়ে উপরের দিকে উঠে।
- ফুল সাদা এবং পাপড়ি মেলার ২-৩ দিন পর ফুল ঝরে পড়ে।
- সাধারণত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফুল ধরা শুরু করে তিন মাসাধিক কাল গাছে ফুল থাকে।
- শিমের শুঁটি চ্যাপ্টা, দৈর্ঘ্যে ৮.৮-৮.৯ সে.মি. ও প্রস্থে ২.০৩-২.২৩ সে.মি. এবং হালকা সবুজ বর্ণের।
- শিম সংগ্রহকাল সময় মূলত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
- প্রতি গাছে গড়ে ৬৮৫-৭১৫ টি পর্যন্ত শিম পাওয়া যায়।
ঞ) বারি শিম-১০ (খাইস্যা)
- জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বড় ও পুষ্ট বীজ; বীজ কিছুটা লম্বাটে এবং রং গোলাপী;
- ১০০ টি বীজের গড় ওজন ১২৯ গ্রাম এবং ১০০ কেজি শিম থেকে প্রায় ৪৪ কেজি ভক্ষণযোগ্য বীজ (খাইস্যা) পওয়া যায়।
- গাছের কান্ড, শাখা- প্রশাখা, পাতা ও ফুলের বৈশিষ্ট্য বারি শিম-৯ এর অনুরূপ।
- সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফুল ধরা শুরু করে আড়াই মাসাধিক কাল গাছে ফুল থাকে।
- শিমের শুঁটি লম্বা এবং মাথার দিকে সুচালো, দৈর্ঘ্যে ১১.২-১১.৪ সে.মি. ও প্রস্থে ১.৯৫-২.২২ সে.মি. এবং গাঢ় সবুজ বর্ণের।
- বীজের আকর্ষণীয় রঙের কারণে এর ভোক্তা চাহিদা বেশি এবং বাজার মূল্যও অধিক যা অন্যান্য দেশি শিমের বারি শিম-১০ এর শুঁটি ও বীজ জাত থেকে একে পৃথক করেছে।
- শিম সংগ্রহকাল মূলত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত।
- প্রতিটি গাছে গড়ে ৫৪৯-৫৭৫ টি পর্যন্ত শিম পাওয়া যায়।
(২) শিম চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত বর্ণনা
ক) মাটি ও জলবায়ু
- সব ধরনের মাটিতেই শিম জন্মে। তবে সুনিষ্কাশিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি ভাল ফলনের জন্য উপযুক্ত।
- ফসলের অঙ্গজ বৃদ্ধি ও প্রজনন পর্যায়ের জন্য তাপমাত্রা ও দিবস দৈর্ঘ্য যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এ সবজির অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র্র্র্র জলবায়ু এবং দীর্ঘ দিবস প্রয়োজন। আবার প্রজনন ধাপের জন্য নিম্ন তাপমাত্রাসহ হ্রাস দিবস প্রয়োজন।
- লক্ষ্য করা যায় যে, শিম যখনই বপন করা হউক না কেন শীতের প্রভাব না পড়লে পুষ্পায়ন ঘটে না। তবে গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো তাপ ও দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় বছরের যে কোন সময় বপন/রোপণ করলে পুষ্পায়ন ঘটে।
খ) জীবনকাল
আগাম জাত: ১৩০- ১৬০ দিন (বীজ সংগ্রহ পর্যন্ত)। নাবী জাত: ১৫০- ২০০ দিন (বীজ সংগ্রহ পর্যন্ত)।
গ) বীজ বপনের সময়
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝী থেকে বীজ বপন করা যেতে পারে। তবে আগাম ফসলের জন্য জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝী থেকে আষাঢ়ের মাঝামাঝী (জুন মাস) বীজ বপন করা উত্তম। গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো বছরের যে কোন সময় বপন করা যায়। বপনের সময় দূরত্ব এবং বপন পদ্ধতির উপর বীজের হার নির্ভর করে।
ঘ) বীজের হার
প্রতি হেক্টরে ৭.৫ কেজি, একরে ৩.০ কেজি এবং শতকে ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন
ঙ) জমি তৈরি
- জমি ৪-৫টি চাষ দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গে খুব পরিপাটি করে তৈরি করতে হয়। এর পর সমতল জমিতে সঠিক দূরত্বে উঁচু মাদা তৈরি করে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা যায়। তবে সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধা এবং পরবর্তী পরিচর্যার সুবিধার জন্য মিড়ি তৈরি করে মিড়িতে বীজ বপন করা সবচেয়ে ভাল।
- মিড়ি ১৫ থেকে ২৫ সেমি উঁচু এবং ২.৫ মিটার প্রশ্বস্ত হবে।
- জমির প্রকৃতি এবং কাজের সুবিধা বিবেচনা করে মিড়ির দৈর্ঘ্য ঠিক করতে হয়। সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধার জন্য পাশাপাশি দুটি মিড়ির মাঝখানে ৫০ সেমি প্রশ্বস্ত ১৫ থেকে ২৫ সেমি গভীর পিলি রাখতে হয়।
- ২.৫ মিটার প্রশ্বস্ত মিড়ির উভয় পার্শ্বে ৫০ সেমি করে বাদ দিয়ে ১.৫ মিটার দূরত্বে মিড়ির লম্বালম্বি দু’টি লাইন টেনে নিতে হবে।
- মিড়ির ২ লাইন বা সারিতে ১.৫ মিটার দূরে দূরে ৩০×৩০×৩০ সেমি সাইজের মাদাতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করে তৈরি করে ফেলতে হবে।
- এতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫ মিটার এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হল ১.৫ মিটার।
- তাছাড়া ২টি মিড়ির মধ্যে ৫০ সেমি প্রশস্ত পিলি থাকায় পাশাপাশি দু’টি মিড়ির নিকটতম সারি দুটির দূরত্ব হল ১.৫ মিটার। তবে আজকাল ১ মিটার প্রস্থ বেডে ও একক সারি পদ্ধতিতে ১.০-১.৫ মিটার দূরত্বে বীজ বপন/চারা রোপণ করা যায়।
উভয় পদ্ধতিতে একক আয়তনের জমিতে সমসংখ্যক গাছ সংকুলান হয়। তবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা ও ফসল উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনা সুবিধাজনক।
চ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি (কেজি/হেক্টর)
শিম ডাল জাতীয় শস্য। এতে সারের পরিমাণ বিশেষ করে নাইট্রোজেন সারের পরিমাণ কম লাগে।
শিম চাষে ‘হেক্টরপ্রতি’ সার প্রয়োগের পরিমাণ:
সারের নাম | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | বপন/চারা রোপণের সময় গর্তে প্রয়োগ | গর্তে উপরিপ্রয়োগ (বপনের/ রোপণের ৩০ দিন পর) |
গোবর | ১০০০০ কেজি | সব | – | – |
ইউরিয়া | ২৫ কেজি | – | ১২.৫ কেজি | ১২.৫ কেজি |
টিএসপি | ৯০ কেজি | – | সব | – |
এমওপি | ৬০ কেজি | – | ৩০ কেজি | ৩০ কেজি |
জিপসাম (সালফার সার) | ৬০ কেজি | সব | – | – |
বোরিক এসিড (বোরন সার) | ৫ কেজি | সব | – | – |
প্রয়োগ পদ্ধতি:
- শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর সার এবং জিপসাম ও বরিক এসিড সবটুকু ছিটিয়ে জমিতে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বীজ বপন বা চারা রোপণের ৪-৫ দিন আগেই ইউরিয়া ও এমপি (পটাশ) সারের অর্ধেক এবং টিএসপি সারের সবটুকু একত্রে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে মাদার মাটির সাথে (১০ সেমি গভীর পর্যন্ত) কোদালের দ্বারা হালকাভাবে কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বপন/রোপণের ৩০ দিন পর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার মাদায় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- বপনকৃত বীজ থেকে চারা বের হওয়ার পর ৮-১০ দিনের মধ্যেই প্রতিটি মাদায় একটি সুস্থ সবল চারা রেখে বাকিগুলি উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- দেশি শিমের ক্ষেত সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
- গাছ ২৫-৩০ সেমি উঁচু হলেই বাউনী দিতে হবে এবং মাচা তৈরি করে শিম গাছকে তুলে দিতে হবে।
- তবে চারা গাছ মাচায় উঠা পর্যন্ত গোড়ার দিকে যেন না পেচাতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গোড়া পেচাতে (Coiling) না দিলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন প্রায় ১০-১৫% বেশি হয়।
- মাটির রস যাচাই করে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
- পুরাতন পাতা ও ফুল বিহীন ডগা/শাখা কেটে ফেলতে হবে।
জ) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- জাতভেদে বীজ বপনের ৯৫-১৪৫ দিন পর শিমের শুঁটি (পড) গাছ থেকে তুলে বাজারজাত করা যেতে পারে।
- ফুল ফোঁটার ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে শিম তোলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ৫-৭ দিন অন্তর অন্তর গাছ থেকে শিম তুললে মোট ১৩-১৪ বার গুণগত মানসম্পন্ন শুঁটি (পড) সংগ্রহ করা যায় এবং এতে হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৫-২০ টন শিম পাওয়া যায়।
(৩) শিম চাষে পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
ক) ফল ছিদ্রকারী পোকা
পোকার লার্ভা ফুল, ফুলের কুঁড়ি এবং ফল ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায়। এদের আক্রমণে প্রচুর পরিমাণে ফল নষ্ট হয় এবং বাজারে বিক্রির অনুপযোগী হয়ে যায়। একটি লার্ভা একাধিক ফুল নষ্ট করতে পারে। আক্রান্ত ফলে পোকার খাওয়ার চিহ্ন ও মল দেখা যায়। অত্যধিক আক্রমণে ফল ঝরে পড়ে এবং ফলন কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- পোকার লার্ভা প্রথমে ফুলের ভেতরে অবস্থান করে। আক্রান্ত ফুল ও ফল পোকার লার্ভাসহ সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
- জমিতে উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর অবমুক্ত করতে হবে। এক হেক্টর জমির জন্য প্রতি সপ্তাহে ১ ব্যাংকার ব্রাকন (৮০০- ১০০০টি পোকা) অবমুক্ত করতে হবে।
- জৈব বালাইনাশক (এমএনপিভি @ ০.২ গ্রাম/লিটার) প্রয়োগ করতে হবে।
- অত্যধিক আক্রান্ত এলাকায় আক্রমণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্পাইনোসেড (ট্রেসার ৪৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৪০ মিলি অথবা সাকসেস ১.২ মিলি) স্প্রে করতে হবে।
খ) জাবপোকা
- পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও নিম্ফ উভয়েই গাছের নতুন ডগা, কচি পাতা, ফুলের কুঁড়ি, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায়। কচি গাছে পোকার সংখ্যা বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।
- বয়স্ক গাছে এদের আক্রমণে পাতা কুচড়ে যায়, হলদে রঙ ধারণ করে, গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। গাছে ফুল ও ফল অবস্থায় আক্রমণ হলে ফুলের কুঁড়ি ও কচি ফল ঝরে পড়ে, কচি ডগা মরে যায়। এরা গাছে মোজাইক ভাইরাস রোগ ছড়ায়।
ব্যবস্থাপনা:
- পোকাগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ডগা এবং পাতায় দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। এই অবস্থায় এদেরকে হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
- নিম বীজের দ্রবণ (১ কেজি অর্ধভাঙা নিমবীজ ২০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) স্প্রে করতে হবে।
- অত্যধিক আক্রমণে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি অথবা ল্যাম্বডা সাইহেলোথ্রিন (সাইক্লোন ২.৫ ইসি বা ক্যারাটে ২.৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গ) পাতা সুরঙ্গকারী পোকা
- সদ্য জাত লার্ভা পাতা ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং পাতার দুই এপিডার্মাল স্তরের মাঝে সবুজ অংশ আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ করে খায়।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতার সমস্ত অংশে সুড়ঙ্গ দেখা যায় এবং দূর থেকে সমস্ত ক্ষেত পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়।
- পাতার সবুজ অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গাছে খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। লার্ভার খাওয়া অংশটুকু স্বচ্ছ পর্দার মতো দেখায় এবং আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- বিভিন্ন অপোষক ফসলের সহিত শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে। ফসলের জমি এবং আশপাশ আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- পূর্ণ বয়স্ক পোকা ধরার জন্য আঠালো হলুদ ফাঁদ (Yellow sticky trap) প্রয়োগ করতে হবে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে এসিফেট (এসাটাফ ৭৫ এসপি, টিডফেট ৭৫ এসপি, ফরচুনেট ৭৫ এসপি, হেসিফেট ৭৫ এসপি) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
- কীটনাশক প্রয়োগের ১৫ দিনের মধ্যে শিম উত্তোলন করা যাবে না।
ঘ) বিছাপোকা
পোকার লার্ভা গাছের পাতায় আক্রমণ করে ফসলের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। লার্ভাগুলো প্রাথমিক অবস্থায় দলবদ্ধভাবে পাতার নিচের অংশ থেকে খাওয়া শুরু করে এবং সমস্ত গাছ ঝাঝরা করে দেয়। অধিক আক্রমণে গাছ পাতাশূন্য হয়ে পড়ে, গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ ও আগাছা দমন করতে হবে। আলোর ফাঁদ দিয়ে মথকে আকৃষ্ট করে ধরে মারা যায়। কীড়া প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় বা গাছে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। এ সময় পোকাসহ পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ল্যাম্বডা সাইহেলোথ্রিন (ক্যারাটে ২.৫ ইসি বা রিভা ২.৫ ইসি বা জুবাস ২.৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
ঙ) ক্ষুদ্র লালমাকড়
এরা পাতা থেকে রস চুষে খায়। ফলে পাতার উপরের অংশে ফ্যাকাশে রং ধারণ করে এবং গাছের খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। অত্যধিক আক্রান্ত পাতা লালচে হয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণ বিঘ্ন হয় এবং ফলন কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- নিম বীজের দ্রবণ (১ কেজি অর্ধ ভাঙ্গা নিম বীজ ২০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) স্প্রে করতে হবে।
- এবামেকটিন (ভার্টিমেক ১.৮ ইসি বা সানমেকটিন ১.৮ ইসি বা এমবুশ ১.৮ ইসি বা লাকাদ ১.৮ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১.২ মিলি হারে অত্যধিক আক্রমণে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
(৪) শিমের রোগ বালাই দমন ব্যবস্তাপনা
ক) অ্যানথ্রাকনোজ বা ফল পচা
পাতায় বৃত্তাকার বাদামি দাগ ও তার চারপাশে হলুদাভ বলয় দেখা যায়। ফলে প্রথমে ছোট গোলাকার গভীর কালো দাগ পড়ে এবং দাগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দাগের কিনারা বরাবর চারপাশে কালো রঙের বেস্টনি দেখা যায়। পরবর্তীতে ফলে রোগের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, আক্রান্ত ফলে গভীর কালো দাগ দেখা যায়। ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায় এবং বাজারমূল্য কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- রোগ মুক্ত গাছ থেকে ভালো বীজ সংগ্রহ করে লাগাতে হবে।
- বপনের পূর্বে বীজ প্রভেক্স (২.৫ গ্রাম/কেজি) দিয়ে শোধন করে লাগাতে হবে।
- অতিরিক্ত আক্রমণে ডায়থেন এম-৪৫ (২ গ্রাম/লিটার) অথবা টিল্ট (০.৫ মিলি/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
খ) শিমের মোজাইক রোগ দমন
- এই রোগের কারণ ভাইরাস, এ রোগের ফলে পাতায় হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ মোজাইকের মতো দাগ দেখা যায়। ফসলের বাড়ন্ত পর্যায়ে আক্রমণ করে ও চারা ফসলের কাণ্ড, পাতার অংশে আক্রমণ করে।
- আক্রান্ত পাতা ছোট, বিবর্ণ, বিকৃত হয়। শিরা ও উপশিরা হলুদ হয়ে যায়। লতার পর্বমধ্য খাটো হয়ে আসে। ফলে গাছ খাটো হয়ে যায়। গাছে সাধারণত ফল ধরে না, ফুল কম আসে, কচি ফল খসখসে, ছোট ও দাগ যুক্ত হয়।
ব্যবস্থাপনা:
- জমি থেকে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলুন অথবা ডালা কেটে দিতে হবে।
- জাব পোকা এ রোগের বাহক, এ পোকা দমনে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মি.লি./ ২ মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে) ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাবেন না বা বিক্রি করবেন না। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
গ) শিমের গোড়া পঁচা বা শিকড় পঁচা রোগ
সাদা মাছি, জাবপোকা ইত্যাদি দ্বারা ভাইরাস ছড়ায়। আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতি হয়। পাতার গায়ে ঢেউয়ের মত ভাজের সৃষ্টি হয়। বয়স্ক পাতা পুরু ও মচমচে হয়ে যায়। অতিরিক্ত শাখা প্রশাখা বের হয় ও ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
ব্যবস্থাপনা:
- আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা বা পুড়ে ফেলা।
- বপনের পূর্বে বীজ শোধন করা (ভিটাভেক্স-২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিষ্টিন- ২ গ্রাম প্রতি কেজি বীজ), ট্রাইকোডারমা ভিডিডি (৩-৪ গ্রাম/কেজি বীজ) দ্বারা শোধন করা।
- চারা গজানোর পর অতিরক্ত সেচ না দেওয়া।
- এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কুপ্রাভিট অথবা ৪ গ্রাম চ্যাম্পিয়ন মিশিয়ে স্প্রে করা।
- কম গভীরে বীজ বপন করা।
- পানি নিস্কাশনের ভাল ব্যবস্থা রাখা।
- একই জমিতে বারবার শুধু শিম চাষ না করা ওফসল সংগ্রহের পর পুরাতন গাছ ও আবর্জনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা।
ঘ) সাদা ছত্রাক
প্রাথমিক অবস্থায় কান্ডে পানি ভেজা সাদা তুলার মতো ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। পরবর্তীতে কান্ডের উপরের দিকে অগ্রসর হয়ে পাতা, ফুল ও ফলে বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত অংশ সাদা ধূসর হতে বাদামি রঙের হয়ে মারা যায়।
ব্যবস্থাপনা:
- রোগ মুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বপনের পূর্বে বীজ প্রভেক্স (২.৫ গ্রাম/কেজি) দিয়ে শোধন করে লাগাতে হবে।
- আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল (২ গ্রাম/লিটার) অথবা ফলিকুর বা কন্টাফ (২ মিলি/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
ঙ) শিমের মরিচা রোগ
ইউরোমাইসিস অ্যাপেন্ডিকুলাটাস ছত্রাক মাটিতে উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশে শীতকাল পার করে। এটি একটি পরবাসী পরজীবী, যার অর্থ বেঁচে থাকার জন্য এরা গাছের কোষকলার উপর নির্ভরশীল।
বীজ, বায়ু, জল এবং পোকামাকড়ের মাধ্যমে ফসলে প্রাথমিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ছত্রাক উচ্চ আর্দ্রতা এবং বর্ধিষ্ণু তাপমাত্রায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দীর্ঘস্থায়ী উষ্ণ, আর্দ্র আবহাওয়াতে এ রোগ আরও তীব্র হয়।
- প্রথম উপসর্গ হিসেবে সাধারনত ক্ষুদ্র বাদামী থেকে হলুদ রঙের ফুস্কুড়ি বিকশিত হয় ফলে বয়স্ক পাতার নিম্ন পৃষ্ঠের বর্হিত্বক ফেটে যায়।
- সময় গড়িয়ে ফুস্কুড়ি হলুদ বিবর্ণ কোষকলার চারিদিকে বলয় আকার ধারন করতে পারে এবং আরও গাঢ় বর্ণের হতে পারে। একই সাথে বড় ফুস্কুড়ি পাতার বৃন্তে, কাণ্ডে এবং শুঁটিতে প্রদর্শিত হতে পারে।
- পাতা বিবর্ণ ও শুকিয়ে যেতে পারে এবং অকালে ঝরে পড়ে যেতে পারে। পত্রমোচন হলে, ফলনে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শিমের মরিচা রোগ কচি গাছকে মেরে ফেলতে পারে এবং পুরানো গাছের উপর এ ছত্রাকের ক্ষতিকর প্রভাব নগণ্য থাকে।
ব্যবস্থাপনা :
- প্রপিকোনাজল জাতীয় বালাইনাশক (যেমনঃ টিল্ট ২৫০ ইসি ৫ মিলিলিটার প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে) ১০ দিন পরপর ৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
- বালাইনাশক ছিটানোর পর ১৫ দিন ফল তোলা থাকে বিরত থাকুন। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাবেন না বা বিক্রি করবেন না। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]