মাছ ও চিংড়ি জলজ প্রাণি। প্রাণি মাত্রই বিভিন্ন রোগের শিকার হয়, মাছ ও চিংড়ি এর ব্যতিক্রম নয়। জলজ পরিবেশের যাবতীয় গুণাগুনের অনুকূল মাত্রা এবং সুষম পুষ্টির যোগান মাছ ও চিংড়ির সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখার পূর্বশর্ত।
জলাশয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রোগ জীবাণু, কীটপতঙ্গ বাস করে এবং এরা সেখানে বাসকারী মাছ ও চিংড়ির সাথে এক ধরনের দূর্বল ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।
কোনো কারণে জলজ পরিবেশের অবনতি বা দূষণ ঘটলে এর একটি ক্ষতিকর প্রভাব মাছ ও চিংড়ির ওপর পড়ে এবং এদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। যার ফলে মাছ ও চিংড়ি দূর্বল হয়ে যায় এবং ঠিক এসময়ই ওৎপেতে থাকা রোগ-জীবাণু এদেরকে আক্রমণ করে এবং এরা রোগক্রান্ত হয়ে পড়ে।
চিংড়ি মাছ চাষ করে সফল হতে চাইলে সঠিক উপায়ে উক্ত চিংড়ি মাছের রোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে হবে ও সেগুলো মেনে চলতে হবে।
এ পাঠ শেষে আপনি- চিংড়ির রোগের কারণ ও সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা পাবেন। চিংড়ি বিভিন্ন প্রকার রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা/প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পারবেন। চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো শিখতে পারবেন। এককথায়, চিংড়ি মাছের রোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটা বিস্তর ধারণা লাভ করতে পারবেন।
(১) চিংড়ি মাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশে চিংড়ির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- আমরা প্রতিদিন প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করি তার প্রায় ৬০% যোগান দেয় মাছ ও চিংড়ি।
- বিগত ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মধ্যে হিমায়িত চিংড়ির পরিমাণ ছিল ৫৩% এবং এসব পণ্য রপ্তানিবাবদ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্থ্যাৎ প্রায় ৮৫% এসেছিল চিংড়ি থেকে।
বাংলাদেশের চিংড়ি উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২০১০-১১ অর্থ বছর থেকে শুরু করে পরবর্তি বছরগুলোতে চাষকৃত চিংড়ির পরিমাণ উত্তরোত্তর বেড়েছে। চিংড়ি চাষের পরিধি বৃদ্ধি এবং প্রচলিত সনাতন চাষ পদ্ধতি থেকে আধা-নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে ক্রমোন্নতি-ই এর প্রধান কারণ।
সনাতন চাষ পদ্ধতিতে প্রথমদিকে তেমন রোগ বালাই ছিল না বা চিংড়ি চাষীরা এ ব্যাপারে তেমন সচেতন ছিলেন না। তবে চিংড়ি চাষে নিবিড়তা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগবালাই ও আপদ বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাগদা চিংড়ি চাষে হোয়াইট স্পট বা চায়না ভাইরাস রোগ মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
চিংড়ি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পাশাপাশি রোগবালাই সম্পর্কিত বাস্তব জ্ঞান থাকলে সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে চিংড়িকে সুস্থ-সবল রেখে ভালো ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব।
(২) চিংড়ি মাছের রোগের কারণ
চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বা বিষয় কাজ করে। এর মধ্যে চিহ্নিত কারণগুলো নিম্নরূপ-
- পানির ভৌত-রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাগুণের অবনতি (পানির তাপমাত্রা, জৈব তলানি, পিএইচ, লবণাক্ততা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, শেওলা)।
- মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন উপকরণ ব্যবহার (সার, খাদ্য, ঔষধ ইত্যাদি)।
- বাইরের এলাকা বা পার্শ্ববর্তী রোগাক্রান্ত খামারের দূষিত পানির প্রবেশ।
- অধিক মজুদ ঘনত ¡।
- রোগমুক্ত/SPF পোনা ব্যবহার না করা।
- অপুষ্টি।
- ক্রটিপূর্ণ পরিবহন ও হ্যান্ডেলিং।
- পরজীবী ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংক্রমণ।
- আক্রান্ত খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপকরণ যথাযথভাবে পরিস্কার না করেই পুনরায় ব্যবহার।
(৩) চিংড়ির মাছের রোগের সাধারণ লক্ষণ
জীবাণুর আক্রমন ও রোগের ধরণ অনুযায়ী রোগাক্রান্ত চিংড়ির মাঝে বিভিন্ন প্রকার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে সাধারণভাবে নিম্নোক্ত লক্ষণ সমূহ দেখা যায়-
- অসুস্থ চিংড়িকে পুকুরের পাড়ের কাছে অচেতন অবস্থায় দেখা যাবে।
- খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখাবে এবং অসুস্থ্য চিংড়ির খাদ্যনালী খালি থাকবে।
- রোগাক্রান্ত চিংড়ির ফুলকায় কাল, হলুদ বা বাদামী দাগ অথবা ক্যারাপেস (Carapace) এবং খোলসে সাদা সাদা দাগ দেখা যাবে।
- রোগের কারণে চিংড়ির উপাঙ্গে পচন ধরতে পারে।
- অসুস্থ চিংড়ির খোলসের উপর শেওলা জমতে দেখা যায়।
- অসুস্থ চিংড়ির খোলস নরম থাকে এবং পেশী সাদা বা হলদে হতে দেখা যায়।
(৪) চিংড়ি মাছের রোগ ও উক্ত রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা/প্রতিকার
ক) হোয়াইট স্পট বা সাদা দাগ রোগ
এটি চিংড়ির মহামারী রোগ কারণ এই রোগে আক্রান্ত চিংড়ির বাঁচার আশা থাকে না। একে White Spot Baculo Virus (WSBV), White spot Syndrome Virus (WSSV) অথবা চায়না ভাইরাস রোগও বলা হয়ে থাকে।
বাগদা চিংড়ি এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। গলদা চিংড়ির হোয়াইট স্পট রোগের কোন রিপোর্ট এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
রোগটি ১৯৯৪ সালে কক্সবাজার অঞ্চলে প্রথম দেখা দেয় এবং পরবর্তিতে খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
রোগের কারন: ভাইরাসের কারনে এ রোগ হয়।
রোগের লক্ষণ:
- মারাত্মকভাবে আক্রান্ত চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ দ্রুত কমিয়ে দেয়।
- ভাইরাস আক্রান্ত চিংড়ি প্রাথমিক অবস্থায় দূর্বল হয়ে পড়ে এবং পাড়ের কাছে এসে অলস বসে থাকে।
- মৃত্যুহার ব্যাপক এবং লক্ষণ প্রকাশ পাবার ৩ থেকে ১০ দিনের ভিতরে শতভাগ চিংড়ি মারা যায়।
- আক্রান্ত চিংড়ির খোলস ঢিলঢিলে হয়ে যায় এবং ক্যারাপেস ও খোলসে সাদা সাদা দাগ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে মুমূর্ষু চিংড়ি নীলাভ থেকে লালচে বাদামি বর্ণের হয়ে যায়।
চিকিৎসা/প্রতিকার: তেমন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তাই ইচ্ছেমত কোন ঔষধ বা কেমিক্যাল ব্যবহার না করাই ভাল। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই একমাত্র পথ।
খ) ডিচংড়ি মাছের ইয়েলোহেড বা মস্তক হলুদ হওয়া রোগ
Yellowhead রোগে আক্রান্ত চিংড়ির মাথা হলুদ হয়ে যায় বিধায় একে ইয়েলোহেড রোগ বলা হয়। সংক্ষেপে একে YHD (Yellowhead Disease) ও বলে। মূলত বাগদা চিংড়ি এ রোগের শিকার। বাংলাদেশে এ রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এখনও ঘটেনি।
রোগের কারণ: ভাইরাসের আক্রমণে এই রোগ হয়।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত চিংড়ি প্রথমদিকে খাদ্য গ্রহণ করলেও দিন বাড়ার সাথে সাথে খাদ্য গ্রহণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়।
- PL ২০-২৫ থেকে শুরু করে কিশোর বয়সের চিংড়ি এ রোগের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।
- আক্রান্ত চিংড়ি থেকে অন্য চিংড়িতে রোগের সংক্রমণ ঘটে।
- আক্রান্ত চিংড়ি লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে ব্যাপক হারে মারা যায় এবং মৃত্যুহার শতভাগেও পৌঁছাতে পারে।
- রোগাক্রান্ত চিংড়ির দেহের বর্ণ ফ্যাকাশে হতে শুরু করে। শিরোবক্ষ (Cephalothorax) এবং হেপাটোপ্যানক্রিয়াস (Hepatopancreas) হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং ফুলে যায়।
চিকিৎসা/প্রতিকার: এ রোগের চিকিৎসায় ঔষধে কাজ হয় না। তাই সুষ্ঠু চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করাই একমাত্র পন্থা। তবে চাষের পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটন চাষ করে এ রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলে শুনা যায়।
গ) চিংড়ির কালো/বাদামি দাগ রোগ অথবা খোলসের রোগ
গলদা চিংড়িতে Black/Brown spot or Shell disease রোগটি বেশি হলেও বাগদা চিংড়িতে এ রোগ হতে দেখা যায়।
কারণ: বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া (যেমন- Vibrio, Pseudomonas, Aeromonas)-এর আক্রমনে এ রোগ হয়।
লক্ষণ: ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চিংড়ির খোলসে কালো কালো বা বাদামি দাগ সৃষ্টি হয়। খোলসের গায়ে ছিদ্র হয়, খোলস ক্ষতিগ্রস্থ হয়, উপাঙ্গ খসে পড়ে এবং পরবর্তিতে ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চিংড়ি মারা যায়। সব বয়সের চিংড়িই এ রোগের শিকার হতে পারে।
প্রতিকার: FAO এর সুপারিশ মোতাবেক Nifurpurinol নামক এন্টিবায়োটিক দ্বারা এ রোগের চিকিৎসায় সুফল পাওয়া যায়। তাছাড়া Oxolinic acid ব্যবহারের পরামর্শও দেয়া হয়। তবে উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনা হলো এ রোগ প্রতিরোধের সব থেকে ভালো পথ।
ঘ) চিংড়ি মাছের ছত্রাক জনিত রোগ
এ রোগের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই। যেহেতু ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়, তাই একে ছত্রাকজনিত রোগ বলা হয়।
সব বয়সের গলদা ও বাগদা চিংড়িই ছত্রাকের শিকার হতে পারে। তবে চিংড়ির লার্ভা ও পিএল এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
ছত্রাক মূলত মাধ্যমিক সংক্রমণ ঘটায়।
রোগের কারণ: Lagenidium, Fusarium solani ইত্যাদি ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়।
লক্ষণ:
- আক্রান্ত চিংড়ির খোলসের ভিতর দিয়ে বিস্তৃত জালের মত ছত্রাক দৃশ্যমান হয়।
- আক্রান্ত চিংড়ির পেশীকলা হলদে ধুসর বা নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।
প্রতিকার: FAO-এর সুপারিশে উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে ছত্রাকের আক্রমণ দমন করতে Trifluralin, Merthiolate-ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
ঙ) চিংড়ি মাছের প্রোটোজোয়াজনিত রোগ
এক বা একাধিক প্রোটোজোয়া পরজীবীর আক্রমণে এ রোগ হয়। যে কোন বয়সের গলদা বা বাগদা চিংড়ির প্রোটোজোয়াজনিত রোগ হতে পারে।
রোগের কারণ: Zoothamnium, Epistylis, Vorticella, Acineta, Opercularia, Vaginicola, Podophyra ইত্যাদি প্রোটোজোয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়।
রোগর লক্ষণ:
- চিংড়ির খোলস, পুষ্টিতন্ত্র ও ফুলকার ক্ষতি হয়।
- আক্রান্ত চিংড়ির চলাচল, খাদ্য গ্রহণ ও খোলস পাল্টানো বাধাগ্রস্থ হয়।
- চিংড়ি স্বাভাবিক বর্ধন হার ব্যহত হয়।
প্রতিকার: Formalin, Merthiolate, Copper-based-algicides ব্যবহার করে প্রতিকার পাওয়া যায়। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনা এ রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল পথ।
চ) চিংড়ি মাছের অপুষ্টিজনিত রোগ
গলদা এবং বাগদা উভয় চিংড়িই অপুষ্টিতে ভুগতে পারে।
i) খোলস নরম রোগ/স্পঞ্জের মত দেহ
চাষাবাদের মাঝামাঝি সময়ে প্রায়ই গলদা চিংড়ির এ রোগ হয়। আবার বর্ষাকালে ঘেরে পানির লবণাক্ততা কমে গেলে বাগদা চিংড়িও এ রোগে আক্রান্ত হয়।
কারণ: পানিতে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া পানিতে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়া। পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব অনেক দিন পানি পরিবর্তন না করা।
লক্ষণ:
- খোলস নরম থাকে অর্থ্যাৎ খোলস বদলানোর ২৪ ঘন্টা পরও খোলস শক্ত হয় না।
- দেহ ফাঁপা হয়ে স্পঞ্জের মত হয়।
- চিংড়ির বর্ধন ব্যহত হয় এবং চিংড়ি ক্রমশঃ দূর্বল হয়ে মারা যায়।
প্রতিকার: পুকুরে ২-৩ মাস পর পর ০.৫-১ কেজি/শতাংশ হারে চুন প্রয়োগ এবং খাবারে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এ সমস্যার সুফল পাওয়া যায়।
ii) খোলস পাল্টানোর পর মৃত্যু
কারণ: খাদ্যে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ফ্যাটি এসিড, আমিষ ও খনিজ লবণের অভাব।
লক্ষণ:
- দেহ নরম থাকে এবং রং নীলাভ হয়ে যায়।
- চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় এবং চিংড়ি ক্রমশ দূর্বল হয়ে মারা যায়।
প্রতিকার: পরিমিত পরিমাণ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করতে হবে।
উপরোক্ত রোগ-বালাই ছাড়াও আরও কিছু রোগ চিংড়ি খামারে নিয়মিত দেখা যায়। যেমন-
ছ) গায়ে শেওলা পড়া
কারণ: বদ্ধ পানিতে অতি মাত্রায় খাদ্য ও সার প্রয়োগে সবুজ শেওলার আধিক্যের কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে। শীতকালে গলদা চিংড়ির পুকুরে এ রোগ বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ:
- চিংড়ির দেহের উপরিভাগে সবুজ শেওলার আস্তরণ দেখা যায়।
- চিংড়ি খোলস পরিবর্তন করে না এবং চলাচলের গতি মন্থর হয়ে যায়।
- বৃদ্ধি ব্যহত হয় এবং চিংড়ি আস্তে আস্তে মারা যায়।
প্রতিকার: দূষিত পানি বের করে দিয়ে পুকুরে নতুন পানি দিতে হবে। নিয়মিত বিরতিতে পানি পরিবর্তন করতে হবে। পানির প্রবাহ বাড়িয়ে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়। চুন সার ও খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা সীমিত রাখতে হবে।
(৫) চিংড়ি মাছের রোগ প্রতিরোধে করণীয়
চিংড়ির ঘেরে/পুকুরে একবার রোগের সংক্রমণ শুরু হলে, বিশেষ করে ভাইরাসের আক্রমণ হলে, বলতে গেলে কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া চিকিৎসা দিয়ে আক্রান্ত চিংড়িকে সারিয়ে তোলাটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
FAO -এর মতে চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো নিম্নমানের চাষ ব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশ, আমদানী করা চিংড়ির জন্য অপর্যাপ্ত সংগনিরোধ ব্যবস্থা (Quarantine procedure) প্রভৃতি।
পানির গুণাগুণের (যেমন-তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, O2, pH, দ্রবীভূত বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি) হঠাৎ নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে দেখা গেছে।
তাই বলা যেতে পারে উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনা চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের পূর্বশর্ত।
নিম্নে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের সাধারণ উপায়গুলো বর্ণনা করা হলো-
হ্যাচারিতে নেওয়ার আগে ব্রুডস্টক এবং চাষের পুকুর/ঘেরে মজুদের আগে চখ PL (Post Larvae) রোগ মুক্ত কিনা তা যাচাই (Screening)করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে SPF ব্রুড ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ, সবল ও ভাইরাসমুক্ত পোনা উৎপাদন ও মজুদ করতে হবে।
- হ্যাচারি ও পুকুরে যথাক্রমে পোনা উৎপাদন ও মজুদের যাবতীয় কার্যক্রম শুরুর পূর্বে অবশ্যই সেগুলো ভালোমত জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
- ঘের/পুকুরের পরিবেশ চিংড়ির জন্য উপযোগী রাখার স্বার্থে পানির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাগুণের হঠাৎ পরিবর্তন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- পোনার মজুদ ঘনত্ব নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে এবং অতিরিক্ত পোনা মজুদ করা যাবে না।
- মাংসজাতীয় খাবার কাচা অবস্থায় না দেওয়াই শ্রেয়। তাছাড়া বাসি-পচা ছাতা ধরা মেয়াদ উত্তীর্ণ নিম্নমানের খাবার দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।
- চাষাবস্থায় ঘের/পুকুরের পানি পরিবর্তন (Water exchange) ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে হবে যাতে করে নতুন পানির সাথে ভাইরাসের বাহক Virus carrier) প্রবেশ করতে না পারে। তাছাড়া জলাশয়ে অবাঞ্চিত ও ক্ষতিকর প্রাণির/পোকার প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
- জলাশয়ে পরিমিত পরিমান চুন সার ও সুষম খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
- জলাশয়ের চারিদিকে শক্ত-পোক্ত ও উচুঁ বাঁধ নির্মান করতে হবে। যাতে বন্যার পানি ও পাশ্ববর্তী ঘের থেকে চুয়ানো পানি প্রবেশ করতে না পারে।
- নিয়মিতভাবে চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘেরে রোগাক্রান্ত ও মরা চিংড়ির উপস্থিতি টের পাবার সাথে সাথে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
- এক জলাশয়ে ব্যবহৃত জাল ও অন্যান্য উপকরণ অন্য জলাশয়ে ব্যবহারের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে পরিশোধন (Disinfect) করে নিতে হবে।
- চিংড়ি চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং যত্রতত্র মলমূত্র, থুতু ও আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ অভ্যাস হ্যাচারি থেকে শুরু করে চাষের ঘের পর্যন্ত সমানভাবে মেনে চলতে হবে।
- আহরণোত্তর ঘেরের পানি ও তলার কালো কাদা শোধন না করে সরাসরি অন্যত্র ফেলা যাবে না।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা আমরা চিংড়ি মাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, চিংড়ি মাছের রোগের কারণ, চিংড়ির মাছের রোগের সাধারণ লক্ষণ, চিংড়ি মাছের রোগ ও উক্ত রোগের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা/প্রতিকার, চিংড়ি মাছের রোগ প্রতিরোধে করণীয় প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অবগত হলাম।
চিংড়ি আমাদের দেশের একটি পরিচিত মাছ। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু; দেখতেও তেমন সুন্দর। বর্তমানে চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আমাদের দেশের উৎপাদিত চিংড়ির শতকরা ৮০ ভাগ বাগদা এবং ২০ ভাগ মিঠা পানির গলদা।
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বাগদা চিংড়ি চাষে হোয়াইট স্পট বা চাইনা ভাইরাস রোগ মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে। পুকুর বা ঘেরের চিংড়ির অস্বাভাবিক আচরণ দেখলেই বুঝতে হবে চিংড়ি রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
মাটির প্রকৃতি, পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, অক্সিজেন, পি এইচ ইত্যাদির সমষ্ঠিগত বৈশিষ্ঠ্যের এক বা একাধিক গুণাবলী খারাপ হলে চিংড়ি দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়। অধিক হারে পোনা মজুদ, অতিরিক্ত খাদ্য ও সার প্রয়োগ, কম গভীরতা উচ্চতাপ, হঠাৎ করে লবণাক্ততায় তারতম্য হওয়া ইত্যাদি কারণেই চিংড়ি আক্রান্ত হয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।