Skip to content

 

সবজি ও ফল সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায়/পদ্ধতি

সবজি ও ফল সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়:

(১) বিভিন্ন শাক ও সবজির গুণাগুণ বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ

আমাদের বাংলাদেশের আবহাওয়ায় উৎপাদিত অধিকাংশ শাক ও সবজি মাঠ থেকে সংগ্রহের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত ২-৩ দিনের বেশি সতেজ ও খাবার উপযোগী থাকে না।

মাঠ থেকে সংগ্রহের পর ২০০ পিপিএম/লিটার ক্লোরাক্স দ্রবণ (২/৩ টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট) দিয়ে ধৌত করার পর শিম ও পালং শাক মুখবন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ৬ দিন, ০.২%, ০.৩%, ০.৪% ও ০.৫% ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে পুঁই শাক, কাঁচা মরিচ, ঢেঁড়স ও লাল শাক যথাক্রমে ৮ দিন, ১০ দিন, ১১ দিন এবং ৭ দিন পর্যন্ত ভাল থাকে।

অন্যদিকে ১.৫% ও ১.০% ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ৯ দিন পর্যন্ত যথাক্রমে ঝিঙ্গা ও ধুন্দল ভাল থাকে।

ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে কাঁচা মরিচ ও ঢেঁড়স
ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে কাঁচা মরিচ ও ঢেঁড়স
ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ঝিঙ্গা ও ধুন্দল
ছিদ্রযুক্ত ও মুখ বন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ঝিঙ্গা ও ধুন্দল

(২) স্ট্রবেরি ফলের গুণাগুণ বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ

স্ট্রবেরি আকর্ষণীয় বর্ণ, গন্ধ ও উচ্চ পুষ্টিমানের জন্য স্ট্রবেরি অত্যন্ত সমাদৃত। স্ট্রবেরি অত্যন্ত রসালো ও নরম বিধায় এর সংরক্ষণকাল খুবই কম যা বাজারজাতকরণের একটি প্রধান অন্তরায়।

তাজা স্ট্রবেরি ফলের সংরক্ষণকাল বাড়ানোর লক্ষে সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় ১০ সে. তাপমাত্রা এবং ৮৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় (RH) তাজা (Fresh) স্ট্রবেরি ফল ৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়, এতে স্ট্রবেরির পুষ্টি উপাদান ও বাহ্যিক বর্ণের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে না।

এছাড়া ৪.৭-১০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও এই ফল ৪-৫ দিন পর্যন্ত ভাল থাকে।

স্ট্রবেরি ফলের গুণাগুণ বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
স্ট্রবেরি ফলের গুণাগুণ বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ

(৩) আম সংরক্ষণে ম্যাংগোবার তৈরিকরণ

আম আমাদের বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ফল। যার জন্য আমকে এ দেশে ফলের রাজা বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

আম থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মধ্যে ম্যাংগোবার অন্যতম। কিন্তু সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে না পারায় আমাদের বাংলাদেশে উৎপাদিত ম্যাংগোবার অল্প সময়ের মধ্যেই কালো হয়ে যায়, জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় ও খাবার অনুপযোগী হয়ে যায়।

ম্যাংগোবার
ম্যাংগোবার

ম্যাংগোবার তৈরির পদ্ধতি:

  1. ম্যাংগোবার তৈরি করার জন্য প্রথমে আমগুলো ভালো করে পানিতে ধুয়ে ছাল ফেলে আঁটি বের করে নিতে হয়।
  2. অতঃপর টুকরো করা আমগুলো ব্লেন্ড করে পাল্প তৈরি করে তাতে চিনি যোগ করতে হয় যতক্ষণ না পাল্পের টিএসএস (TSS) ৩০০ ব্রিক্স পর্যন্ত পৌঁছে।
  3. অতঃপর ৩ মিনিট সময়কাল পর্যন্ত আগুনে জ্বাল দিতে হয় এবং ৫০০ পিপিএম পটাসিয়াম মেটাবাই সালফাইট (কেএমএস) যোগ করতে হয়।
  4. এভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত আমের পাল্পকে ৫০০- ৫৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় একটি শুকানো যন্ত্রে শুকালে আকর্ষণীয় রঙের সুস্বাদু ম্যাংগোবার হয় এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী থাকে।

(৪) স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পেয়ারার পাল্প সংরক্ষণ

বাংলাদেশে ফলের মধ্যে পেয়ারা একটি অন্যতম জনপ্রিয় ফল। পেয়ারা অত্যন্ত পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ, সহজপাচ্য ও সুস্বাদু। পেয়ারা উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে ও সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি ফল এবং এতে কমলা থেকে প্রায় ২ থেকে ৫ গুন বেশি ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

কিন্তু অন্যান্য ফলের মত পেয়ারাও দ্রুত পচনশীল, ফলে ভরা মৌসুমে এর প্রচুর অপচয় ঘটে। পেয়ারা থেকে পাল্প প্রস্তুত করে তা সংরক্ষণের মাধ্যমে পরবর্তীকালে জ্যাম, জেলি, জুস ইত্যাদি তৈরি করে এর অপচয় অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পেয়ারার পাল্প সংরক্ষণ
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পেয়ারার পাল্প সংরক্ষণ

পেয়ারার পাল্প তৈরির পদ্ধতি:

  1. পেয়ারা থেকে পাল্প প্রস্তুত করে তা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণের জন্য পুষ্ট ও পরিপক্ক পেয়ারা নিতে হবে।
  2. অতঃপর সেগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কাটতে হবে।
  3. এবার টুকরোর ওজনের অর্ধেক পরিমাণে পানিতে (পেয়ারা ও পানি ২:১ অনুপাতে) প্রায় ৩০ মিনিট সময় সিদ্ধ করতে হবে যেন টুকরোগুলো নরম হয়।
  4. সিদ্ধ করা পেয়ারার টুকরোগুলোকে এবার হাতে চেপে ও ৪৫ মাইক্রন মাপের ছাকনিতে নিয়ে ছাল ও বিচিগুলো আলাদা করে পাল্প আহরণ করা হয়।
  5. এভাবে আহরিত পাল্পকে ১০০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩ মিনিট পর্যন্ত তাপ প্রয়োগ করা হয় এবং এর সাথে প্রতি কেজিতে এক গ্রাম হিসেবে সাইট্রিক এসিড যোগ করা হয় যেন পাল্পের এসিডিটি ১% এর মতো হয়।
  6. অতঃপর এই পাল্পের সাথে প্রতি কেজিতে ২,০০০ পিপিএম পটাসিয়াম মেটাবাই সালফাইট (কেএমএস) যুক্ত করে তা গরম অবস্থায় পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত কাঁচের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।
  7. স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এ পাল্প প্রায় ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়।

(৫) স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পেঁয়াজের পেস্ট সংরক্ষণ

বাংলাদেশের প্রধান মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আমাদের প্রতিদিনের রান্নার কাজে পেঁয়াজের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

মাঠ থেকে সংগ্রহ করা পেঁয়াজ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে, রোগ-জীবাণুর আক্রমণ এবং এর মধ্যস্থিত এনজাইমের কারণে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য বাংলাদেশের ন্যায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে পেঁয়াজের সংরক্ষণ একটি বড় সমস্যা।

বাংলাদেশে পেঁয়াজের সংরক্ষণকালীন অপচয় প্রায় শতকরা ৬৬ ভাগ এবং কিছু কিছু এক্সোটিক কাল্টিভারের ক্ষেত্রে এই অপচয়ের হার আরও বেশি। পেঁয়াজের এই সংরক্ষণকালীন অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব যদি মাঠ থেকে সংগ্রহের পর পরই এটি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।

পেঁয়াজ শুকিয়ে সংরক্ষণ একটি প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু শুকিয়েপেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে এর রং ও ঝাঁঝের জন্য দায়ী উদ্বায়ী তৈল ও রাসায়নিক উপকরণ হ্রাস পায়। পেস্ট আকারে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ব্যবস্থায় এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকে, অপচয় বহুলাংশে কমে যায় এবং ব্যবহার করাও সহজ হয়।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষিত পেঁয়াজের পেস্ট
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষিত পেঁয়াজের পেস্ট

পেঁয়াজের পেস্ট তৈরি ও সংরক্ষণ পদ্ধতি:

  1. স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পেঁয়াজের পেস্ট প্রস্তুত ও সংরক্ষণের জন্য ভালমানের পেঁয়াজের কন্দ (Bulb) নিতে হবে।
  2. কন্দগুলো ধুয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে গ্রাইন্ডার/ব্লেন্ডার মেশিনে দিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে।
  3. অতঃপর কক্ষতাপমাত্রায় একটি ঢাকনা দিয়ে ১ ঘণ্টা ঢেকে রেখে দিতে হবে যাতে এনজাইমের বিক্রিয়ার দ্বারা উৎপাদিত স্বাদ ও গন্ধ সম্পূর্ণরূপে পেঁয়াজের পেস্টের সাথে মিশে যেতে পারে।
  4. এরপর এই পেস্টের সাথে সাধারণ খাবার লবণ ৮% এবং ২ গ্রাম সাইট্রিক এসিড/কেজি হারে মেশাতে হবে যাতে পেঁয়াজের পেস্টের pH এর মান ৪ হয়।
  5. অতঃপর পেঁয়াজের পেস্টকে ১০০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ মিনিটকাল ফুটিয়ে ১০০০ পিপিএম পটাশিয়াম মেটাবাই সালফাইট (কেএমএস) মিশিয়ে সাথে সাথে জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ঢালতে হবে।
  6. এরপর বোতলের মুখে ভালভাবে ছিপি লাগিয়ে সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে সংরক্ষিত পেঁয়াজের পেস্ট ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
  7. পেঁয়াজের পেস্টের সাথে লবণের ভাগ বেশি থাকে বলে রান্নার সময় অতিরিক্ত লবণ সাবধানতার সাথে ব্যবহার করতে হবে।

(৬) চাল ও ডালের পাপড় তৈরিকরণ

বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের মুখরোচক খাবারের মধ্যে পাপড় অন্যতম। এটি অতি জনপ্রিয়, সহজ পাচ্য ও সুস্বাদু মুখরোচক খাদ্য।

পাপড় যেমন তেলে ভেজে খাওয়া যায় তেমনি বিভিন্ন সবজি স্যুপ ও কারী স্যুপের সাথে খেতে ভাল লাগে। দেশের প্রায় অধিকাংশ জায়গায় সারা বছর এটি পাওয়া যায় এবং সকলেই গ্রহণ করে থাকে।

ক্রটিমুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি সঠিক প্রয়োগের অভাবে পাপড়ের পরিমাণগত ও গুণগতমানের অপচয় ঘটে।

এটির প্রস্তুত পদ্ধতি অতি সহজ। দরিদ্র লোকজন এ সহজ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বহুলাংশে অপচয় রোধের পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করতে পারে।

ডালের পাপড়
ডালের পাপড়

পাপড় তৈরি পদ্ধতি:

  1. উন্নতমানের চাল ও ডালের মিহি গুঁড়া/ময়দা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়।
  2. ভালমানের সমপরিমাণ মুগ ও মাসকলাই ডাল একসাথে মিশিয়ে মেশিনের মাধ্যমে ভেঙ্গে গুঁড়া করা হয়।
  3. এক কেজি পানি ফুটিয়ে নিয়ে ৮০ গ্রাম লবণ, ৫ গ্রাম জিরা, ৫ গ্রাম কালোজিরা, ৫ গ্রাম গোল মরিচের গুঁড়া, ৭০ গ্রাম দই, ১০ গ্রাম খাবার সোডা, ১ গ্রাম হিং ও ১ গ্রাম কাতেলী দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়।
  4. এরপর সমপরিমাণ মুগ ও মাসকলাই ডালের মিহি গুঁড়া/ময়দা নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মিশ্রিত ঠান্ডা পানি যোগ করে ৫-৮ মিনিট রোলিং করলে পাপড় তৈরির উপযুক্ত মন্ড তৈরি হয়।
  5. মন্ডটিকে লম্বালম্বি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে সুতা দিয়ে কেটে নেয়া হয়।
  6. গোল আকৃতির মসৃণ কাঠের পিঁড়িতে বেলুন দিয়ে চাপ দিয়ে কয়েকবার এপিঠ-ওপিঠ করলে পাপড় তৈরি হয়।
  7. পাপড়ের ব্যাস সাধারণত ১০-১৪ সেমি ও পুরুত্ব ০.৬-০.৯ মিলি মিটার আকৃতির হয়ে থাকে।
  8. এগুলো ২০-২৫ মিনিট রৌদ্রে শুকানোর পর ঠান্ডা হলে পলিপ্রোপাইলিন প্যাকেটে ভরে ভালভাবে মুখ সিল করে ৮-১০ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
See also  মাছ পচে কেন ব্যাখ্যা কর? কোন পদ্ধতির মাধ্যমে মাছকে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায়? মাছ সংরক্ষণের পদ্ধতি

(৭) বিভিন্ন ফলের সংরকক্ষণে (আমড়া, চালতা) আচার ও চাটনি তৈরিকরণ

ক) আচার তৈরি

রকমারি মশলা মেশানো ফল বা সবজিকে খাওয়ার তেল অথবা ভিনেগারে ডুবানো অবস্থায় প্রস্তুত খাদ্যকে আচার বা পিকল বলা হয়। এ পদ্ধতিতে ফল বা সবজির জলীয়াংশ বেশ কমে গিয়ে (১২% বা কম) তেল বা ভিনেগারে সম্পৃক্ত হয়ে উঠলে এদের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায়।

আচার তৈরিতে মশলা হিসেবে সরিষা, আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, মেথী, জিরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া টক মিষ্টি করার জন্য চিনি এবং অ্যাসেটিক এসিড ব্যবহার করা হয়।

আচারে ব্যবহৃত সরিষার তেল ও এসিড প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করে। আচার বা পিকলস্ খাদ্যকে সুস্বাদু করে। চিনি পুষ্টি ও মিষ্টতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে এবং মশলা উহাকে সুস্বাদু ও মুখরোচক করে তুলে।

সব ধরনের আচার বা পিকলসে মুলত একই নীতির প্রয়োগ ঘটে এবং তৈরির প্রক্রিয়াও প্রায় অভিন্ন। শুধুমাত্র উপকরণের ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে।

খুব সহজ পদ্ধতিতে এবং মূল্যবান যন্ত্রপাতি ছাড়াই আচার প্রস্তুত করা সম্ভব বিধায় গ্রাম পর্যায়ে এ প্রযুক্তির প্রসারের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে।

আমড়ার আচার
আমড়ার আচার

খ) চাটনি তৈরি

চাটনি অর্থ যা চেটে চেটে খাওয়া হয়। বিভিন্ন রকমের ফল ও সবজি যেমন- বরই, তেঁতুল, জলপাই, আম, আমড়া, চালতা ইত্যাদি থেকে চাটনি তৈরি করা যায়।

চাটনি সাধারণত ভাত, রুটি, লুচি, ইত্যাদি তন্দুর জাতীয় খাদ্যের সঙ্গে অল্প পরিমাণ মিশিয়ে খেতে ভাল লাগে। এটি খাদ্যকে বেশ সুস্বাদু ও মুখরোচক করে তোলে।

সাধারণত ফলের পাল্পের সাথে চিনি, লবণ ও বিভিন্ন মশলা মিশেয়ে চাটনি তৈরি করা হয়।

মশলা হিসেবে সরিষা, মরিচ, মেথী, কালোজিরা, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, জয়ফল, জয়ত্রী ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

চিনি ও অ্যাসেটিক এসিড চাটনিকে টকমিষ্টি করে। চাটনিতে ব্যবহৃত সরিষার তেল, অ্যাসেটিক এসিড এবং সোডিয়াম বেনজোয়েট প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া চিনি পুষ্টি ও মিষ্টতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে এবং মশলা চাটনির স্বাদ ও সুগন্ধ বাড়ায়।

সব ধরনের চাটনিতে মূলত একই নীতির প্রয়োগ ঘটে এবং তৈরির প্রক্রিয়াও প্রায় অভিন্ন। শুধুমাত্র উপকরণের ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে থাকে।

চাটনির মধ্যে বরই-তেঁতুলের মিশ্র চাটনির স্বাদে অন্যতম একটি মুখরোচক খাবার।

মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছাড়াই বিএআরআই উদ্ভাবিত সহজ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বরই-তেঁতুলের মিশ্র চাটনি তৈরি করা যায়। গ্রাম পর্যায়ে এই প্রযুক্তির প্রসারের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে।

বরই-তেতুঁলের মিশ্র চাটনি
বরই-তেতুঁলের মিশ্র চাটনি

(৮) ডাবের পানি সংরক্ষণ

নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত। দেশের প্রায় সব জেলাতেই এটি জন্মায়, তবে দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাসমূহে এর উৎপাদন বেশি। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট নারিকেলের শতকরা ৩০-৪০ ভাগ কচি ডাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কচি ডাবের শাঁসে স্নেহ ও খনিজ জাতীয় পর্দাথের পরিমাণ বেশি থাকে। খনিজ পদার্থের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে পটাসিয়াম, সোডিয়াম ও ফসফরাস থাকে। মূলত কচি ডাবের ভিতরের তরল পদার্থই ডাবের পানি হিসেবে পরিচিত। এই পানি ৯৯ ভাগ চর্বিমুক্ত এবং কম ক্যালরিযুক্ত।

প্রচলিতভাবে উন্নত দেশে ডাবের পানি কোমল ও সতেজ পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদের বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে এর চাহিদা ব্যাপক। কচি ডাবের পানি শরীরকে ঠান্ডা ও দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখে। এ ছাড়াও ডায়রিয়া আক্রান্ত, বয়স্ক এবং বৃদ্ধ লোকের জন্য ডাবের পানি খুবই কার্যকর।

আমাদের বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাতকৃত ডাবের পানির বাণিজ্যিক চাহিদা আছে।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কাঁচের বোতলে ডাবের পানি সংরক্ষণ
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কাঁচের বোতলে ডাবের পানি সংরক্ষণ

ডাবের পানি প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতি:

  1. ডাবের পানি প্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রথমে ভালমানের কচি ডাব সংগ্রহ করে পরিষ্কার পানিতে ধৌত করতে হয়।
  2. অতঃপর ডাব থেকে পানি বের করে মসৃণ কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে যাতে কোন আঁশ বা শাঁস না থাকে।
  3. এখন পরিষ্কার ডাবের পানি একটি কাঁচের বিকার বা কনটেইনারে নিয়ে ৯৫-১০০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ১০ মিনিট ওয়াটার বাথে রেখে পাস্তুরাইজেশন করতে হবে।
  4. পাস্তুরাইজেশনকৃত ডাবের পানির সাথে ১০০ পিপিএম পটাসিয়াম মেটাবাইসালফাইট এবং ০.০৫% কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ যোগ করতে হবে যাতে কোন অবশিষ্টাংশ বা দ্রব্যাদি বোতলের নিচে পড়ে না থাকে।
  5. পরিশেষে গরম পানিতে ফুটানো কাঁচের বোতলে গরম অবস্থায় ডাবের পানি ভর্তি করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শুষ্ক ও ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়।
  6. এই প্রক্রিয়ায় ডাবের পানি প্রায় ৬-৮ মাস সহজে সংরক্ষণ করা যায়।

(৯) নারিকেলের ক্যান্ডি তৈরিকরণ

নারিকেল আমাদের বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। খাদ্য-পানীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমারি কাজে এটি ব্যবহৃত হয়।

নারিকেলের শাঁস আমাদের শরীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। এই শাঁসে আমিষ, শর্করা এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উপাদান রয়েছে।

নারিকেলের শাঁস দিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু খাবার যেমন নাড়–, বরফি, বিস্কুট, নারিকেল বার, নারিকেল ক্যান্ডি ও সালাদ তৈরি করা হয়। নারিকেল থেকে তৈরিকৃত খাবারগুলোর মধ্যে নারিকেল ক্যান্ডি অন্যতম আকর্ষণীয় খাবার।

নারিকেল ক্যান্ডি
নারিকেল ক্যান্ডি

নারিকেল থেকে ক্যান্ডি তৈরির পদ্ধতি:

  1. নারিকেল থেকে ক্যান্ডি তৈরির জন্য প্রথমে গুটনযুক্ত ভাতের মল্ট তৈরি করতে হয়।
  2. এরপর নারিকেলের শাঁস পিষে নিতে হয় যাতে সহজেই শাঁস চেপে নারিকেল মিল্ক বের করা যায়।
  3. এখন ক্যান্ডির জন্য ৫০ ভাগ নারিকেল মিল্কের সাথে ২৫ ভাগ চিনি ও ২৫ ভাগ ভাতের মল্ট মিশিয়ে দ্রবীভূত না হওয়া পর্যন্ত তাপ প্রয়োগ করতে হবে।
  4. অতঃপর মিশ্রণটিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ লেবুর রস যোগ করে মসৃণ কাপড়ের সাহায্যে ছাঁকতে হয়।
  5. এখন মিশ্রণটির সঙ্গে পরিমাণমতো বাদাম যোগ করে কঠিন সমসত্ব মিশ্রণ তৈরির জন্য অনবরত জ্বাল দিতে হবে।
  6. তৈরিকৃত স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কাঁচের বোতলে ডাবের পানি সংরক্ষণ মিশ্রণ ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত ঠান্ডা করতে হয়।
  7. এখন ক্যান্ডি তৈরির জন্য মিশ্রণটিকে নির্দিষ্ট মল্ডে রেখে মিশ্রণের উপরিভাগ মসৃণ করা হয় এবং চাকু বা ছুরির সাহায্যে ২ সেমি পরিমাণ করে নারিকেল ক্যান্ডি কাটা হয়।
  8. পরিশেষে ক্যান্ডিগুলো Rapping কাগজে মুড়িয়ে পলিপ্রপাইলিন ব্যাগে ভর্তি করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়।
  9. এই পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত নারিকেল ক্যান্ডি ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

(১০) ভুট্টার কনডেন্সড মিল্ক তৈরিকরণ

ভুট্টা একটি অধিক ফলনশীল দানাশস্য। ধান ও গমের তুলনায় এর পুষ্টিমান বেশি। এতে শর্করা ছাড়াও প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’, অ্যামাইনো এসিড ও ফাইবার বিদ্যমান। দেশে অনেক জেলাতেই ভুট্টার চাষ হয়ে থাকে।

আমাদের বাংলাদেশে হাঁস-মুরগি, মাছ ও গো-খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটির দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে অল্প পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার হিসেবে কঁচি ভুট্টা থেকে কনডেন্সড মিল্ক তৈরির সহজ পদ্ধতি গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করেছে।

ভুট্টার মোচা
ভুট্টার মোচা
তৈরিকৃত ভুট্টার কনডেন্সড মিল্ক
তৈরিকৃত ভুট্টার কনডেন্সড মিল্ক

ভুট্টার কনডেন্সড মিল্ক তৈরির পদ্ধতি:

  1. ভুট্টা কাঁচা অবস্থায় দানা যখন অল্প নরম থাকে (Milky stage) তখনই মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
  2. মোচা থেকে খোসা ও সিল্ক সরিয়ে পরিষ্কার পানিতে ভুট্টা ধুয়ে নিতে হবে।
  3. এখন ভুট্টার মোচা থেকে ধারালো ছুরির সাহায্যে কেটে দানা বা কার্নেলগুলো আলাদা করতে হবে।
  4. অতঃপর জুস এক্সট্রাক্টরের মাধ্যমে কার্নেল থেকে কর্নমিল্ক বা ভুট্টার রস বের এবং পরিষ্কার কাপড়ের মাধ্যমে ছেঁকে নিতে হবে।
  5. এভাবে প্রাপ্ত কর্নমিল্ককে একটি সসপেনে নিয়ে টিএসএস (TSS) ১৭০ ডিগ্রি ব্রিক্স না আসা পর্যন্ত ৭০-৮০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে।
  6. এবার পাত্রটিতে প্রাপ্ত কর্নমিল্কের ৮০% চিনি যোগ করে ৮০-৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে যাতে টিএসএস (TSS ৬৫০ ডিগ্রি ব্রিক্স হয়।
  7. এখন কর্নমিল্কের ০.৩% কার্বোস্কি মিথাইল সেলুলোজ (সিএমসি) এবং কর্নমিল্কের ০.৫% ল্যাকটোজ পাত্রে যোগ করতে হবে।
  8. অতঃপর মিশ্রণটিতে কর্নমিল্কের ০.২৫% লবণ এবং ৪% গ্লুকোজ সিরাপ যোগ করে ভালোভাবে নেড়ে ৭২-৭৫০ ডিগ্রি ব্রিক্স পর্যন্ত রান্না করতে হবে।
  9. অতঃপর প্রাপ্ত মিশ্রণটিকে ব্লেন্ডার এর মাধ্যমে ব্লেন্ড করে সমঘনত্বে আনতে হবে যাতে কোন ছোট দানা না থাকে।
  10. এভাবে প্রাপ্ত কনডেন্সড মিল্ককে নির্ধারিত তাপমাত্রায় ৫ মিনিট ফুটন্ত পানিতে রেখে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  11. গরম মিশ্রণটিতে ১,০০০ পিপিএম পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইড যোগ করে গরম অবস্থায় জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভর্তি করে শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
See also  মাছ ও পশুপাখির খাদ্য সংরক্ষণ কাকে বলে, বলতে কী বুঝায়? প্রয়োজনীয়তা ও সংরক্ষণ পদ্ধতিসমূহ

(১১) কাঁচা আমের জুস তৈরিকরণ

আম বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় উপাদেয় ফল। এ ফলটি স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান ও ব্যবহার বৈচিত্রে তুলনাহীন বলে এটিকে ফলের রাজা বলা হয়।

আমে ভিটামিন এ, সি ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। দেশের প্রায় সকল জেলাতেই আমের চাষ হয়ে থাকে।

এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে উন্নত প্যাকেজিং, পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে প্রতি বছর ২৫-৩০ ভাগ আমের সংগ্রহোত্তর অপচয় হয়ে থাকে।

এ ছাড়াও ঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে পরিপক্ক হওয়ার পূর্র্বেই কাঁচা আমের একটি বিরাট অংশ গাছ থেকে পড়ে যায়। গাছ থেকে অকালে ঝড়ে পড়া এ কাঁচা আম কৃষককে নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় করতে হয়। এই ঝড়ে পড়া কাঁচা আমকে শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যসামগ্রী বিশেষ করে কাঁচা আমের জুস তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ গবেষণার মাধ্যমে সহজ পদ্ধতিতে কাঁচা আমের জুস তৈরি এবং এর সংরক্ষণ কৌশল উদ্ভাবন করেছে।

বাছাই করা কাঁচা আম
বাছাই করা কাঁচা আম
কাঁচা আমের জুস
কাঁচা আমের জুস

কাঁচা আমের জুস তৈরির পদ্ধতি:

  1. কাঁচা আম সংগ্রহ করে ভালভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে এবং আমের খোঁসা ও আঁটি ফেলে টুকরো করতে হবে।
  2. অতঃপর ব্লেন্ডারে নিয়ে এক ভাগ আমের সাথে চার ভাগ পানি নিয়ে পাল্প তৈরি করতে হবে।
  3. এখন পাল্পগুলো একটি পরিষ্কার নেট বা সাদা কাপড়ে নিয়ে ছাঁকতে হবে এবং প্রস্তুতকৃত পাল্পকে একটি পাত্রে নিয়ে ৭৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২ মিনিট জ্বাল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  4. এভাবে প্রস্তুতকৃত কাঁচা আমের পাল্পকে পরবর্তী সময়ের জন্য ব্যবহারে জন্য -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (ডীপ ফ্রিজ) সংরক্ষণ করতে হয়।
  5. কাঁচা আমের জুস তৈরি করার জন্য একটি পাত্রে এক লিটার পরিমাণ পানি নিয়ে ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় আট মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে।
  6. অতঃপর এ পানিতে ১২৭ গ্রাম চিনি মিশিয়ে দ্রবীভূত করে মোটা কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে।
  7. প্রাপ্ত চিনির দ্রবণে ৩.৩৯ গ্রাম কার্বোস্কি মিথাইল সেলুলোজ (সিএমসি) মিশ্রিত করে ৫-৬ মিনিট জ্বাল দিয়ে দ্রবীভূত করতে হবে।
  8. এরপর প্রাপ্ত দ্রবণে ২২৬ মিলি লিটার কাঁচা আমের পাল্প যোগ করে ভালোভাবে নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে এবং দুই মিনিট পর্যন্ত জ্বাল দিতে হবে।
  9. পরিশেষে প্রস্তুতকৃত কাঁচা আমের জুসকে পর পর দুইবার মোটা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিয়ে তাতে ৬৮ মিলি গ্রাম পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইড (কেএমএস) সংরক্ষণকারক মিশিয়ে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত বোতলজাত করতে হবে।
  10. এভাবে প্রস্তুতকৃত কাঁচা আমের জুস ৬-৮ মাস স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।

(১২) তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আনারস, কলা ও লেবুর সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ

আনারস বাংলাদেশের অন্যতম একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর জনপ্রিয় ফল। এটি ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ছাড়াও অন্যান্য খনিজ লবণ বিদ্যমান।

বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে উৎপাদিত আনারসের জাতগুলোর মধ্যে জায়ান্ট কিউ ও হানিকুইন ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

মৌসুমে উৎপাদিত শতকরা ৬০-৬৫ ভাগ আনারস দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয় হয়ে থাকে। মাত্র ৫-৭ ভাগ আনারস শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী যেমন জ্যাম, জেলী, স্কোয়াশ, জুস ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ভরা মৌসুমে একসঙ্গে অধিক আনারস পাঁকার ফলে দাম কমে যায়, এছাড়া সঠিক পরিবহন ব্যবস্থা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে শতকরা প্রায় ২০-৪০ ভাগ আনারস নষ্ট হয়ে থাকে।

পরিবহন ব্যবস্থা, উন্নত প্যাকেট জাতকরণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সতেজ অবস্থায় পুষ্টিগুণ বজায় রেখে ৩-৪ সপ্তাহ অনায়াসে আনারস সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি দেশে বিক্রয়ের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে, ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি আনারসের সংগ্রহোত্তর অপচয় বহুলাংশে কমানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগ আনারস পরিবহন, প্যাকেটজাতকরণ ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির প্রযুক্তি গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করেছে।

পরিপক্ক আনারস
পরিপক্ক আনারস
পরিপক্ক আনারস সংরক্ষণ (২১ দিন পর)
পরিপক্ক আনারস সংরক্ষণ (২১ দিন পর)
ফালিকৃত আনারস (২৮ দিন পর)
ফালিকৃত আনারস (২৮ দিন পর)

আনারস সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি:

  1. পরিপক্ক, সতেজ ও সমআকারের আনারস বাগান হতে সংগ্রহ করার পর কাঠের বাক্সে/ক্রেটস্ অথবা বড় আকারের প্লাস্টিক ক্রেটস্ সারিবদ্ধভাবে সাজাতে হবে যাতে আঘাতপ্রাপ্ত/নষ্ট না হয়।
  2. ডিজাইনকৃত কেরোসিন (৬০ সেমি ⨉ ৩৬ সেমি ⨉ ৩২ সেমি) কাঠের বাক্সে/ ক্রেটস্-এ ২০-২৫টি আনারস সহজেই পরিবহন করা যাবে। কার্টুনে (৫ প্লাই, ভার্জিন কার্টুন) পরিবহনের ক্ষেত্রে ১২-১৫ টি আনারস পরিবহন করা যায়।
  3. ক্রেটস্ বা কার্টুনে আনারস ভর্তি করার পর বেশি দূরত্বে পরিবহনের জন্য রিফ্রিজারেটেড ট্রাক/রিফার ভ্যান ব্যবহার করতে হবে, যাতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের (১৮-২০ঙ) মাধ্যমে সতেজ থাকে।
  4. অতঃপর ক্রেটস্/কার্টুনে ভর্তি আনারস অধিক সময় সতেজ অবস্থায় গুণাগুণ বজায় রেখে সংরক্ষণ করার জন্য কোল্ড চেম্বার বা কোল্ড রুমে সংরক্ষণ করতে হবে।
  5. উল্লেখ্য যে, পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে আনারস ভর্তি না করে কোল্ড রুমে রাখলে সতেজ থাকলেও ভিতরের শ্বাস শুকিয়ে যায়।
  6. গবেষণায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে, জায়ান্ট কিউ জাতের (CV. Giant Kew) ২টি আনারস ১% ছিদ্রযুক্ত পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে (৩৪ মাইক্রোন) একত্রে রাখলে সতেজ ও রসালো অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়।
  7. প্যাকেটে ভর্তি আনারসগুলো কোল্ডরুমে রেখে ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং ৮৮±১% আর্দ্রতা নির্ধারণ করে দিতে হবে। ফলে কোল্ডরুমে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সতেজ অবস্থায় আনারস সংরক্ষণ করা যাবে।
  8. অপরপক্ষে, হানিকুইন জাতের আনারস (CV. Honey Queen) ৬০ গ্রাম/লি. স্টা-ফ্রেশ ১৯৫২ (Sta-Fresh 2952) দিয়ে প্রলেপ দিয়ে, ১১±১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এবং ৮৮±২% আর্দ্রতায় রেখে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
  9. বিক্রয়ের জন্য কোল্ডরুম থেকে বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখলে আরও ৩-৪ দিন সতেজ অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়, যেখানে মাঠ থেকে পরিপক্ক আনারস উঠানোর পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় মাত্র ৬-৭ দিন সতেজ থাকে বা বিক্রয়ের উপযোগী থাকে।

এভাবে সংরক্ষণকৃত আনারস বাণিজ্যিক উদ্দেশে বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি আমাদের বাংলাদেশেও দীর্ঘ সময় ভোক্তাগণ খেতে পারবে।

কলার সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
কলার সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
সংরক্ষিত কলা ২৮ দিন পর
সংরক্ষিত কলা ২৮ দিন পর

কলা ও লেবু সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি:

কলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফল। যথাযথ হ্যান্ডেলিং, পরিবহন ও সংরক্ষণাগারের অভাবে প্রচুর কলা নষ্ট হয়। এই ক্ষতির পরিমাণ সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং সংরক্ষণকালে যথাযথ তাপমাত্রা বজায় রেখে সহজেই কমানো যায়।

পরীক্ষায় দেখা যায়, অ্যালাম (২০ গ্রাম/মিলি), থায়াবেন্ডাজল (০.৫ গ্রা/লিটার), ইমিডাজল (০.৫ গ্রা/লিটার) এবং জিব্রেলিক এসিড (০.০৫ গ্রাম/লিঃ) দ্রবণে কলাকে ডোবানোর পরে একে কম ঘনত্বের পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগে (৪৫ মাইক্রন) ভরে ১৩ + ২০ সে. তাপমাত্রায় এবং ৮৫% + ৫% ভাগ আর্দ্রতায় একে অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় কলা পাকার বিভিন্ন পর্যায়গুলো দীর্ঘায়িত করা যায় এবং গুণগতমান ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত রক্ষা করা যায়।

অপরদিকে, লেবু ১৩+২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় এবং ৮৮+২% আর্দ্রতায় ১% ছিদ্রযুক্ত পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগে (৩৪ মাইক্রন) ভরে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

(১৩) গাজরের ফ্রেশ কাট প্রসেসিং

শোধন ছাড়া গাজর ৪র্থ দিন
শোধন ছাড়া গাজর ৪র্থ দিন
২% খাবার লবন (NaCl) এর হালকা গরম দ্রবণে শোধনকৃত, ৮ দিন
২% খাবার লবন (NaCl) এর হালকা গরম দ্রবণে শোধনকৃত, ৮ দিন
২% সাইট্রিক এসিডের হালকা গরম দ্রবণে শোধনকৃত, ১০ দিন
২% সাইট্রিক এসিডের হালকা গরম দ্রবণে শোধনকৃত, ১০ দিন

তাঁজা গাজর কেটে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি:

  1. প্রথমে ফ্রেশ কাট প্রস্তুতকারীর হাত পরিষ্কার করে স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়ে এপ্রোন, হ্যান্ড গ্লোভস, ক্যাপ ও মাস্ক পরতে হবে।
  2. সতেজ গাজর সংগ্রহ করে ত্রুটিমুক্তগুলো বাছাই করতে হবে। গাজরসহ ব্যবহৃত সকল পাত্র, ছুরি ০.১% ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম (প্রতি লিটার পানিতে ১গ্রা.) অথবা ২০০ পিপিএম সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (প্রতি লিটার পানিতে ৩.৫ মিলি. ক্লোরক্স) জীবাণুনাশক দ্রবন দ্বারা ধুতে হবে।
  3. গাজরের শিকড় বা অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে, ধারালো পিলার দিয়ে গাজর ছিলে, পছন্দমত টুকরা করতে হবে।
  4. গাজর টুকরাগুলো ২% সাইট্রিক এসিড অধবা ২% খাবার লবন (NaCl) এর হালকা গরম (৬০ ডিগ্রি সে:) দ্রবনে ১ মিনিট শোধন করতে হবে।
  5. শোধনকৃত টুকরাগুলোর গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে PP বক্সে রেখে মুখ আটকিয়ে রেফ্রিজারেটরে (৪±১ ডিগ্রি সে: তাপমাত্রা) সংরক্ষণ করতে হবে।
  6. ২% সাইট্রিক এসিডের গরম দ্রবনে শোধনকৃত টুকরা ১০ দিন, ২% খাবার লবনের গরম দ্রবনে শোধনকৃত টুকরা ৮ দিন ভালো ছিল এবং শোধন ছাড়া টুকরাতে ৩ দিনেই সাদা দাগ দেখা যায় এবং টকটকে কমলা রংও ফিকে হয়ে যায়।

(১৪) রেডি-টু-কুক মিশ্র সবজি

০.৫% সাইট্রিক এসিড দ্রবণে ট্রিটকৃত রেডি-টু-কুক মিশ্র সবজি (সংরক্ষণের ০৭ দিন পর)
০.৫% সাইট্রিক এসিড দ্রবণে ট্রিটকৃত রেডি-টু-কুক মিশ্র সবজি (সংরক্ষণের ০৭ দিন পর)
টাটকা মিশ্র সবজি (১ম দিন)
টাটকা মিশ্র সবজি (১ম দিন)

রান্নার জন্য প্রস্তুত মিশ্র সবজি সংরক্ষণের পদ্ধতি:

  1. বিভিন্ন ধরণের সবজি সংগ্রহ করে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নেয়া হয়।
  2. এরপর খোসা ছাড়িয়ে, অপ্রোয়জনীয় অংশ সরিয়ে সবজিগুলোকে রান্নার উপযোগী করে কাটা হয়।
  3. কাটা সবজির টুকরোগুলো একত্রে মিশিয়ে মিশ্র সবজি তৈরি করা হয়।
  4. মিশ্র সবজির টুকরোগুলো ০.৫% সাইট্রিক এসিড দ্রবণে ৩ মিনিট ডুবিয়ে রেখে তুলে পানি ঝরিয়ে পলিপ্রপাইলিন বক্সে (PP box) রেখে প্রতিটি বক্স ক্লিং র‍্যাপ (cling wrap, ১২.৭ মিলি মাইক্রন পুরুত্ব বিশিষ্ট পলিথিন) দিয়ে মুড়ে ৪±১০ সে. তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে রেখে ৭ দিন পর্যন্ত রান্না ও খাওয়ার উপযোগী রাখা গেছে।
See also  ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ, লক্ষণ এবং ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

(১৫) রেডি-টু-কুক মিষ্টি কুমড়া

রান্নার জন্য টুকরাকৃত টাটকা মিষ্টিকুমড়া (১ম দিন)
রান্নার জন্য টুকরাকৃত টাটকা মিষ্টিকুমড়া (১ম দিন)
ক্লিং রেপকৃত পলিপ্রপাইলিন বক্সে সংরক্ষিত রেডি-টু-কুক মিষ্টিকুমড়ার টুকরা (সংরক্ষণের ১০ দিন পর)
ক্লিং রেপকৃত পলিপ্রপাইলিন বক্সে সংরক্ষিত রেডি-টু-কুক মিষ্টিকুমড়ার টুকরা (সংরক্ষণের ১০ দিন পর)

রান্নার জন্য প্রস্তুত কুমড়া সংরক্ষণের পদ্ধতি:

রান্নার উপযোগী করে কাটা মিষ্টি কুমড়ার টুকরা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে পলিপ্রপাইলিন বক্সে রেখে প্রতিটি বক্স ক্লিং র‍্যাপ (১২.৭ মিলি মাইক্রন পুরুত্ব বিশিষ্ট পলিথিন) দিয়ে মুড়ে ৪±১০ সে. তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে রেখে ১০ দিন পর্যন্ত রান্না ও খাওয়ার উপযোগী রাখা গেছে।

অন্যদিকে ০.১% অ্যাসকরবিক এসিড দ্রবণে ডুবানো মিষ্টিকুমড়ার টুকরা ০৭ দিন, ০.১% সাইট্রিক এসিড দ্রবণে ডুবানো টুকরা ০৬ দিন এবং ০.৫% ক্যালসয়িাম ক্লোরাইড দ্রবণে ডুবানো টুকরা ০৬ দিন পর্যন্ত রান্না ও খাওয়ার উপযোগী রাখা গেছে।

(১৬) মোম ও নারকেল তেলের খাদ্যোপযোগী আবরক প্রয়োগে লেবুর গুণমান রক্ষা ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি

নারকেল তেল ও মোমের আবরক প্রয়োগবিহীন লেবু (৬ দিন পর)
নারকেল তেল ও মোমের আবরক প্রয়োগবিহীন লেবু (৬ দিন পর)
নারকেল তেলের আবরকযুক্ত লেবু (১৮ দিন পর)
নারকেল তেলের আবরকযুক্ত লেবু (১৮ দিন পর)
মোম ও নারকেল তেল সহযোগে প্রস্তুতকৃত খাদ্যোপযোগী আবরকযুক্ত লেবু (১৮ দিন পর)
মোম ও নারকেল তেল সহযোগে প্রস্তুতকৃত খাদ্যোপযোগী আবরকযুক্ত লেবু (১৮ দিন পর)

লেবু সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি:

বিশুদ্ধ নারকেল তেল অথবা মোম ও বিশুদ্ধ নারকেল তেল ৯০:১০ বা ৮০:২০ (গ্রাম/মিলি) অনুপাতে মিশিয়ে খাদ্যোপযোগী আবরক তৈরি করে ত্রুটিমুক্ত, পরিপক্ক লেবুতে প্রয়োগ করে খোলা বাতাসে শুকিয়ে নেয়ার পর ০.৫% ছিদ্রযুক্ত পাতলা পলিথিন ব্যাগে কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে (২২±২ক্ক সে. তাপমাত্রা ও ৫০±৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা) ১৮ দিন পর্যন্ত ভাল পাওয়া গেছে।

পক্ষান্তরে, আবরক প্রয়োগ না করে ও খোলা অবস্থায় প্লাস্টিক ক্রেটে রেখে লেবু ৬ দিন পর্যন্ত ভাল ছিল। নারকেল তেল ও মোমের খাদ্যোপযোগী আবরক লেবুর দৃঢ়তা ও সবুজ রং রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল। আবরকযুক্ত লেবু এবং ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষিত লেবুর ওজন হ্রাস কম হয়েছিল।

(১৭) স্টীপিং পদ্ধতিতে কাঁচা আম সংরক্ষণ

কাঁচা আম
কাঁচা আম
সংরক্ষক দ্রবণে কাঁচা আম আমের টুকরো
সংরক্ষক দ্রবণে কাঁচা আম আমের টুকরো

স্টীপিং পদ্ধতিতে কাঁচা আম সংরক্ষণের পদ্ধতি:

আম বাংলাদেশের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ফল। আমকে ফলের রাজা বলা হয়। এটি সুস্বাদু ও পুষ্টি সমৃদ্ধ। আম পাকা ও কাঁচা দুই ভাবেই খাওয়া হয় এবং বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

প্রতি বছর ঝড়ে ও শিলা বৃষ্টির ফলে অধিক পরিমাণ কাঁচা আম বিশেষ করে অপরিপক্ক আম গাছ থেকে ঝরে পড়ে এবং আমে বিভিন্ন দাগ বা কষ লেগে থাকার ফলে আমের গুণগত মান (ফলের রং) দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

কাঁচা আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অপচয় রোধ করা যায়। তাছাড়া, স্থানীয় উৎপাদিত জাতের আম গুণগত মানসম্পন্ন হওয়ায় সে আমগুলোও প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

স্টীপিং পদ্ধতিতে কাঁচা আম খুব সহজেই ৮ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা করা যায় যা হতে পরবর্তীতে কাঁচা আমের বহুমুখী ব্যবহার হিসেবে রকমারি খাবার তৈরি করা যায়।

স্টীপিং পদ্ধতির উদ্দেশ্য:

  • স্বল্প ব্যয় সম্পন্ন এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করা যায়।
  • বর্ণ, স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তনের মাধ্যমে আকর্ষণীয় এবং মুখরোচক প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা।
  • সংরক্ষিত ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাতে সরবরাহের মাধ্যমে পারিবারিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধি করণ।

প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি:

  1. বায়ুরোধ নিশ্চিতকারী ঢাকনাসহ পাস্টিক ড্রাম/কনটেইনার;
  2. ব্যালেন্স, বটি/ছুরি এবং সসপেন;
  3. বিশুদ্ধ পানি, লবণ, গ্যাসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড এবং পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট (কেএমএস)।

স্টীপিং/লবণ দ্রবণে কাঁচা আম সংরক্ষণ পদ্ধতি:

  1. পরিপুষ্ট (৬-১৬ সপ্তাহ) কাঁচা আম সংগ্রহ করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন।
  2. ফলের আকার অনুযায়ী সম্পূর্ণ আম অথবা দুই বা চার টুকরো করে কেটে এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায়।
  3. ফলগুলো বাঞ্চিং (৭০-৮০০সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ২-৩ মিনিট রাখা) করুন। অতঃপর পানিতে ১০ মিনিট ডুবিয়ে ঠান্ডা করে নিন।
  4. স্টীপিং দ্রবণ তৈরির জন্যে ১০% লবণ, ১% গ্যাসিয়াল অ্যাসেটিক এসিড এবং ০.১% পটাসিয়াম মেটাবাইসালফাইট ব্যবহার করুন (১ কেজি দ্রবণ তৈরির জন্য ১০০ গ্রাম লবণ, ১০ গ্রাম অ্যাসেটিক এসিড, ১ গ্রাম পটাসিয়াম মেটাবাইসালফাইট এবং ৮৯০ গ্রাম পানি প্রয়োজন)।
  5. প্রথমে লবণের দ্রবণ তৈরি করে তা ৫ মিনিট ফুটিয়ে পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন এবং পরে পরিমিত অ্যাসেটিক এসিড ও পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট যোগ করুন।
  6. পাস্টিক ড্রাম/কনটেইনারটি ভালভাবে পরিষ্কার করে ৮০-৯০০ সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ধুয়ে (Rinse) জীবাণুমুক্ত করুন।
  7. ফল/ফলের টুকরো পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত ড্রাম বা কনটেইনারে রেখে স্টীপিং দ্রবণ যোগ করুন (প্রতি কেজি ফল/স্লাইসের জন্য আনুমানিক ১.২৫ থেকে ১.৫ কেজি স্টীপিং দ্রবণের প্রয়োজন)।
  8. দ্রবণ ও ফলে ভর্তি পাত্রের মুখে ঢাকনা ভালভাবে লাগিয়ে দিয়ে সংযোগস্থলের উপর দিয়ে আঠাযুক্ত টেপ ভালভাবে লাগিয়ে দিন যাতে পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বায়ুরোধী হয়।
  9. পাত্রগুলো পরিষ্কার জায়গায় অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা স্থানে রেখে দিন।

স্টীপিং/লবণ দ্রবণ থেকে সংরক্ষণকৃত আম বের করার পর করণীয়:

  • ব্যবহারের পূর্বে স্টীপিং দ্রবণে সংরক্ষিত কাঁচা আম/আমের টুকরোগুলো ভালভাবে পরিষ্কার/বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।
  • প্রয়োজনীয় পরিমাণ আম বা আমের টুকরো সংরক্ষিত পাত্র হতে বের করার পর পুনরায় পাত্রের মুখে ভালভাবে ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে যাতে পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বায়ুরোধী হয়।

স্টীপিং/লবণ দ্রবণ সংরক্ষণকৃত আমের ব্যবহার:

  • সংরক্ষণকৃত আম সরাসরি খাওয়া যাবে।
  • সবজি ও ডাল জাতীয় খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।
  • সহজেই আচার/চাটনী জাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
  • আমের পাল্প জুস তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।

সতর্কতা:

  • আম প্রক্রিয়াজাতকরণ বা লবণ দ্রবণ তৈরি করার সময় হ্যান্ড গাভস্ ব্যবহার করতে হবে।
  • আম বা আমের টুকরো পাত্র হতে বের করার সময় চামচ ব্যবহার করতে হবে।
  • প্রক্রিয়াটি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে সম্পন্ন করতে হবে।

(১৮) উৎকৃষ্টমানের আমচুর প্রক্রিয়াজাতকরণ

আম বাংলাদেশের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ফল। এটি খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টি সমৃদ্ধ বলে আমকে ফলের রাজা বলা হয়।

আম পাঁকা ও কাঁচা দুই ভাবে খাওয়া হয় এবং প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

আমের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে কাঁচা আম দিয়ে আমচুর তৈরি করে সংরক্ষণ করলে সারা বছর ব্যাপী এ ফলের স্বাদ নেওয়া যায়।

আমাদের বাংলাদেশে প্রতি বছর ঝড়ে ও শিলা বৃষ্টির ফলে অধিক পরিমানে কাঁচা আম বিশেষ করে অপরিপক্ক আম গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। অনেক সময় গাছ থেকে পড়া আম ফেটে যায়। ফলে বিভিন্ন দাগ বা কষ আমের গায়ে লেগে থাকার ফলে আমের গুনগত মান (ফলের রং) দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

অনেক সময় আম উৎপাদনের জন্য সাথে সম্পৃক্ত চাষী ও আম ব্যবসায়ী খুব অল্প মূল্যে কাঁচা আম বাজারে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়ে থাকে কিন্তু কাঁচা আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অপচয় রোধ করা যায়।

কাঁচা আমের বহুমুখী ব্যবহার হিসেবে বিভিন্ন খাবার তৈরি করা যায়। কাঁচা আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সহজ পদ্ধতিতে আমচুর তৈরি করে সংরক্ষণ করা একটি অন্যতম প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি যা রকমারি খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।

এইচডিপি প্যাকেটে প্রক্রিয়াজাতকৃত শুকনো আমের পণ্য বা আমচুর
এইচডিপি প্যাকেটে প্রক্রিয়াজাতকৃত শুকনো আমের পণ্য বা আমচুর
কেএমএস মিশ্রিত পানিতে রাখা আমের টুকরো
কেএমএস মিশ্রিত পানিতে রাখা আমের টুকরো

আমচুর তৈরির পদ্ধতি:

  1. আমচুর তৈরিতে পরিপক্ক বা অপরিপক্ক দুই ধরনের আমই (৮ – ১৫ সপ্তাহ) ব্যবহার করা যায়। প্রথমে কাঁচা আম ও আম কাটার ধারালো চাকু বা বটি (স্টেইনলেস ষ্টীল ব্যবহার করা ত্তম) ভালভাবে পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।
  2. অত:পর আমের উপরের ত্বক ও বীচি (সীড) বের করে নিয়ে আমটি মাঝারী সাইজের (৮০- ১০০ গ্রাম) হলে ৮-১০ টি লম্বালম্বিভাবে ফালি করে নিতে হবে এবং ৫০০ পিপিএম (১ লিটার পানিতে ০.৫০ গ্রাম পরিমান পটাসিয়াম মেটা বাই সালফাইট) কেএমএস মিশ্রিত পানিতে আমের টুকরোগুলো ৫ মিনিট রেখে দিতে হবে যাতে আমের টুকরোগুলোতে কোন কালো দাগের সৃষ্টি না হয় বা রং এর পরিবর্তন না ঘটে।
  3. এখন কেএসএস মিশ্রিত পানি থেকে আমের টুকরোগুলো উঠিয়ে নিয়ে গরম পানিতে (৮০০ সে: তাপমাত্রায়) ২-৩ মিনিট রাখতে হবে বা ভাব দিতে হবে। গরম পানিতে ভাব দেওয়াকে ব্লাঞ্চিং বলে।
  4. স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে আসার জন্য আমের টুকুরোগুলো গরম পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে ৫ মিনিট ঠান্ডা পানিতে রেখে পরে পানি নিংড়ানোর জন্য ছিদ্রযুক্ত ট্রে বা বা চালুনীতে আমের টুকুরোগুলোকে কিছুক্ষন রেখে দিতে হবে।
  5. অত:পর আমের টুকরোগুলোতে ০.২% হলুদ (১ কেজি আমের টুকরোর জন্য ২ গ্রাম হলুদ মিশানো) মিশিয়ে নিতে হবে। এখন হলুদ মিশানো আমের টুকরোগুলো ছিদ্রযুক্ত ট্রেতে নিয়ে কেবিনেট ড্রাইয়ার এ ৫৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বা রৌদ্রে পর্যায় ক্রমে (৪৮-৭২ ঘন্টা) বা ২-৩ দিন শুকাতে হবে যাতে আমের টুকুরোগুলোতে আর্দ্রতা পরিমান শতকরা ৫ ভাগ এর নীচে থাকে।
  6. কেবিনেট ড্রাইয়ার ব্যবহার করলে আমচুরের গুণগতমান ভালভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ড্রাইয়ার এর পরির্বতে রৌদ্রে শুকালে পরিষ্কার জায়গায় ছিদ্রযুক্ত ট্রেতে নিয়ে আমের টুকুরোগুলো শুকাতে হবে এবং কিছুক্ষন পর পর আমের টুকুরোগুলো উল্টিয়ে দিতে হবে যাতে কোন পাশে বেশি আর্দ্রতা না থাকে।
  7. এখন শুকানো আমের টুকরোগুলোকে ৩৫ – ৪০ পুরুত্বের এইচডিপি (হাইডেনসিটি পলিইথিলিন) বা মেটালেক্স ফয়েল প্যাকেটে রেখে ভালভাবে সিলিং করতে হবে যাতে কোন ভাবে প্যাকেটের ভিতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে প্রস্তÍতকৃত শুকনো আমের পণ্য বা আমচুর ৬ – ৮ মাস পর্যন্ত স্বাভাবিক তাপমাত্রায় শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করা যায়।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page