Skip to content

 

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম): প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বালাই ব্যবস্থাপনা বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা হলো উদ্ভিদ সংরক্ষণের এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সম্ভবপর সব রকম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যেমন- প্রাকৃতিক, জৈবিক, কৃষি পরিচর্যা, যান্ত্রিক, আইনগত, রাসায়নিক প্রভৃতির সমন্বয় সাধন ও প্রয়োগ করে এবং কৃষি পরিবেশের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ন্যূনতম পর্যায়ে রেখে বালাইসমূহকে অর্থনৈতিক ক্ষতিকর মাত্রার নিচে রাখে।

(১) বালাই নিয়ন্ত্রণের সাধারণ নীতি

বালাইসমূহকে একেবারে উচ্ছেদ বা প্রতিরোধ না করে তাদের সংখ্যা কমানো বালাই নিয়ন্ত্রণের একটি যুক্তিসঙ্গত নীতি। এতে অন্তত কিছু সংখ্যক বালাইকে পরিবেশে রেখে দিলে পরিবেশের ভারসাম্যের পাশাপাশি ফসলের কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

উপযুক্ত দমন ব্যবস্থা নিলেই যে অধিক ফসল পাওয়া যাবে বা লাভ হবে তা ঠিক নয়। কেননা অনেক সময় বালাই দমনে যে খরচ হয় তা বালাই দমনের ফলে প্রাপ্ত বাড়তি শস্যের মূল্যের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বালাই নিয়ন্ত্রণে সর্বদা এমন নীতি গ্রহণ করা উচিত যাতে কৃষি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট না হয় এবং অধিক খরচ না পড়ে। এজন্য যথাসম্ভব কৃষি পরিচর্যা, জৈবিক দমন ও পোষক প্রতিরোধের মাধ্যমে সর্বদা সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।

(২) সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) উপাদানসমূহ

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) উপাদানসমূহ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং আইপিএম বালাই ব্যবস্থাপনার যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি নির্বাচন এবং এদের যথোপযোগী ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বালাই ব্যবস্থাপনার নির্বাচিত পদ্ধতি কার্যকর, বাস্তবসম্মত, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং পরিবেশসম্মত হতে হবে।

একটি উপযুক্ত কৌশল নির্বাচনের জন্য একজনকে ক্ষতিকর পোকার জীবনচক্র এবং আচরণ, পোকার আক্রমণ ক্ষতির কারণ হবে কিনা তা বুঝতে হবে এবং তাকে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য পদ্ধতি তুলনাপূর্বক উপযোগী আইপিএম পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) বিভিন্ন উপাদান নিচে দেওয়া হলো-

ক) সঙ্গনিরোধ এবং আইনগত

এ প্রক্রিয়ায় সরকারি আইনসমূহ প্রয়োগ করা হয় এবং এর আওতায় বীজ এবং আক্রান্ত গাছ বা গাছের অংশ দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না অথবা দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে দেওয়া হয় না। একে বলা হয় সঙ্গনিরোধ পদ্ধতি এবং ইহা দুই ধরনের, যেমন- দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্গনিরোধ এবং বৈদেশিক সঙ্গনিরোধ।

খ) পরিচর্যাগত

পরিচর্যাগত পদ্ধতি হচ্ছে নিয়মিত খামার কার্যক্রম পরিচালনা, যাতে ক্ষতিকর বালাইসমূহ ধ্বংস হয় অথবা এরা আর্থিক ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকে। বিভিন্ন পরিচর্য্যাগত পদ্ধতির মধ্যে ফসল এবং জাত নির্বাচন, বপনের সময় এবং পদ্ধতি, ভূমি কর্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, সেচ এবং সার প্রয়োগ, ফসল সংগ্রহের সময় ও পদ্ধতি এবং ফসল না থাকার সময়ে মাঠ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিকর পোকা সহযোগিতা করে থাকে।

গ) কৌলিতাত্ত্বিক প্রতিরোধী জাত ব্যবহার

উচ্চ ফলন ক্ষমতাসম্পন্ন পোকা প্রতিরোধী/সহনশীল জাত নির্বাচন করতে হবে। পোকা প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় সুবিধাজনক।

ঘ) ভৌতিক

এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন যন্ত্র/পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে পোকাকে শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে পোকার সংখ্যা কমিয়ে রাখা হয়।

গরম ও ঠাণ্ডা তাপমাত্রা প্রয়োগ: শুষ্ক তাপ প্রয়োগ অথবা সূর্যের আলোতে শুকানোর মাধ্যমে গরমকাল বিশেষত এপ্রিল-জুন মাসে বীজ এবং গুদামজাত পণ্যের অনেক পোকাই নিধন করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের তাজা ও শুকনা ফল হিমাগারে গুদামজাত করলে মাছি পোকা, আলুর সুতলি পোকা এবং অনেক রোগ-জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ফল বা সবজি ১০ সে. এর নিচের তাপমাত্রায় রাখা হলে ফলের মাছি পোকার কিড়া মারা যায়।

আর্দ্রতা: বাতাসের আর্দ্রতা হ্রাসের প্রতি পোকামাকড় খুবই সংবেদনশীল, কিন্তু মাঠে বাতাসের আর্দ্রতার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটানো সাধারণত সম্ভবপর নয়।

আলোক ফাঁদ: কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার শুরুর আগে আলোক ফাঁদের সাহায্যে বিভিন্ন মথ ও প্রজাপতি বিপুল সংখ্যায় আকৃষ্ট করে মেরে ফেলে পোকা দমন করা হতো। এ ধরনের ফাঁদ এখনও কোনো একটি এলাকার প্রধান প্রধান ক্ষতিকারক পোকার উপস্থিতি নির্ণয়ের কাজে উপযোগী।

ঙ) যান্ত্রিক

হাত ব্যবহারের মাধ্যমে পোকার সংখ্যা কমানোর জন্য নিম্নলিখিত যান্ত্রিক পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার হয়ে থাকে। 

হাত বাছাই: বড়, সুস্পষ্ট, পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ পোকাসমূহকে হাত বাছাইয়ের মাধ্যমে ধ্বংস করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি যা কিছু নির্দিষ্ট অবস্থার প্রেক্ষাপটে কার্যকর। 

পর্দা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে পোকাকে দূরে রাখা: ৩০-৬০ সে. মি. গভীর পরিখা খননের মাধ্যমে এবং জমির চারপাশে ৩০ সে. মি. উঁচু টিনের বেড়া দিয়ে উড়ন্ত পঙ্গপালসহ বিভিন্ন ধরনের বিছা পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ফাঁদ এবং সাকশন যন্ত্রের মাধ্যমে: ক্ষতিকর পোকা সংগ্রহের বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক উপায় রয়েছে। উপযুক্ত টোপের মাধ্যমে তাদেরকে এমন ফাঁদে/খাঁচায় ফেলা হয় যেখান থেকে তাদের বের হওয়া কঠিন।

ডালপালা ছাঁটাই এবং পারে পিষে মেরে ফেলা: আক্রান্ত ডগা এবং ফুলের অংশ ছাঁটাই ও ধ্বংসের মাধ্যমে আঙ্গুর, সাইট্রাস, বরই, আতা ও ডুমুর আক্রমণকারী বিভিন্ন ধরনের জেল, মিলিবাগ এবং গলমাছি পোকা কার্যকরভাবে দমন করা সম্ভব।

চ) জৈবিক

স্মিথ ১৯১৯ সালে প্রথম জৈবিক দমন কথাটি ব্যবহার করেন যার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনের জন্য প্রাকৃতিক শত্রুসমূহের ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা।

প্রাকৃতিক উপায়ে দমন: বিভিন্ন বায়োটিক এবং এবায়োটিক উপাদানের সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমিত রাখাকে প্রাকৃতিক সমন বলা হয়ে থাকে।

রজীবী (প্যারাসিটয়েড): এরা সাধারণত পোষক পোকার চেয়ে আকারে অনেক ছোট, এরা পোষককে মেরে ফেলে ও একটি মাত্র পোষকের মাধ্যমে অপ্রাপ্ত অবস্থা সম্পন্ন করে এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় মুক্তভাবে জীবনযাপন করে ব্রাকনিড বোলতা একটি কার্যকর প্যারাসিটয়েডের ভালো উদাহরণ।

পরভোজী পোকা: একটি পরভোজী পোকা সাধারণত মুক্তভাবে জীবন ধারণ করে। এরা পোষককে মেরে ফেলে এবং সাধারণত পোষকের চেয়ে আকারে বড় হয় এবং তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে সাধারণত একাধিক পোষকের প্রয়োজন হয়। লেস উইং, লেডিবার্ড বিটল, প্রেয়িং ম্যান্টিড ইত্যাদি পরভোজী পোকার ভালো উদাহরণ।

রোগজীবাণু ব্যবহারের মাধ্যমে: তিনটি পদ্ধতিতে অণুজীব ব্যবহারের মাধ্যমে রোগ সৃষ্টি করে পোকা দমন করা যায়।

অনুজীব প্রতিষ্ঠাকরণ: এ পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকার আবাসস্থলে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব অবমুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরে যা নিজে থেকেই উক্ত এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পর পর রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব অবমুক্ত করাকে মৌসুমি প্রতিষ্ঠাকরণ বলা হয়ে থাকে।

অণুজীব সংরক্ষণ: এই পদ্ধতি বলতে পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পরিচর্য্যাগত পদ্ধতি পরিবর্তন অথবা পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে কোনো এলাকার বিভিন্ন বালাইয়ের রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবসমূহের সংখ্যা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

অণুজীব কীটনাশক: এই পদ্ধতি বলতে বিপুল সংখ্যায় অণুজীব বৃদ্ধি করানোকে বোঝানো হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োগের মতো পোকার আবাসস্থলে বিপুল সংখ্যায় অণুজীব প্রয়োগ করা হয়। ব্যাকুলোভাইরাস, ব্যাসিলাস থুরিনজাইএনসিস, বিউভেরিয়া রেবডিটিস ইত্যাদি অণুজীব কীটনাশকের উদাহরণ।

ছ) জীব প্রযুক্তিগত

আধুনিক উদ্ভিদ জীবপ্রযুক্তির তিনটি উপাদান স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে-

  1. রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি;
  2. মনোক্লোনাল এন্টিবডি উৎপাদন;
  3. সেল এবং টিস্যু কালচার।

এই তিনটি পদ্ধতির সমন্বয়ই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মূল ভিত্তি। বিভিন্ন ফসল উন্নয়নে উদ্ভিদ জীব প্রযুক্তির উপযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গতানুগতিক প্রজনন (ব্রিডিং) পদ্ধতিতে হাইব্রিডাইজেশন-এর মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে সফলতার সাথে জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। বন্য প্রজাতিসমূহ বিভিন্ন বায়োটিক ও এবায়োটিক প্রতিকূলতা প্রতিরোধী জিনের খুব গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বন্য প্রজাতির ধান Oryza nivara থেকে গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস প্রতিরোধী জিন এবং Oryza officinalis থেকে সাদা পিঠ গাছ ফড়িং প্রতিরোধী জিন সফলতার সাথে স্থানান্তর করা হয়েছে।

জ) উদ্ভিজ্জ

প্রায় ২,১২১ ধরনের উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের গুণাগুণ রয়েছে। তবে আদর্শ উদ্ভিজ্জ কীটনাশক হতে হলে উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহকে উচ্চ কীটনাশক গুণসম্পন্ন হওয়া ছাড়াও নিম্নলিখিত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন।

  • এরা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের জন্য নিরাপদ হবে;
  • এরা পরিবেশে স্থায়ী হবে না কিন্তু কার্যকর অবশিষ্টাংশ সম্পন্ন হতে হবে;
  • এদের মূল উপাদানসমূহ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক পদ্ধতিতে আলাদা করা যাবে; এদের উৎপাদিত দ্রব্যসমূহ একই রকম গুণাবলি সম্পন্ন হবে (যেমন- নিম, চিনাবেরি, তামাক, পনগ্রাম, শরিফা ইত্যাদি।

ঝ) রাসায়নিক

কৃষিকাজে রাসায়নিক বালাইনাশক বিভিন্ন বালাই, যেমন- পোকামাকড়, ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, আগাছা, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি দমনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

রাসায়নিক পদ্ধতিতে বালাই ব্যবস্থাপনায় অনেক ধরনের পদার্থ ব্যবহৃত হতে পারে। কোনোটি বালাইসমূহকে বিভ্রান্ত করে, আবার কোনোটি আগাছার সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বা কীটপতঙ্গের খোলস পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। অন্যদিকে কিছু উদ্ভিদজাতসহ সকল প্রচলিত রাসায়নিক কীটনাশকসমূহ জীবন্ত প্রাণিকূলের উপর সার্বিকভাবে বিষাক্ত।

বালাইনাশকের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘বালাই ধ্বংসকারী। নির্দিষ্ট শ্রেণির বালাইনাশককে উক্ত শ্রেণির নামে অভিহিত করা হয়, যেমন- কীটপতঙ্গ ধ্বংসকারীকে কীটনাশক, আগাছা ধ্বংসকারীকে আগাছানাশক, ছত্রাক ধ্বংসকারীকে ছত্রাকনাশক, মাকড় ধ্বংসকারীকে মাকড়নাশক ইত্যাদি।

তবে বালাইনাশকের ক্ষতিকারক দিকসমূহ, যেমন- বিভিন্ন বালাইয়ের সাধারণভাবে ব্যবহৃত বালাইনাশকসমূহের উপর প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তোলা, বিভিন্ন অপ্রধান বালাইয়ের প্রধান বালাই হিসেবে পুনরুত্থান, খাদ্য, পশুখাদ্য, মাটি, পানি, বাতাস ইত্যাদিতে বালাইনাশকসমূহের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতির ফলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও পরিবেশ বিপর্যয় ইত্যাদি বিবেচনা করে আইপিএম-এর সর্বশেষ ধাপ হিসেবে এটির ব্যবহার করা উচিত।

(৩) সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ

ক) আইপিএম-এর সুবিধাসমূহ

  • সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকামাকড় বা রোগবালাই কার্যকরী ও টেকসইভাবে দমন করা সম্ভব যা এককভাবে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে সম্ভবপর নয়।
  • বালাইনাশকের ব্যবহার কম হওয়ার কারণে মাঠ শ্রমিক/কৃষক/ভোক্তাদের স্বাস্থ্যহীনতার ঝুঁকি কমে যাবে।
  • রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কম হওয়ার কারণে ফসলের জমির ক্ষয় ও অনুর্বর হয়ে যাওয়া হ্রাস পাবে।
  • রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কম হওয়ার কারণে কৃষকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে।
  • আইপিএম কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘমেয়াদে ফসলের জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি ফসলসমূহ টেকসইভাবে বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
  • যে সমস্ত ক্ষেত্রে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার কার্যকর নয় সে সব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনের জন্য আইপিএম পদ্ধতিই একমাত্র সমাধান।

খ) আইপিএম-এর অসুবিধা/সীমাবদ্ধতাসমূহ

  • বালাই দমনের গতানুগতিক পদ্ধতির তুলনায় আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারে সময় ও শ্রম বেশি লাগে। আইপিএম পদ্ধতি সফলভাবে ব্যবহার করার জন্য কোনো এলাকার কৃষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয়।
  • বালাই দমনের গতানুগতিক পদ্ধতির তুলনায় আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারের প্রাথমিক খরচ বেশি হতে পারে।

(৪) ফেরোমন ফাঁদের মাধ্যমে পোকা দমন পদ্ধতি

চিত্র- করলার ক্ষেত
চিত্র- করলার ক্ষেত
চিত্র- বাঁধাকপির ক্ষেত
চিত্র- বাঁধাকপির ক্ষেত

পুরুষ পোকাকে প্রজনন কাজে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্ত্রী পোকা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয় এবং স্ত্রী পোকার সাথে মিলিত হয় এবং পোকার বংশবৃদ্ধি ঘটায়।

বর্তমানে স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিঃসৃত এমনই কয়েক ধরনের কৃত্রিম সেক্স ফেরোমন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও সহজলভ্য করা হয়েছে। সেক্স ফেরোমনের গন্ধ দিয়ে তৈরি টোপ বা পিউর ঝুলিয়ে রেখে আকৃষ্ট পুরুষ পোকাকে আটকানো ও পরে মেরে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের পোকা ধরার ফাঁদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ সহজলভ্য দ্রবাদি দিয়ে তৈরি ‘বারি ফাঁদ’ নামে এক ধরনের ফাঁদ উদ্ভাবন করেছেন, যা অত্যন্ত সত্তা ও পোকা ধরার কাজে অত্যন্ত কার্যকরী। চমকপ্রদ কার্যকারিতার জন্য কৃষকদের মাঝে এটি ‘জানুর ফাঁদ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

  • ‘বারি ফাঁদ’-এর আকার সাধারণত ২০-২৪ সে.মি. লম্বা, ১২-১৫ সে.মি. দৈর্ঘ্য ও ১০-১২ সে.মি. প্রস্থ চার কোণাকার বা গোলাকৃতি উন্নতমানের (পিভিসি যেন হতে তৈরি) প্লাস্টিকের তৈরি পাত্র (বৈয়াম)।
  • ফাঁদটি অবশ্যই স্বচ্ছ সাদা প্লাস্টিকের তৈরি হতে হবে, পাত্রের কোনো অংশে রং ব্যবহার করলে পোকা ধরার পরিমাণে হেরফের হবে। তবে প্লাস্টিকের পাত্রের মুখ যে কোনো রঙের (লাল, হলুদ, সবুজ) হতে পারে।
  • ফাঁদের ভিতর পোকা ঢোকার সুবিধার্থে পাত্রের তলা হতে ৫-৬ সে.মি. উপরে পাত্রের উভয় পার্শ্বে ত্রিকোণাকারভাবে কাটা (ভূমি ৭-৮ সে.মি. ও উচ্চতা ৭-৮ সে.মি.)।
  • ফেরোমন টোপটি পানি ফাঁদের প্লাস্টিক পাত্রের মুখ হতে ৩-৪ সে.মি. নিচে একটি সরু তার দিয়ে স্থাপন করতে হয়।
  • ফাঁদ পাতা অবস্থায় সব সময় পাত্রের তলা থেকে ৩-৪ সে.মি. উচ্চতা পর্যন্ত সাবান মিশ্রিত পানি রাখতে হবে। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে পাত্রের তলায় রক্ষিত সাবান পানি যেন শুকিয়ে না যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ (চার) ধরনের পোকা দমনের জন্য সেক্স ফেরোমনের ফাঁদ বিভিন্ন ফসলে, যেমন- বেগুন, বিভিন্ন কুমড়াজাতীয় ফসল (১৬টি), বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, মরিচ, সরিষা, আম, পেয়ারা ইত্যাদি ফসলে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাধারণত ফেরোমনের ফাঁদ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পোকা দমনে ফেরোমনের ফাঁদভিত্তিক সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থসাশ্রয়ী, কার্যকর এবং পরিবেশবান্ধব।

ফেরোমন ফাঁদ নির্দিষ্ট দূরত্বে ফসলের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে স্থাপন করতে হবে। সাধারণত একটি ফেরোমন টোপ ৫০-৬০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে বলে ব্যবহারের ৬০ দিন পর প্রয়োজন অনুসারে পুরাতন টোপ পরিবর্তন করে নতুন ফেরোমন টোপ ব্যবহার করতে হবে।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page