এ পাঠটি শেষে অবধি পড়লে আপনি- গৃহপালিত পশুর জন্য সাইলেজ ও হে তৈরির পদ্ধতির ব্যবহার করে ঘাস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবেন। শুকনো ঘাস বা হে তৈরি ও সাইলেজ তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে করতে পারবেন।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত গোখাদ্যের বেশিরভাগই কৃষি শস্যের উপজাত দ্রব্য। এসব উপজাত শস্য মাড়াইয়ের বা শস্যদানা প্রক্রিয়াজাত করার পর পাওয়া যায়। সাধারণত এসব উপজাতগুলোর মধ্যে জলীয় অংশের পরিমাণ ১৫%-এর নিচে থাকে এবং শুকনো অবস্থায়ই এগুলো সংরক্ষণ করা হয়।
(১) সাইলেজ ও হে তৈরির পদ্ধতির ব্যবহার করে ঘাস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বর্ষা মৌসুমে মাটিতে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বা কৃত্রিমভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে যেসব পশুখাদ্য উৎপাদন করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে তা ব্যবহার করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তখন অতিরিক্ত এই ঘাস সংরক্ষণের দরকার হয়। ঘাসের পরিপক্কতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পুষ্টিমানও কমে যায়। অতএব, অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ঘাস একসঙ্গে সংগ্রহ করলে সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। অল্প সময়ে ঘাস সংগ্রহ করলে ঐ জমিও পরবর্তী ফসলের জন্য ব্যবহার করা যায়।
আঁশজাতীয় গোখাদ্য দুইভাবে সংরক্ষণ করা যায়। যেমন- শুকনো ঘাস বা হে ও সাইলেজ তৈরি করে সংরক্ষণ। আবহাওয়া বা ঘাসের গঠনের ওপর নির্ভর করে উপরোক্ত যে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
(২) শুকনো ঘাস বা হে তৈরি
হে কি/কাকে বলে: হে মানে হলো শুখনো ঘাস। তাজা ও সবুজ ঘাসের প্রায় ৯০%-ই পানি, কাজেই তাজা ও সবুজ ঘাস রোদে বা কৃত্রিম উপায়ে শুকিয়ে এর জলীয় অংশ যখন ১০-১৫%-এ নামিয়ে আনা হয় তখন ঐ ঘাসের পুষ্টিমানসহ সংরক্ষণ করার উপযোগী হয়। এই পদ্ধতিকে সংরক্ষণ করা ঘাসকে হে বলে।
খড় এবং হে কি একই: না, খড় এবং হে একই না। মূলত কোন ঘাসকে (যেমন- আলফা আলফা ঘাস) ৮৫-৯০ ভাগ শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে সেটাকে হে বলে। অপরদিকে কোন শস্যর ডালপালাকে (যেমন- ধান গাছ) শতভাগ শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে সেটাকে খড় বলে।
ক) হে তৈরিতে বিবেচ্য বিষয়
শুকনো ঘাস বা হে তৈরি করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। যেমন-
- যেসব ঘাসের কান্ড নরম, সহজে শুকানো যায় ও শুকানোর পর সহজে পাতা ঝরে পড়ে না সেসব ঘাস হে করার জন্য নির্বাচন করতে হবে। উদাহরণসরূপ বলা যায় ওট, খেসারি, মাসকালাই ইত্যাদি ঘাস থেকে ভালো হে তৈরি হয়।
- ঘাসের সঠিক পরিপক্কতা নির্ধারণ করতে হবে। ঘাস বেশি পাকা হলে হে ভালো হয় না। সাধারণত নরম ফলসহ হে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
খ) ঘাস শুকানোর পদ্ধতি নির্বাচন
নিম্নোাক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে কাঁচা ঘাস শুকানোর পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। যথা-
- কী পরিমাণ ঘাস কোন সময়ে পাওয়া যাচ্ছে?
- বাতাসের আর্দ্রতা।
- বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা বা পরিমাণ এবং
- দিনের তাপমাত্রা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকে, বৃষ্টিপাত খুবই কম হয় ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশি পরিমাণে ডালজাতীয় ঘাস উৎপাদিত হয়। এসব ঘাস সহজেই রোদে শুকিয়ে হে তৈরি করা যায়।
অন্যদিকে, মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই সবুজ ঘাসের প্রাপ্যতাও বাড়ে। কিন্তু এসময় রোদে শুকানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। কাজেই এ সময় কৃত্রিমভাবে ঘাস শুকানো যেতে পারে। সাধারণত খামারিরা যে অল্প পরিমাণ ঘাস উৎপাদন করে তা কৃত্রিমভাবে শুকানো ব্যয়বহুল।
গ) ভালো হে-এর গুণাগুণ
ভালোমানের হে-
- অ্যারোমা বা সুগন্ধিযুক্ত হবে।
- নির্দিষ্ট জাতের ঘাস বাদে অন্য কোন অপ্রয়োজনীয় ঘাস বা আবর্জনা থাকবে না।
- দেখতে মোটামুটি সবুজ মনে হবে।
- ঘাসের আর্দ্রতা ১৫-২০%-এর কম থাকবে।
- ঘাসের পাতা ও কান্ডের গঠন ঠিক থাকবে।
- গবাদিপশু সহজেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে।
ঘ) হে সংরক্ষণ পদ্ধতি
হে তৈরির পর কোন শেডের নিচে যেভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিম্নরূপ-
- স্তুপ করে।
- বেল বা বোঝা বানিয়ে।
- কেটে ও স্তুপ করে।
- পিলেট করে ব্যাগে সংরক্ষণ করা যায়।
- কেটে চৌকোনা ব্লক করে সংরক্ষণ করা যায়।
- এছাড়া বেল বা চৌকোনা ব্লক পলিথিন দিয়ে মুড়ে বাইরে পাকা মেঝেতে রাখা যেতে পারে।
(৩) সাইলেজ তৈরি
ক) সাইলেজ কি? এর পরিচয়
সাইলেজ কাকে বলে: বায়ুনিরোধক স্থানে (সাইলো) সংরক্ষিত ঘাসকে (যেমন- ভুট্টা গাছ) সাইলেজ বলে। সাইলেজ তৈরির প্রক্রিয়াকে অ্যানসাইলেজিং বলে।
আমাদের বাংলাদেশে ভুট্টার সাইলেজ সবচেয়ে বেশি তৈরি করা ও পশুকে খাওয়ানো হয়। সাইলেজ তৈরির জন্য ভুট্টা একটি উৎকৃষ্ট ঘাসও বটে।
সাইলেজ কেন করা হয়: সাধারণত তাজা ও সবুজ ঘাস সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতিটি ব্যবহার হয়।
খ) সাইলো কাকে বলে, কত প্রকার?
সাইলো কাকে বলে: সাইলেজ তৈরির জন্য বায়ুনিরোধক বা মোটামুটিভাবে বায়ু চলাচল করতে পারে না এমন ধরনের ধারককে সাইলো বলে।
সাইলো কত প্রকার: সাইলো তিন প্রকার। যথা-
- ট্রেন্স সাইলো: উঁচু জায়গা বা পাহাড়ের ঢালে মাটি খুঁড়ে ট্রেন্স সাইলো তৈরি করা হয়। এ ধরনের সাইলো মাটির গর্তের তলা থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিক প্রশস্ত হয়। গর্তের দৈর্ঘ্য ঘাসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। গর্তের তলা ও চারপাশ খড়কুটো দিয়ে ঢেকে বা পাকা করেও সাইলেজ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
- বাংকার সাইলো: এ ধরনের সাইলো মাটির উপরে কাঠ বা প্লাষ্টিকের দেয়াল তৈরি করে করা হয়। ট্রেন্স ও বাংকার সাইলোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ট্রেন্স সাইলো মাটির নিচে গর্ত ও বাংকার সাইলো মাটির উপরে তৈরি করা হয়।
- টাওয়ার সাইলো: টাওয়ার সাইলো আয়াতকার করে মাটির উপরে তৈরি করা হয়। এটি বেশ ব্যয়বহুল।
উল্লিখিত তিনটি সােইলো পদ্ধতি ছাড়াও- একদম প্রান্তিক কৃষকেরা বা ছেট খাটো খামারিগণ ড্রাম ও মোটা প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করেও সাইলেজ তৈরি করে থাকেন। অপরদিকে অনেক বড় খামার হলে তারা স্বয়ংক্রিয়ে মেশিন দ্বারা প্লাস্টিং রেপিং করেও সাইলেজ তৈরি ও সংরক্ষণ করে থাকেন।
খ) যে ধরনের ঘাস সাইলেজ করা যায়
- যেসব ঘাসে পরিমাণমতো জলীয় অংশ (৬০-৭০%), সহজপাচ্য শর্করা ও অন্যান্য খাদ্যোপাদান থাকে এবং সহজে গাঁজানো যায় তা সাইলেজ করার জন্য ব্যবহার করা যায়।
- ডালজাতীয় ঘাস, যেমন- কাউপি ও খেসারি সাধারণত হে তৈরি করে সংরক্ষণ করা হয়। এ ধরনের ডাল ও অ-ডালজাতীয় ঘাস, যেমন- ভূট্টা, সরগাম বা খড়ের সঙ্গে স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাইলেজ তৈরি করা যায়।
- সংরক্ষণের জন্য ঘাসের ওজনের ২-৩% চিটাগুড় ব্যবহার করতে হবে।
গ) কীভাবে সাইলেজ তৈরি হয়
সাইলেজ তৈরির মৌলিতত্ব হলো-
- তাজা ও সবুজ ঘাস সুন্দর করে গাঁজানো হয় যাতে ঘাসের ফাঁকে কোনো বাতাস না থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত ভুট্টা গাছকে কুুচকুচ করে কেটে এটিকে সাইলেজ তৈরিরতে ব্যবহার করা হয়।
- যতটুকু বাতাস থাকে তা অক্সিজেন ব্যবহার করে ঘাসের শর্করা থেকে পানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। এই তাপে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শর্করা ভেঙ্গে ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত ল্যাকটিক অ্যাসিড ঘাসের পিএইচ হ্রাস করে ঘাসের পচন বন্ধ করে ও ঘাস সংরক্ষিত হয়। সাইলোর ভিতর কোনভাবে বাতাস প্রবেশ করলে পুনরায় পচন শুরু হয়।
- সাইলেজে গাঁজন প্রক্রিয়া দমন বা দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য অ্যাডিটিভ ব্যবহার করা হয়। ফরমিক বা প্রপিওনিক অ্যাসিড যোগ করে গাঁজন প্রক্রিয়া দমন করে ঘাস সংরক্ষণ করা হয়। অন্যদিকে, চিটাগুড়, শস্য ভাঙ্গা ইত্যাদি ব্যবহার করে গাঁজন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা যায় ও পরিমিত পরিবেশে ঘাস সংরক্ষণ করা যায়।
প্রিয় পাঠক, আজকের এই পোষ্টতে আমার সংক্ষিপ্তভাবে সাইলেজ ও হে তৈরির পদ্ধতির ব্যবহার করে ঘাস সংরক্ষণৈর সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। এই তথ্যগুলি দ্বারা যদি আপনি অজানা কোন বিষয় জানতে পারেন ও তথ্যগুলো আপনাকে কোন ভাবে উপকার পৌছায় তাতেই আমাদের সময় ও শ্রমের সার্থকতা।
আঁশজাতীয় গোখাদ্যকে এদেশে দু’ভাবে সংরক্ষণ করা যায়, যথা- হে ও সাইলেজ তৈরি করে। তাজা ও সবুজ ঘাস রোদে বা কৃত্রিমভাবে শুকিয়ে পুষ্টিমানসহ সংরক্ষণ করাকে হে বলে। আবার বায়ু নিরোধক স্থানে সংরক্ষিত ঘাসকে সাইলেজ বলে। সাইলেজ তৈরির প্রক্রিয়াকে অ্যানসাইলেজিং বলে। সাইলেজ তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের সাইলো ব্যবহার করা হয়।
পরবর্তী সাইলেজ ও হে তৈরি করার পদ্ধতি আলাদা আলাদাভাবে বিস্তারিত আকারে তুলে ধরব, ইংশাআল্লাহ। আজকে পর্যন্ত ‘ইন বাংলা নেট’ এর সাথেই থাকুন।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]