(১) সামাজিক বনায়ন কি?
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বনভূমিতে গাছলাগানো, পরিচর্যা ও সংরক্ষণকে বলা হয় বনায়ন।
বসতবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সড়ক ও বাঁধের ধার, পাহাড়ি অঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সৃজিত বনায়নকে বলা হয় সামাজিক বনায়ন।
(২) সামাজিক বনায়ন এর গুরুত্ব
বাস উপযোগী পরিবেশ তৈরি ও তা সংরক্ষণে বনের ভূমিকা অপরিসীম। কোনো দেশের বা অঞ্চলের বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে বড় বড় বৃক্ষরাজি ও লতা-গুল্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠা বনকেই বনভূমি বলা হয়। এসব বনভূমি কখনো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয় ও গড়ে উঠে। আবার কখনো মানুষ তার প্রয়োজনে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে সৃষ্টি করে থাকে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের মোট আয়তনের তুলনায় বনভূমির পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ হওয়া অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাই সামাজিক বনায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(৩) সামাজিক বনায়ন মডেল বর্ণনা
সামাজিক বন:
উদ্ভিদ বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য মানুষ পরিকল্পনা করে নিজস্ব চেষ্টায় এ বন তৈরি করে। বসতবাড়ি, প্রতিষ্ঠান, বাঁধ ও সড়ক, উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি পতিত জমিতে সামাজিক বন সৃষ্টি করা হয়।
সড়ক ও বাঁধে সামাজিক বনায়ন:
বাংলাদেশে সচরাচর সড়ক ও বাঁধে গাছ রোপণের জন্য একসারি ও দ্বি-সারি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সড়ক বা বাঁধের ঢাল অনুযায়ী সারির সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।
একসারি পদ্ধতি:
রাস্তা সরু হলে এ পদ্ধতিতে অনুসরণ করে গাছ লাগানো হয়। গাছ লাগানোর সময় একই ধরনের দূরত্ব অনুসরণ করা হয়।
দ্বি-সারি পদ্ধতি:
রাস্তা বা বাঁধের ধার চওড়া হলে এ পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয়। গাছ লাগানোর সময় সঠিক নকশা অনুসরণ করা আবশ্যক।
সড়কের ধারে বৃক্ষরোপণ:
বৃক্ষরোপণ কৌশল এখানে গাছ লাগানোর স্থান অপর্যাপ্ত। তাই সরু লাইন করে গাছ লাগানো হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে বনায়নের সময় সাধারণত ২ মিটার x ২ মিটার দূরে দূরে গাছ লাগানো হয়।
গাছ নির্বাচনে বিবেচ্য কৌশলসমূহ:
যেসব গাছের পাতা ছোট ও চিকন সেরকম গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার ধারে বহুস্তরী বনায়ন করা ভালো, অর্থাৎ গাছের নিচে বিরুৎ বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের সংমিশ্রণ দিয়ে বনায়ন করা দরকার। অন্যথায় মাঝারি বা ছোট আকৃতির গাছ নির্বাচন করতে হবে।
গাছ লাগানোর কৌশল:
- যানবাহন ও জনগণের চলাচলের জন্য পাশে যে স্থান থাকে তাতে এক সারি গাছ লাগানো যেতে পারে। স্থানভেদে জমির প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে একাধিক সারি গাছ লাগানো যেতে পারে। যদি দুইসারি লাগানো হয় তবে ১.৫-২.৫ মিটার দূরে দূরে গাছ লাগানো যেতে পারে।
- বাঁধের ধারে ঢালু অংশে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো হয়। তবে এখানে প্রথম সারির একটি গাছ থেকে অন্য গাছের যে দূরত্ব তা ঠিক রেখে দুইটি গাছের মধ্যবর্তী স্থান থেকে দ্বিতীয় লাইন শুরু করা বাঞ্ছনীয়।
- সড়কের নিচের অংশে এক সারিতে গাছ লাগানো হয়। মাটির যে অংশ নিচে তাতে মান্দার, জারুল, হিজল প্রভৃতি গাছ লাগানো হয়।
- প্রথম লাইন যেখান থেকে শুরু হবে, দ্বিতীয় লাইন তার বরাবর না হয়ে মধ্যবর্তী স্থান থেকে শুরু হবে ফলে দুই মিটার দূরে দূরে গাছ লাগানো হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি চারা থেকে অন্য চারার দূরত্ব হবে ২ মিটার x ১ মিটার। এর ফলে মাটিক্ষয় রোধ করার ক্ষমতা বাড়বে। এতে বাঁধ নষ্ট হয় না।
গাছ নির্বাচন:
- বাঁধের দুই পাশে দ্বিবীজপত্রী উঁচু ও বেশি শাখা-প্রশাখা সম্পন্ন গাছ লাগানো উচিত নয়। কারণ বেশি উঁচু গাছ হলে মাটির ক্ষয় বেশি হয়।
- বেশি এলাকাজুড়ে মূল বা শিকড় থাকে এমন গাছ নির্বাচন করা উত্তম। যেমন: নারকেল, সুপারি প্রভৃতি এক-বীজপত্রী গাছ। এদের শিকড় বেশি এলাকা জুড়ে থাকে বলে মাটির ক্ষয় রোধ হয়।
- বাঁধের পাশে গাছ লাগানোর সময় যেসব গাছের পাতা গোখাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়, সেসব গাছ নির্বাচন করা দরকার। কারণ বন্যার সময় এসব বাঁধ গৃহপালিত পশুর আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
(৪) সড়ক ও বাঁধের ধারে বৃক্ষরোপণ পদ্ধতি
ক) সারিবদ্ধ বনায়ন
সড়ক ও বাঁধের ধারে কোথাও এক সারিতে, কোথাও দুই বা তিন সারিতে বনায়ন করা হয়ে থাকে। বৃক্ষরোপণের এ পদ্ধতিকে বলা হয় সারিবদ্ধ বনায়ন। সারিবদ্ধ বনায়ন বা স্ট্রিপ বনায়ন সামাজিক বনায়নের একটি উল্লেখযোগ্য উৎপাদন কৌশল।
সারিবদ্ধ বনায়নে সাধারণত শিশু, আকাশমনি, অর্জুন, মেহগনি, জারুল, শিরীষ, রেইনট্রি, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, নিম প্রভৃতি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। বন বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও বিশ্বস্বাস্থ্য কর্মসূচির সহায়তায় এবং নিজস্ব কর্মসূচির আলোকে সারাদেশে ব্যাপকভাবে সারিবদ্ধ বনায়ন সৃজন করেছে।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সাল থেকে থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সারিবদ্ধ বনায়ন পদ্ধতিতে বাগান সৃজন কর্মসূচি চালু আছে।
খ) সারিবদ্ধ বনায়নের মডেল
সারিবদ্ধ বনায়নের প্রচলিত তিনটি মডেল হলো-
মডেল-১: বড় সড়ক, রেল ও বাঁধ বনায়ন
মডেল-২: সংযোগ সড়ক ও গ্রামীণ রাস্তা বনায়ন
মডেল-৩: মহাসড়ক ও উঁচু রেলপথ বনায়ন
মডেল- ১-এর বর্ণনা-
- সড়ক/বাঁধের কিনারা থেকে ৩০ সে.মি. নিচে অড়হরের সারি থাকবে।
- অড়হরের সারি থেকে ৩০ সে.মি. নিচে গাছের প্রথম সারি যাতে ২ মিটার ব্যবধানে বৃক্ষ রোপণ করা হবে।
- প্রথম সারি হতে ১.৫-২.৫ মিটার দুরে (ঢোলের প্রস্থ অনুসারে) গাছের দ্বিতীয় সারি যাতে ২ মিটার ব্যবধানে গাছ লাগাতে হয়।
- সড়ক/বাধের ঢালের একেবারে নিচের প্রান্তে থাকবে ধৈঞ্চার সারি।
- সড়ক/বাঁধের ঢালের প্রশস্ততা ৩ মিটারের বেশি হলে ১.৫-২.৫ মিটার ব্যবধানে তিন কিংবা ততোধিক সারিতে গাছ লাগানো যেতে পারে।
- চারা লাগানোর আগে ৩০ সে.মি. ৮ ৩০ সে.মি. x ৩০ সে.মি. গর্ত করতে হবে। প্রত্যেক গর্তে ১ কেজি গোবর, ২৫ গ্রাম টিএসপি, ২৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- এ মডেলে ১ কিলোমিটারে সর্বমোট ১৬০০ চারা লাগানো যেতে পারে।
গ) প্রজাতি নির্বাচন
প্রথম সারিতে শোভাবর্ধনকারী, ছায়া ও কাঠ উৎপাদনকারী গাছ লাগানো হয়। যেমন: মেহগনি, রেইনদ্রি, শিশু, সেগুন, আম, কীঠাল, খেজুর, তাল ইত্যাদি।
দ্বিতীয় সারিতে জ্বালানি ও খুঁটি প্রদানকারী দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগানো হয়। যেমন: আকাশমনি, অর্জন, বাবলা, শিশু, ইপিল ইপিল, রেইনট্রি ইত্যাদি।
ঘ) বৃক্ষরোণের পদ্ধতি
- প্রয়োজনীয় উপকরণ কোদাল, খুন্তি, শাবল, ছুরি, গোবর, রাসায়নিক সার ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিতে হবে।
- যে গাছ রোপণ করবে তার সতেজ চারা সংগ্রহ করতে হবে।
- সঠিক নিয়মে প্রয়োজনীয় মাপের গর্ত করতে হবে।
- গর্তের মাটিতে গোবর ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে ভালোভাবে মাটি গুঁড়ো করে ১৫ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
- মাটি আবার গর্তে ভরাট করে রাখতে হবে।
- চারার শিকড়ের সমপরিমাণ গর্ত করতে হবে।
- ছুরি দিয়ে চারাসহ পলিব্যাগের পলিখিন কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে।
- মাটিসহ চারা গর্তে দিয়ে চারপাশের মাটি ভালো করে চেপে দিতে হবে।
- এবার পানি দিতে হবে।
ঙ) সড়ক ও বাঁধের ধারে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা
- মাটিক্ষয় রোধ করে সড়ক ও বাঁধ রক্ষা করা।
- পশুখাদ্য তৈরি করা।
- সড়ক ও বাধসংলগ্ন এলাকা সবুজায়ন করা।
- জাতীয় উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি করা।
- কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- পরিবেশে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের আবাস সৃষ্টি করা।
- এলাকার পরিবেশ ঠান্তা থাকা ও বৃষ্টিপাতের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
- পরিবেশ সংরক্ষণ করা।
(৫) মিশ্র বৃক্ষরোপণ
মিশ্র বৃক্ষ চাষ এক ধরনের বনায়ন ব্যবস্থা। বনায়নের এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকমের বৃক্ষের সমন্বিত চাষ হয়ে থাকে।
মিশ্র বৃক্ষ চাষে একই জমিতে ফলদ, বনজ ও ওঁষধি উদ্ভিদের চাষ করা হয়। কখনো কখনো এসব বৃক্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম ফসলি শস্যের চাষও হয়ে থাকে। অনেক সময় মিশ্র উদ্ভিদের সাথে পশুপাখি ও মৎস্য চাষও করা হয়।
বাড়ির চারদিকে, খেলার মাঠের চারদিকে, বিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি, নদী, খাল ও পুকুরপাড় প্রভৃতি স্থানে মিশ্র উদ্ভিদ চাষ করা সম্ভব।
ক) মিশ্র উদ্ভিদ চাষের এলাকা নির্বাচন
মাঝারি নিচু ও নিচু এলাকা:
যেসব গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে সেসব গাছ নিচু এলাকায় লাগানো যেতে পারে। যেমন: হিজল, রয়না, জারুল, করছ, মান্দার, কড়ই ইত্যাদি উদ্ভিদ নিচু এলাকায় রোপণ করা হয়। হাওর, বিল ও পার্শ্ববর্তী নিচু এলাকায় এসব উদ্ভিদ রোপণ করা হয়।
মাঝারি উঁচু ও উঁচু এলাকা:
এসব এলাকা সব রকম গাছ লাগানোর জন্য উপযোগী। আম, কাঁঠাল, তাল, খেজুর, মেহগনি, শাল, সেগুন, বেল, কদবেল, আমলকী, বহেরা, হরীতকী প্রভৃতি উদ্ভিদের মিশ্র বৃক্ষ চাষ এসব এলাকায় হয়ে থাকে। বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি এলাকায় এসব উদ্ভিদের চাষ হয়ে থাকে। এলাকাভিত্তিক শিমুল, কার্পাস, আনারস, কমলা, কলা প্রভৃতি ফসলি উদ্ভিদ ও মিশ্র বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে চাষ করা হয়।
খ) মিশ্র বৃক্ষ চাষের প্রয়োজনীয়তা
- এলাকাভিত্তিক বৃক্ষরোপণের প্রজাতি নির্বাচন করা যায়।
- এলাকায় বসবাসকারী জনগণের সব রকম চাহিদা মেটানো যায়
- জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়।
- পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের আবাস সৃষ্টি হয় এবং খাদ্যের চাহিদা মেটে।
- পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
- গ্রামীণ জনসাধারণের কাজের ক্ষেত্র বাড়ে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে, ফলে দারিদ্র্য বিমোচন হয়।
- জ্বালানি, পুষ্টি, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজনে এ বন ভূমিকা রাখে।
- পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকে, বৃষ্টিপাত হয়।
- ভূমিক্ষয় ও ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।