আদিমকাল থেকেই বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু। প্রাচীনকালে মানুষের যখন ঘরবাড়ি ছিল না তখন মানুষ গাছেই বাস করত। আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন সেটিও বৃক্ষই যোগান দেয়। মানুষসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষের অবদান অপরিসীম।
প্রতিটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বৃক্ষ বা বনভুমি থাকা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বনায়ন ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে থেকে বনায়ন কর্মসুচী গ্রহণ করে।
(১) সামাজিক বনায়ন কি/কাকে বলে?
সামাজিক বনায়ন কি: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে ‘সামাজিক বনায়ন হলো এমন বন ব্যবস্থাপনা বা কর্মকান্ড যার সাথে পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠি ওতপ্রোতভাবে জড়িত’। এর মাধ্যমে উপকারভোগী জনগণ কাঠ ও জ্বালানি, খাদ্য, পশু খাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকে।
সামাজিক বনায়ন কাকে বলে: গ্রামীণ সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রমকে সামাজিক বনায়ন বলে।
সামাজিক বনায়ন বলতে কি বুঝায়: যে বনায়ন বা বন ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সরাসরি জড়িত থাকে বা অংশগ্রহণ করে অর্থাৎ জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে এবং জনগণ দ্বারা সৃষ্ট বনকে সামাজিক বনায়ন বা বন বলে।
(২) সমাজিক বনায়ন কত প্রকার?
সামাজিক বনায়ন ৪ প্রকারের হতে পারে। যেমন-
- কমিউনিটি বনায়ন
- গ্রামীণ বনায়ন
- অংশীদারিত্ব বনায়ন
- স্বনির্ভর বনায়ন
(৩) সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব
- সামাজিক বনায়নের উৎপাদিত বনজ দ্রব্য: ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত সামাজিক বনায়ন থেকে বিপুল পরিমাণ বনজ দ্রব্য আহরিত হয়। এসব বনজ দ্রব্য বিক্রয় হয়েছে ২৩৭ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭৫৫ টাকা যা দেশের অথনীতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।
- পরিবেশ রক্ষায়: পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে সামাজিক বনায়ন ভূমিকা রাখছে।
- উপকুলীয় বনাঞ্চল: ১৯৬০ সাল থেকে বন বিভাগ সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্জা ও জলোচ্ছাসের ক্ষতি মোকাবেলা করতে উপকুলীয় ১০ জেলার বাঁধের উপর বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১.৫১ লাখ হেক্টর ভূমি উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সমুদ্র গর্ভ থেকে পুনুরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এতে দেশের প্রায় ১% ভূমি বৃদ্ধি পেয়েছে।
- মরুময়তারোধে বনায়ন: দেশের উত্তরা লে মরুময়তা রোধ করার জন্য বনবিভাগ ব্যাপক বনায়ন করেছে। বনায়নের ফলে উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ার যথেষ্ট অনুকুল ও কৃষিবান্ধব হয়েছে যার ফলে এটি দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে।
- শিল্প বনায়ন: চট্ট্রগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্ট্রগ্রামে ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের হস্তক্ষেপে ২৪ হাজার ৪০১ হেক্টর শিল্প বনায়ন হয়েছে। এসব বনায়ন থেকে কম মূল্যে বিভিন্ন মিল কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ করা হচ্ছে।
- ঔষধি বনায়ন: সামাজিক বনায়নের আওতায় বন বিভাগ স্বাস্থ্য সেবা ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে ঔষধি বনায়ন শুরু করেছে যা দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলের ৬ শত একর ভূমি নিয়ে বিস্তৃত।
(৪) সামাজিক বনায়ন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তা হলো-
- প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও মরু প্রক্রিয়া থেকে দেশকে রক্ষা করা।
- ভুমির সুষ্ঠু ও উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা।
- দেশের বিরাজমান গাছ ও জ্বালানি কাঠের ঘাটতি নিরূপণ করা।
- গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাঁচামাল ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- পতিত, অনাবাদী ও প্রান্তিক জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা।
(৫) বাংলাদেশের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র-বিমোচনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সে সাথে সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক বনায়নের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। বন বিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচী বনাঞ্চলের বাইরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের বন বিভাগ ১৯৮১-৮২ সালে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) আর্থিক সহযোগীতায় উত্তরা লের ২৩ টি জেলার জনগণকে অংশীদার করে প্রথম সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
এরপর ১৯৯৫-৯৭ সালে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করে সম্প্রসারিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৯৫- ২০০২ সালে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সরকার ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা প্রবর্তন করে। যা আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় সরকারী বন ভূমিতে বনায়নের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠিীর বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
(৬) বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের সুযোগ
সরকারী বনভূমি ব্যতীত বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচুর সুযোগ রয়েছে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ, অফিস অঙ্গন, রাস্তার ধার, পতিত জমি, কৃষি জমির আইল, সড়কের ধার, নদী ও খালের পাড়, বাঁধের পাড়, জলাশয় ও পুকুরপাড়, মসজিদের অঙ্গন, গোরস্থান, উদ্যান, বসতবাড়ির আশেপাশে, শিল্প এলাকায়, শহরের প্রধান সড়কের পাশে, গো-চারণ ভূমি, বাণিজ্যিক ভূমি, বাণিজ্যিক এলাকা, উপকূলীয় এলাকা।
মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বনায়নের বিকল্প নেই। সেজন্য আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, নতুন নতুন সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে এবং বর্তমান যে বনাঞ্চল রয়েছে সেটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
কোন অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহনে সৃষ্ট বনায়নই সামাজিক বনায়ন। দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সামাজিক বনায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।