Skip to content

 

স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি

স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি

প্রিয় পাঠক বৃন্দ পূর্বে আমরা বিভিন্ন দেশী ফলের চাষ পদ্ধতি নিয়ে অনেক তথ্য আপনাদের সামনে উপন্থাপন করেছি, তারই ধারাবাহিকতায় আজকেও আমরা একটি বিদেশি ফল স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি তুলে ধরব।

স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার জানার আগ্রহ থাকলে আজকেই এই পোষ্টটি আপনার জন্য, আশা করি শেষ অবধি পড়বেন।

চলুন শুরু করা যাক-

(১) স্ট্রবেরি ফল

স্ট্রবেরি ফ্যাগারিয়া (Fragaria) জাতীয় উদ্ভিদ এবং সারা বিশ্বে এটি ফল হিসেবে চাষ করা হয়। গন্ধ, বর্ণ ও স্বাদে আকর্ষণীয় এই ফল, ফলের রস, জ্যাম, আইসক্রিম, মিল্কশেক এবং আরও অনেক খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত শীতপ্রধান দেশের ফল।

প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ২,০০,০০০ হেক্টর জমিতে এর চাষ হয় এবং প্রায় ৩০ লক্ষ টন স্ট্রবেরি উৎপাদিত হয়।

স্বল্প খরচে এর চাষ করা সম্ভব হলেও এটি বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয় বিধায় এর চাষ খুবই লাভজনক।

গুলজাতীয় এ ফল গাছটি খুব ছোট বিধায় টবে বাড়ির ছাদ বা বারান্দায় স্ট্রবেরি উৎপাদন সম্ভব হয়।

চিত্র- স্ট্রবেরি
চিত্র- স্ট্রবেরি

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভাবে স্ট্রবেরির চাষ শুরু হয়েছে। টিস্যুকালচার পদ্ধতির সোমাক্লোনালভেরিয়েশন প্যুক্তির মাধ্যমে ৩টি জাত, রাবি-১, রাবি-২, রাবি-৩ তৈরি হয়েছে। এছাড়া বারি স্ট্রবেরি-১ উদ্ভাবিত হয়েছে।

বাংলাদেশে স্ট্রবেরির ফলন বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) ১৫০০ কেজি (১.৫ টন)। প্রতি বিঘায় ৫০০০টি গাছ রোপণ করতে হয়। কেজি প্রতি ৩০০ টাকা দরে বিক্রয় করলে বিঘাপ্রতি প্রায় ৪ লক্ষ টাকা নিট লাভ করা যায়।

(২) স্ট্রবেরির উপকারিতা

স্ট্রবেরি খেলে নিচের সারণিতে উল্লিখিত ভিটামিন ও মিনারেল পুষ্টিসমূহ পাওয়া যায়-

পুষ্টি উপাদানপরিমাণ
পানি৯.৯৭ গ্রাম
খাদ্যশক্তি৩০ কি.ক্যালরি
আমিষ০.৬১ গ্রাম
চর্বি০.৩৭ গ্রাম
শর্করা৭.০১ গ্রাম
অশোধিত আঁশ২.২৯ গ্রাম
ক্যালশিয়াম১৩.৮৯ মি.গ্রা.
লৌহ০.৩৮ মি.গ্রা.
ম্যাগনেসিয়াম৯.৭২ মি.গ্রা.
ফসফরাস১৮.৭৫ মি.গ্রা.
পটাশিয়াম১৬৭ মি.গ্রা.
ভিটামিন সি৫৭ মি.গ্রা.
নিয়াসিন০.২৩ মি.গ্রা.
ভিটামিন এ২৭ আ.এ.

সূত্র: ইউএসডিএ নিউট্রিয়েন্ট ডাটাবেজ

See also  ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ

(৩) স্ট্রবেরির চাষযোগ্য জাতসমূহ

  • বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক অবমুক্তারিত জাত বারি স্ট্রবেরি-১,
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রচলিত জাতসমূহ রাবি-১, রাবি-২ এবং রাবি-৩ এবং,
  • মর্ডান হর্টিকালচার সেন্টার, নাটোর কর্তৃক প্রচলিত জাতসমূহ মর্ডান স্ট্রবেরি-১, মর্ডান স্ট্রবেরি-২, মর্ডান স্ট্রবেরি-৩, মর্ডান স্ট্রবেরি-৪ (Camarosa), মর্ডান স্ট্রবেরি-৫ আমাদের বাংলাদেশে চাষযোগ্য জাত।

(৪) বারি স্ট্রবেরি-১ স্ট্রবেরি গাছ এর বৈশিষ্ট্য

বারি স্ট্রবেরি-১ বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী অবমুক্তায়িত একটি উচ্চফলনশীল জাত।

  • জাতটি পর্যাপ্ত সরলতা (Runner) ও চারা উৎপাদন করে বিধায় এর বংশবিস্তার সহজ।
  • সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রোপণ করা হলে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
  • গাছের গড় উচ্চতা ৩০ সে.মি. এবং বিস্তার ৪৫-৫০ সে.মি.।
  • হৃৎপিণ্ডাকৃতির ফল ক্ষুদ্র থেকে মধ্যম আকারের, যার গড় ওজন (১৪ গ্রাম)।
  • পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল বর্ণের।
  • ফলের ত্বক নরম ও ঈষৎ খসখসে।
  • ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য।
  • স্ট্রবেরির বৈশিষ্ট্য পূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি (টিএসএস ১২%)।
  • গাছপ্রতি গড়ে ৩২টি ফল হয়, যার মোট গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন।

(৫) স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি

ক) মাটি ও আবহাওয়া

  • স্ট্রবেরি মূলত মৃদু শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল। গ্রীষ্মায়িত জাত কিছুটা উচ্চ তাপসহিষ্ণু। দিন ও রাতে যথাক্রমে ২০-২৬ ডিগ্রি সে. ও ১২-১৬ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা গ্রীষ্মায়িত জাতসমূহের জন্য প্রয়োজন।
  • ফুল ও ফল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া আবশ্যক। দেশের আবহাওয়ায় রবি মৌসুম স্ট্রবেরি চাষের উপযোগী।
  • বৃষ্টির পানি জমে না এধরনের সুনিষ্কাশিত উর্বর দো-আঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটি স্ট্রবেরি চাষের জন্য উত্তম।

খ) স্ট্রবেরি বীজ বপন পদ্ধতি/চারা উৎপাদন

  • স্ট্রবেরি বীজ থেকে নয় বরং স্ট্রবেরি রানারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে ভুলে জৈব পদার্থসমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে।
  • পূর্ববর্তী বছরের গাছ হতে উৎপন্ন রানারের পর্ব সন্ধির নিচ থেকে যখন মূল বের হবে, তখন রানারটি মাতৃগাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভালোভাবে মিশানো গোবর মাটি (১১) দিয়ে ভরা পলিথিন ব্যাগে (৪” x ৩”) লাগাতে হবে এবং তা হালকা ছায়াযুক্ত নার্সারিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টি হতে রক্ষার জন্য বর্ষা মৌসুমে চারার উপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে।
  • রানারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। তাই ফলন ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তিন বছর পরপর টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারার রানার থেকে বংশবিস্তার করা উত্তম।
See also  স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি, গাছের পরিচর্যা ও রোগ দমন

গ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ

  • স্ট্রবেরি উৎপাদনের জন্য কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে এবং আগাছা, বিশেষ করে বহুবর্ষজীবী আপাছা অপসারণ করে উত্তমরূপে জমি তৈরি করতে হবে।
  • চারা রোপণের জন্য বেড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এজন্য ১ মিটার প্রশস্ত এবং ১৫-২০ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুইটি বেডের মাঝে ৫০ সে.মি. নালা রাখতে হবে। প্রতি বেডে ৫০ সে.মি. দূরত্বে দুই সারিতে ৫০ সে.মি. দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
  • বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাস (সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) স্ট্রবেরির চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।

ঘ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চ ফলন পেতে হলে  স্ট্রবেরির জমিতে নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। ছকে বিভিন্ন সারের হেক্টরপ্রতি পরিমাণ দেখানো হলো।

সারের নামপরিমাণ
পচা গোবর৩০ টন/হেক্টর
ইউরিয়া২৫০ কেজি/হেক্টর
টিএসপি২০০ কেজি/হেক্টর
এমপিও২২০ কেজি/হেক্টর
জিপসাম১৫০ কেজি/হেক্টর
জিংক সালফেট২.৫ কেজি/হেক্টর

শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও অর্ধেক পরিমাণ এমওপি সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১৫-২০ দিন পরপর ৪-৫ কিন্তুি উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

ঙ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন

স্ট্রবেরি চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে পর্যাপ্ত পানি সেচ দিতে হবে। স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

চ) স্ট্রবেরি গাছের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা

  • সরাসরি মাটির সংস্পর্শে এলে স্ট্রবেরির ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরির বেড খড় বা কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
  • খড়ে যাতে উইপোকার আক্রমণ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
  • জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
  • গাছের গোড়া হতে নিয়মিতভাবে রানার বের হয়, যা ফল উৎপাদনের অন্তরায়। এজন্য উক্ত রানারসমূহ নিয়মিত কেটে ফেলতে হবে। রানার কেটে না ফেললে গাছের ফুল ও ফল উৎপাদন বিলম্বিত হয় এবং হ্রাস পায়।
See also  ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ

ছ) রোগবালাই ও প্রতিকার

পাতায় দাগপড়া রোগ: কোনো কোনো সময়, বিশেষত কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় পাতায় বাদামি রং-এর দাগ পরিলক্ষিত হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে ফলন এবং ফলের গুণগত মান হ্রাস পায়।

ফল পচা রোগ: এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

ভারটিসিলিয়ামউইন্ট: এ রোগে আক্রান্ত গাছ হঠাৎ করে দুর্বল ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং মারা যায়। সাধারণত জলাবদ্ধ জমিতে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়।

প্রতিকার-

জমি শুষ্ক রাখতে হবে। পলিথিন ব্যবহার করলে তা তুলে ফেলতে হবে। অনুমোদিত কীটনাশক ছত্রাকনাশক সনির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

পাখি:

বিশেষ করে বুলবুলি ও শালিক স্ট্রবেরি ফলের সবচেয়ে বড় শত্রু। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়।

প্রতিকার-

ফুল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দ্বারা ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল খেতে না পারে।

জ) মাতৃগাছ রক্ষণাবেক্ষণ

  • স্ট্রবেরির গাছ প্রখর সৌরতাপ এবং ভারী বর্ষণ সহ্য করতে পারে না। এ জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ফল আহরণের পর মাতৃগাছ তুলে টবে রোপণ করে ছায়ায় রাখতে হবে।
  • ফল আহরণ শেষ হওয়ার পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃগাছকে খরতাপ ও ভারী বর্ষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে।
  • মাতৃগাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

(৬) স্ট্রবেরি কোন মাসে পাওয়া যায়?

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে (সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে) রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্ৰহ পৌষ মাসে আরম্ভ হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত (ডিসেম্বর থেকে মার্চ) চলে।

ফল পেকে লাল বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করতে হয়। স্ট্রবেরির সংরক্ষণকাল খুবই কম বিধায় ফল সংগ্রহের পরপর তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page