Skip to content

 

হরমোন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষের পদ্ধতি

হরমোন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষের পদ্ধতি

লাউ Cucurbitaceae গোত্রভুক্ত বাংলাদেশের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় সবজি। উৎপাদনের পরিমাণে কুমড়া পরিবারের সবজিসমুহের মধ্যে লাউয়ের স্থান দ্বিতীয়।

শীতকালে এ সবজির চাষাবাদ বেশী হলেও বর্তমানে গ্রীষ্মকালেও এর উৎপাদন যথেষ্ট। গ্রীষ্মকালীন লাউ এর জাত উদ্ভাবনের কারনে এ মৌসুমে লাউয়ের উৎপাদন বেড়েছে।

বারি লাউ-৪ একটি জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন জাত।

মানবপুষ্টি ও স্বাস্থের উপকারী দিক থেকে লাউয়ের জুড়ি নেই।

  • সবজিটিতে পানির পরিমাণ ৯২-৯৬%, সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলষ্টেরলের পরিমাণ খুবই কম, খাবারউপযোগী আঁশের পরিমাণ বেশি।
  • এতে ভিটামিন সি, রিবোফ্লাবিন, থায়ামিন, জিংক, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ যথেষ্ট পরিমানে আছে।
  • আশ সমৃদ্ধতার কারনে সবজিটি নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটের গুড়গুড়ভাব দূর হয়।
  • সবজিটিতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও অন্যান্য অপরিহার্য খনিজ থাকার কারনে এটি খাবার ফলে মানুষের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে।
  • লাউয়ের ক্যালরি মান খুব কম বিধায় ইহা শিশুদের, যাদের হজমশক্তি কম এবং যারা এইমাত্র অসুস্থতা থেকে সেরে উঠেছেন তাদের জন্য একটি উত্তম সবজি।
  • ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও ইহা অন্যতম একটি ভাল সবজি।

নিম্নে লাউ উদ্ভিদের বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক পদার্থ (plant growth regulators) বা গ্রোথ হরমোন (plant growth hormones) ব্যবহার করে চাষের পদ্ধতি সম্মন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

(১) গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষে হরমোন প্রয়োগের কারণ

উদ্ভিদ শারীরতাত্বিক প্রক্রিয়া পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রনে উদ্ভিদ বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্যাদির (Plant Growth Regulators) ভূমিকা সর্বজন বিদিত।

সাধারণত গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে লাউয়ের ফলন বেশি হয়। গ্রীষ্মকালের লম্বা দিবা দৈর্ঘ্য ও প্রখর আলো লাউয়ের পুরুষ ফুলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়, পরিণতিতে স্ত্রী ফুলের সংখ্যা কমে যায়। স্ত্রী ফুলের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে ফলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলশ্রুতিতে হেক্টরপ্রতি ফলন কমে য়ায়।

See also  চালকুমড়া চাষ পদ্ধতি

বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্য ব্যাবহার করলে পুরুষ ফুলের সংখ্যা কমে যায় এবং স্ত্রী ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব ব্যাবহারে শীতকালের মত অনুকুল আাহাওয়া লাউয়ের জন্য সৃষ্টি হয়।

এই কারণে হরমোন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষ করা হয়ে থাকে।

(২) হরমোন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন লাউ চাষের পদ্ধতি

ক) উৎপাদন মৌসুম

গ্রীষ্মে বীজ বপনের সময় ফেব্রুয়ারী-মার্চ। সবচেয়ে উপযোগী সময় হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ।

খ) জমি তৈরি ও বীজ বপন

  1. প্রথমে জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে।
  2. তারপর নির্দিষ্ট দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে, মাদা ১৫ সে.মি. উঁচু হওয়া বাঞ্ছনীয়।
  3. পাশাপামি দুটো মাদার মধ্যে ২ মিটার দূরত্ব রাখতে হবে।
  4. বপনের পূর্বে বীজ ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অঙকুরোদগম তরান্বিত হয়।
  5. বীজ সরাসরি মাদায় বপন করা যায়। প্রতি মাদায় ৫-৬ টি বীজ লাগাতে হয়। পরে মাদা প্রতি ২ টি চারা রেখে দিতে হয়।
  6. আবার বীজ পলিব্যাগে অথবা প্লাস্টিক পটে তৈরি করে নেয়া যায়। ২-৩ পাতা বিশিষ্ট চারা (১৬-১৮ দিন) মাঠে প্রতি মাদায় ২ টি করে লাগাতে হয়।

গ) বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্য, তার মাত্রা ও প্রয়োগ

  • ম্যালেয়িক হাইড্রাজাইড (MH) ও সাইকোসেল (CCC) গ্রীষ্মকালীন লাউয়ের ফলন বৃদ্ধির জন্য খুবই কার্যকরী বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্য।
  • MH ৫০-১৫০ ppm এবং CCC ৩০০-৫০০ ppm এর যে কোনো একটি নিদিষ্ট মাত্রায় নিদিষ্ট বয়সের চারায় স্প্রে করতে হবে।
  • লাউয়ের চারা ১৬-১৮ দিন পরে ২ পাতা বিশিষ্ট হলে ম্যালেয়িক হাইড্রাজাইড বা সাইকোসেল প্রয়োগ করতে হবে।
  • পরে চার থেকে ছয় দিন পরে একই হরে ঐ বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব চারার পাতায় প্রয়োগ করতে হবে।
  • চারায় পাতার সংখ্যা ৪ টার বেশী হলে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যায় না।
হরমোন ব্যবহারের উপযোগী চারা; দুই পাতা বিশিষ্ট (১৬ দিন বয়স্ক) লাউয়ের চারা
হরমোন ব্যবহারের উপযোগী চারা; দুই পাতা বিশিষ্ট (১৬ দিন বয়স্ক) লাউয়ের চারা
হরমোন ব্যবহারের উপযোগী চারা; তিন পাতা বিশিষ্ট (২০ দিন বয়স্ক) লাউয়ের চারা
হরমোন ব্যবহারের উপযোগী চারা; তিন পাতা বিশিষ্ট (২০ দিন বয়স্ক) লাউয়ের চারা

ঘ) সারের পরিমান ও প্রয়োগ পদ্ধতি

সারের নামপরিমান (প্রতি হেক্টর)
গোবর/কম্পোস্ট১০ টন
ইউরিয়া১৭৫ কেজি
ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি)১৫০ কেজি
মিউরিয়েট অব পটাশ (এমপি)১৭৫ কেজি
জিপসাম১১০ কেজি
জিংকসালফেট১২ কেজি
বোরিক এসিড১০ কেজি

প্রয়োগ পদ্ধতি:

  • অর্ধেক গোবর/কম্পোস্ট এবং জিপসাম, জিংকসালফেট ও বোরিক এসিড এর সবটুকু এবং টিএসপি ও এমপি এ দুটি সার ৩০ কেজি/হেক্টর হারে জমি চাষ দেয়ার সময় মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • বাকি অর্ধেক গোবরের সবটুকু এবং টিএসপি ও এমপি এ দুটি সার ১৫ কেজি/হেক্টর হারে মাদায় প্রয়োগ করতে হবে।
  • বাকি টিএসপি ও এমপি চারা গজানোর ৫ সপ্তাহ পর অথবা চারা লাগানোর ২০ দিন পর থেকে সমান ৪-৫ কিস্তিতে ২০ দিন পর পর মাদা (চারা)’র চারপাশে মাটির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
See also  মিষ্টি কুমড়া চাষ পদ্ধতি

ঙ) অন্যান্য পরিচর্যা

  1. সেচ ও বাউনী দেয়া লাউয়ের প্রধান পরিচর্যা।
  2. ফসলটির পানির চাহিদা বেশি হওয়ায় গ্রীষ্ম মৌসুমে মাটির প্রয়োজন অনুসারে ৭-১০ দিন পর পর প্লাবন সেচ দিতে হবে। মৌসুমে ১০-১২ বার সেচের প্রয়োজন হতে পারে।
  3. বাধাহীনভাবে বাইতে না পারলে লাউয়ের গাছে ফলনশীলতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। তাই লাউয়ে বাউনী দেয়া প্রয়োজন। বাঁশ ও কঞ্চির সাহায্যে অথবা অন্য উপায়েও বাউনী দেয়া যেতে পারে।
বাউনিতে ফলন্ত লাউ (বারি লাউ-৪) গাছ (বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয়েছে)
বাউনিতে ফলন্ত লাউ (বারি লাউ-৪) গাছ (বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয়েছে)

চ) পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন

রেড পামকিন বীটল ও এপিলাকনা বীটল:

লাউ গাছ চারা অবস্থায় রেড পামকিন বীটল ও এপিলাকনা বীটল দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ পোকাদ্বয় দমনের জন্য সেভিন ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

পাউডারি মিল্ডিউ:

লাউ গাছ পাউডারি মিল্ডিউ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে থিওভিট ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।

লাউয়ে গামোসিস (গামি স্টেম ব্লাইট):

  • আজকাল লাউয়ে গামোসিস (গামি স্টেম ব্লাইট) রোগ দেখা যাচ্ছে। এ রোগটি Didymella bryoniae প্যাথোজেন দ্বারা হয়।
  • এ রোগে আক্রান্ত হলে লাউয়ের গোড়ার দিকে কান্ড ফেটে যায় এবং কান্ড থেকে কষ ঝরে। এ রোগ দমনের জন্য বোর্দোপেস্ট (১ ভাগ তুঁতে, ১ ভাগ চুন ও পরিমান মত পানি দিয়ে তৈরি) আক্রান্ত স্থানে তুলার সাহায্যে কান্ড পেচিয়ে দিতে হবে অথবা ব্রাসের সাহায্যে বোর্দোপেস্ট অক্রান্ত স্থানে ভালভাবে লাগিয়ে দিতে হবে।
  • গাছের শাখা-প্রশা এবং পাতাও এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

প্যাথোজেন ফাইটোফথোরা:

  • Didymella bryoniae এর সাথে অন্যান্য প্যাথোজেন ফাইটোফথোরা (Phytophthora) ও আক্রমন করে থাকে।
  • সবগুলো প্যাথোজেন মিলে রোগের একটি জটিল অবস্থা তৈরি করে। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হলে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
  • এ রোগ দমনের জন্য প্রথমে সিকিউর (২%) আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে। এক দিন পরে রিডোমিল গোল্ড (২ %) স্প্রে করতে হবে। সাত দিন পরে আবার একইভাবে সিকিউর (২%) ও রিডোমিল গোল্ড (২ %) স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
See also  চালকুমড়া চাষ পদ্ধতি

ছ) ফলনের ওপর বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্যের প্রভাব

বারি লাউ-৪ এর উৎপাদিত ফল
বারি লাউ-৪ এর উৎপাদিত ফল
  • বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্য (গ্রোথ হরমোন) ব্যাবহার করলে পুরুষ ফুলের সংখ্যা কমে যায় এবং স্ত্রী ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং লাউয়ের ফলন বাড়ে।
  • গ্রীষ্মকালে প্রতি লাউ গাছে ৬-৭ টির বেশি ফল ধরে না। কিন্তু বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্য সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে প্রতি লাউ গাছ থেকে ১২-১৪ টি ফল পাওয়া সম্ভব। এতে ফলন প্রায় ৪৫-৫০% বৃদ্ধি পায়।

জ) খরচ ও নিট মুনাফা

২০২৩ সালের হিসাব মতে, প্রতি হেক্টরে প্রায় ২.৫ লক্ষ টাকা খরচ করে নিট মুনাফা প্রায় ৮ লক্ষ টাকা অর্জন করা যায়। হেক্টর প্রতি বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক দ্রব্যের জন্য খরচ হয় ২০০০.০০- ২৫০০.০ টাকা। প্রতি শতাংশে ১০০০.০০ টাকা খরচ করে ৩০০০.০০ টাকা আয় করা সম্ভব।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page