(১) হাইব্রিড টমেটোর জাত পরিচিতি
ক) বারি হাইব্রিড টমেটো-৪ (গ্রীষ্মকালীন)
- গ্রীষ্মকালীন এ সংকর (হাইব্রিড) জাতের ফল আকারে মাঝারী গোল ও আকষর্ণীয় লাল রঙের।
- ফলের গড় ওজন ৫০ গ্রাম। গাছপ্রতি গড়ে ৩০টি ফল ধরে এবং গাছপ্রতি ফলন প্রায় ১.৫ কেজি।
- গ্রীষ্ম মৌসুমে ফল উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তবে হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ফল ধারণ প্রায় দ্বিগুণ করা যায় এবং ফলনও অনেক বৃদ্ধি পায়।
- চারা লাগানোর ৬০ দিন পর ফল পাকতে শুরু করে এবং ২০-২৫ দিন ধরে ফল সংগ্রহ করা যায়।
- ঘরের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ক্ষমতাও ভাল।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে সারা বছর এই জাতটি চাষ করা যায়। তবে গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের জন্যই এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন ছাউনিতে এর চাষ করা হয়।
- জ্যৈষ্ঠ-ভাদ্র মাস পর্যন্ত যে কোন সময় এ জাতের বীজ বপন করা যায়।
- জীবনকাল প্রায় ৯০ দিন (চারা লাগানোর পর)।
- ফলন ৪০ টন/হেক্টর।
খ) বারি হাইব্রিড টমেটো-৫
- শীতকালীন হাইব্রিড জাত। বড় চ্যাপ্টা গোলাকৃতির আকর্ষণীয় লাল বর্ণের ফল
- প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৫-৪০ টি ফল ধরে। প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৯৫-১০০ গ্রাম। গাছপ্রতি ফলন গড়ে ৩.৫-৪.০ কেজি।
- চারা রোপণের ৮০-৯০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে এবং প্রায় ১ মাসব্যাপী ফল সংগ্রহ করা যায়।
- অধিক সংরক্ষণ গুণসম্পন্ন।
- ব্যাক্টোরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ এবং পাতা হলুদ পাতা কোকড়ানো ভাইরাস রোগের প্রতি সহনশীল।
গ) বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ (গ্রীষ্মকালীন)
- উচ্চ তাপমাত্রায় ফুল ও ফল ধারণে সক্ষম। আকর্ষণীয় লাল বর্ণ বিশিষ্ট ত্বক এবং শাস। ফল বেশ মাংসল।
- প্রতিটি গাছে গড়ে ৪০-৪৫টি ফল ধরে। প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৬০-৬৫ গ্রাম।
- ফলের আকৃতি চ্যাপ্টা গোলাকার (flattened round) ধরনের।
- ফলন ৩৫-৪০ টন/হেক্টর।
ঘ) বারি হাইব্রিড টমেটো-৯
- উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন জাত। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংগ্রহযোগ্য (৪৫-৫৫ দিন)।
- ৪৭-৫০ দিনে প্রথম ফুল আসে, ফল মাঝারী আকারের গোলাকার, লাল রঙের, টিএসএস ৪.০২%, যুক্ত পাঁচ প্রকোষ্ট (locule) বিশিষ্ট মাংসল ফল যার ১০০% ভক্ষণযোগ্য।
- ফলের গড় ওজন ৯০-৯৫ গ্রাম। প্রতি গাছে ৫০-৫৪ টি ফল ধরে। ফল গোলাকার এবং ফলে বীজের সংখ্যা কম।
- এ জাতটি টমেটো হলুদ পাতা মোড়ানো ভাইরাস রোগ সহনশীল।
ঙ) বারি হাইব্রিড টমেটো-১০
বারি হাইব্রিড টমেটো-১০ জাতটি উচ্চ তাপ সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন হাইব্রিড জাত। জাতটি ২০১৭ সালে চাষাবাদের জন্য মুক্তায়িত হয়।
- গাছে আকর্ষণীয় লাল রঙের মাঝারী আকারের ফল ধরে। গাছ প্রতি গড়ে ফলের সংখ্যা ২৪-২৮টি। প্রতি ফলের ওজন প্রায় ৬৮-৭১ গ্রাম।
- গ্রীষ্ম মৌসুমে ফল উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না তবে হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ফল ধারণ এবং আকার কিছুটা বাড়ে।
- ভালভাবে চাষাবাদের ব্যবস্থা করলে বীজবপনের ৮০-৯০ দিন পর ফসল তোলা যায়। ফসল তোলার উপযোগী হওয়ার পর প্রায় ৩৫-৪০ দিন পর্যন্ত টমেটো আহরণ করা যায়।
- জীবনকাল ১১০-১২০ দিন।
- জাতটি ভাইরাস জনিত রোগ প্রতিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগের প্রতি সহনশীল।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ফলন গ্রীষ্মকালে হেক্টর প্রতি প্রায় ৪৮-৫১ টন হয়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে সারা বছর এই জাত টি চাষ করা যায় তবে গ্রীষ্ম বর্ষা কালের জন্যই এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে পলিথিনের ছাউনিতে চাষ করতে হয় এবং বর্ষা মৌসুমে মূল্য বেশি থাকে বলে এ জাতের টমেটো চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
চ) বারি হাইব্রিড টমেটো-১১
গ্রীষ্মকালীন এই হাইব্রিড জাতটি চাষাবাদের জন্য বারি হাইব্রিড টমেটো-১১ হিসেবে ২০১৮ সালে অবমুক্ত করা হয়।
- টমেটোর এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং উচ্চ তাপ সহ্য করতে পারে। গাছে আকর্ষণীয় লাল রঙের মাঝারী আকারের অবলং (Oblong) ফল ধরে।
- প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফল ধরে। প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৭৫-৮০ গ্রাম।
- গ্রীষ্ম মৌসুমে ফল উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না তবে হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ফলের ধারণ এবং আকার কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
- সাধারণত বীজ বপনের ৯০-৯৫ দিন পর থেকে টমেটো পাকতে শুরু করে এবং ফসল তোলা যায়। এ জাতের টমেটো মাসাধিক কাল ধরে সংগ্রহ করা যায়
- জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন।
- জাতটি টমেটোর দাগ যুক্ত ঢলে পড়া (TSWV), টমেটোর হলুদ পাতা কুঁকড়ানো ভাইরাস (TYLCV) এবং ঢলে পড়া জনিত রোগের প্রতি সহনশীল।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ফলন গ্রীষ্মকালে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৪৮-৫০ টন হয়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলে সারা বছর এই জাতটি চাষ করা যায় তবে গ্রীষ্ম বর্ষা কালের জন্যই এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। গ্রীষ্মবর্ষা মৌসুমে পলিথিনের ছাউনিতে চাষ করতে হয় এবং বর্ষা মৌসুমে মূল্য বেশি থাকে বলে এ জাতের টমেটো চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
(২) হাইব্রিড টমেটো চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
- টমেটো এ দেশে শীতকালীন ফসল তবে কিছু কিছু জাত গ্রীষ্মকালেও চাষ করা যায়।
- উচ্চ তাপমাত্রা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় টমেটোর ফুল ঝরে পড়ে। টমেটোর ভাল ফলনের জন্য তাপমাত্রা ২০-২৫০ সে. উত্তম।
- সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
- বারি হাইব্রিড টমেটো-৫, বারি হাইব্রিড টমেটো-৯ শীতকালে এবং বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, বারি হাইব্রিড টমেটে-৮, বারি হাইব্রিড টমেটো-১০ ও বারি হাইব্রিড টমেটো-১১ বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে চাষ উপযোগী।
খ) বীজ বপনের সময়
শীতকালে অক্টোবর-নভেম্বর (আশ্বিন-কার্তিক) এবং গ্রীষ্মকালে এপ্রিল-জুন (বৈশাখন্ডআষাঢ়) মাস।
গ) জমি তৈরি
- টমেটোর ভাল ফলন অনেকাংশে জমি তৈরির ওপর নির্ভর করে। তাই ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
- মাটির প্রকৃতি ও স্থান এবং রোপণকাল ভেদে ২০-৩০ সেমি চওড়া নালা রাখতে হবে। এত অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতজনিত পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে এবং প্রয়োজনে সেচ দেয়ার সুবিধা হয়।
- কম বৃষ্টিপাত এলাকায় বা বর্ষার আগে ও শীতের আগে খোলা মাঠে চাষের ক্ষেত্রে এইভাবে জমি তৈরি করতে হবে।
ঘ) পলিথিন ছাউনি
- ভরা বর্ষা মৌসুমে লাগানো চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পরবর্তী সময় ভাল ফলনের নিশ্চয়তার জন্য বেডে বা মিড়িতে নৌকার ছইয়ের আকৃতি করে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ছাউনি দিতে হবে।
- ২৩০ সেমি চওড়া (মাঝে ৩০ সেমি নালাসহ) দুটি মিড়িতে লম্বালম্বিভাবে ১টি করে ছাউনির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ছাউনির উচ্চতা হবে দুপাশে ৪.৫ ফুট বা ১৩৫ সেমি ও মাঝখানে ৬ ফুট বা ১৮০ সেমি দু’টি ছাউনির মাঝে অন্তত ৫০ সেমি চওড়া নালা রাখতে হবে যাতে করে ছাউনি থেকে নির্গত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনসহ বিভিন্ন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- পলিথিন ছাউনি লম্বায় জমির আকার আকৃতির ওপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে কিন্তু চওড়া (বাজারে প্রাপ্ত পলিথিনের সর্বোচ্চ চওড়া অনুযায়ী) ২.৩ মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। ছাউনি ২০ মিটার লম্বা হলে প্রতি হেক্টরে এ ধরনের প্রায় ১৭০টি ছাউনি প্রয়োজন হতে পারে।
ঙ) বীজ শোধন
কেজিপ্রতি ২ গ্রাম ভিটাভেক্স/অটোস্টিন দিয়ে টমেটোর বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে বীজবাহিত রোগ হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
চ) চারা উৎপাদন
- সুস্থ ও সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে ৯-১০ গ্রাম পরিপক্ক ও রোগমুক্ত বীজ ঘন করে ৩ মি.দ্ধ ১মি. আকারের বীজতলায় বুনতে হবে। এই হিসেবে প্রতি হেক্টরে ২০০ গ্রাম (১ গ্রাম প্রতি শতাংশ) বীজ বুনতে হয়।
- গজানোর ৮-১০ দিন পর চারা দ্বিতীয় বীজতলায় ৪ × ৪ সেমি দূরত্বে স্থানান্তর করতে হবে।
- এক হেক্টর জমিতে টমেটো চাষের জন্য এইরূপ ২২টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।
ছ) সারের প্রয়োগের নিয়ম পরিমাণ (কেজি/শতাংশ)
ভাল ফলন পাওয়ার জন্য জমিতে সুষম সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সারের মাত্রা জমির ঊর্বরতার ওপর নির্ভরশীল।
মধ্যম ঊর্বর জমিতে প্রতি শতাংশে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা হয়-
সার | মোট পরিমাণ (কেজি/শতাংশ) | শেষ চাষের সময় দেয় | ১ম কিস্তি | উপরি প্রয়োগ ২য় কিস্তি | ৩য় কিস্তি |
গোবর বা কম্পোস্ট | ২০ | ২০ | – | – | – |
ইউরিয়া | ০.৭৯ | – | ০.২৭ | ০.২৭ | ০.২৭ |
টিএসপি | ০.৭৩ | ০.৭৩ | – | – | – |
এমওপি | ০.৩৭ | ০.১৯ | – | ০.১০ | ০.১০ |
জিপসাম | ০.৩৮ | ০.৩৮ | – | – | – |
জিংক সালফেট | ০.০৫ | ০.০৫ | – | – | – |
বরিক এসিড | ০.০৩ | ০.০৩ | – | – | – |
- শেষ চাষের সময় সবটুকু গোবর/কম্পোস্ট, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমপি সার জমিতে ভালভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বাকি অর্ধেক এমপি সার দুই কিস্তেতে চারা লাগানোর ২৫ দিন ও ৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে চারা লাগানোর ১০, ২৫ ও ৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগকৃত ইউরিয়া এবং এমপি সার গাছের গোড়ায় ১০-১৫ সেমি দূরে মাটির সঙ্গে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঝ) চারা রোপণ
- চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে বীজতলা থেকে উঠিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
- এক মিটার চওড়া বেডে দুই সারি করে চারা লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪০ সেমি।
- বীজতলা থেকে চারা অত্যন্ত যত্ন সহকারে তুলতে হবে যেন চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
- বিকেলের পড়ন্ত রোদে চারা রোপণ করাই উত্তম। লাগানোর পর গোড়ায় হালকা সেচ প্রদান করতে হবে।
ঞ) সেচ ও নিষ্কাশন
- চারা রোপণের পর ৩-৪ দিন পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরবর্তী সময় প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়।
- টমেটো গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সেচ অথবা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য ৩০-৪০ সেমি চওড়া নালা এবং এক দিকে সামান্য ঢালু হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ট) নিড়ানী দেয়া
প্রতিটি সেচের পরে মাটির উপরিভাগের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।
ঠ) আগাছা দমন
টমেটোর জমিকে প্রয়োজনীয় নিড়ানী দিয়ে আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
ড) বিশেষ পরিচর্যা
১ম পুষ্পমঞ্জুরীর ঠিক নিচের কুশিটি ছাড়া নিচের সব পার্শ্বকুশি ছাঁটাই করতে হবে। গাছে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দিতে হবে।
ঠ) ফল সংগ্রহ
ফলের নিচের ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। এরূপ ফল সংগ্রহ করলে অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]