Skip to content

 

মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

(১) বাংলাদেশের মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সকল জলভাগ থেকে বর্তমানে যে মৎস্য উৎপাদন হয় তা এদের আয়তনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ থেকে আরও অনেক বেশি উৎপাদন সম্ভব।

দিন দিন অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় যেমন-নদী, খাল, বিল, হাওর প্লাবনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে ও পাচ্ছে। সেখানে কমে যাচ্ছে মাছের জীববৈচিত্র্যও। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন।

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনাবৃষ্টি বা অপর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও সংখ্যা। এ সমস্ত কারণে মাছ চাষ, মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বিচরণ ব্যাহত হচ্ছে।

নিচে মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আলোচনা করা হলো-

ক) মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

  • বাংলাদেশে মৌসুমি পুকুরগুলোতে এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টির পানি জমলে চাষিরা মাছ ছাড়ে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। অথবা বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হচ্ছে। এতে করে পোনা ছাড়তে দেরি হচ্ছে। আবার দেরিতে পোনা ছাড়ার পর পুকুর শুকিয়েও যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। ফলে চাষের সময় কমে যাচ্ছে এবং মাছ বড় হওয়ার আগেই ছোট মাছ বাজারজাত করতে হচ্ছে। এতে করে চাষিরা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।
  • জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কম বৃষ্টিপাতের ফলে হ্যাচারিতে মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রজননের অনুকূল পরিবেশ না পাওয়া ও তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে হ্যাচারিতে মাছ কৃত্রিম প্রজননে সাড়া দিচ্ছে না। পেটে ডিম আসলেও ডিম ছাড়ছে না। ডিম শরীরে শোষিত হয়ে যাচ্ছে। আবার মাছ ডিম ছাড়লেও তা নিষিক্ত হচ্ছে না বা কম হচ্ছে। আবার নিষিক্ত হওয়া ডিম ফোটার হারও কম হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন এভাবে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন ব্যাহত করছে।
  • স্বল্প গভীর পুকুরে অধিক তাপমাত্রায় মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে ও চাষিদের আয় কমে যাচ্ছে।
  • কম বৃষ্টির কারণে চাষের পুকুরে কম পানি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পুকুরে বা খামারে পানি সরবরাহে চাষিকে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা এবং সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য সেক্টরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে চাষিদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পুকুর থেকে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে।
  • সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের চাষের পুকুরগুলো ডুবে যেতে পারে।
See also  বিরূপ আবহাওয়া কাকে বলে? প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়ায় ফসল ও পশুপাখি রক্ষার কৌশল

খ) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে প্রভাব

  • কম বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে কম পানি হচ্ছে ফলে অল্প পানিতে সহজেই মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে। এতে করে ছোট-বড়, প্রজননক্ষম সব মাছ ধরা পড়ছে। ফলে নদীতে মাছের জীববৈচিত্র্য ও স্থায়ী উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
  • তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে ফলে লবণাক্ততা ঢুকে পড়ছে মূল ভূ-খণ্ডের দিকে। এতে করে উপকূলীয় এলাকার স্বাদুপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। সেই সাথে কমে যাচ্ছে উৎপাদনও।
  • আমাদের বাংলাদেশে দেশে বিল, বাঁওড়, প্লাবন ভূমিতে এপ্রিল-মে মাস হচ্ছে দেশীয় জাতের ছোট মাছের প্রজননকাল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বা কম হওয়ার কারণে জুলাই মাস পর্যন্তও এসব জলাশয়ে পানি হচ্ছে না। ফলে এসব মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে সমগ্র মৎস্য উৎপাদনে এবং যারা মাছ আহরণ করে তাদের পুষ্টি ও জীবীকার ক্ষেত্রে।
  • বাংলাদেশে একমাত্র হালদা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরমের পর ভারী বৃষ্টি শুরু হলে এরা ডিম ছাড়ে। তখন নদী থেকে জেলেরা নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে এবং এই ডিম ফুটিয়ে পোনা উৎপাদন করে। জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে ব্রুডমাছের ডিমের পরিপক্বতা এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সময় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে করে মাছের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার সাথে বৃষ্টিপাতের সময়ের অমিল হচ্ছে। ফলে ডিম পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে।

গ) সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

  • বায়ুমণ্ডলে দিন দিন কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে ফলে বেড়ে যাচ্ছে বাতাসের ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। ফলে বাতাসের গতি প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, বৃষ্টির ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। এতে করে সাগরে মাছের বিচরণ ও উৎপাদশীলতায় প্রভাব পড়ছে। ফলে সমুদ্রের কোনো অংশে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার মাছের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র বলে খ্যাত কিছু এলাকা মাছশূন্য হয়ে যেতে পারে।
  • বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মাছ উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের সাগরের দিকে সরে যাচ্ছে। অনেক মাছ তার অভিপ্রায়ন (migration) পথ, প্রজননক্ষেত্র এবং বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন করে ফেলছে। ফলে জেলেরা সুদূর অতীত থেকে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সমুদ্রের যে সব সামুদ্রিক এলাকায় মাছ আহরণ করতে যেত সেগুলোর পরিবর্তন হলে জেলেরা বিপাকে পড়বে।
  • কোরাল রীফ বা প্রবাল সামুদ্রিক মাছের উৎকৃষ্ট আবাসস্থল, যেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছ বাস করে এবং প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করে। পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঢেউয়ের তারতম্য, সমুদ্রের অম্লত্ব বৃদ্ধি, দূষণ, স্রোতের গতি পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রবাল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র তথা মৎস্য বৈচিত্র্যের উপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
See also  ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

(২) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মৎস্য ক্ষেত্রে অভিযোজন কলাকৌশল

জলবায়ু পরিবর্তন মৎস্য জীববৈচিত্র্য ও উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা কাটিয়ে উঠা জরুরি। অন্যথায় একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে অন্যদিকে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের এই নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠার জন্য পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ-খাইয়ে চলার উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত অভিযোজন কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যথা-

  1. জলবায়ু পরিবর্তনে যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে তাই লবণাক্ততা সহনশীল মাছের চাষ এবং পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন-ভেটকী, বাটা, পারশে ইত্যাদি।
  2. লবণাক্ততা বেড়ে চলছে এমন জলাশয়ে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করা যেতে পারে।
  3. খরা প্রবণ এলাকা যেখানে বৃষ্টিপাত কম হয় সেখানে স্বল্প সময়ের পানিতে বড় পোনা চাষ করা যায়। এজন্য এলাকায় বড় পোনা মজুদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তেলাপিয়া বেশ খরা সহনশীল একটি মাছ। খরা অঞ্চলে কই ও দেশি মাগুরের চাষও করা যেতে পারে।
  4. বন্যাপ্রবণ বা অধিক বৃষ্টিযুক্ত এলাকায় পুকুরের পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে বা নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে যেন বন্যার পানি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে বা পুকুর ভেসে মাছ বেরিয়ে যেতে না পারে।
  5. বন্যাপ্রবণ এলাকায় পুকুরের পাড় উঁচু করে সমাজভিত্তিক মৎস্য পোনা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যায়। ঐ এলাকায় যে সময়ে বন্যা হয় না সে সময়ে ঐ পোনা পুকুরে মজুদ করা যায়।
  6. বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যার সময়টাতে খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে।
  7. উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি ও জনদুর্ভোগের এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত মাছ চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ ও কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে সে পানিকে কাজে লাগানো যায়।
  8. দিন দিন পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা সহনশীল মাছ চাষ ও এদের পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যেমন- মাগুর, রুই, শিং।
  9. তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে পুকুরের পানি গরম হয়ে গেলে পুকুরে কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের ফ্রেম তৈরি করে তাতে টোপাপানা রাখা যেতে পারে। এতে করে মাছ গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এর নিচে অবস্থান নিতে পারবে। একই উদ্দেশ্যে পুকুরের পাড়ে পানির উপর কিছু লতানো উদ্ভিদ জন্মানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে কিছু পানি সেচ দেওয়া যেতে পারে।
  10. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক মৎস্য বিচরণ এলাকা পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে তা যেন জেলেদের মৎস্য আহরণে ও জীবিকা নির্বাহে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে এ লক্ষ্যে নতুন বিচরণ এলাকাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। এ জন্য আধুনিক গবেষণা ও জরিপ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
See also  আবহাওয়া কাকে বলে? জলবায়ু কাকে বলে? বাংলাদেশের জলবায়ু কেমন? বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর উপাদান সমূহ ব্যাখ্যা

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page