(১) ধানের জাতসমূহ
ক) স্থানীয় ধানের জাত
- টেপি
- গিরবি
- দুধসর
- লতিশাইল
খ) স্থানীয় উন্নতজাতের ধান
- কটকতারা
- কালিজিরা
- হাসিকলমি
- নাইজারশাইল
- লতিশাইল
- বিনাশাইল
গ) উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান
বাংলাদেশে অনেক জমিতে উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ধানের চাষ করা হয়ে থাকে। উফশী ধানের জাতগুলোর সাধারণ কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন-
- গাছ মজবুত এবং পাতা খাড়া।
- শীষের ধান পেকে গেলেও গাছ সবুজ থাকে।
- গাছ খাটো ও হেলে পড়ে না।
- খড়ের চেয়ে ধানের উৎপাদন বেশি।
- পোকা ও রোগের আক্রমণ কম হয়।
- অধিক কুশি গজায়।
- সার গ্রহণক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি।
উফশী ধানে যখন প্রয়োজনীয় বিশেষ গুণাগুণ, যেমন- রোগবালাই সহনশীলতা, স্বল্প জীবনকাল, চিকন চাল, খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ইত্যাদি সংযোজিত হয়, তখন তাকে আধুনিক ধান বলে।
তাই সকল উফশী ধান আধুনিক নয়, কিন্তু সকল আধুনিক ধানে উফশী গুণ বিদ্যমান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এ পর্যন্ত ধানের উফশী ৭৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে।
ধানের মৌসুম তিনটি। যথা- আউশ, আমন ও বোরো।
ব্রি ধানের কতকগুলো অনুমোদিত জাত আছে যেগুলো আউশ ও বোরো দুই মৌসুমেই চাষ করা যায়। যেমন- বিআর ১ (চান্দিনা), বি আর ২(মালা), বিআর ৯(সুফলা), বিআর ১৪ (গাজী)।
আবার বিআর ৩ (বিপ্লব) জাত সকল মৌসুমে চাষ করা যায়।
ঘ) আউশ মৌসুমের ধানের জাত
- শুধু আউশ মৌসুমেই চাষ করা হয় এরূপ জাত হলো ৮টি।
- এদের মধ্যে কয়টি বিআর ২০ (নিজামী), বিআর ২১ (নিয়ামত) ইত্যাদি।
- এ জাতগুলো আউশ মৌসুমে বপন ও রোপণ দুইভাবেই আবাদ করা যায়।
- এ মৌসুমে বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫-৩০ শে চৈত্র এবং চারা রোপণের জন্য চারার বয়স হবে ২০-২৫ দিন।
গ) আমন মৌসুমের ধানের জাত
- শুধু আমন মৌসুমেই চাষ করা হয় এরূপ জাত হলো ২৭টি।
- এদের কয়েকটি হলো বিআর ৫ (দুলাভোগ), বিআর ১১ (মুক্তা), বিআর ২২ (কিরণ), ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৫৭ ও ব্রি ধান ৬২ ইত্যাদি।
- সবগুলো জাতই রোপণ পদ্ধতিতে চাষ করা হয় এবং রোপণের জন্য চারার বয়স হতে হবে ২৫-৩০ দিন।
চ) বোরো মৌসুমের ধানের জাত
- শুধু বোরো মৌসুমেই চাষ করা যায় এরূপ জাত হলো ১৬টি।
- এদের কয়েকটি হলো বিআর ১৮(শাহজালাল), ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ২৯, ব্রি ধান ৪৫, ব্রি ধান ৫০ (বাংলামতি), ব্রি হাইব্রিড ধান ১, ব্রি হাইব্রিড ধান ২ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান ৩ ইত্যাদি।
- রোপণের জন্য চারার বয়স হতে হবে ৩৫-৪৫ দিন।
(এ ছাড়া ধান ফসলের আরও কিছু জাত আছে। যেমন: বৃষ্টিবহুল, খরা সহিষ্ণু, লবণাক্ততা-সহিষ্ণু, হাওর, ঠাণ্ডা-সহিষ্ণু জাত ইত্যাদি।)
(২) ধান চাষের পদ্ধতি
ক) ধান চাষের জন্য জমি নির্বাচন
বাংলাদেশে দানাজাতীয় ফসলের মধ্যে ধানের চাষ ও উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। কারণ মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হলো ভাত।
ধানের ফলন সব জমিতে ভালো হয় না। মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন বেশি ভালো হয়।
মাঝারি উঁচু জমিতেও ধান চাষ করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়।
এঁটেল ও পলি দোআঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।
খ) ধান বীজ বাছাই
কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ বীজ গজায় এরূপ পরিষ্কার, সুস্থ ও পুষ্ট বীজ বীজতলায় বপনের জন্য বাছাই করতে হবে।
নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে বীজ বাছাই করা হয়-
- প্রথমে দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে প্রাপ্ত দ্রবণে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দিলে পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও হালকা বীজগুলো পানির উপর ভেসে উঠবে।
- হাত বা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে নিলেই পানির নিচ থেকে ভালো বীজ পাওয়া যাবে।
- এ বীজগুলো পুনরায় পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ধুয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ইউরিয়া মেশানো পানি বীজতলায় সার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
গ) বীজ শোধন ও জাগ দেওয়া
- বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (হাতে সহনীয়) তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয়।
- এছাড়া প্রতি কেজি ধান বীজ ৩০ গ্রাম কার্বক্সিন (১৭.৫%) + থিরাম (১৭.৫%) দ্বারাও শোধন করা যায়।
- শোধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২-৩ স্তর শুকনো খড় বিছিয়ে তার উপর বীজের ব্যাগ রেখে পুনরায় ২-৩ স্তর শুকনো খড় দিয়ে বা কচুপাতা দিয়ে ঢেকে ভালোভাবে চেপে তার উপর কোনো ভারী জিনিস দিয়ে চাপ দিয়ে রাখতে হবে।
- এভাবে জাগ দিলে আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা বা দুই দিনে, বোরো মৌসুমে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনে ভালো বীজের অঙ্কুর বের হবে এবং সেগুলো বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।
ঘ) ধানের চারা তৈরির জন্য বীজতলা তৈরি
ধানের চারা তৈরির জন্য সাধারণত চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা হয়। যথা-
- শুকনো বীজতলা
- ভেজা বীজতলা
- ভাসমান বীজতলা
- দাপোগ বীজতলা
উঁচু ও দোআঁশ মাটিসম্পন্ন জমিতে শুকনো বীজতলা এবং নিচু ও এঁটেল মাটি সম্পন্ন জমিতে ভেজা বীজতলা তৈরি করা হয়। আর বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান ও দাপোগ বীজতলা তৈরি করা হয়।
প্রচুর আলো বাতাস থাকে এবং বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়।
এখানে শুকনো ও ভেজা বীজতলা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
শুকনো বীজতলা:
- বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। জমিতে ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরা ও সমান করতে হবে।
- মাটিতে অবশ্যই রস থাকতে হবে প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। এর আগে জমি থেকে আগাছা বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে।
- জমি যদি অনুর্বর হয় জমিতে জৈব সার দিতে হবে। বীজতলায় রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম।
- এক শতক জমিতে দুই খণ্ডের বীজতলা তৈরি করা যায়। প্রতিটি বীজতলার আকার ১০ মিটার x ৪ মিটার জায়গার মধ্যে নালা বাদ দিয়ে ৯.৫ মিটার x ১.৫ মিটার হবে।
- বীজ তলার চারদিকে ২৫ সেমি জায়গা বাদ দিতে হবে এবং দুই খণ্ডের মাঝখানে ৫০ সেমি জায়গা নালার জন্য রাখতে হবে।
- বীজতলায় বীজ বোনার আগে বীজ জাগ দিতে হবে। বিভিন্ন জাতের ধানের অঙ্কুর বের হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়কাল দরকার। যেমন- আউশের জন্য ২৪ ঘণ্টা, আমনের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে।
- এক শতক বীজতলার জন্য ৩ কেজি পরিমাণ বীজ উল্লিখিত নিয়মে জাগ দিয়ে অঙ্কুরিত করতে হবে। এরূপ অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় বুনতে হবে।
- চারার পরিচর্যা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝের জায়গা থেকে মাটি উঠিয়ে দুই বেড়ে সমানভাবে উঠিয়ে দিতে হবে। এতে বেডগুলো উঁচু হয়।
- এরপর প্রতি বর্গমিটার বেডে ৬০-৮০ গ্রাম বীজ বেডের উপর সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বেডের উপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে সমান করতে হবে। দুই বেডের মাঝে সৃষ্ট নালা সেচ, নিষ্কাশন ও সার বা ঔষধ প্রয়োগের জন্য খুবই দরকার হয়।
ভেজা বীজতলা:
- এক্ষেত্রে জমিতে পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দেওয়ার পর ৬-৭ দিন ফেলে রাখতে হয়। এতে জমির আগাছা, খড়কুটা ইত্যাদি পচে গিয়ে সারে পরিণত হয়।
- এরপর জমি আরও ২-৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হয়।
- ভেজা বীজতলায় বীজ বাড়িতে গজিয়ে বোনা ভালো। এক্ষেত্রেও বীজতলার মাপ শুকনো বীজতলার মতোই।
ঙ) ধানের বীজতলার পরিচর্যা
- পাখি যাতে বীজতলার বীজ খেতে না পারে সেজন্য বপনের সময় থেকে ৪-৫ দিন পর্যন্ত পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
- বেড যাতে শুকিয়ে না যায় সেজন্য দুই বেডের মাঝের নালায় পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর নালা থেকে প্রয়োজনীয় পানি বেডে সেচ দিতে হয়।
- বীজ তলায় আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হয়।
- রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে তা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
- বীজ তলার চারাগুলো হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া প্রয়োগের পর চারাগুলো সবুজ না হলে গন্ধকের (সালফার) অভাব হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় বীজতলায় চারাগুলো ক্ষতি হতে পারে। তাই রাতে পলিথিন দ্বারা চারাগুলো ঢেকে দিনের বেলায় খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে চারার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
চ) চারা উঠানো
- চারা তোলার পূর্বে বীজতলায় পানি সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নেওয়া উত্তম। এতে বীজতলার মাটি নরম হয়। ফলে চারা তুলতে সুবিধা হয়।
- ধানের চারা পোকায় আক্রান্ত থাকলে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
- চারার গোড়া বা কাণ্ড যাতে না ভাঙে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- চারা তোলার পর তা ছোট ছোট আঁটি আকারে বেঁধে নিতে হয়।
ছ) চারা বহন ও সংরক্ষণ
সরাসরি রোপণের ক্ষেত্রে-
- বীজতলা থেকে রোপণের জন্য চারা বহন করার সময় পাতা ও কাণ্ড মোড়ানো যাবে না।
- ঝুড়ি বা টুকরিতে সারি করে সাজিয়ে পরিবহন করতে হয়।
- বস্তাবন্দী করে কখনো ধানের চারা বহন করা যাবে না।
- চারা সরাসরি রোপণ সম্ভব না হলে চারার আঁটি ছায়ার মধ্যে ছিপছিপে পানিতে রেখে সংরক্ষণ করতে হবে।
জ) ধানের জমি তৈরি
৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে কাদাময় ও সমান করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোদাল দিয়ে জমির চারদিক ছেঁটে দিতে হবে।
ঝ) ধান চাষে সার ব্যবস্থাপনা
- ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই জমিতে সার দিতে হবে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত মাটি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
- গোবর বা আবর্জনা পচা জাতীয় জৈব সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- ইউরিয়া ব্যতীত সকল রাসায়নিক সার যেমন- টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা প্রভৃতি জমিতে শেষ চাষ দেওয়ার আগে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- চারা রোপণ করার পর ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ চারার গোছায় ৪-৫টি কুশি আসা অবস্থায় এবং শেষ কিস্তি ৪৫-৫০ দিন পর অর্থাৎ কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে।
ঝ) সার প্রয়োগের পরিমাণ
শতকপ্রতি ২০ কেজি পচা গোবর সার বা কমপোস্ট দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
নিচে শতক প্রতি জৈব সার, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পরিমাণ দেওয়া হলো।
সারের নাম | পরিমাপ |
পচা গোবর বা কমপোষ্ট | ২০ কেজি |
ইউরিয়া | ৩৬০-৮৪০ গ্রাম |
টিএসপি | ৩০০-৫০০ গ্রাম |
এমওপি | ১৬০-২৮০ গ্রাম |
জিপসাম | ২৪০-২৮০ গ্রাম |
দস্তা | ৪০ গ্রাম |
ট) সার প্রয়োগের সাধারণ নীতিমালা
জাত ও মৌসুম ছাড়া সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। যেমন-
- পাহাড়ের পাদভূমির মাটি ও লাল বেলে মাটিতে এমওপি সার দেড়গুণ দিতে হয়।
- গঙ্গাবাহিত পলিমাটি ও সেচপ্রকল্প এলাকার মাটিতে দস্তা সার বেশি পরিমাণে দিতে হয়।
- হাওর এলাকার মাটিতে প্রত্যেক সার কম পরিমাণে দিতে হবে।
- স্থানীয় জাতের ধানে সারের পরিমাণ অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে।
ঠ) ধানের চারা রোপন
- সমান করা সমতল জমিতে জাত ও মৌসুম ভেদে ২৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপন করা ভালো।
- জমিতে ছিপছপে পানি রেখে দড়ির সাহায্যে সারি করে চারা রোপন করতে হবে।
- এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি এবং এক গোছা থেকে অন্য গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি হওয়া দরকার।
- প্রতি গোছায় ২-৩ টি চারা রোপন করতে হবে।দেরিতে রোপন করলে চারার সংখ্যা বেশি ও ঘন করে রোপন করতে হবে।
ড) সেচ
- জমি সমান হলে মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে এবং ঢালু হলে আইললম্ব মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে পানি সেচ দিতে হয়। বোরো ধান সম্পূর্ণভাবে সেচের উপর নির্ভরশীল।
- জমিতে ৫-৭ সেমি এর নিচে পানি থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়।
- চারা রোপন করার পর ৬-৭ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সেমি সেচ দিতে হবে। এতে আগাছা দমন হয়। এরপর কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২-৩ সেমি এবং চারার বয়স ৫০-৬০ দিন হলে ৭-১০ সেমি পরিমাণ পানি সেচ দেওয়া উত্তম।
- থোড় আসার সময় পানি সেচ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দানা পুষ্ট হতে শুরু করলে আর সেচ দেওয়া প্রয়োজন হয় না।
ঠ) আগাছা দমন
কমপক্ষে তিন বার ধানের জমিতে আগাছা দমন করতে হয়। যেমন-
- চারা রোপন করার ১০-১৫ দিনের মধ্যে।
- প্রথম আগাছা দমনের পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে।
- থোড় বের হওয়ার পূর্বে।
ধানক্ষেতে সাধারণত আরাইল, গইচা, শ্যামা প্রভৃতি আগাছার উপদ্রব হয়। এগুলো সরাসরি হাত/নিড়ানি দ্বারা ও ওষুধ প্রয়োগ করে দমন করতে হবে।
ঞ) ধানের ফলন
আউশের চেয়ে আমনের, আবার আমনের চেয়ে বোরোর ফলন বেশি হয়ে থাকে। উল্লেখ্য স্থানীয় জাতের তুলনায় উফশী জাতের ফলন বেশি হয়ে থাকে। উফশী জাতের ধানের হেক্টরপ্রতি ফলন ৫-৬ টন এবং শতক (৪০ বর্গমিটার) প্রতি ২০-২৪ কেজি।
ত) ধান কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
- শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদা পোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে।
- শীষের উপরের দিকে শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং নিচের অংশের ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে।
- কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা দরকার।
- কাঁচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে।
- মাড়াইয়ের পর ধান ৩-৪ দিন পূর্ণ রোদে শুকাতে হবে। এবার ভালোভাবে কুলাদিয়ে ঝেড়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
- যে পাত্রে ধান রাখা হবে তা পরিপূর্ণ করে রাখতে হবে।
- সংরক্ষণের সময় নিম/নিশিন্দা/বিষকাটালীর পাতা (গুঁড়া) মিশিয়ে দিলে পোকার আক্রমণ হয় না। তারপর পাত্রের মুখ শক্ত করে বন্ধ করতে হবে যেন ভিতরে বাতাস না ঢুকে।
(৩) ধানে পোকার সমস্যা ও সমাধান
ধানক্ষেতে অনেক পোকার উপদ্রব হয়। এদের আক্রমনে ধানের ফলন অনেক কমে যায়।
সাধারণত ধান ফসলে মাছরা পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, গল মাছি, শীষকাটা লেদা পোকা প্রভৃতি দেখা যায়।
নিম্নলিখিত তালিকায় পোকার আক্রমণের লক্ষণসমূহ অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহার করে পোকা দমন করা যায়।
ক) পোকা ও আক্রমনের লক্ষণসমূহ
পোকার নাম | আক্রমনের লক্ষণসমূহ |
মাজরা পোকা | ধান গাছের মাঝডগা ও শীষের ক্ষতি করে, কুশি অবস্থায় আক্রমণ করলে মাঝ ডগা সাদা হয়ে যায়, ফুল আসার পর আক্রমণ করলে ধানের শীষে সাদা চিটা হয়, সব ঋতুতেই কমবেশি আক্রমণ করে। |
পামরি পোকা | পামরি পোকার কীড়া পাতার ভিতরে ছিদ্র করে সবুজ অংশ খায়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা পাতার সবুজ অংশ খুঁড়ে খুঁড়ে খায় বলে পাতা সাদা হয়ে যায়। |
গল মাছি | গল মাছির কীড়া ধানগাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পিঁয়াজ পাতার মতো হয়ে যায়। কুশিতে শীষ হয় না। |
গান্ধি পোকা | গান্ধি পোকা ধানের দানায় দুধ সৃষ্টির সময় আক্রমণ করে। বয়স্ক পোকার গা থেকে গন্ধ বের হয়। |
বাদামি গাছ ফড়িং | ধানের গোড়ায় বসে রস চুষে খায়। গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যায়, একে হপার বার্ন বলে। |
খ) পোকা ও কীটনাশকের নাম
পোকার নাম | কীটনাশকের নাম |
গান্ধি পোকা, পামরি পোকা, মাজরা পোকা, গলমাছি, ছাতরা পোকা, চুঙ্গী পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, পাতা শোষক পোকা | ক্লোরোপাইরিফস ৫০ বা ম্যালাথিয়ন ৫৭ বা ফেনিট্রথিয়ন ৫৭ বা ডায়াজিনন ৬০ |
বাদামি গাছ ফড়িং | কার্বোফুরান ৩ জি/ ১০জি বা ডায়াজিনন ১৪ |
শীষকাটা লেদা পোকা | ভেপোনা ১০০ |
(৪) ধানের রোগের কারণ, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
ধান গাছের অনেক রোগ হয়। ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি জীবাণু রোগের কারণ।
ক) ব্লাস্ট রোগ
কারণ:
ছত্রাক।
লক্ষণসমূহ
- পাতায় ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে।
- দাগের চারদিকে গাঢ় বাদামি এবং মাঝের অংশ সাদা ছাই বর্ণের হয়
- অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে গিয়ে সম্পূর্ণ পাতা মরে যায়।
দমনপদ্ধতি:
- নীরোগ বীজ ব্যবহার করা।
- পটাশ জাতীয় সার উপরি প্রয়োগ করা।
- বীজ শোধন করে বোনা।
- জমিতে পানি ধরে রাখা।
- জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করা।
- রোগ প্রতিরোধ জাত বিআর৩, বিআর ১৪, বিআর ১৫, বিআর ১৬, বিআর ২৪, ব্রি ধান ২৮ রোপণ করা।
খ) টুংরো রোগ
কারণ:
ভাইরাস
লক্ষণসমূহ:
- চারা রোপণের এক মাসের মধ্যে টুংরো রোগ দেখা দিতে পারে।
- আক্রমণের প্রথমে পাতার রংহালকা সবুজ, পরে আস্তে আস্তে হলদে হয়ে যায়।
- গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে।
- কুশি হয় না।
- প্রথমে দুই-একটি গোছায় এ রোগটি দেখা যায়, পরে ধীরে ধীরে আশেপাশের গোছায় ছড়িয়ে পড়ে।
দমনপদ্ধতি:
- পাতা ফড়িং এ রোগ ছাড়ায়, তাই পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধীজাত যেমন- চান্দিনা, দুলাভোগ, ব্রি শাইল, গাজী, বিআর ১৬, বিআর ২২, ব্রি ধান ৩৭, ব্রি ধান ৩৯, ব্রি ধান ৪১, ব্রি ধান ৪২ চাষ করা।
- আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতা ফড়িং মেরে ফেলা।
- রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা
- ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি স্প্রে করা।
(এছাড়া ধান ফসলে পাতা পোড়া রোগ, উফরা রোগ, খোল পোড়া রোগ, বাকানি রোগ, বাদামি দাগ রোগ, খোলপচা রোগ, স্মার্ট প্রভৃতি রোগ দেখা যায়।)
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।