বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি নদ-নদীর পলিবাহিত উর্বর সমতল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাট জন্মে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, বার্মা, মিশর ও ব্রাজিল প্রভৃতি দেশেও পাট জন্মে। পাটের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে পাটশিল্প গড়ে উঠেছে।
(১) পাট চাষ করার পদ্ধতি
ক) জমি নির্বাচন
- উর্বর দোআঁশ মাটি পাট চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে বেলে ও এঁটেল মাটি ছাড়া সব জমিতেই পাট চাষ করা যায়।
- যে জমিতে বর্ষার শেষের দিকে পলি পড়ে সে জমি পাট চাষের জন্য উত্তম।
- তোষা পাট উঁচু জমিতে এবং দেশি পাট উঁচু ও নিচু দুই ধরনের জমিতেই চাষ করা যায়।
খ) চাষ উপযোগী পাটের জাতসমূহ
প্রত্যেকটি ফসলের এমন অনেক জাত আছে যেগুলোর মধ্যে ফলনশীলতা, পরিবেশগত উপযোগিতা, পোকা ও রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, দৈহিক বৈশিষ্ট্য (আকার, আকৃতি ও বর্ণ), পুষ্টিমান, খাদ্যগুণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি গুণাবলি বিদ্যমান।
তবে একই জাতে সব বৈশিষ্ট্যের সর্বোৎকৃষ্ট সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হয় না।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (BJRI) ১৭টি দেশি, ১৬টি তোষা বা বগী পাট, ২টি কেনাফ এবং ১টি মেস্তা জাতের পাট উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করেছে।
দেশি পাটের জাতসমূহ:
সিভিএল -১ (সবুজপাট), সিভিই-৩ (আশু পাট), সি সি-৪৫ (জো পাট), ডি – ১৫৪, এটম পাট -৩৮ ইত্যাদি দেশি পাটের জাত।
তোষা বা বগী পাটের জাতসমূহ:
ও-৪, ও- ৯৮৯৭ (ফাল্গুনি তোষা), সিজি (চিন সুরা গ্রিন) ইত্যাদি তোষা বা বগী পাটের জাত।
কেনাফ জাতসমূহ:
এইচ সি – ২ (জলি কেনাফ), এইচ সি – ৯৫।
মেস্তাজাত:
এইচ এস – ২৪ (টানী মেস্তা)।
গ) জমিচাষ
- ফাল্গুন-চৈত্র মাসে দুইএক পশলা বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে পাটের জমি চাষ করতে হয়।
- রবি ফসল তোলার পর পরই জমি চাষ করা উচিত।
- ৫-৬টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটির ঢেলা ভেঙে সমান করতে হবে।
- পাটের বীজ ছোট বলে মাটির দলা ভেঙে মিহি করতে হবে এবং আগাছা থাকলে বা পূর্ববর্তী ফসলের শিকড় উঠিয়ে ফেলতে হবে, নতুবা বীজ আশানুরূপ গজাবে না।
ঘ) সার প্রয়োগ
- পাটের জমিতে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে পাটের ফলন সহজেই বৃদ্ধি করা যায়।
- পাটের জমিতে সঠিক নিয়মে জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার পরিমাণে কম লাগবে। তবে মাটিতে দস্তা ও গন্ধকের অভাব অনুভূত না হলে জিপসাম ও জিঙ্ক সালফেট ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
- বীজ বপনের ৬-৭ সপ্তাহ পর সার প্রয়োগ করা আবশ্যিক।
- জমি নিড়ানি দিয়ে আগাছা মুক্ত করে ও-৯৮৯৭ জাত বাদে অন্যান্য জাতের বেলায় শতক প্রতি ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ও-৯৮৯৭ জাতের বেলায় শতক প্রতি ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া কিছু পরিমাণ শুকনো মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে ‘হো’ বা নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- দ্বিতীয়বার ইউরিয়া সার দেওয়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন গাছের কচি পাতা ও ডগায় প্রয়োগকৃত সার না লাগে। সার প্রয়োগের সময় মাটিতে যেন পর্যাপ্ত রস থাকে।
ঙ) বীজ শোধন
বীজ বপন করার আগে শোধন করে নেওয়া উত্তম। প্রতি কেজি পাট বীজের সাথে রিডোমিল বা ক্যাপটান ৭৫% বালাইনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করে নেওয়া উচিত।
চ) বীজ বপনের সময়
সঠিক সময়ে পাটের বীজ না বুনলে গাছে অসময়ে ফুল আসে এবং ফলন কম হয়, পাটের গুণগত মানও কমে যায়। পাট জাতভেদে ১৫ই ফেব্রুয়ারি হতে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোনা হয়।
ছ) বীজ বপন পদ্ধতি ও বীজ হার
- জমিতে পাট বীজ সারিতে ও ছিটিয়ে এ দুই উপায়ে বপন করা যায়। সারিতে বীজ বপন করলে বীজের পরিমাণ কম লাগে।
- এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৭-১০ সেমি আবার ছিটানো পদ্ধতিতে বুনলে বীজ বেশি লাগবে।
- বীজ যেন মাটির খুব গভীরে বোনা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে “জো” আসলে বীজ বুনতে হবে।
জ) চারা পাতলা করণ ও আগাছা দমন
- চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর ঘন চারা থেকে দুর্বল চারাগুলো উঠিয়ে এবং সাথে সাথে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- দ্বিতীয় বার ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে এবং শেষবার ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ঝ) সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা
পাটের জমিতে খরা দেখা দিলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে এবং জমিতে পানি জমে থাকলে তাকে নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঞ) ফলন
জাত ভেদে ফল নের তারতম্য হয়। তোষা পাটের তুলনায় দেশি পাটের ফলন সামান্য বেশি হয়।
ট) পাট-কাটা ও আঁটি বাঁধা
- সঠিক সময়ে পাট না কাটলে পাটের গুপ ও ফলন উভয়ই কমে যায়। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দেশি পাট এবং শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তোষা পাট কাটতে হয়।
- গাছে ফুল আসলে বুঝতে হবে পাট কাটার সময় হয়েছে। তাই পাট গাছ কাটার পরই এ সমস্ত গাছকে আলাদা করে প্রায় ১০ কেজি ওজনের আঁটি বাঁধা হয়।
- আঁটি বাঁধার পর সেগুলোকে ৩-৪ দিন জমিতেই স্তূপ করে রাখলে পাছের পাতাগুলো ঝরে যাবে। পাতাগুলো জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। পাটের পাতা ভালো সার।
ঠ) পাট জাগ দেওয়া
- প্রথমে ১০-১৫ টি আঁটি একদিকে পোড়া রেখে তারপর উল্টা দিকে গোড়া রেখে আরও আঁটি পানির উপর সাজাতে হবে একেই পাটের জাগ বলে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে জাগের উপর ৩০ সেমি ও নিচে ৫০ সেমি পানি থাকে।
- প্রতি ১০০টি আঁটির উপরে ১ কেজি ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে পাট তাড়াতাড়ি পচে ও পাটের আঁশের রং ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার জন্য বিল, খাল বা নদীর মৃদু স্রোতযুক্ত পরিষ্কার পানি সর্বাপেক্ষা উত্তম।
- জাগ ডুবানোর জন্য মাটির ঢেলা, কলাগাছ, আমগাছ ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এতে আঁ পাট পচনের সময় নির্ধারণ পাট গাছের আঁটি পানিতে ডুবানোর ১০-১১ দিন পর থেকেই পাটের পচন পরীক্ষা করতে হবে।
- বাঁশের খুঁটির সাথে রশি দিয়ে বেঁধে, কিংবা পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে জাগ ডুবানো যায়। জাগ ঢাকার জন্য কচুরিপানা, ধানের খড় ব্যবহার করা যেতে পারে।
- সাধারণত জাগ থেকে ৪-৫ টি পাট গাছ টেনে বের করে যদি সহজে ছাল তথা আঁশ পৃথক করা যায় তবে বুঝতে হবে পাট গাছের পচন শেষ হয়েছে। গরম আবহাওয়ায় ১২-১৪ দিন এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ২০-২৫ দিনের মধ্যেই পাট পচে যায়।
আঁশ ছাড়ানো ও পরিষ্কারকরণপচার পর গাছ থেকে দুইভাবে আঁশ ছাড়ানো যায়। যথা-
- পানি থেকে প্রতিটি আঁটি উঠিয়ে এবং শুকনো জায়গায় বসে প্রতিটি গাছ থেকে আলাদাভাবে আঁশ ছাড়িয়ে নেওয়ার পর কতকগুলো পাট গাছের আঁশ একত্রে করে ধুয়ে নেওয়া হয়।
- হাটু বা কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে পাটের আঁটির গোড়ায় কাঠ বা বাঁশের মুগুর দ্বারা পিটানো হয়। পরে গোড়ার অংশ হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে পানির উপর সমান্তরালভাবে সামনে পিছনে ঠেলা দিলেই অগ্রভাগের পাটকাঠি বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে আঁশগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে আঁটি বেঁধে রাখা হয়। আঁশ শুকানো ও সংরক্ষণ বাঁশের আড় তৈরি করে তাতে প্রখর সূর্যালোকে পাটের আঁশ শুকানো হয়। আঁশ কম শুকালে ভিজা থাকে বিধায় পচন ক্রিয়া শুরু হয়। এতে আঁশের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সঠিকভাবে পাটের আঁশ শুকিয়ে নেওয়ার পর সুন্দর করে আঁটি বেঁধে গুদামে সংরক্ষণ করতে হয়।
(২) পাট চাষে পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
পাট ক্ষেতে বিছা পোকা, উরচুঙ্গা, চেলে পোকা, ঘোড়া পোকা, মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হয়ে থাকে। নিচে কয়েকটি পোকার নাম, ক্ষতির লক্ষণ ও দমনের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।
ক) বিছা পোকা
লক্ষণ:
- কচি ও বয়স্ক সব পাতাই খেয়ে ফেলে।
- স্ত্রী মথ পাটের পাতার উল্টা পিঠে গাদা করে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর প্রায় ৬-৭ দিন পর্যন্ত বাচ্চাগুলো পাতার উল্টা দিকে দলবদ্ধভাবে থাকে। পরে এরা সব গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
- দলবদ্ধভাবে থাকা অবস্থায় কীড়াগুলো পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে সাদা পাতলা পর্দার মতো করে ফেলে এবং আক্রান্ত পাতাগুলো দূর থেকেই সহজে দৃশ্যমান হয়। আক্রমণ ব্যাপক হলে এরা কচি ডগাও খেয়ে ফেলে।
দমন পদ্ধতি
- পাটের পাতায় ডিমের গাদা দেখলে গাদাসহ পাতা তুলে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে যখন ডিম থেকে বের হওয়া কীড়াগুলো দলবদ্ধভাবে থাকে, তখন পোকাসহ পাতাটি তুলে পায়ে পিষে, গর্তে চাপা দিয়ে অথবা অল্প কেরোসিন মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে মারতে হবে।
- পাট কাটার পর শুকনো জমি চাষ করলে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা পুত্তলিগুলো বের হয়ে আসে যা পোকাখাদক পাখি খেয়ে ফেলে।
- বিছা পোকা যাতে আক্রান্ত ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেতে ছড়াতে না পারে সেজন্য আক্রান্ত ক্ষেতের চারদিকে প্রতিবন্ধক নালা তৈরি করে অল্প কেরোসিন মিশ্রিত পানি নালায় রাখতে হবে।
- নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
খ) উচুঙ্গা পোকা
লক্ষণ:
- জমিতে গর্ত করে দিনের বেলায় গর্তে বসবাস করে এবং সন্ধ্যা বেলায় গর্ত থেকে বের হয়ে চারা পাটগাছের গোড়া কেটে গর্তে নিয়ে যায়। এতে পাট ক্ষেত মাঝে মাঝে গাছশূন্য হয়ে যায়।
- অনাবৃষ্টির সময় আক্রমণ বেশি হয় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর আক্রমণ কমে যায়।
- পূর্ণ বয়স্ক পোকা পাট গাছের শিকড় ও কাণ্ডের গোড়ার অংশ খায়।
দমন পদ্ধতি
- প্রতিবছর যেসব জমিতে উরচুঙ্গার আক্রমণ দেখা যায় সেখানে সাধারণ পরিমাণের চেয়ে বেশি করে বীজ বপন করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে চারা ৮-৯ সেমি হওয়ার পর ঘন গাছ বাছাই করে পাতলা করতে হবে।
- সম্ভব হলে নিকটস্থ জলাশয় থেকে আক্রান্ত জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। জমি চাষের সময় নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
- গর্তে কীটনাশক প্রয়োগ করে।
- কীটনাশক, বালাইনাশকের বিষটোপ প্রয়োগ করে।
গ) ঘোড়া পোকা
লক্ষণ:
- ঘোড়া পোকা পাট গাছের কচি ডগা ও পাতা আক্রমণ করে।
- ফলে কচি ডগা নষ্ট হয়ে যায় এবং শাখা-প্রশাখা বের হয়।
- ফলে পাটের ফলন ও আঁশের মান কমে যায়।
দমন পদ্ধতি:
- পোকার আক্রমণ দেখা দিলে কেরোসিন ভেজা দড়ি গাছের উপর দিয়ে টেনে দিলে পোকার আক্রমণ কম হয়।
- শালিক বা ময়না পাখি ঘোড়া পোকা খেতে পছন্দ করে। তাই এসব পাখি বসার জন্য পাট ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি এবং গাছের ডাল পুঁতে দিতে হবে।
- নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক বালাইনাশক ছিটাতে হবে।
ঘ) চেলে পোকা
লক্ষণ:
- স্ত্রী পোকা চারা গাছের ডগায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা গাছের ভিতরে চলে যায় এবং সেখানে বড় হতে থাকে। ফলে গাছের ডগা মরে যায় এবং শাখা প্রশাখা বের হয়।
- গাছ বড় হলে পাতার গোড়ায় কাণ্ডের উপর ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ফলে ঐ জায়গায় গিটের সৃষ্টি হয়। পাট পচানোর সময় ঐ গিটগুলো পচেনা। আঁশের উপর কালো দাগ থেকে যায়। এতে আঁশের মান ও দাম কমে যায়।
দমন পদ্ধতি:
- বীজ বপনের আগে ও পাট কাটার পরে ক্ষেত্রের আশে পাশে যে সব আগাছা থাকে সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
- আক্রান্ত পাট গাছগুলো তুলে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
- গাছের উচ্চতা ৫-৬ সেমি লম্বা হওয়ার পর নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) মাকড়
পাটক্ষেতে দুই ধরনের মাকড় দেখা যায়। যথা- হলদে ও লাল মাকড়।
লক্ষণ:
- হলদে মাকড় কচি পাতায় আক্রমণ করে পাতার রস চুষে খায়। এতে কচি পাতাগুলো কুঁকড়ে যায় এবং পাতার রং তামাটে হয়ে যায়।
- হলদে মাকড় ফুলের কুঁড়িকেও আক্রমণ করে। ফলে কুঁড়ি ফুটতে পারে না। ফুলের পাপড়ির রং হলদে থেকে কালচে রঙের হয়ে যায় ও ঝরে পড়ে। এতে বীজের ফলনও কমে যায়।
- একটানা খরা বা অনাবৃষ্টির সময় এদের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। লাল মাকড় একটু নিচের পাতা আক্রমণ করে।
দমন পদ্ধতি
- চুন ও গন্ধক ১৪২ অনুপাতে পানির সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত পাট ক্ষেতে ছিটাতে হবে।
- কাঁচা নিমপাতার রস ২ঃ৫ অনুপাতে পানির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক বালাইনাশক ছিটাতে হবে।
(৩) পাট চাষে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
পাটে কাণ্ড পচা, কালোপট্টি, গোড়া পচা, শুকনা ক্ষত, ঢলে পড়া, ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়।
নিম্নে কয়েকটি রোগের লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
ক) কাণ্ড পচা রোগ
- পাতা ও কাণ্ডে গাঢ় বাদামি রঙের দাগ দেখা দেয়।
- এ দাগ গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত যে কোনো অংশে দেখা দিতে পারে।
- দাগগুলোতে অসংখ্য কালো বিন্দু দেখা যায়। এ কালো বিন্দুগুলোতে ছত্রাক জীবাণু থাকে।
- কখনো কখনো আক্রান্ত স্থানে গোটা গাছই ভেঙে পড়ে।
- কেনাফ ও মেস্তা পাটে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
খ) কালো পট্টিরোগ
- এ রোগের লক্ষণ প্রায় কাণ্ড পচা রোগের মতোই। তবে এতে কাণ্ডে কালো রঙের বেষ্টনীর মতো দাগ পড়ে।
- আক্রান্ত স্থানে ঘষলে হাতে কালো গুঁড়ার মতো দাগ লাগে।
- এ রোগে গাছ শুকিয়ে মারা যায়।
গ) শুকনা ক্ষত
- এ রোগটি শুধু দেশি জাতের পাটেই দেখা যায়।
- চারা অবস্থায় আক্রমণ করলে চারা মারা যায়। বড় গাছের কাণ্ডে কালচে দাগ পড়ে।
- আক্রান্ত স্থান ফেটে যায় এবং ক্ষতস্থানে জীবাণু সৃষ্টি হয়। এ জীবাণুগুলো বাতাসে উড়ে ফল আক্রমণ করে।
- আক্রান্ত ফল কালো ও আকারে ছোট হয়।
- এ রোগে গাছ মরে না, তবে আক্রান্ত অংশ শক্ত হয়। তাই পাট পচানোর পরেও আক্রান্ত স্থানের ছাল পাট কাঠির সাথে লেগে থাকে। এর আঁশ নিম্নমানের হয়।
কাণ্ড পচা, কালোপট্টি ও শুকনা ক্ষত এ তিনটি রোগই বীজ, মাটি ও বায়ুবাহী। এদের প্রতিকারের ব্যবস্থাও একই রকমের। যেমন-
- পাট কাটার পর জমির আগাছা, আবর্জনা ও পরিত্যক্ত গাছের গোড়া উপড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করতে হবে।
- নীরোগ পাট গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- জমি থেকে সর্বদা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে।
- রাসায়নিক বালাইনাশক ছিটাতে হবে।
(১৪) বাংলাদেশের পাট ফসলের গুরুত্ব
পাট একটি আঁশ জাতীয় ফসল। বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাটের স্থান শীর্ষে। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে সোনালি আঁশ বলে অভিহিত করা হয়।
পাট ফসলটি যে সময়ে জন্মায় সে সময় বৃষ্টি থাকে। তাই সেচের দরকার হয় না।
পাট ফসলটি খরা ও জলাবদ্ধতা দুটোই সহ্য করতে পারে। কাজেই বাংলাদেশের যে সব এলাকায় সেচ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে এবং যেখানে মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জমিতে পানি জমে থাকে, সেখানে ধানের চেয়ে পাট চাষ বেশি হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৩০০-৪০০ হাজার হেক্টর জমি আছে যেখানে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পাট ছাড়া অন্য কোনো ফসল চাষ সম্ভব নয়। খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির কারণে পাট অন্যান্য ফসলের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে দেশি ও তোষা এ দুই জাতের পাটের চাষ হয়।
তবে দেশি জাতের তুলনায় তোষা জাতের পাটের চাষ বর্তমানে বেশি হচ্ছে। এর কারণ হলো পূর্বে যে সব এলাকায় দেশি পাটের চাষ হতো, তা ছিল নিচু এলাকা। বর্তমানে খাদ্য শস্যের চাহিদার জন্য ঐ সমস্ত এলাকা ধান চাষের আওতায় চলে গেছে। পাট চলে গেছে তুলনামূলকভাবে উঁচু ভূমি এলাকায় যেখানে বৃষ্টি নির্ভরতা বেশি।
যাহোক পাট ফসল শুধু আঁশ হিসাবেই নয়, কৃষিজাত শিল্পে, ঔষধি শিল্পে, পরিবেশ সংরক্ষণে ও সবজি হিসাবে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।