বাংলাদেশে তেল ফসল হিসাবে সরিষা, সয়াবিন, তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী প্রভৃতির চাষ হয়ে থাকে। তবে এ দেশের মানুষ সরিষাকেই প্রধান ভোজ্য তৈল বীজ ফসল হিসাবে বেশি চাষ করে থাকে।
(১) সরিষার চাষ করার পদ্ধতি
ক) সরিষা চাষে জমি নির্বাচন
সরিষা চাষের জন্য বেলে দোআঁশ অথবা পলি দোআঁশ মাটি উপযোগী। অতএব, সহজে পানি নিকাশ করা যায় এরূপ বেলে দোআঁশ বা পলি দোআঁশ মাটির জমি নির্বাচন করতে হবে।
খ) সরিষার জাত নির্বাচন
অনেক জাতের সরিষার চাষ হয়। নিম্নে সরিষার অনুমোদিত কতকগুলো জাতের নাম, যেমন- টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা, সম্পদ, রাই সরিষা, বারি সরিষা-৮, সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬ বারি।
গ) সরিষা বপনের সময়
- বাংলাদেশে সরিষা শীতকালীন ফসল। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির “জো” অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায়।
- বারি-১৪, বারি-১৫ ও বারি-১৬ এর বীজ আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। চিত্র : ফুল ও বীজ সহ সরিষা গাছের ডাল।
ঘ) জমি তৈরি
- জমির প্রকারভেদ অনুযায়ী মাটির ‘জো’ অবস্থায় ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে জমি তৈরি করতে হবে।
- সরিষার বীজ ছোট বিধায় ঢেলা ভেঙে মই দিয়ে মাটি সমান ও মিহি করতে হবে। জমির চারদিকে নালার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে প্রয়োজনে সেচ এবং পানি নিকাশে সুবিধা হয়।
ঙ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- জাত, মাটি ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সরিষার জমিতে কমপোস্ট সার, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট, বোরাক্স/বোরিক এসিড ইত্যাদি সার সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করতে হয়।
- ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ বাকি সব সার জমি প্রস্তুত করার সময় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকী অর্ধেক ইউরিয়া ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার উপরি প্রয়োগের সময় মাটিতে রস থাকা দরকার।
চ) বীজের হার
- সরিষার জাত টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা ও বারি সরিষা-৮ এর জন্য প্রতি শতকে ২৮-৩২ গ্রাম বীজ লাগে। বপন পদ্ধতি সরিষার বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বোনা হয়।
- বীজ ছোট বিধায় বোনার সময় জমিতে সমানভাবে ছিটানো কষ্টকর হয়। এজন্য বালি বা ছাই এর যে কোনো একটি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ ছিটালে জমিতে সমভাবে পড়ে। এতে জমির কোনো জায়গায় গাছ ঘন এবং কোনো জায়গায় পাতলা হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
- সারি করে সরিষার বীজ বোনা যায়। এতে সার, সেচ, নিড়ানি প্রভৃতি পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব সাধারণত ২৫-৩০ সেমি রাখা হয় ও প্রতি সারিতে ৪-৫ সেমি দূরত্বে এবং ২-৪ সেমি গভীরতায় বীজ বপন করা হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা গজাবে।
ছ) পানিসেচ
- মাটির আর্দ্রতা পর্যাপ্ত থাকলে সরিষার জমিতে সেচের প্রয়োজন হয় না। মাটির আর্দ্রতা বুঝে ২-৩ টি সেচ দিলে বেশ ভালো ফলন হয়।
- প্রথম সেচ বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ গাছে ফল হওয়ার সময় দিলে ভালো হয়।
- বপনের পূর্বে যদি মাটি শুষ্ক থাকে তবে একটি হালকা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করা উচিত।
- সরিষা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই সেচের পানি জমিতে জমে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।
জ) গাছ পাতলাকরণ
চারা খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। জমির কোথাও চারা না গজালে প্রয়োজনে সেখানে বীজ আবার বপন করতে হবে। পাতলাকরণের কাজটি চারা গজাবার ১০-১৫ দিনের মধ্যে করতে হবে।
ঝ) আগাছা দমন
সরিষার জমিতে আগাছা দেখা মাত্র নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। চারা পাতলা করার সময়ই আগাছা দমন করা যায়। যে সব জমিতে অরোবাংকির আক্রমণ দেখা যায় সে সব জমিতে পর পর দুই বছর সরিষা চাষ না করাই ভালো।
ঞ) ফলন
বাংলাদেশে সরিষার ফলন প্রতি শতকে প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ কেজি।
ট) ফসল সংগ্রহ
- যখন গাছের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ সরিষার ফল খড়ের রং ধারণ করে এবং গাছের পাতা হলদে হয় তখনই ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।
- সকালে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় শিশিরভেজা অবস্থায় ফসল সংগ্রহ করা উত্তম।
- মূলসহ গাছ টেনে তুলে অথবা কাঁচির দ্বারা কেটে ফসল সংগ্রহ করা যায়। তবে টেনে তোলাই ভালো।
ঠ) ফসল মাড়াই
ফসল সংগ্রহের পর ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। কিছু কিছু অপুষ্ট বীজ থাকতে পারে। অপুষ্ট বীজগুলোকে আলাদা করতে হবে।
ড) বীজ শুকানো ও সংরক্ষণ
- মাড়াই করার পর বীজ ঝেড়ে রোদে ভালোভাবে ৩-৪ দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর শুষ্ক পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম।
- সংরক্ষিত বীজ মাঝে মধ্যে শুকিয়ে আবার সংরক্ষণ করতে হয়।
- রোদে শুকানো বীজ গরম অবস্থায় সংরক্ষণ করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোদে শুকানো বীজ ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিক পাত্রে, টিনে বা ড্রামে রেখে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন পাত্রের ভিতরে বায়ু প্রবেশ করতে না পারে।
(২) সরিষা চাষে রোগের লক্ষণ ও দমন
সরিষা ফসলের প্রধান রোগ অল্টারনারিয়া রাইট বা পাতায় দাগ পড়া রোগ অন্যতম। এ রোগ দেখা দিলে গাছের পাতায় প্রথমে বাদামি পরে গাঢ় রঙের গোলাকার দাগ দেখা যায়। এ রোগের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে প্রতিরোধ হিসাবে সঠিক নিয়মে বপন করা দরকার।
সরিষার প্রধান ক্ষতিকারক পোকা হলো জাবপোকা। বাচ্চা ও পরিণত জাব পোকা সরিষার কাণ্ড, পাতা, পুষ্পমঞ্জুরি, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায় ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। ফুল ও ফল ধারণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফল কুঁচকে ছোট হয়ে যায় এবং শতকরা ৩০-৭০ ভাগ ফলন কম হতে পারে।
জানুয়ারি মাসে জাব পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। জাব পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে সিঞ্চন যন্ত্রের সাহায্যে সরিষার ক্ষেতে ছিটাতে হবে।
(৩) সরিষা ফসলের গুরুত্ব
- বাংলাদেশের ৩ প্রকার সরিষার চাষ হয়। যথা- টরি, শ্বেত ও রাই। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে ৪০-৪৪% তেল থাকে।
- সরিষার বীজ থেকে তৈল নিষ্কাশনের পর যে খৈল থাকে তাতে প্রায় ৪০% আমিষ এবং ৬৪% নাইট্রোজেন থাকে।
- সরিষার খৈল গরু, মহিষের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাদ্য এবং উৎকৃষ্ট জৈব সার। এছাড়া রান্নার কাজে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- আবার সরিষার জমিতে কৃত্রিম উপায়ে অত্যন্ত অল্প খরচে মৌমাছি পালন করে মধু সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য সরিষাকে মধু উদ্ভিদও বলা হয়।
- কাজেই অর্থনৈতিক, ঔষধশিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সরিষা ফসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- কৃষিজ উৎপাদন বলতে বিভিন্ন প্রকার মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, ঔষধি গাছপালা, মাছ চাষ ও গৃহপালিত পশুপাখি পালন প্রভৃতির উৎপাদনকে বোঝায়। মানুষের জীবনযাত্রা চলমান রাখতে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানো দরকার।
- বাংলাদেশে পতিত ও অব্যবহৃত জায়গাতেও পরিকল্পিতভাবে ফুলফল ও শাকসবজি চাষ করা যায়। এছাড়া শস্যপর্যায় অবলম্বন করে দানা জাতীয় ফসলের পরে সরিষা বা মাসকলাই চাষ, আঁশ জাতীয় ফসলের পরে দানা জাতীয় ফসল চাষ করা যায়।
- এছাড়া এ দেশে বাঁশ, বেত, পাটকাঠি, খড়, নারিকেলের ছোবড়া ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। কাজেই কৃষিজ উৎপাদন সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।