আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন: খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ডোবা-নালায় শিং, মাগুর, পাবদা ও টেংরা মাছ এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এরা আঁইশবিহীন ক্যাটফিশ জাতীয় মাছ।
সিরিফরমিস বর্গের অন্তর্ভুক্ত মাছ যাদের শরীরে আঁইশ নেই এবং মুখে বিড়ালের ন্যায় লম্বা গোঁফ বা শুঁড় আছে তাদেরকে ক্যাটফিশ বলে।
প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশ বিপর্যয় ও অত্যাধিক আহরণের কারণে বর্তমানে এসব মাছের প্রাপ্যতা অনেক কমে গেছে। চাষের মাধ্যমে এদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
শিং ও মাগুর মাছের চাষ পদ্ধতি প্রায় একই রকম। আবার টেংরা ও পাবদার চাষ পদ্ধতিতেও যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশে কয়েক ধরনের টেংরা মাছ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে গুলশা টেংরার পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে।
নিম্নে শিং, মাগুর, পাবদা ও গুলশা টেংরা মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
(১) শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি
ক) শিং ও মাগুর মাছের পরিচিতি
শিং ও মাগুর মাছের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছুটা মিল রয়েছে।
- এদের দেহ লম্বাটে, সামনের দিক নলাকার, পিছনের দিক চ্যাপ্টা ও আঁইশবিহীন এবং মাথার উপর নিচ চ্যাপ্টা। মুখে চার জোড়া শুঁড় ও মাথার দুই পাশে দুইটি কাঁটা আছে।
- কিন্তু শিং মাছ মাগুর মাছের চেয়ে আকারে ছোট হয় এবং মাথা তুলনামূলক সরু হয়।
- শিং মাছের পার্শ্বীয় কাঁটা দুইটি বিষাক্ত হয়। এজন্য শিং মাছের কাঁটা খেলে আক্রান্ত স্থানে যথেষ্ট ব্যথা অনুভব হয়।
- শিং মাছের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি লাল এবং বড় অবস্থায় ধূসর কালচে। অন্যদিকে মাগুরের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি খয়েরি ও বড় হলে ধূসর বাদামি হয়।
- শিং ও মাগুর মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফুলকা ছাড়াও এদের অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন নিতে পারে। ফলে এরা অল্প অক্সিজেন যুক্ত পানিতে বা পানি ছাড়াও দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। এজন্য শিং ও মাগুর মাছকে জিওল মাছ বলা হয়।
- শিং ও মাগুর মাছ সর্বভুক জাতীয় মাছ। এরা জলাশয়ের তলদেশে থাকে এবং সেখানকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী ও পচা জৈব আবর্জনা খায়। এরা বছরে ১ বার প্রজনন করে থাকে। এদের প্রজনন কাল হচ্ছে মে থেকে সেপ্টেম্বর। তবে জুন-জুলাই মাসে এদের সর্বোচ্চ প্রজনন হয়ে থাকে।
খ) শিং ও মাগুর চাষের সুবিধা
- বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে তাই এ মাছ চাষে অধিক মুনাফা লাভ করা যায়।
- চাষ পদ্ধতি সহজ।
- যে কোনো ধরনের জলাশয়ে এমনকি চৌবাচ্চা ও খাঁচাতেও চাষ করা যায়। প্রতিকূল পরিবেশে যেমন-অক্সিজেন স্বল্পতা, পানির অত্যাধিক তাপমাত্রা, এমনকি পচা পানিতেও এরা বেঁচে থাকে।
- অল্প পানিতে ও অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।
- রোগবালাই খুব কম হয় ও অধিক সহনশীল।
- অল্প পানিতে এমনকি পানি ছাড়াও এরা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকে বলে জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায়।
- সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে অল্প সময়েই (৬-৮ মাস) বাজারজাত করার উপযোগী হয়।
- একক মাছ চাষ ছাড়াও অন্যান্য কার্প মাছ, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের সাথে পুকুরে মিশ্র চাষ করা যায়।
গ) শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগত গুরুত্ব
- বড় অনেক প্রজাতির তুলনায় শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
- এসব মাছে শরীরের উপযোগী লৌহ অধিক পরিমাণে আছে।
- এসব মাছে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি ও তেল কম থাকে। এজন্য সহজে হজম হয়।
- অসুস্থ ও রোগ মুক্তির পর স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতির জন্য পথ্য হিসাবে এসব মাছ সমাদৃত।
- শিং ও মাগুর মাছ রক্ত স্বল্পতা রোধে ও বল বর্ধনে সহায়তা করে।
ঘ) শিং ও মাগুর চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
- শিং ও মাগুর মাছ চাষের জন্য পুকুর ১-১.৫ মিটার গভীর হওয়া দরকার। পুকুরের আয়তন ১০ শতক থেকে ৩০ শতক হলে ভালো হয়।
- চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরটির পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে।
- পুকুরে কচুরিপানা সহ অন্যান্য জলজ আগাছা থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
- পাড়ে বড় গাছপালা থাকা উচিত নয়।
- পুকুরে রাক্ষুসে ও অপ্রয়োজনীয় মাছ থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পুকুর শুকিয়ে, বার বার জাল টেনে বা পুকুরের পানিতে রোটেনন প্রয়োগ করে তা করা যায়।
- শীতকালে যখন পুকুরের পানি অনেক কমে যায় তখন পুকুর শুকিয়ে ফেলে পুকুর প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করলে ভালো হয়।
- পুকুর শুকানো হলে তলায় চুন, গোবর বা হাঁসমুরগির বিষ্ঠা, ইউরিয়া, টিএসপি সার প্রতি শতকে নির্ধারিত হারে যথাযথ নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে যদি পানি থাকে তাহলে পানিতেই চুন ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) নেটের বেষ্টনী/বেড়া নিৰ্মাণ
- শিং ও মাগুর মাছ চাষে পুকুর প্রস্তুতির সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পুকুরের চারদিকে পাড়ের উপর অন্তত ৩০ সেমি উঁচু করে নেটের বেষ্টনী বা বেড়া নিমার্ণ করা।
- বেষ্টনী দেওয়ার সুবিধা হচ্ছে এতে করে বৃষ্টির সময় মাছ পুকুরের বাইরে চলে যেতে পারে না। বিশেষত মাগুর মাছকে সামান্য বৃষ্টি বা বন্যা হলে প্রায়ই “হেঁটে” (গড়িয়ে) পুকুর থেকে বাইরে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে বেষ্টনী দেওয়ার ফলে মাছের শত্রু যেমন-সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি পুকুরে প্রবেশ করতে পারে না।
- নাইলনের নেট খুঁটির সাথে বেঁধে পাড়ের চারদিকে ঘিরে দিতে হবে। নেটের নিচের দিক মাটির ভিতর কিছুটা ঢুকিয়ে আটকে দিতে হবে যেন মাটি ও নেটের মাঝে ফাঁক না থাকে।
- পুকুর শুকানো হলে শুকানোর পর পরই এ কাজ করতে হবে। কারণ শুকনো অবস্থায় পুকুরে কোনো ক্ষতিকর প্রাণী যেমন-ব্যাঙ, সাপ না থাকে। পানি থাকা অবস্থায় পুকুরে এসব প্রাণী থাকে বিধায় তখন বেষ্টনী দিলে এরাও পুকুরে আটকা পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভিতরে সেগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- কোচ দিয়ে বা বিষ টোপ দিয়ে।
চ) পোনা মজুদ
- পুকুর প্রস্তুতির ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ টি মাগুর মাছের পোনা মজুদ করতে হবে। শিং মাছ যেহেতু আকারে ছোট তাই এ মাছ কিছু বেশি যেমন- ৩০০-৪০০টি পর্যন্ত মজুদ করা যেতে পারে।
- শতকে ৩-৪টি সিলভার কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে যা পুকুরে উৎপাদিত অতিরিক্ত ফাইটোপ্লাংকটন খেয়ে পরিবেশ ভালো রাখবে।
- পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকলে শতকে মাগুরের পোনা ২৫০-৩০০টি এবং শিং মাছের পোনা ৪০০-৫০০টি মজুদ করা যাবে।
- কার্প বা রুই জাতীয় মাছের সাথে শিং/মাগুর এর মিশ্রচাষ করতে চাইলে শতকে শিং/মাগুর এর পোনা ৫০টি এবং রুই জাতীয় মাছের পোনা ৪০টি মজুদ করা যায়।
- পোনা ছাড়ার আদর্শ সময় হচ্ছে সকাল বা বিকাল (ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়)। দুপুরে রোদে বা মেঘলা দিনে পোনা মজুদ করা উচিত নয়।
- পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পটাশ বা লবণ পানিতে পোনা শোধন ও পুকুরের পানিতে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
ছ) মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
খাদ্য ব্যবস্থাপনা মাগুর ও শিং মাছ চাষে মাছকে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে।
নিচে মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদান ও এগুলোর মিশ্রণের হার দেওয়া হলো।
শিং ও মাগুরের সম্পুরক খাদ্য তৈরির উপাদান ও মিশ্রণ হার:
খাদ্য | নমুনা মিশ্রণ হার (%) |
ফিশমিল | ২০ |
মুরগির নাড়ি ভুঁড়ি ও হাড় চূর্ণ (মিট ও বোন মিল) | – |
সরিষার খৈল | ২০ |
চালের কুঁড়া | ৩০ |
গমের ভুসি | ১২ |
আটা/ চিটাগুড় | ৫ |
ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ | ১ গ্রাম/কেজি |
সয়াবিন চূর্ণ | ৮ |
ভুট্টা চূর্ণ | ৫ |
শিং/মাগুর মাছের দৈহিক ওজনের সাথে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা:
মাছের গড় ওজন (গ্ৰাম) | দৈহিক খাদ্যের পরিমাণ (%) |
১-৩ | ১৫-২০ |
৪-১০ | ১২-১৫ |
১১-৫০ | ৮-১০ |
৫১-১০০ | ৫-৭ |
> ১০০ | ৩-৫ |
জ) খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি
- প্রতিদিনের খাবার ২ ভাগ করে দিনে ২ বার (সকাল ও বিকালে) দিতে হবে।
- খাবার অল্প পানিতে মিশিয়ে ছোট ছোট বল করে পুকুরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে পানির নিচে স্থাপিত ট্রেতে দেওয়া যাবে।
- খাদ্য প্রস্তুতের ২৪ ঘণ্টা পূর্বেই সরিষার খৈল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- বাজার থেকে কেনা বাণিজ্যিক খাবারও মাছকে প্রদান করা যায়। এতে তৈরিকৃত খাদ্যের চেয়ে দাম কিছুটা বেশি পড়তে পারে।
ঝ) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
চাষকালীন মাছ নিয়মিত বাড়ছে কিনা এবং মাছ রোগাক্রান্ত হচ্ছে কিনা জাল টেনে মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করতে হবে।
শিং ও মাগুর মাছে সাধারণত কোনো রোগ হয় না। তবে মাঝে মাঝে শীতকালে ক্ষত রোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ এবং পেট ফোলা রোগ দেখা যায়।
নিচে এদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দেওয়া হলো।
i) ক্ষত রোগ
- মূলত এ্যাফানোমাইসিস ইনভাডেন্স নামক একধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়।
- এতে মাংশপেশিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
- পুকুরে ১-১.৫ মিটার পানির গভীরতায় শতকে ১ কেজি হারে চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করলে আক্রান্ত মাছগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে।
- আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে শীতের শুরুতে একই হারে পুকুরে চুন ও লবণ প্রয়োগ করলে শীতকালে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
ii) লেজ বা পাখনা পচা রোগ
- এ্যারোমোনাডস ও মিক্সোব্যাকটার জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়।
- প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রিত করে আক্রান্ত মাছকে ৩-৫ মিনিট গোসল করাতে হবে।
- পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
- প্রতি শতক পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
iii) পেট ফোলা রোগ
- এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ।
- এ রোগ হলে মাছের পেট ফুলে যায়।
- মাছ ভারসাম্যহীন ভাবে চলাচল করে ও পরিশেষে মৃত্যু ঘটে।
- আক্রান্ত মাছের পেট হতে খালি সিরিঞ্জ দিয়ে পানি বের করে নিতে হবে।
- প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২০০ মি গ্রাম ক্লোরামফেনিকল পাউডার মিশিয়ে সরবরাহ করতে হবে।
- আক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যায়।
জ) মাছ আহরণ
- সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে ৭-১০ মাসে শিং ও মাগুর মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়। উক্ত সময়ে শিং মাছ গড়ে ১০০-১২৫ গ্রাম ও মাগুর মাছ ১২০-১৪০ গ্রাম হয়ে থাকে।
- পুকুরে জাল টেনে বেশির ভাগ মাছ ধরতে হবে। সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হলে পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।
(২) পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ পদ্ধতি
ক) পাবদা ও গুলশা মাছের পরিচিতি
বিল, হাওর, নদী, পুকুর এবং দিঘিতে পাবদা ও গুলশা মাছ পাওয়া যায়। পাবদা ও গুলশা মাছ খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এ কারণে এদের চাহিদা ও বাজার মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি।
পাবদা মাছের বৈশিষ্ট্য:
- পাবদা মাছ ১৫-৩০ সেমি লম্বা হয়ে থাকে।
- দেহ চ্যাপ্টা ও সামনের দিকের চেয়ে পেছনের দিক ক্রমাগত সরু।
- এ মাছের মুখ বেশ বড় ও বাঁকানো নিচের চোয়াল উপরের চোয়ালের চেয়ে বড়।
- মুখের সামনের দিকে দুই জোড়া লম্বা গোঁফ আছে।
- পৃষ্ঠ পাখনা ছোট।
- পায়ু পাখনা বেশ লম্বা ও লেজ দুই ভাগে বিভক্ত।
- দেহের রং সাধারণত উপরিভাগে ধূসর রূপালি ও পেটের দিক সাদা।
- ঘাড়ের কাছে কানকোর পিছনে কালো ফোঁটা আছে।
- শিরদাঁড়া রেখার উপরিভাগে হলুদাভ ডোরা দেখতে পাওয়া যায়।
- পাবদা মাছ মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন সম্পন্ন হয়।
গুলশা মাছের বৈশিষ্ট্য:
- গুলশা মাছের দৈর্ঘ্য ১৫-২৩ সেমি হয়ে থাকে।
- মাছের দেহ পার্শ্বীয় ভাবে চাপা।
- পিঠের অংশ বাঁকানো।
- মুখ বেশ ছোট, উপরের চোয়াল সামান্য বড়।
- মুখে ৪ জোড়া গোঁফ বা শুঁড় আছে ৷
- পৃষ্ঠ ও কানকো পাখনা লম্বা কাঁটা যুক্ত।
- শরীরের রং জলপাই ধূসর, নিচের দিক কিছুটা হাল্কা।
- শিরদাঁড়া রেখা বরাবর নীলাভ ডোরা দেখা যায়। .
- এরা বছরে একবার ডিম দেয়।
- গুলশা মাছের প্রজননকাল জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। জুলাই-আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন করে থাকে।
খ) পাবদা ও গুলশা মাছ চাষের গুরুত্ব
- বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। তাই এদের চাষের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি সম্ভব।
- এদের দেহে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও মাইক্রোনিউট্রেন্ট বিদ্যমান থাকে।
- খেতে খুবই সুস্বাদু।
- চাষ পদ্ধতি সহজ।
- কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা যায়। ফলে সহজে পোনা পাওয়া সম্ভব।
- বার্ষিক পুকুর ছাড়াও মৌসুমি পুকুর ও অন্যান্য অগভীর জলাশয়েও চাষ করা যায়।
- দ্রুত বর্ধনশীল, ৫-৬ মাসেই বিপণনযোগ্য হয়।
গ) চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন
- সাধারণত ১৫-২০ শতাংশের পুকুর যেখানে ৭-৮ মাস পানি থাকে এমন পুকুরে এ মাছ দুইবার চাষ করা যায়।
- পুকুরে পানির গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো।
ঘ) পুকুর প্রস্তুতি
- পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- পাড়ে বড় গাছপালা থাকা উচিত নয়। থাকলে তা ছেঁটে দিতে হবে যেন পুকুরে পাতা ও ছায়া না পড়ে।
- পুকুরে রাক্ষুসে ও অপ্রয়োজনীয় মাছ থাকলে তা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- এরপর পুকুরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হারে গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) পোনা মজুদ
- সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর ৩-৫ গ্রাম ওজনের পোনা শতক প্রতি ২৫০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
- সকালে বা বিকালে বা দিনের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পুকুরে পোনা ছাড়া উচিত।
- পোনা আনার সাথে সাথে সেগুলো সরাসরি পুকুরে ছাড়া উচিত নয়।
- পোনা ছাড়ার পূর্বে পটাশ বা লবণ পানিতে শোধন করে নিতে হবে এবং পোনাকে পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
চ) খাদ্য প্রয়োগ
পাবদা ও গুলশা মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির উপাদান ও মিশ্রণ হার:
খাদ্য উপাদান | মিশ্রণ হার (%) |
ফিশমিল | ৩০ |
মিট ও বোন মিল | ১০ |
সরিষার খৈল | ১৫ |
সয়াবিন খৈল | ২০ |
চালের কুঁড়া | ২০ |
আটা | ৪ |
ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশ্ৰণ | ১ |
ছ) খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি
২-৩ টি ডুবন্ত ট্রেতে করে প্রতিদিন দেহ ওজনের শতকরা ৫-৬ ভাগ হারে দৈনিক ২ বার (সকালে ও বিকালে) প্রয়োগ করতে হবে।
জ) সার প্রয়োগ
সম্পূরক খাদ্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হওয়ার জন্য ৭-১৫ দিন পর পর শতক প্রতি ৪-৫ কেজি হারে পচা গোবর রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে গুলিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ঝ) ব্যবস্থাপনা
- মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা তা লক্ষ রাখতে হবে। ট্রেতে খাবার দেওয়ার আগে পূর্ববর্তী দিনের খাবার সম্পূর্ণ খেয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যে পরিমাণ খাদ্য থেকে যাবে তার সমপরিমাণ খাদ্য কম সরবরাহ করতে হবে।
- প্রতি মাসে ২ বার জাল টেনে দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
- সপ্তাহে একবার পুকুরে হররা টানতে হবে।
- পুকুরে পানি কমে গেলে বাইরে থেকে পানি সরবরাহ করতে হবে।
- পানির স্বচ্ছতা (সেক্কিডিস্ক গভীরতা) ২৫ সেমি মধ্যে থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
ঞ) মাছ আহরণ
- গুলশা মাছ ৬ মাসে ৪০-৪৫ গ্রাম এবং পাবদা মাছ ৭-৮ মাসের মধ্যে ৩০-৩৫ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে।
- এই আকারের পাবদা মাছ বেড় জাল দিয়ে ও গুলশা মাছ পুকুর শুকিয়ে আহরণ করা যায় ৷
(৩) মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কাজের সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং সামাজিক উন্নয়নে মাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম।
নিচে মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো।
ক) পুষ্টির চাহিদা পূরণ
- আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় আমিষের প্রধান উৎস হচ্ছে মাছ। এটি একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০% আমিষের যোগান দেয় মাছ।
- একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ৮০ গ্রাম আমিষ জাতীয় খাবারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা গড়ে মাত্র ৬০ গ্রাম আমিষ খেয়ে থাকি। মাছ চাষের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই মাছ চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- এছাড়া মাছের তেল দেহের জন্য উপকারী। বিভিন্ন জাতের ছোট মাছ যেমন- মলা, ঢেলা, কাচকি মাছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’পাওয়া যায়। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ দূর করে।
- মাছের কাঁটায় প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস পাওয়া যায় যা দেহের হাড় গঠনে সাহায্য করে।
খ) কাজের সুযোগ সৃষ্টি
বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ % বা ১৬৫ লক্ষের অধিক লোক মৎস্য সেক্টর থেকে বিভিন্ন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন- মাছ চাষ, মাছ ধরা, বিক্রয় ইত্যাদি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের বাংলাদেশে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে।
মাছ চাষের মাধ্যমে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
গ) রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটা অংশ আসে মৎস্য খাত হতে।
মাছ চাষ বৃদ্ধি করে এ আয় আরও বাড়ানো সম্ভব।
ঘ) আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন
বাংলাদেশে অনেক পতিত পুকুর, ডোবা ও নালা রয়েছে যেখানে মাছ চাষ করা হয় না।
এসব জলাশয়ে মাছ চাষ করে গ্রামের গরিব ও স্বল্প আয়ের লোকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।