কলা বাংলাদেশের সব জেলায়ই কম বেশি জন্মে। তবে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ এসব জেলায় কলার ব্যাপক চাষ হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে কলার চাষ হয় যা থেকে বছরে ছয় লক্ষাধিক টন কলা পাওয়া যায়।
কলা ভিটামিন ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলায় ক্যালরির পরিমাণও বেশি।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই কলার চাষ হয়ে থাকে। কলা কাঁচা অবস্থায় তরকারি হিসাবে এবং পাকা অবস্থায় ফল হিসাবে খাওয়া হয়। রোগীর পথ্য হিসাবে কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
(১) কলার জাত
বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে যেসব কলার জাত চাষ করা হয় সেগুলো হচ্ছে অমৃতসাগর, সবরি, চাপা, মেহেরসাগর, কবরী ইত্যাদি।
এ ছাড়াও কলার আরও অনেক জাত আছে যেমন: এঁটে কলা, বাঙলা কলা, জাহাজি কলা, কাচকলা বা আনাজি কলা ইত্যাদি।
তবে বারি কলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে তিনটি উন্নত জাত চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বারিকলা-২ জাতটি কাঁচকলার।
(২) কলার চাষ পদ্ধতি
কলার উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো হচ্ছে-
- মাটি ও জমি তৈরি।
- রোপণের সময় ও চারা রোপণ।
- সার প্রয়োগ পদ্ধতি।
- অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা ইত্যাদি।
ক) কলা চাষের জন্য মাটি ও জমি তৈরি
- উর্বর দোআঁশ মাটি কলা চাষের জন্য ভালো।
- জমিতে প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এবং পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকবে।
- গভীরভাবে জমি চাষ করে দুই মিটার দূরে দূরে ৫০ সেমি x ৫০ সেমি x ৫০ সেমি আকারের গর্ত খুঁড়তে হবে।
- চারা রোপণের প্রায় একমাস আগে গর্ত করে গর্তে গোবর ও টিএসপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত পূর্ণ করতে হবে।
খ) কলার চারা রোপণের সময়
বছরে তিন মৌসুমে কলার চাষ করা হয় বা কলার চারা রোপণ করা হয় যথা-
- আশ্বিন-কার্তিক
- মাঘ-ফাল্গুন
- চৈত্র-বৈশাখ
খ) কলার চারা নির্বাচন
কলার চারাকে তেউড় বলা হয়।
দুই রকমের তেউড় দেখা যায়। যথা-
- অসি তেউড় (Sword Sucker)
- পানি তেউড় (Water Sucker)
অসি তেউড়:
- কলা চাষের জন্য অসি তেউড় উত্তম।
- অসি তেউড়ের পাতা সরু, সুচালো এবং অনেকটা তলোয়ারের মতো।
- গোড়ার দিকে মোটা এবং ক্রমশ উপরের দিকে সরু হতে থাকে।
পানি তেউড়:
- পানি তেউড় দুর্বল।
- এর আগা-গোড়া সমান থাকে।
- কলা চাষের জন্য এই চারা উপযুক্ত নয়।
এ দুই ধরনের চারা ছাড়াও সম্পূর্ণ মূলগ্রন্থি বা তার ক্ষুদ্র অংশ থেকেও কলা গাছের বংশবিস্তার সম্ভব। তবে এতে ফল আসতে কিছু বেশি সময় লাগে। ফলন্ত ও অফলন্ত দুই ধরনের গাছেরই মুলগ্রন্থি চারা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ) কলার চারা রোপণ
- চারা রোপণের জন্য প্রথমত অসি তেউড় বা তলোয়ার তেউড় নির্বাচন করতে হবে।
- খাটো জাতের ৩৫-৪৫ সেমি আর লম্বা জাতের ৫০-৬০ সেমি দৈর্ঘ্যের তেউড় ব্যবহার করা হয়।
- অতঃপর নির্দিষ্ট গর্ভে যাতে প্রয়োজনীয় গোবর ও টিএসপি সার দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে সেখানে চারা লাগাতে হবে।
- লক্ষ রাখতে হবে যেন চারার কাণ্ড মাটির ভিতরে না ঢুকে।
ঘ) কলা গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
কলা গাছে ব্যবহৃত সারের নাম ও গাছ প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো-
সারের নাম | গাছ প্রতি পরিমাপ |
ইউরিয়া | ৫০০-৬৫০ গ্রাম |
টিওএসপি | ২৫০-৪০০ গ্রাম |
এমওপি | ২৫০-৩০০ গ্রাম |
গোবর/ আবর্জনা সার | ১৫-২০ কেজি |
ঙ) সার প্রয়োগ করার সময়
- চারা রোপণের ১ মাস পূর্বে গর্ত করে গোবর/আবর্জনা সার ও ৫০% টিএসপি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- রোপণের ২ মাস পর বাকি ৫০% টিএসপি, ৫০% এমওপি ও ২৫% ইউরিয়া গাছের গোড়ার চারদিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- এর ২ মাস পর বাকি ৫০% এমওপি ও ৫০% ইউরিয়া এবং ফুল আসার সময় বাকি ২৫% ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
চ) কলা গাছের পরিচর্যা
i) সেচ ও নিকাশ
- কলার জমিতে আর্দ্রতা না থাকলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
- শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচ দেওয়া দরকার।
- বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নালা কেটে দিতে হবে। কারণ কলাগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
ii) অতিরিক্ত চারা কাটা
ফুল বা মোচা আসার পূর্ব পর্যন্ত গাছের গোড়ায় যে তেউড় জন্মাবে তা কেটে ফেলতে হবে। মোচা আসার পর গাছ প্রতি ১টি তেউড় রাখা ভালো।
iii) খুঁটি দেওয়া
কলাগাছে ছড়া আসার পর বাতাসে গাছ ভেঙে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাঁশ বা গাছের ডাল দিয়ে খুঁটি বেঁধে দিতে হবে।
ছ) ফসল সংগ্ৰহ
- চারা রোপণের পর ১১-১৫ মাসের মধ্যে সব জাতের কলা সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
- ধারালো দা দিয়ে কলার ছড়া কাটতে হবে।
জ) ফলন
ভালোভাবে কলার চাষ করলে গাছ প্রতি প্রায় ২০ কেজি বা প্রতি হেক্টরে প্রায় ২০-৪০ টন কলা উৎপাদিত হবে।
(৩) কলার চষে রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
ক) কলার পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
- কলাগাছ ফল ও পাতার বিটল পোকা, রাইজম উইভিল, থ্রিপস এসব পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
- ডায়াজিনন ৬০ ইসি পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
খ) কলার রোগ ব্যবস্থাপনা
কলা ফল চাষের সময় প্রধানত তিনটি রোগের আক্রমণ দেখা যায়। যথা-
- পানামা রোগ।
- সিগাটোগা।
- গুচ্ছ মাথা রোগ।
i) পানামা রোগ
- এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ।
- এ রোগের আক্রমণে গাছের পাতা হলদে হয়ে যায়।
- পাতা বোটার কাছে ভেঙে ঝুলে যায় এবং কাণ্ড অনেক সময় ফেটে যায়। .
- আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে মরে যায় অথবা ফুল-ফল ধরে না।
- রোগের প্রতিকার হিসাবে রোগমুক্ত গাছ লাগাতে হবে, রোগক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে এবং প্রতিরোধী জাত রোপণ করতে হবে।
- এ ছাড়া টিল্ট-২৫০ ইসি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যাবে।
ii) সিগাটোগা
- এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ।
- এ রোগের আক্রমণে পাতার উপর গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় বাদামি রঙের দাগ পড়ে।
- আক্রমণ ব্যাপক হলে পাতা ঝলসে যায় ও সমস্ত পাতা আগুনে পোড়ার মতো দেখায়। ফলে ফল ছোট হয় এবং ফলন কম হয়।
- রোগের প্রতিকার হিসাবে আক্রান্ত গাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
iii) গুচ্ছ মাথা রোগ
- এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ।
- জাব পোকার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
- ম্যালাথিয়ন বা অন্য যে কোনো অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগে জাব পোকা দমন করে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।