আলুু বীজ জমিতে বপন থেকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন প্রকারের ক্ষতিকর রোগ দ্বারা আলু গাছ ও বীজ আলু আক্রান্ত হয়।
আলুর ক্ষতিকর প্রধান রোগের মধ্যে নাবি ধ্বসা, ঢলে পড়া, দাঁদ, স্কাব বা ষ্টেম ক্যাঙ্কার, ব্লাক লেগ এবং বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস রোগ হলো অন্যতম।
এ সমস্ত রোগ দমনে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে কৃষক পর্যায়ে আলুর লাভজনক উৎপাদন ব্যহত হয়। এসব আলুর রোগের লক্ষণ এবং রোগ বালাই ও তার প্রতিকার সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
(১) আলুর মড়ক বা নাবি ধ্বসা রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- আলুর মড়ক রোগ বাংলাদেশের আলু উৎপাদনের প্রধান অন্তরায়। ফাইটোপথোরা ইনফেসট্যান্স নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
- এ রোগের আক্রমণে প্রথমে পাতায় ছোপ ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা এলোমেলো দাগ দেখা দেয়, যা দ্রুত কালো হয়ে পচে যায়। গাছের কান্ড এবং টিউবারেও এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়।
- সকাল বেলা মাঠে গেলে পাতার নিচে সাদা সাদা পাউডারের মত ছত্রাক দেখা যায়।
- তীব্র আক্রমণে সম্পূর্ণ জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
- নিম্ন তাপমাত্রা এবং কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ, দ্রুত লতাপাতা ও কান্ডসহ পচে যায় এবং ২-৩ দিনের মধ্যেই আলুর মড়ক রোগ আক্রান্ত গাছ আলুর মড়ক রোগ আক্রান্ত পাতা মাঠের সমস্ত গাছই মরে যেতে পারে।
- আক্রান্ত টিউবারের গায়ে ও ভিতরের অংশে গাঢ় বাদামী থেকে কালচে দাগ পড়ে।
অনুকূল আবহাওয়া ও রোগের উৎস:
- ঠান্ডা ও ভেজা আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল। যদি রাতে নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চ জলীয় বাষ্প এবং তার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কুয়াশা এবং পাতায় শিশির আলুর মড়ক রোগে মারাত্মক আক্রান্ত মাঠ রোগ আক্রান্ত আলু জমে থাকে তাহলে এ রোগ কয়েক দিনের মধ্যে মহামারী রূপ ধারণ করে।
- ডিসেম্বরের মাঝামাঝী থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের যে কোন সময় এ রোগ আলু গাছে দেখা দিতে পারে।
- এ রোগের প্রধান উৎস হল আক্রান্ত বীজ। সাধারণত এক হেক্টর জমিতে একটি রোগাক্রান্ত বীজ আলু থাকলেই সেটা অনুকূল পরিবেশে ঐ পরিমাণ জমির ফসল নষ্ট করে ফেলতে পারে।
- বাতাস, বৃষ্টিপাত, সেচের পানি ইত্যাদির সাহায্যে এ রোগের জীবাণু আক্রান্ত গাছ থেকে সুস্থ গাছে বিস্তার লাভ করে। বিকল্প পোষক যেমন টমেটো গাছ থেকেও এ রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে।
- হিমাগারে রাখা আলুতে এই রোগের জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং গাছ গজানোর ৪৫-৫০ দিন পর অনুকূল পরিবেশে এই রোগের সূচনা হতে পারে।
রোগের প্রতিকার ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগ প্রতিরোধী বা সহনশীল জাত যেমন- ‘বারি আলু-৪৬’, ‘বারি আলু-৫৩’, ‘বারি আলু-৭৭’ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।
- সারিতে ভালোভাবে মাটি উঁচু করে দিতে হবে।
- আগাম জাতের আলু চাষ করতে হবে এবং আগে সংগ্রহ করতে হবে।
- নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক যেমন- ডাইথেন এম-৪৫/ইন্ডোফিল ইত্যাদি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে স্প্রে করতে হবে।
- জমিতে রোগ দেখা দেওয়া মাত্রই ৭ দিন অন্তর অন্তর নিম্নের যে কোন একটি ছত্রাকনাশক বা ছত্রাকনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে-
-সিকিউর (২ গ্রাম/লিটার) অথবা,
-এক্রোভেট এম জেড (২ গ্রাম/লিটার) অথবা,
-মেলোডি ডুও ৪ গ্রাম + সিকিউর ২ গ্রাম (প্রতি লিটার পানিতে) অথবা,
-এক্রোভেট এম জেড ২ গ্রাম + সিকিউর ১ গ্রাম (প্রতি লিটার পানিতে) অথবা,
-মেলোডি ডুও ১ গ্রাম + এক্রোভেট এম জেড ২ গ্রাম (প্রতি লিটার পানিতে)।
(এখানে উল্লেখ্য যে, রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হলে আরো ঘন ঘন ঔষধ ছিটানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক না দেয়াই ভাল। আর যদি দিতেই হয় তাহলে প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম সাবানের গুড়া পাউডার যোগ করে নিতে হবে। ছত্রাকনাশক ভালভাবে ছিটাতে হবে যাতে পাতার নিচে ও উপরে ভালভাবে ভিজে যায়। এ ক্ষেত্রে সাধারন স্প্রেয়ারের পরির্বতে পাওয়ার স্প্রেয়ার ভাল ফল দেয়।) - মাটি ভেজা অবস্থায় কিংবা বৃষ্টির পর পর আলু না তুলে শুকনা অবস্থায় মাটিতে ‘জো’ এলে আলু তুলতে হবে।
- হিমাগারে আলু রাখার আগে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বীজ বাছাই করতে হবে, যাতে কোনভাবে রোগাক্রান্ত আলু সুস্থ বীজের সাথে না থাকে।
- রোগাক্রান্ত গাছ দিয়ে আলুর স্তুপ বা পাতার উপরে স্প্রে
- পাতার নিচে স্প্রে সংগৃহীত আলু ঢেঁকে রাখা যাবে না।
- আলুর মৌসুমে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করতে হবে।
- মেটালেক্সিল গোত্রের ছত্রাকনাশকের বিরুদ্ধে ফাইটোপথোরা ইনফেসট্যান্স এর নতুন রেস তৈরি হওয়ায় এখন থেকে ঐ গোত্রের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
- আক্রান্ত জমি হতে বীজ আলুু সংগ্রহ করা যাবে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কীটনাশক ব্যবহারের পূর্বে স্প্রেকারীকে অবশ্যই এপ্রোন, হাত মোজা, সানগ্লাস ও মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। তাছাড়াও বাতাসের অনুকূলে সব সময় স্প্রে করতে হবে।
(২) ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ আলুর আর একটি মারাত্মক সমস্যা। র্যালসটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
- এ রোগে গাছ সাধারণত সবুজ অবস্থায়ই ঢলে পড়ে। গাছের একটি শাখা বা এক অংশও ঢলে পড়তে পারে।
- কান্ডের নিম্নাংশ ও শিকড় অক্ষত থাকে। কান্ডের ভিতরে পরিবহন কলায় বাদামী বর্ণের উপস্থিতি, ঢলে পড়া রোগের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ যা কান্ড চিরলে স্পষ্ট দেখা যায়।
- আক্রান্ত গাছের কান্ড কেটে পরিষ্কার পানিতে খাড়া করে রাখলে কিছুক্ষণ পর দুধের মতো সাদা উজ (Ooze) বের হয়। সংগৃহীত আলুর চোখে সাদা পুঁজের মতো দেখা যায় এবং আলু অল্প দিনের মধ্যেই পচে যায়।
- বীজ আলুর ক্ষেত্রে একরপ্রতি যদি ১টি গাছ আক্রান্ত হয় তাহলে সেই মাঠ হতে বীজ আলু কখনই সংগ্রহ করা যাবে না।
রোগের অনুকূল আবহাওয়া:
- আলুর ঢলে পড়া রোগ প্রধানত তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। সাধারনত ২৮-৩০ক্ক সে তাপমাত্রা এ রোগের জন্য সবচেয়ে অনুকূল।
- তবে নিম্ন তাপমাত্রায় আলুর কান্ডে ও টিউবারে এই জীবাণুু সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০-৯০% এ রোগের বৃদ্ধির জন্য খুবই সহায়ক।
রোগের উৎস ও বিস্তার:
- এই ব্যাকটেরিয়া মাটিতে ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া ঢলে পড়া রোগাক্রান্ত কান্ডের কিংবা আক্রান্ত আলুতে বেঁচে থাকে। এ ছাড়াও রোগাক্রান্ত আলু গাছ ভিতরের অংশ ফসলের পরিত্যক্ত অংশ ও বিকল্প পোষকেও বেঁচে থাকতে পারে।
- মাটিতে বৃষ্টি ও সেচের পানি, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষকের পায়ের মাটি, চারা সংলগ্ন মাটি ইত্যাদি দিয়েও এই জীবাণুুর বিস্তার হতে পারে।
- এই জীবাণু মাটিতে ৩০ সেমি থেকে ৭৫ সেমি গভীরতা পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে বা শস্যাবশেষের মধ্যে বেঁচে থাকে।
- সাধারণত আলু গাছের শিকড়ে জীবাণুুর আক্রমণের সূচনা হয়ে থাকে। অনেক সময় আলুতে এ রোগের ঢলে পড়া রোগের পরীক্ষালক্ষণ সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং বাহির থেকে ঢলে পড়া রোগের ব্যাকটেরিয়া (র্যালসটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম) সাদা উজ নির্গমন আক্রমণের কোন লক্ষণ বুঝা যায় না।
রোগের প্রতিকার ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা:
এই রোগ দমন করা বেশ কষ্টসাধ্য, কেননা এই জীবাণু মাটিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং যার অনেক বিকল্প পোষক আছে। তবে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি অবলম্বন করলে ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ অনেকাংশে কমানো যায়।
- প্রত্যায়িত অথবা রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ আলু চাষের ক্ষেত্রে কাটা বীজ লাগানো পরিহার করতে হবে।
- আলু লাগানোর সময় জমিতে সর্বশেষ চাষের পূর্বে প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ কেজি হারে ষ্ট্যাপল ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। বপনের পর যত শীঘ্র সম্ভব গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
- পরিমিত মাত্রায় সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ আলুসহ আশেপাশের মাটি দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রান্ত জায়গায় ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। সেচের প্রয়োজন হলে আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে সেচ দিতে হবে। আশে পাশের গাছও এভাবে বাছাই করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে পরবর্তীতে আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, তামাক ইত্যাদি জাতীয় ফসল চাষ করা যাবে না।
- গম, ধান, ভুট্টা, কাউন, বার্লি, সরগাম, পেঁয়াজ, রসুন, কপি, গাজর ইত্যাদি ফসল দিয়ে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। বীজ আলু জমিতে ভুট্টা দ্বারা আন্ত:ফসল চাষ করলে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কম হয়।
- গ্রীষ্মকালে কয়েকবার জমি চাষ করে প্রখর রৌদ্রে মাটি শুকিয়ে নিতে হবে এতে মাটিতে অবস্থিত রোগ জীবাণুু অনেক কমে যায়।
- এ রোগ দেখা মাত্র আক্রান্ত জমিতে সেচ প্রদান, নিড়ানী দেওয়া, মালচিং ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে।
- আলু লাগানোর পূর্বে জমিতে ধান থাকলে সে ধানের নাড়া শুকিয়ে মাটিতে বিছিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। এতে মাটির রোগ জীবাণু অনেকাংশে কমে যায়।
- যে জমি সব সময় ভেজা বা স্যাঁত স্যাঁতে থাকে সে জমিতে বীজ আলু কখনই চাষ করা যাবে না। কারণ ভেজা জমিতে ব্যাকটেরিয়ার উপদ্রব বেশি হয়।
(৩) আলুর দাঁদ রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- আলুর দাঁদ রোগ বর্তমানে আলুর একটি মারাত্মক রোগ হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত আলু কখনই বীজ আলু হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
- ষ্ট্রেপ্টোমাইসিস ষ্কেবিজ নামক জীবাণুর আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। দাঁদ রোগে আলুর টিউবারের উপরে উঁচু অমসৃণ বিভিন্ন আকারের বাদামী খস্খসে দাগ পড়ে।
- আক্রমণ বেশি হলে পুরো টিউবারই দাগে ভরে যায় এবং দাঁদ রোগে আক্রান্ত আলু অনেক সময় দাগগুলো দেবে যায়। রোগের আক্রমণ সাধারণত ত্বকেই সীমাবদ্ধ থাকে।
অনুকূল আবহাওয়া ও রোগের উৎস:
- উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা এ রোগ বিস্তারে সহায়ক।
- এ রোগটি বীজ ও মাটি বাহিত। কোন পোষক গাছ ছাড়াই এ রোগের জীবাণু মাটিতে পাঁচ (৫) বছরের অধিক কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
- সাধারণত গাছে টিউবার আসার সময় কম পক্ষে ৩০ দিন পর্যন্ত যদি জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকে অথবা আলু গাছের বয়স ৬৫ দিন পর যদি জমিতে অতিরিক্ত রস থাকে তাহলে এ রোগটি বেশি হয়।
- বিভিন্ন প্রকার ফসল যেমন মূলা, গাজর, শালগমে এই রোগের জীবাণু বহুদিন বেঁচে থাকে।
রোগের প্রতিকার ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- বীজ আলু বোল্ড স্টোরেজ হতে সংগ্রহের পরে স্প্রাউটিং এর পূর্বে প্রোভেক্স-২০০ (০.২%) বা ডাইথেন এম-৪৫ (০.২% দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
- সেচের তারতম্যের কারণে অনেক সময় দাঁদ রোগের সূচনা হয়। দাঁদ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আলু লাগানের ৩০-৩৫ দিন পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই মাটিতে রসের যেন ঘাটতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আলুর টিউবার ধারণের সময় ৩৫-৫৫ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। আলু উত্তোলনের আগে মাটিতে বেশি রস থাকলে আলু দাঁদ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। গাছের বয়স ৭০ দিনের পর সেচ বন্ধ করতে হবে।
- বীজ আলু চাষের পূর্বে জমিতে সবুজ সার চাষ করতে হবে।
- শস্য পর্যায়ে জমিতে গম বা ডাল জাতীয় ফসল চাষ করতে হবে।
- সুষম সার (জৈব ও অজৈব) ব্যবহার করতে হবে।
(৪) আলুর স্টেম ক্যাঙ্কার বা স্কার্ফ রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- আলুর স্কার্ফ রোগও আলুর একটি ক্ষতিকারক রোগ। রাইজোকটনিয়া প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। কৃষক পর্যায়ে একে রাইজোকটনিয়া রোগ বলে।
- এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো কান্ডের সাথে ছোট ছোট সবুজ টিউবার দেখা যায়। বড় গাছের গোড়ার দিকে কান্ডে লম্বা কালো বর্ণের দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
- অনেক ক্ষেত্রে গাছে বেশি শাখা প্রশাখা দেখা দেয় এবং পাতা ভাইরাসের মত হালকা মোড়ানো দেখা যায়। গাছের কান্ড তুলনামূলকভাবে শক্ত হয়ে যায়, কান্ডে গিঁট মোটা হয়ে যায় ও কান্ড সহজেই মট করে ভেঙে যায়।
- আক্রান্ত আলুতে কালো কালো উঁচু দাগ পড়ে এবং বীজ হিসেবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
অনুকূল আবহাওয়া ও রোগের উৎস:
উচ্চ তাপমাত্রা এবং জমির উচ্চ আর্দ্রতা এ রোগ বিস্তারে সহায়ক। এ রোগটি বীজ ও মাটি বাহিত এবং প্রাথমিক উৎস আক্রান্ত বীজ।
রোগের প্রতিকার ও দমন ব্যবস্থাপনা:
- প্রত্যায়িত অথবা রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- ভালোভাবে অঙ্কুরিত বীজ আলু রোপণ করতে হবে।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- বীজ আলু মাটির বেশি গভীরে রোপণ পরিহার করতে হবে।
- প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম প্রোভেক্স ২০০ অথবা, অটোস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- রোগের আক্রমণ বেশি হলে অটোস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- কখনও জমিতে অতিরিক্ত পানি দেয়া যাবে না।
(৫) আলুর কালো পা রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- আলুর কালো পা বীজ আলুর একটি প্রধান রোগ। আরউইনিয়া কেরোটোভোরা নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
- মাঠে ও সংরক্ষিত আলুতে এ রোগ দেখা দেয়।
- মাঠে গাছের গোড়ায় কালো দাগ পড়ে বলে কালো পা এবং সংরক্ষণাগারে টিউবার আক্রান্ত হলে নরম পচা রোগ বলে।
- আক্রান্ত গাছের কান্ডের গোড়ার দিকে বাদামী থেকে কালো রঙের দাগ পড়ে এবং যা সহজেই সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।
- আক্রান্ত ডাল তুলে নাকের কাছে ধরলে এক ধরনের পচা আলুর মতো গন্ধ পাওয়া যায়। আক্রান্ত গাছের আলু পচে যায়।
অনুকূল আবহাওয়া ও রোগের উৎস:
উচ্চ তাপমাত্রা এবং জমির উচ্চ আর্দ্রতা এ রোগ বিস্তারে সহায়ক। এ রোগটি বীজ ও মাটি বাহিত।
রোগের প্রতিকার ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা:
- প্রত্যায়িত অথবা রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- অতিরিক্ত সেচ পরিহার করতে হবে।
- উচ্চ তাপ এড়ানোর জন্য আগাম চাষ করতে হবে।
- আলুর কালো পা রোগে আক্রান্ত গাছ
- ভালভাবে বাছাই করে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে হবে।
- আলু লাগানোর সময় জমিতে সর্বশেষ চাষের পূর্বে প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ কেজি হারে স্টেপল ব্লিচিং পাউডার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বপনের পর যত শীঘ্র সম্ভব গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
- স্টেপল ব্লিচিং পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অথবা বোরিক এসিড প্রতি লিটার হালকা গরম পানিতে ৩০ গ্রাম দ্রবণে টিউবার শোধন করে বীজ আলু সংরক্ষণ করতে হবে।
- রোগ দেখা মাত্র পানি সেচ বন্ধ করতে হবে। আলুর কালো পা রোগে আক্রান্ত গাছ আলুসহ আশেপাশের মাটি দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রান্ত জায়গায় ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। সেচের প্রয়োজন হলে আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে সেচ দিতে হবে। আশে পাশের গাছও এভাবে বাছাই করতে হবে।
(৬) আলুর শুকনো পচা রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- ফিউজেরিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
- আলুর গায়ে কিছুটা গভীর বাদামী চক্রাকার দাগ পড়ে।
- আলুর ভিতরে গর্ত হয়ে যায়।
- প্রথম পচন যদিও ভিজা থাকে পরে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়।
- আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়।
রোগের প্রতিকার:
- আলু বাছাই করে এবং যথাযথ কিউরিং করে আলু গুদামজাত করতে হবে।
- যান্ত্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ টিউবার ব্যবহার করা যাবে না। আগাম বপন করা এবং আগাম সংরক্ষণ করা।
- বস্তা, ঝুড়ি ও গুদামঘর ইত্যাদি ৫% ফরমালিন দিয়ে শোধন করতে হবে।
(৭) আলুর ভিতরের কালো দাগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
ভিতরের কালো দাগ সাধারনত হিমাগারে অক্সিজেন এর অভাব হলে এ রোগ দেখা দেয় এবং আলুর গুণাগুণ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার:
- বীজ হিমাগারে ২.২-৩.৫ক্কপ তাপমাত্রা সবসময় বহাল রাখতে হবে।
- হিমাগারে বাতাস চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে।
- তাছাড়া, আলুর বস্তা প্রতি মাসে অন্তত একবার উল্টাতে হবে।
(৮) ভিতরে ফাঁপা রোগ ও তার প্রতিকার
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগে আলুর ভিতরের অংশ ফাঁপা হয়ে যায়।
- জমিতে সাধারনত পানির অভাব হলে হঠাৎ সেচ প্রয়োগের ফলে টিউবার অতিরিক্ত বড় আকার ধারণ করলে এ রোগ হতে পারে।
রোগের প্রতিকার:
- নিয়মিত সেচ প্রয়োগে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- জমির মাটির নমুনা পরীক্ষা করে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট এর ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে।
[সূত্র: বিএআরআই]