আলুর ভাইরাস রোগ আলুর ফলন কম হওয়ার অন্যতম কারণ। আমাদের বাংলাদেশের কৃষকরা এই রোগ সম্পর্কে সচেতন নয় বিধায় ভাইরাস আক্রান্ত আলু বছরের পর বছর ব্যবহার করে। ফলে কৃষক দ্বারা উৎপাদিত আলুর ফলন অত্যন্ত কম।
আলুর ভাইরাস রোগসমূহের মধ্যে আলুর পাতা মোড়ানো (PLRV), আলুর ভাইরাস ওয়াই (PYV), আলুর ভাইরাস এক্স (PVX) এবং আলুর ভাইরাস এস (PVS) এ দেশের জন্য প্রধান। এই সমস্ত ভাইরাস এককভাবে অথবা যৌথভাবে আলু গাছ আক্রমণ করে।
সাধারণভাবে ভাইরাস আক্রান্ত আলু গাছ আকারে ছোট, পাতা কোঁকড়ানো, হলুদ অথবা মোজাইকের রং হয় এবং খসখসে হয় যা সহজেই নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে কৃষক সুস্থ গাছ থেকে ভাইরাস আক্রান্ত আলু গাছ আলাদা করতে পারবে।
ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হলে আলুর আকার ছোট হয় এবং আলুর উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
ভাইরাসসমূহ জাব পোকা এবং স্পর্শের মাধ্যমে গাছ থেকে গাছে ছড়ায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া আলুর এই ভাইরাস রোগসমূহের বাহক জাব পোকা (Aphids) বংশ বিস্তারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
রোগমুক্ত বীজ আলু উৎপাদনের জন্য আলুর ভাইরাস রোগসমূহ চেনা কৃষকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে প্রধান কয়েকটি ভাইরাস রোগের লক্ষণ ও দমন সন্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
(১) আলুর পাতা মোড়ানো ভাইরাস রোগ
লক্ষণ:
- জাব পোকার মাধ্যমে আলুর এই ভাইরাস গাছ থেকে গাছে ছড়ায়।
- এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো আক্রান্ত গাছের পাতা উর্ধ্বমুখী হয়ে উপরের দিকে গুটিয়ে যায়।
- দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণ হলে নিচের পাতা খসখসে, খাড়া ও উপরের দিকে গুটানো হয়।
- কখনও কখনও পাতার কিনারা শুকিয়ে সুস্থ আলুর গাছ পাতা মোড়ানো ভাইরাস রোগে আক্রান্ত গাছ যায়।
- গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় ফলে গাছ খাটো ও খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
- এ রোগে আক্রান্ত হলে শতকরা ৪০-৮০% উৎপাদন হ্রাস পায় এবং আলুর আকার ছোট হয়।
অনুকূল আবহাওয়া ও রোগের উৎস:
- এ রোগটি আক্রান্ত বীজ আলু ও জাব পোকার সাহায্যে ছড়ায়।
- সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে জাব পোকার দ্রুত বংশ বৃদ্ধির সাথে সাথে এ রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
- ধুতুরা, ফোসকা বেগুন ইত্যাদি এ রোগের বিকল্প পোষক হিসেবে কাজ করে।
(২) আলুর ওয়াই ভাইরাস রোগ
লক্ষণ:
- পাতা মোড়ানো ভাইরাসের পরই আলুর ওয়াই ভাইরাস এর স্থান।
- এ রোগে ক্ষতির পরিমাণ ৯৫% পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং আলুর আকার অত্যন্ত ছোট হয়।
- এ রোগ জাব পোকা এবং স্পর্শ দুই ভাবেই বিস্তার লাভ করে।
- আক্রান্ত গাছের পাতার শিরায় কালচে দাগ, পাতা মরে যেয়ে গাছে ঝুলে থাকা, গাছ বেটে ও কুঁকড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ।
- আবার অনেক সময় পাতায় মৃদু মোজাইক লক্ষণও দেখা যায়।
রোগের বিস্তার ও বিকল্প পোষক:
- প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত বীজ আলু এবং পরবর্তীতে জাবপোকা, জমিতে কাজ করার কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির স্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
- টমেটো, বথুয়া ইত্যাদি এ রোগের বিকল্প পোষক।
(৩) আলুর এক্স ভাইরাস রোগ
লক্ষণ:
- আলুর ওয়াই ভাইরাসের পরই আলুর এক্স ভাইরাসের স্থান।
- এ রোগে ৫-১৫% ফলন কমতে পারে। যা একটি মারাত্মক স্পর্শক রোগ।
- গাছে এ রোগের লক্ষণ কদাচিৎ মোজাইক, হলদেভাব, ছোট পাতা, মরা বা থুবড়ে যাওয়া পাতা দেখা যায়।
- এ রোগের ফলে গাছ ও টিউবার ছোট হয়ে যায়।
রোগের বিস্তার ও বিকল্প পোষক:
মরিচ, টমেটো, বথুয়া, ধুতুরা, তামাক ইত্যাদি এ ভাইরাসের বিকল্প পোষক হিসাবে কাজ করে।
(৪) আলুর এস ভাইরাস
লক্ষণ:
- আলুর এস ভাইরাসের লক্ষণ বোঝা বেশ কঠিন।
- কোন কোন জাতে এ রোগে পাতার উপরে শিরা গভীর হয়ে যায়, পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে ঝরে যেতে পারে, এক্স ভাইরাস আক্রান্ত আলু গাছ অনেক সময় পাতা খসখসে হয় এবং পাতায় মরা দাগ পড়ে।
- এ ভাইরাসের আক্রমণেও আলুর আকার ছোট হয়ে যায়।
রোগের উৎস ও বিস্তার:
আক্রান্ত বীজ আলু, জাব পোকা এবং স্পর্শের সহায্যে এ রোগের বিস্তার ঘটে।
(৬) মিশ্র ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত আলু গাছের বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ
আলু গাছ যখন পরিপক্কতার দিকে যায় তখন সাধারণত একই গাছে একাধিক ভাইরাস আক্রমণ করে। মিশ্র/যৌথ ভাইরাস আক্রান্ত পাতাও কোঁকড়ানো ও খসখসে হয় এবং এতে কাল দাগ পড়ে জটিল লক্ষণ দেখা যায়। একাধিক ভাইরাস আক্রান্ত গাছেও আলু আকারে ছোট হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
লক্ষণ:
- আলু গাছ যখন পরিপক্কতার দিকে যায় তখন সাধারণত একই গাছে একাধিক ভাইরাস আক্রমণ এস ভাইরাসে আক্রান্ত আলু গাছ করে।
- যৌথ ভাইরাস আক্রান্ত পাতাও কোঁকড়ানো ও খসখসে হয় এবং এতে কাল দাগ পড়ে জটিল লক্ষণ দেখা যায়।
- একাধিক ভাইরাস আক্রান্ত গাছেও আলু আকারে ছোট হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
(৭) আলুর ভাইরাস রোগের প্রতিকার ও সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা
- ভাইরাসমুক্ত প্রত্যায়িত বীজ আলু ব্যবহার করতে হবে।
- আগাম জাতের আলু চাষ যা নভেম্বরের ২৫ তারিখের (১১ কার্তিক) মধ্যে করতে হবে এবং আগাম সংগ্রহ করতে হবে।
- জমি আগাছা মুক্ত করতে হবে। জমির আশে পাশের বিকল্প পোষক গাছ যেমনটমেটো, তামাক, মরিচ, ধুতুরা, বথুয়া, ফোসকা বেগুন ইত্যাদি থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে।
- সারিতে ভালোভাবে মাটি উঁচু করে দিতে হবে।
- আলু গজানোর সাথে সাথে (২০-২৫ দিন বয়স হতে) নিয়মিতভাবে ভাইরাস আক্রান্ত গাছ রোগিং অর্থাৎ আলু সহ তুলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
- জাব পোকা দমনে ইমিডাক্লোরোপিড গোত্রের কীটনাশক যেমন- এডমায়ার (০.৫ মি.লি./লিটার পানিতে) অথবা, ম্যালাথিয়ন (২ মি.লি./লিটার পানিতে) ১০-১৫ দিন পর পর জমিতে নিয়মিত ভাবে স্প্রে করতে হবে।
- আলু গাছের বয়স ৮০ দিন হলে হামপুলিং (আলু গাছ শিকড়সহ তুলে ফেলা) করতে হবে এবং এরপর কমপক্ষে ৮-১০ দিন আলু জমিতে মাটির নিচে রেখে দিতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]
সুন্দর।