(১) স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট (মুসুর গাছের পাতা ঝলসানো রোগ)
স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট বাংলাদেশে বর্তমানে মসুরের সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ। ১৯৮৬ সালে এ রোগ সর্ব প্রথম শনাক্ত করা হয়। এর পর থেকে ঢাকা জেলাসহ দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এর প্রকোপ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণভাবে সমগ্র বাংলাদেশে এর আক্রমণ লক্ষ করা গেছে।
স্টেমফাইলিয়াম বোট্রায়সাম নামক একটি ছত্রাক জাতীয় জীবাণু এ রোগের কারণ।
এ রোগের রোগচক্র খুব বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে জীবাণু ছত্রাকটি বায়ু প্রবাহ দ্বারা পরিবাহিত হয়। বীজের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিকভাবে পরিবাহিত হওয়ারও কোন নিদর্শন বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আক্রান্ত ফসলের অবশিষ্টাংশ থেকে এরাগ ছড়ায়।
এ রোগের আক্রমণের ফলে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে বলে গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়।
ক) রোগের লক্ষণ
- রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাতার উপর হালকা বাদামী বা শুকনা খড়ের রঙের পিনের মাথা বরাবর সাইজের ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। এই দাগগুলো আকারে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ পাতাটি আক্রান্ত হয়ে ঝরে পড়ে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন শাখার অগ্রভাগও আক্রান্ত হয় এবং শুকিয়ে মরে যায়।
- আক্রমণের প্রকোপ বেশি হলে সমগ্র ফসলের মাঠটি ঝলসানো রং ধারণ করে। তবে ফলগুলি তখনও সবুজ থেকে যায়।
খ) দমন ব্যবস্থাপনা
- এ ক্ষতিকর রোগটি দমনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডাল গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদগণ বিভিন্ন প্রকার গবেষণা ও অনেক পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এসব পরীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায় রোভরাল-৫০ ডব্লিউ পি অথবা ফলিকূর ২৫০ ইসি অথবা দুটি ঔষুধের মিশ্রণ ০.২% হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর অন্তর তিন থেকে চারবার হালকা রোদ্রোজ্জ্বল সকালে (৯-১০ টা) স্প্রে করলে এই রোগের অনিষ্ট থেকে ফসল রক্ষা করা যায়।
- এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত মসুরের উন্নত জাত বারি মসুর-৮ এ, এ রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। উক্ত জাতটি আবাদ করলে এ রোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করে ক্ষতির মাত্রা বহুলাংশে কমানো যায়।
(২) মসুর গাছের গোড়া পচা রোগ
গোড়া পচা মসুরের একটি ক্ষতিকর রোগ। মসুর আবাদকারী অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ রোগের যথেষ্ট প্রকোপ রয়েছে।
গোড়া পচা রোগটি মূলত একটি চারা আক্রমণকারী রোগ। ইহা সাধারণত এক মাস বা তার চেয়ে কম বয়সের চারাকে আক্রমণ করে।
এই রোগটি স্কে্লরোশিয়াম রল্ফছি (Sclerotium rolfsii) নামক ছত্রাকের আক্রমণের কারণেই হয়ে থাকে। এই ছত্রাক জীবাণু প্রধানত মাটিতেই অবস্থান করে।
ক) রোগের লক্ষণ
- অতি অল্প বয়সে আক্রান্ত হলে চারা হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে মারা যায় এবং নেতিয়ে পড়া চারা শুকিয়ে খড়ের রং ধারণ করে এবং পরিশেষে তা অদৃশ্য হয়ে যায়।
- বয়স্ক চারা আক্রান্ত হলে আক্রান্ত অংশে সুতার মত ছত্রাকের মাইসিলিয়াম এবং সরিষার বীজের মত স্কে্লরোশিয়াম লক্ষ্য করা যায়। গাছের মূল এবং শিকড় আক্রান্ত হলে প্রাথমিক অবস্থায় গাছের আকার বামুন বা খর্বাকৃতির হয় এবং পরিশেষে গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়।
খ) দমন ব্যবস্থাপনা
- গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায় যে সাধারণত যে সকল জমির মাটিতে বপনের প্রারম্ভে স্বাভাবিক অবস্থার (জো অবস্থা) চেয়ে বেশি রস থাকে সেই সকল জমিতে গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। সুতরাং বপনের সময় জমিতে যাতে অতিরিক্ত রস না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- এছাড়া বিভিন্ন ছত্রাক নাশক দিয়ে বীজ শোধন করেও এ রোগ দমনের প্রচেষ্ট নেয়া যায়। এ সমস্ত ছত্রাক নাশকের মধ্যে প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউ @ ২.৫-৩.০ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে এ রোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।
- এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে অটোস্টিন-৫০ ডব্লিউ পি নামক ঔষধ ০.২ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ হতে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করলে এরোগ অনেকাংশে দমন করা যায়।
- এভাবে দমন করা সম্ভব না হলে পরবর্তী বছর শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
(৩) মসুরের মরিচা রোগ
মরিচা রোগ ইউরোমাইসিস ফেবেই নামক এক প্রকার ছত্রাক জাতীয় জীবাণুর আক্রমণে হয়ে থাকে। মসুরের বেশি ক্ষতিকর রোগসমূহের অন্যতম। তবে রোগের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ফসলের অবস্থার উপর নির্ভর করে।
যদি ফুল আসার সাথে সাথে আক্রমণ শুরু হয় তা হলে ক্ষতির পরিমাণ হয় অনেক বেশি। পক্ষান্তরে ফল পরিপক্কতার পরে আক্রান্ত হলে কম ক্ষতি হয়। কিন্তু আক্রমণের মাত্রা কম বেশি হওয়া নির্ভর করে আবহাওয়া এবং জমিতে গাছের ঝোপের পরিমাণের উপর।
ঘন ঝোপ যুক্ত জমিতে যেখানে ঝোপের অভ্যন্তরে বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ থাকে এবং বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ২০-২২০ সেলসিয়াস সে স্থান এ রোগের আক্রমণের জন্য খুবই উপযোগী।
রোগের আক্রমণকারী ছত্রাক মসুর গাছেই তার জীবনচক্র পরিপূর্ণ করে। বীজের সাথে মিশ্রিত আক্রান্ত গাছের অংশ বিশেষের সহিত জীবাণু পরবর্তী বৎসর প্রাথমিক আক্রমণের উৎস হিসাবে বাহিত হয়ে থাকে।
ক) রোগের লক্ষণ
- সাধারণত জমির যে অংশ গাছের ঘনত্ব বেশি এবং বৃদ্ধি বেশি সে অংশে সর্ব প্রথম রোগের আক্রমণ শুরু হয়। পাতা কান্ড, শাখা-প্রশাখা এবং ফলের উপর হলুদ বা মরিচা রঙের ফোস্কা পড়া দাগ দেখা দেয়। পরে এই ফোস্কাগুলি গাঢ় বাদামী বা কাল রং ধারণ করে। আক্রমণের প্রকোপ বেশি হলে পাতা ঝরে যায় এবং পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছগুলো শুকিয়ে যায়। দূর থেকে তাকালে ফসল ধূসর বর্ণের দেখায়।
- সাধারণত দেশের দক্ষিণাংশে জানুয়ারি মাস শেষ হওয়ার পূর্বে এবং উত্তরাংশে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে এ রোগের আক্রমণ শুরু হয়।
খ) দমন ব্যবস্থাপনা
- বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭ এবং বারি মসুর-৮ জাতটি মরিচা রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। ইহা সাধারণত ১১০-১১৫ দিনের মধ্যে পাকে। এ জাতটি যদি দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে এবং উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন করা যায় তাহলে এরোগের আক্রমণ থেকে ফসলকে বাঁচানো যায়।
- স্বাভাবিক ঊর্বর জমিতে জৈব সার কিংবা নাইট্রোজেন সার দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আক্রান্ত গাছের অংশ বিশেষের সাথে এ রোগের জীবাণু বাহিত হয় বিধায় বীজ ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিলে আক্রমণের প্রাথমিক উৎস নির্মূল করা যায়। এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ হতে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
(৪) মসুর গাছের ঢলে পড়া রোগ
ঢলে পড়া বা নেতিয়ে পড়া মসুরের একটি ক্ষতিকর রোগ। মসুর আবাদকারী অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও এ রোগের যথেষ্ট প্রকোপ রয়েছে।
বাংলাদেশে এ রোগটি সর্ব প্রথম শনাক্ত করা হয় ১৯৭৭সালে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর খামারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন থানার কৃষকের মাঠে এরোগের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।
আক্রান্ত গাছের নমুনা ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, ইহা একটি ছত্রাকজনিত রোগ এবং আক্রমণকারী ছত্রাক হল ফিউসারিয়াম অক্সিস্পোরাম নামক একটি জীবাণু। এই ছত্রাক জীবাণু প্রধানত মাটিতেই অবস্থান করে তবে কখনও ইহা বীজের মাধ্যমে বিস্তার ঘটায় বলেও জানা যায়। এরোগের কারণে ফসলের শতকরা কতভাগ ক্ষতি হতে পারে ইহার পরিমাণ বাংলাদেশের অবস্থায় নির্ণয় করা হয় নাই।
ক) রোগের লক্ষণ
- চারা গজিয়ে উপরে উঠার আগে ও পরে উভয় অবস্থায়ই রোগের লক্ষণ শনাক্ত করা যায়।
- পূর্বেই বলা হয়েছে যে এরোগের জীবাণু ছত্রাক বীজের মাধ্যমে বাহিত হয়ে বিস্তার লাভ করতে পারে। আক্রান্ত বীজ অঙ্কুরিত হলে অঙ্কুর বাদামী রং ধারণ করে এবং চারা মাটির উপরে বের হওয়ার পূর্বেই মারা যায়। চারা অবস্থায় মাটিতে থাকা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে চারার বৃদ্ধি থেমে যায় এবং গাছের নিচের দিক থেকে ক্রমশ উপরের দিকে পাতা হলুদ রং ধারণ করে বেকে যায়। চারার আগা নেতিয়ে পড়ে এবং চারা মারা যায়।
- বয়স্ক গাছ আক্রান্ত হলেও মোটামুটি একই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এছাড়াও আক্রান্ত গাছের শিকড় হলুদাভ বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী রং ধারণ করে। তবে আক্রান্ত শিকড়ের উপর ফুটরট বা গোড়া পচা রোগের অনুরূপ কোন ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়াম দেখা যায় না।
- কম বয়সের চারার শিকড়ের অগ্রভাগ আক্রান্ত হলে শিকড়ের নিচের অংশ নষ্ট হয়ে যায়। মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ রস থাকলে আক্রান্ত শিকড়ের উপরের অংশে গুচ্ছ আকারের নতুন শিকড় গজায়। ঢলে পড়া রোগ আক্রান্ত গাছের শিকড় বা মূল লম্বালম্বিভাবে চিরলে লম্বা কালো বা গাঢ় বাদামী রঙের ডোরা দাগ দেখা যায়।
খ) দমন ব্যবস্থা
- এরোগের দমন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গোড়া পচা রোগের অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
- রাসায়নিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে এ রোগ দমনের চেষ্টা করা যেতে পারে। অটোস্টিন এবং থিরাম নামক ঔষধ একত্রে (১ঃ১ অনুপাতে) শুকনা বীজের সাথে ০.২৫% হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে এ রোগ উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়।
- আবাদ কৌশলে বা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও এ রোগ দমনের চেষ্টা করা যায়। উপযুক্ত সময়ে বপন করে যেমন দেশের মধ্য দক্ষিণাঞ্চলে অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে এবং উত্তারাঞ্চলে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বপন করলে এরোগের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কম হতে দেখা যায়।
- এছাড়া বপনের সময় জমির মাটিতে যাতে “জো” অবস্থার চেয়ে বেশি রস না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ মাটিতে অতিরিক্ত রস থাকা অবস্থায় বপন করলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
- এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে অটোস্টিন ২ গ্রাম/প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ হতে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
- এসব ব্যবহারের পরেও যদি এরাগের আক্রমন থাকে তাহলে পরবর্তী বছর শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
(৫) মসুরের জাবপোকা
জাবপোকা মসুরের পাতা, কান্ড, পুষ্পমঞ্জুরী ও ফলে আক্রমণ করে থাকে এবং সেখান থেকে রস চুষে খায়।
ক) রোগের লক্ষণ
মারাত্মক আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন ব্যাহত হয়।
খ) দমন ব্যবস্থা
মারাত্মক আক্রমণে ডায়মেথয়েট জাতীয় কীটনাশক (যেমন- টাফগর ৪০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]