Skip to content

সরিষা চাষের পদ্ধতি, সময়, সারপ্রয়োগ এবং সরিষার গাছের রোগ ও পোকার প্রতিকারসহ

সরিষা চাষের পদ্ধতি, সময়, সারপ্রয়োগ এবং সরিষার গাছের রোগ ও পোকার প্রতিকারসহ

(১) সরিষা চাষের পদ্ধতি, সময় ও সারপ্রয়োগের নিয়মনীতি বর্ণনা

ক) মাটি

সরিষা বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে।

খ) জমি তৈরি

জমির প্রকারভেদে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। জমির চারপাশে নালার ব্যবস্থা করলে পরবর্তীকালে সেচ দিতে এবং পানি নিকাশে সুবিধা হয়।

গ) বপন পদ্ধতি

সরিষা বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বোনা হয়। সারি করে বুনলে সার, সেচ ও নিড়ানী দিতে সুবিধা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি রাখতে হবে। বপনের সময় জমিতে বীজের অঙ্কুরোদগমের উপযোগী রস থাকতে হবে।

বিভিন্ন প্রকার সরিষার দানা
বিভিন্ন প্রকার সরিষার দানা

ঘ) সরিষা চাষের সময়

বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির ‘জো’ অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭ ও বারি সরিষা-১৮ এর বীজ মধ্য-আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস (অক্টোবর থেকে নভেম্বর) পর্যন্ত বোনা যায়।

বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে নভেম্রব) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।

বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির ‘জো’ অবস্থা অনুসারে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৩ ও বারি সরিষা-১৬ জাতের বীজ কার্তিক মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) বপনের উপযুক্ত সময়।

ঙ) সারের পরিমাণ

জাত, মাটি ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হয়।

সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) নিম্নরূপ:

সারের নামসোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩ ও ১৬টরি-৭, কল্যাণীয়া,রাই-৫, দৌলতবারি সরিষা-৯, ১৪, ১৫, ১৭ ও ১৮
ইউরিয়া২৫০-৩০০২০০-২৫০
টিএসপি১৭০-১৮০১৫০-১৭০
এমওপি৮৫-১০০৭০-৮৫
জিপসাম১৫০-১৮০১২০-১৫০
জিংক সালফেট৫-৭৪-৫
বরিক এসিড (প্রয়োজনবোধে)১০১০
পচা গোবর৮০০০-১০০০০৮০০০-১০০০০

চ) সরিষা চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি

ইউরিয়া সার অর্ধেক ও অন্যান্য সার বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার উপরি প্রয়োগের সময় মাটিতে রস থাকা দরকার।

See also  সরিষা কোন মাটিতে ভালো হয়? সরিষা চাষ পদ্ধতি ও বিঘা প্রতি সরিষার ফলন

ছ) বীজের হার

  • টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৭ এবং বারি সরিষা-১৭ এর জন্য প্রতি হেক্টরে ৬-৭ কেজি বীজ লাগে।
  • রাই ও দৌলত সরিষার জন্য প্রতি হেক্টরে ৭-৮ কেজি বীজের প্রয়োজন।

জ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা

বীজ বপনের ১০-১২ দিন পর এক বার এবং ফুল আসার আগে ২০-২৫ দিন দ্বিতীয় বার নিড়ানী দিতে হয়।

ঝ) সেচ প্রয়োগ

  • সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১২, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬ ও বারি সরিষা-১৭ উফশী জাতসমূহে পানি সেচ দিলে ফলন বেশি হয়।
  • বীজ বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।
  • বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে একটি হালকা সেচ দিতে হয়।

ঝ) ফসল সংগ্রহ

টরি জাতীয় সরিষা ৭০-৯০ দিন এবং রাই জাতীয় সরিষা ৯০-১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়।

ঞ) বীজ সংরক্ষণ

  • মাড়াই করার পর রোদে শুকানো বীজ গরম অবস্থায় সংরক্ষণ করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোদে শুকানো বীজ ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের পাত্রে, টিনে বা ড্রামে রেখে মুখ এমনভাবে বন্ধ করতে হবে যেন পাত্রের ভিতরে বায়ু প্রবেশ করতে না পারে।
  • সংরক্ষণের জন্য বীজ ভর্তি পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা বাঞ্ছনীয়। বীজসহ পাত্র আর্দ্রতা কম এমন ঘরের শীতল স্থানে রাখলে ১ বছর এমনকি ২ বছর পর্যন্ত বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে।

(২) সরিষার গাছের রোগ ও পোকার প্রতিকার

ক) সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ দমন

অলটারনেরিয়া ব্রাসিসি নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।

See also  পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন পদ্ধতি

প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নিচে বয়স্ক পাতায় এ রোগের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে এ ছত্রাকের আক্রমণে গাছের পাতা, কান্ড ও ফলে চক্রাকার কালচে দাগের সৃষ্টি হয়।

আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। ফলে সরিষার ফলন খুব কমে যায়।

সরিষার পাতা ঝলসানো ও শুঁটি রোগের লক্ষণ
সরিষার পাতা ঝলসানো ও শুঁটি রোগের লক্ষণ

প্রতিকার:

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের সরিষার চাষ করতে হবে।
  • রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
  • বীজ বপনের পূর্বে প্রোভেক্স-২০০ ডাব্লিউপি ছত্রাকনাশক দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
  • এ রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোভরাল-৫০ ডাব্লিউপি ০.২% হারে (প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম) পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।

খ) পরজীবী উদ্ভিদজনিত রোগ দমন

সরিষার পরজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অরোবাংকিই প্রধান।

সরিষা গাছের শিকড়ের সাথে এ পরজীবী উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপন করে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। এর ফলে পরজীবী আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।

সরিষার পরজীবী উদ্ভিদ অরোবাংকি
সরিষার পরজীবী উদ্ভিদ অরোবাংকি

এটি এক প্রকার সপুষ্পক পরজীবী উদ্ভিদ এবং এর বংশবৃদ্ধি সরিষা গাছের উপর নির্ভরশীল।

অরোবাংকির বীজ মাটিতেই অবস্থান করে। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে অরোবাংকির উৎপত্তি ও বিস্তার ঘটে। বারবার একই জমিতে সরিষা পরিবারের ফসল চাষ করলে এ পরজীবীর বিস্তার ঘটে।

প্রতিকার:

  • ফুল আসার পূর্বে পরজীবী উদ্ভিদ জমি হতে তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
  • পরিমিত হারে টিএসপি সার ব্যবহার করতে হবে।
  • পূর্বে এ রোগ আক্রান্ত জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে।
  • আগাছানাশক যেমন ২, ৪-ডি ছিটিয়ে পরজীবী উদ্ভিদ দমন করতে হবে।

গ) সরিষার কান্ড পচা রোগ দমন

এটি বীজ ও মাটি বাহিত রোগ।

বাড়ন্ত গাছে ফুল ধরার সময় আক্রমণ বেশি দেখা যায়। আক্রমণের স্থলে সাদা তুলার মতো মাইসেলিয়াম দেখা যায়। ফলে গাছ পচে মারা যায়। আক্রান্ত গাছের কান্ড চিরলে কালো রঙের স্কেলেরোশিয়া দেখা যায়।

সরিষার কান্ড পচা রোগ
সরিষার কান্ড পচা রোগ

তাপমাত্রা (১৫-১৮০ সে.) ও আর্দ্রতা (৮০-৯০%) আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিকার:

  • বপনের পূর্বে প্রোভেক্স-২০০ এর মাধ্যমে বীজ শোধন করতে হবে (২.৫ গ্রাম/কেজি বীজ)।
  • রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল ২.০ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩ বার (বৃদ্ধি পর্যায়ে, ফুল ও পড ধরার পর্যায়) প্রয়োগ করলে সরিষার কান্ড পচা রোগ দমন হয়।
See also  সরিষার জাত কী কী? সরিষার জাতের নাম ও পরিচিতি

ঘ) সরিষার জাব পোকার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা

জাব পোকা সরিষার পাতা, কান্ড, পুষ্পমঞ্জুরী, ফুল ও ফল থেকে রস চুসে খায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পাতা কুকড়ে যায়, ফুল ও ফল ধারণ বাঁধাগ্রস্ত হয়। আক্রান্ত ফল কুচকে ছোট হয়ে যায়।

সরিষার জাব পোকা আক্রমণের লক্ষণ
সরিষার জাব পোকা আক্রমণের লক্ষণ

সাধারণত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল ও ফল আসার সময় আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এদের আক্রমণে শতকরা ৩০-৮০ ভাগ ফলন কমে যায়।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনা:

  1. স্বল্প মেয়াদী জাত (বারি সরিষা-৯, ১৪, ১৫ ও ১৭) নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন করা।
  2. আক্রমণ দেখা মাত্র ৫০ গ্রাম নিম বীজ ভেঙ্গে ১ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে ২-৩ গ্রাম গুঁড়া সাবান মিশিয়ে ছেকে ৭ দিন অন্তর ২ বার ছিটাতে হবে।
  3. আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ২ মিলি বা এডমায়ার ২০০ এম এল ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকাল ৩ টার পর ১০ দিন অন্তর ২ বার ছিটাতে হবে।

ঙ) সাধারণ কাটুই পোকা

সাধারণ কাটুই পোকা বিগত কয়েক বছর ধরে সিরাজগঞ্জের চলনবিল এলাকায় এবং দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের জেলাসমূহে সরিষার ফসলে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষতিসাধন করছে।

এ পোকা তেল, ডাল জাতীয় শস্য, সবজি ইত্যাদির চারা অবস্থায় গোড়া কেটে ও পাতা খেয়ে প্রচুর ক্ষতি করে।

ক্ষতির ধরন:

  • এদের কীড়া সরিষার গাছের চারা অবস্থা থেকে শুরু করে পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল পেটুকের মতো খেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে।
  • দিনে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে, রাতে লক্ষ লক্ষ কীড়া দলবদ্ধভাবে ফসলে আক্রমণ করে খেয়ে ক্ষতি করে।
  • সাধারণত চারা অবস্থায় ও গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে এদের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
  • ডিসেম্বর-জানুয়ারি হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত সরিষা গাছে আক্রমণ হয়ে থাকে।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনা:

  1. আলোর ফাঁদ দ্বারা মথ ধরে মারা যায়।
  2. প্রাথমিক অবস্থায় এ পোকার কীড়া দলবদ্ধভাবে একটি গাছের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। তখন হাত দ্বারা পাতাসহ কীড়া সংগ্রহ করে মেরে দমন করা যায়।
  3. আক্রান্ত ক্ষেতে বিঘাপ্রতি ৮/১০টি ডাল পুঁতে দিলে পোকাভোজী পাখি কীড়া খেয়ে পোকা দমন করতে পারে।
  4. আক্রমণ বেশি হলে রিপকার্ড- ১০ ইসি বা ডারসবান-২০ ইসি ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষেতে ১০ দিন অন্তর ২ বার স্প্রে করে পোকা দমন করা যায়।
  5. ফসল বপনের পর ফাঁদ (Sex pheromone) ব্যবহার করলে প্রচুর সংখ্যক পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদে পড়ে মারা যায়।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts