(১) করলার জাতের নাম ও পরিচিতি
ক) বারি করলা-১
- ফল গাঢ় সবুজ রঙের।
- ফল লম্বায় ১৭-১৮ সেমি এবং ব্যাস ৪-৫ সেমি।
- প্রতি ফলের গড় ওজন ১০০ গ্রাম এবং গাছপ্রতি প্রায় ৩৫-৪০টি ফল ধরে।
- চারা রোপণের ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে প্রথম ফল তোলা যায়।
- ফলন গড়ে ২৪-২৭ টন/হেক্টর।
খ) বারি করলা-২
- এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত।
- গাঁঢ় সবুজ রং ও মাঝারী আকারের (৯৮ গ্রাম) ফল।
- ফলের গায়ে প্রচুর ছোট ছোট চোখা আঁচিলের মতো বৃদ্ধি (wart) এবং কাটা spine দেখা যায়।
- গাছ প্রতি গড় ফলের সংখ্যা ৩৮ টি এবং গড় ফলন প্রায় ২০-২২ টন/হেক্টর।
গ) বারি করলা-৩
- এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত।
- সবুজ রং ও মাঝারী আকারের (৭৭ গ্রাম) ফল।
- ফলের গায়ে অল্প কিছু ছোট ছোট ভোতা আঁচিলের মতো বৃদ্ধি (wart) দেখা যায়
- গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৪৫টি এবং গড় ফলন প্রায় ২০-২২ টন/হেক্টর।
ঘ) বারি করলা-৪
বারি করলা-৪ জাতটি চাষাবাদের জন্য ২০১৮ সালে অবমুক্ত করা হয়। এ জাত টি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। এ জাতের জার্মপ্লাজম World Vegetable Center, থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
- এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত।
- গাছে গাড় সবুজ রং এর মধ্যম আকারের ফল ধরে।
- প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ১০৫-১১০ গ্রাম।
- গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৩৫-৪০ টি।
- ফল লম্বায় ১৫-২০ সেমি এবং ব্যাস ৪-৫ সেমি।
- চারা রোপণের ৫৫-৬০ দিন পর প্রথম ফল তোলা যায়।
- জীবনকাল ১০০-১২০ দিন।
- সারা বাংলাদেশে এ জাতটি চাষ উপযোগী।
- মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফালগুন মাস পর্যšত বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
- করলার এ জাতটি পাউডারি মিলডিউ রোগের প্রতি সহনশীল।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ২১-২৫ টন হয়।
ঙ) বারি হাইব্রিড করলা-২
বারি হাইব্রিড করলা -২ জাতটি চাষাবাদের জন্য ২০১৯ সালে মুক্তায়িত করা হয়। এ জাতটি দুইটি প্যারেন্ট লাইনের মধ্যে সংকরায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। এর একটি প্যারেন্ট লাইনের জার্মপ্লাজম World Vegetable Center, থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
- এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত।
- গাছে আকর্ষণীয় গাড় সবুজ বর্ণের মাঝারী আকারের ফল ধরে।
- গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৪৩-৪৫ টি।
- প্রতি ফলের গড় ওজন প্রায় ১৪১ গ্রাম।
- গাছ প্রতি ৫.৫-৫.৭ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
- ফল লম্বায় ১৮-১৯ সেমি এবং ব্যাস ৪-৫ সেমি।
- ভালভাবে চাষাবাদের ব্যবস্থা করলে বীজবপনের ৫০-৫৫ দিন পর প্রথম ফল তোলা যায়।
- জীবনকাল ১০০-১২০ দিন।
- মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফালগুন মাস পর্যন্ত বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
- জাতটি ভাইরাস ও কিউকারবিট পাউডারী মিলডীউ রোগের প্রতি সহনশীল এবং সারা বছর চাষ উপযোগী।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩৫-৩৭ টন হয়।
চ) বারি হাইব্রিড করলা-৩
বারি হাইব্রিড করলা-৩ জাতটি ২০১৯ সালে চাষাবাদের জন্য মুক্তায়িত করা হয়। এ জাতটি দুইটি প্যারেন্ট লাইনের মধ্যে সংকরায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। এর একটি প্যারেন্ট লাইনের জার্মপ্লাজম World Vegetable Center, থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
- করলার এই জাতটি একটি উচ্চফলনশীল জাত।
- গাছে আকর্ষণীয় সবুজ বর্ণের মাঝারী আকারের ফল ধরে।
- ফলের নীচের দিকে হালকা সাদাটে রং হয়।
- গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৩৫-৩৭ টি।
- ফলের গড় ওজন প্রায় ১১৩ গ্রাম।
- গাছ প্রতি ৪.২-৪.৪ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
- ফল লম্বায় ১৫-১৬ সেমি ও এর ব্যস ৪-৫ সেমি।
- ভালভাবে চাষাবাদের ব্যবস্থা করলে বীজবপনের ৫০-৫৫ দিন প্রথম পর ফল তোলা যায়।
- জীবনকাল ১০০-১২০ দিন।
- মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফালগুন মাস পর্যন্ত বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়।
- জাতটি কিউকারবিট পাউডারী মিলডীউ রোগের প্রতি সহনশীল এবং গ্রীষ্মকালে চাষ উপযোগী।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ২৪-২৫ টন হয়।
(২) করলা চাষের পদ্ধতি বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
- উচ্চ আর্দ্র আবহাওয়ায় করলা ভাল জন্মে। পরিবেশগত ভাবে এটি একটি কষ্ট সহিষ্ণু উদ্ভিদ। মোটামুটি শুষ্ক আবহাওয়ায় এটি জন্মানো যায়, তবে বৃষ্টিপাত-এর জন্য খুব ক্ষতিকর নয়। তবে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পরাগায়ণ বিঘ্নিত হতে পারে। তাই শীতের দু’ এক মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় করলা জন্মানো যায়।
খ) উৎপাদন মৌসুম
- বছরের যে কোন সময় করলার চাষ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে প্রধানত খরিফ মৌসুমেই করলার চাষ হয়ে থাকে।
- ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে যে কোন সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। কেউ কেউ জানুয়ারি মাসেও বারি হাইব্রিড করলা-২ বীজ বুনে থাকেন কিন্ত এ সময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না, ফলে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না। পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে আশাব্যাঞ্জক ফলন পাওয়া যায়।
গ) বীজের হার
করলার জন্য হেক্টরপ্রতি ৬-৭ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
মাঠে বপনের আগে করলা বীজ ১% KNO3 (পটাশিয়াম নাইট্রেট) অথবা ১% বরিক এসিড অথবা পানিতে ১৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজের সুপ্ততা হ্রাস পায় এবং অঙ্কুরোদগম হার বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বীজের হার কম লাগে এবং কৃষেেকর উৎপাদন খরচ কম হয়।
ঘ) মানসম্মত করলার বীজ উৎপাদনে বপন সময়ের প্রভাব
করলা একটি দিবস নিরপেক্ষ উদ্ভিদ হলেও বাংলাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ সবজিটি গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়ে থাকে।
শীতকালে এর বীজ গজানোর হার কমে যায় এবং বাড়-বাড়তিও কমে যায়, ফলে ফলের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং বীজ উৎপাদন কমে যায়।
অন্যদিকে দেরিতে বপন করলে গাছের বাড়-বাড়তি ভাল হলেও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে পরাগায়ণ ব্যাহত হয়। ফলশ্রুতিতে ফলন কমে যায়। তাছাড়া বৃষ্টিপাতের দরুণ বীজ শুকাতে বিলম্ব হয় এবং এতে বীজের মান কমে যায়।
২০২০ সালের একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গাজীপুর অঞ্চলে ফেব্রুয়ারি মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে বীজ বপন করলে বারি করলা-১ এর গাছপ্রতি ফলন ১৬-১৮টি এবং বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ১৮০-১৯০ কেজি হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এ সময়ে বীজ বপন করলে উৎপাদিত বীজের মানও অধিকতর ভাল হয়ে থাকে। বীজ গজানোর হার ৮৫% এর অধিক হয়ে থাকে।
ঙ) জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি
- খরিফ মৌসুমে করলার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পানি জমার সম্ভাবনা নেই।
- বসতবাড়িতে করলার চাষ করতে হলে দু’চারটি মাদায় বীজ বুনে গাছ বেয়ে উঠতে পারে এমন ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয় যাতে শিকড় সহজেই ছাড়াতে পারে।
- জমি বড় হলে নির্দিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বায় কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হয়।
- বেড়ের প্রশস্ততা হবে ১.০ মিটার এবং দু’ বেডের মাঝে ৬০ সেমি নালা থাকবে।
- করলার বীজ সরাসরি মাদায় বোনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন করতে হবে অথবা পলিব্যাগে (১০-১৫ সেমি) ১৫-২০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করে নেওয়া যেতে পারে।
চ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ
করলার জমিতে হেক্টর ও শতাংশ প্রতি নিম্নে বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
সার | সারের পরিমাণ (হেক্টরে) | সারের পরিমাণ (শতাংশে) | জমিতে গর্ত তৈরির সময় দেয় (হেক্টরে) | জমিতে গর্ত তৈরির সময় দেয় (শতাংশে) | ২০ দিন পর/মাদা (হেক্টরে) | ২০ দিন পর/মাদা (শতাংশে) | ৪০ দিন পর/মাদা (হেক্টরে) | ৪০ দিন পর/মাদা (শতাংশে) | ৬০ দিন পর/মাদা (হেক্টরে) | ৬০ দিন পর/মাদা (শতাংশে) |
গোবর | ১০ টন | ৪০ কেজি | সব | ৪০ কেজি | – | – | – | – | – | – |
ইউরিয়া | ১৭৩ কেজি | ৭০০ গ্রাম | – | – | ৫৮ কেজি | ২৩৩ গ্রাম | ৫৮ কেজি | ২৩৩ গ্রাম | ৫৭ কেজি | ২৩৩ গ্রাম |
টিএসপি | ১৭৩ কেজি | ৭০০ গ্রাম | সব | ৩৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
এমপি | ১৪৮ কেজি | ৬০০ গ্রাম | ৭৪ কেজি | ৩০০ গ্রাম | ২৫ কেজি | ১০০ গ্রাম | ২৫ কেজি | ১০০ গ্রাম | ২৪ কেজি | ১০০ গ্রাম |
জিপসাম | ৯৯ কেজি | ৪০০ গ্রাম | সব | ৪০০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
জিঙ্ক সালফেট | ১২ কেজি | ৫০ গ্রাম | সব | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
বোরিক এসিড | ১০ কেজি | ৪০ গ্রাম | সব | ৪০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট | ৪০ গ্রাম | ১৬০ গ্রাম | সব | ৮০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
ছ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- চারা লাগানোর থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয় বলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না।
- সেচের পর জমিতে চটা রাঁধলে গাছেল শিকড়াঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যহত হয়। কাজেই প্রত্যেক সেচের পর গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। পানির অভাবে প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়, পরবর্তীতে ফুলও ঝরে যায়।
- চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মি উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে।
জ) ফসল সংগ্রহ
স্ত্রী ফুলের পরাগায়ণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুমাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
[সূত্র: বিএআরআই]