স্কোয়াশ মূলত একটি শীতকালীন সবজি।
এটি দেখতে অনেকটা শশার মত বা বাঙ্গির মতো লম্বা ও সবুজ। মিষ্টি কুমড়ার মতো এক ধরণের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। এটি সবুজ ও হলুদ দুই ধরনের রঙের হয়ে থাকে।
এই সবজির আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়ায়। যারা পূর্ণ নাম জুকিনি স্কোয়াশ, এটিকে কোর্জেট নামেও ডাকা হয়।
স্কোয়াশ বাংলাদেশে একটি নতুন সবজি। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সবজির চাষাবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে কম উর্বর জমিতে এবং চরাঞ্চলে জুকিনির চাষাবাদ বেশি হচ্ছে। দেশের অন্য অঞ্চলে এই জুকিনির রয়েছে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ভাল সম্ভাবনা। ভারতে চাষাবাদ হচ্ছে এরকম কয়েকটি জাতের মাঝে zucchini (Cucurbita pepo) একটি জনপ্রিয় জাত।
- স্কোয়াশ আবাদের সুবিধা অল্প সময়ে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ফসল উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ কুমড়া লাগানো যায়, তার চেয়ে দ্বিগুণ স্কোয়াশ লাগানো সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক একটি স্কোয়াশ গাছ অল্প জায়গা দখল করে।
- স্কোয়াশের একেকটি গাছের গোড়ায় আট থেকে ১০টি পর্যন্ত ফল বের হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই খাওয়ার উপযোগী হয় এটি।
- স্কোয়াশে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ আছে। এর পাতা ও কাণ্ড সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। সামার স্কোয়াশ তরকারি ও ভাজি হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে।
- যেহেতু এটি বিদেশি সবজি তাই বিদেশে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে কাজে লাগিয়ে, মানসম্পন্ন ভাবে স্কোয়াশ উৎপাদন করা গেলে, এই সবজিটি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জ করা সম্ভব।
এখানে স্কোয়াশ চাষ পদ্ধতি ও নিয়ম সমূহ তুলে ধরা হয়েছে।
(১) স্কোয়াশের জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য
বারি স্কোয়াশ-১:
- এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত।
- পরাগায়ণের পর থেকে মাত্র ১৫-১৬ দিনেই ফল সংগ্রহ করা যায়।
- নলাকার গাঢ় সবুজ বর্ণের ফল।
- গড় ফলের ওজন ১.০৫ কেজি।
- প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ৪৫ টন।
(২) স্কোয়াশ চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত বর্ণনা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- স্কোয়াশের জন্য উষ্ণ, প্রচুর সূর্যালোক এবং নিম্ন আর্দ্রতা উত্তম।
- চাষকালীন সময়ে অনূকুল তাপমাত্রা হলো ২০-২৫০ ডিগ্রি সে.। চাষকালীন সময়ে উচ্চ তাপমাত্রা ও লম্বা দিন হলে পুরুষ ফুলের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং স্ত্রী ফুলের সংখ্যা কমে যায়।
- জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ মাটি এর চাষাবাদের জন্য উত্তম। তবে চরাঞ্চলে পলিমাটিতে স্কোয়াশের ভালো ফলন হয়।
খ) বীজেরহার
প্রতি হেক্টরে ২-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
গ) বীজ বপন ও চারা উৎপাদন
- শীতকালে চাষের জন্য অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে বীজ বপন করা যায়।
- চারা নার্সারিতে পলিব্যাগে উৎপাদন করে নিলে ভাল হয়।
- বীজ বপনের জন্য ৮ x ১০ সেমি বা তার থেকে কিছুটা বড় আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা যায়।
- প্রথমে অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে পলিব্যাগে ভরতে হবে।
- সহজ অঙ্কুরোদগমের জন্য পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা এক ভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে বীজ এক রাত ভিজিয়ে তারপর পলিব্যাগে বপন করতে হবে।
- প্রতিব্যাগে দুইটি করে বীজ বপন করতে হবে।
- বীজের আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বীজ পুঁতে দিতে হবে।
- বীজ সরাসরি মাদায়ও বপন করা হয়। সেক্ষেত্রে সার প্রয়োগ ও মাদা তৈরির ৪-৫ দিন পর প্রতি মাদায় ২-৩টি করে বীজ বপন করা যেতে পারে। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর ১টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। চারার বয়স ১৬-১৭ দিন হলে তা মাঠে প্রস্তুত মাদায় লাগাতে হবে।
ঘ) বেড তৈরি
- বেডের উচচতা ১৫-২০ সেমি ও প্রস্থ ১-১.২৫ মি এবং লম্বা জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে সুবিধামতো নিতে হবে। এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে।
- পাশাপাশি দুইটি বেডের মাঝ খানে ৭০ সেমি প্রশস্থ সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে।
ঙ) মাদা তৈরি
- মাদার ব্যাস ৫০-৫৫ সেমি, গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি এবং তলদেশ ৪৫-৫০ সেমি প্রশস্ত হবে।
- ৬০ সেমি প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা সংলগ্ন বেডের কিনারা হইতে ৫০ সেমি বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে ২ মিটার অন্তর অন্তর এক সারিতে মাদা তৈরি করতে হবে।
- প্রতি বেডে এক সারিতে চারা লাগাতে হবে।
চ) সারের মাত্রা ও প্রয়োগ প্রদ্ধতি (প্রতি শতাংশে ৬টি মাদা)
সারের নাম | মোট সারের পরিমাণ (হেক্টরপ্রতি) | মোট সারের পরিমাণ (শতাংশ প্রতি) | জমি তৈরির সময় (শতাংশ প্রতি) | মাদা প্রতি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে | মাদা প্রতি চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর | মাদা প্রতি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর | মাদা প্রতি চারা রোপণের ৫০-৫৫ দিন পর | মাদা প্রতি চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর |
পচা গোবর | ১০ টন | ৪০ কেজি | ১০ কেজি | ৫ কেজি | – | – | – | – |
টিএসপি | ১৭৫ কেজি | ৭০০ গ্রাম | ৩৫০ গ্রাম | ৬০ গ্রাম | – | – | – | – |
ইউরিয়া | ১৭৫ কেজি | ৭০০ গ্রাম | – | – | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম |
এমওপি | ১৫০ কেজি | ৬০০ গ্রাম | ২০০ গ্রাম | ৫০ গ্রাম | ২৫ গ্রাম | – | – | – |
জিপসাম | ১০০ কেজি | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
দস্তা সার | ১২.৫ কেজি | ৫০ গ্রাম | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
বোরাক্স | ১০ কেজি | ৪০ গ্রাম | ৪০ গ্রাম | – | – | – | – | – |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট | ৪০ কেজি | ১৬০ গ্রাম | – | ২৫ গ্রাম | – | – | – | – |
ছ) চারার বয়স
বীজ গজানোর পর ১৬-১৭ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর জন্য উত্তম।
জ) চারা রোপণ
- মাঠে প্রস্তুত মাদাগুলোর মাটি ভালোভাবে ওলট-পালট করে, কোদালের এক কোপ দিয়ে চারা লাগানোর জন্য জায়গা করে নিতে হবে।
- অতঃপর পলিব্যাগের ভাঁজ বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটির দলাসহ চারাটি উক্ত জায়গায় লাগিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে।
- চারা লাগানোর পর গর্তে পানি দিতে হবে।
- পলিব্যাগ সরানোর সময় এবং চারা রোপণের সময় সাবধান থাকতে হবে যাতে চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং মাটির দলা না ভাঙ্গে। নতুবা শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে ঢলে পড়া রোগের (ফিউজেরিয়াম উইল্ট) জীবাণু ঢুকবে এবং শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হলে গাছের বৃদ্ধি দেরিতে শুরু হবে।
ঝ) সেচ দেওয়া
- স্কোয়াশ ফসল পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। কাজেই সেচ নালা দিয়ে প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
- জমিতে কখনও সমস্ত জমি ভিজিয়ে প্লাবন সেচ দেয়া যাবে না। শুধুমাত্র সেচ নালায় পানি দিয়ে আট্কে রাখলে গাছ পানি টেনে নিবে। প্রয়োজনে সেচ নালা হতে ছোট কোন পাত্র দিয়ে কিছু পানি গাছের গোড়ায় সেচে দেওয়া যায়।
- শুষ্ক মৌসুমে ৫-৭ দিন অন্তর সেচ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ঞ) মালচিং
- প্রত্যেক সেচের পর হালকা খড়ের মালচ্ করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- আগাছা অনেক রোগের আবাস স্থল। এছাড়াও আগাছা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয়। কাজেই চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সবস ময়ই আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
ট) বিশেষ পরিচর্যা
- সাধারণত স্কোয়াশ উৎপাদনের জন্য ১৬-২৫০ সে. তাপমাত্রা ও শুষ্ক পরিবেশ সবচেয়ে উপযোগী। রাতের তাপমাত্রা ১৭-২১ ডিগ্রি সে. এর কম বা বেশি হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, ফুল ঝরে পড়ে ও ফলন কমে যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই ফলন হয়না।
- অক্টোবর মাসে বীজ বপন করে নভেম্বরে লাগালে দেখা যায় যে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারি পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, ফলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এজন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনি বা গ্লাস হাউসে গাছ লাগালে রাতে ভিতরের তাপমাত্রা বাহির অপেক্ষা বেশি থাকে।
ট) ফসল তোলা (পরিপক্কতা সনাক্তকরণ)
- সাধারণত বীজ বপন বা চারা রোপণের ৩০ দিন থেকে ৪০ দিনের ভিতর গাছ থেকে ফুল এসে ফল ধরা শুরু হয়।
- ফল পরাগায়ণের ১০-১৫ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। তখনও ফলে সবুজ রঙ থাকবে এবং ফল মসৃণ ও উজ্জ্বল দেখাবে। নখ দিয়ে ফলের গায়ে চাপ দিলে নোখ সহজেই ভিতরে ঢুকে যাবে।
- এছাড়াও ফলের বোঁটা খয়েরী রঙ ধারণ করে ধীরে ধীরে গাছ মরতে শুরু করলে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ঠ) রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা
স্কোয়াসের চাষ করতে নিম্ন পোকান্ডমাকড় ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনা করাতে হয়। যথা-
- স্কোয়াসের হোয়াইট মোল্ড রোগ
- স্কোয়াসের এনথ্রাকনোজ রোগ
- স্কোয়াশ বাগ পোকা
- স্কোয়াশের সাদা মাছি পোকা
- স্কোয়াশের ভাইন বোরার পোকা
- স্কোয়াশের লাল বিটল পোকা
- স্কোয়াশের পাউডারী মিলডিউ রোগ
ইত্যাদি।
আমাদের বাংলাদেশের সম্মানিত কৃষকগণ নতুন এই সুস্বাদু সবজিটির রপ্তানি বাড়াতে, রোগমুক্ত ও মানসম্মত সবজি উৎপাদন করে দেশের ও নিজের অর্থনৈতিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
[সূত্র: বিএআরআই]