দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে অনেক দেশের ন্যায় সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারি ড্রাগন ফল-১’ নামে ড্রাগন ফলের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
(১) ড্রাগন ফলের জাত পরিচিতি
বারি ড্রাগন ফল-১:
- নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- বারি উদ্ভাবিত ড্রাগন ফলের জাতটি সুস্বাদু এবং এ থেকে প্রচুর সংখ্যক ফল আহরণ করা যায়।
- ফলের আকার বড় (৩৭৫.১১ গ্রাম), পাকা ফলের খোসা লাল।
- শাঁস গাঢ় গোলাপী রঙের, রসালো এবং টিএসএস ১৩.২২%।
- খাদ্যোপযোগী অংশ ৮১%।
- বীজসমূহ খুব ছোট কালো ও নরম।
- ফলে বেটা কেরোটিন ১২.০৬ মিলিমাইক্রো গ্রাম/১০০ গ্রাম এবং ভিটামিন সি ৪১.২৭ মি. গ্রাম/১০০ গ্রাম থাকে।
- তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৯ থেকে ১৫টি এবং ফলন ৩.২২ কেজি/গাছ/বছর এবং ২০.৬ টন/হেক্টর/বছর।
(২) ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা
ক) বংশ বিস্তার
অঙ্গজ উপায়ে অথবা বীজের মাধ্যমে ড্রাগন ফলের বংশ বিস্তার হয়ে থাকলেও মাতৃ গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার কাম্য।
বীজ দিয়ে সহজে এ ফলের বংশ বিস্তার করা যেতে পারে। তবে এতে ফল ধরতে একটু বেশি সময় লাগে এবং হুবহু মাতৃ বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। সেজন্য কাটিং এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা উত্তম।
কাটিং এর সফলতার হার প্রায় শতভাগ এবং ফলও তাড়াতাড়ি ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত একটি গাছে ফল ধরতে ১২-১৮ মাস সময় লাগে।
- সাধারণত ছয় থেকে এক বছর বয়স্ক গাঢ় সবুজ শাখা হতে ২০ থেকে ৩০ সেমি লম্বা টুকরা কাটিং হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
- কাটিং ৫০ ভাগ পচা গোবর ও ৫০ ভাগ ভিটি বালুর মিশ্রণ দ্বারা পূর্ণ ৮ ⨉ ১০ ইঞ্চি আকারের পলি ব্যাগে স্থাপন করে ছায়া যুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে।
- ৩০ থেকে ৪৫ দিন পরে কাটিং এর গোড়া থেকে শিকড় এবং কান্ডের প্রান্ত থেকে নতুন কুশি বেরিয়ে আসবে। তখন এটা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হবে।
- তবে উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী কাটিংকৃত কলম সরাসরি মূল জমিতেও লাগানো যায়।
খ) জমি নির্বাচন ও তৈরি
- ড্রাগন ফল চাষের জন্য সুনিষ্কাশিত উঁচু ও মাঝারী উঁচু ঊর্বর জমি নির্বাচন করতে হবে।
- পর্যায়ক্রমিক কয়েকটি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে।
- মাদা তৈরির পূর্বে জমি থেকে বহুবর্ষজীবী আগাছা বিশেষ করে উলুঘাস সমূলে অপসারণ করতে হবে।
গ) রোপণ পদ্ধতি ও রোপণের সময়
- সমতল ভূমিতে বর্গাকার কিংবা ষড়ভুজাকার এবং পাহাড়ী জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে কাটিং ড্রাগন ফল রোপণ করতে হবে।
- কাটিং রোপণের পর হালকা ও অস্থায়ী ছায়ার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল।
- মধ্য এপ্রিল থেকে থেকে মধ্য অক্টোবর ড্রাগন ফল রোপণের উপযুক্ত সময়।
ঘ) মাদা তৈরি
- উভয় দিকে ২.৫-৩ মিটার দূরত্বে ১.৫ মিটার ⨉ ১.৫ মিটার ⨉ ১ মিটার আকারের গর্ত করে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখতে হবে।
- গর্ত তৈরির ২০-২৫ দিন পর প্রতি গর্তে ২৫-৩০ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ১৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট সার গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে।
- মাটিতে রসের অভাব থাকলে পানি সেচ দিতে হবে।
- গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ৫০ সে.মি. দূরত্বে ৪টি ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করতে হবে।
- চারা রোপণের ১ মাস পর থেকে ১ বছর পর্যন্ত ৩ মাস অন্তর প্রতি গর্তে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) চারা রোপণ ও পরিচর্যা
- গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ৫০ সেমি দূরত্বে ৪ টি চারা সোজাভাবে গর্তের মাঝখানে লাগিয়ে চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হবে।
- রোপণের পরপরই পানি সেচ দিতে হবে। এরপর নিয়মিত পানি সেচ ও প্রয়োজনে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- ড্রাগন ফলের গাছ লতানো এবং ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ জন্য গাছের সাপোর্টের জন্য চারা চরটির মাঝখানে ৪ মিটার লম্বা সিমেন্টের খুটি এমনভাবে পুতে দিতে হবে যাতে করে মাটির উপরে ৩ মিটার অবশিষ্ট থাকে।
- চারা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে নারিকেলের রশি দিয়ে সিমেন্টের খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছ বড় হলে কান্ড থেকে শিকড় বের হয়ে খুঁটিকে আকড়ে ধরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।
- প্রতিটি খুঁটির মাথায় একটি মটর সাইকেলের পুরাতন টায়ার মোটা তারের সাহায্যে আটকিয়ে দিতে হবে এবং গাছের মাথা ও অন্যান্য ডগা টায়ারের ভিতর দিয়ে বাহিরের দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এইরূপ ঝুলন্ত ডগায় ফল ধরার পরিমাণ বেশি হয়।
চ) গাছে সার প্রয়োগ
বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও কাঙ্খিত ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
- উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে ফেব্রুয়ারি, জুন ও অক্টোবর মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
- সার প্রয়োগের পর প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে।
বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হলো।
গাছের বয়স | মাদাপ্রতি গোবর সার (কেজি) | মাদাপ্রতি ইউরিয়া (গ্রাম) | মাদাপ্রতি টিএসপি (গ্রাম) | মাদাপ্রতি এমওপি (গ্রাম) |
১-৩ | ৪০-৫০ | ৩০০ | ২৫০ | ২৫০ |
৩-৬ | ৫০-৬০ | ৩৫০ | ৩০০ | ৩০০ |
৬-৯ | ৬০-৭০ | ৪০০ | ৩৫০ | ৩৫০ |
১০ এর উর্দ্ধে | ৭০-৮০ | ৫০০ | ৫০০ | ৫০০ |
ছ) আগাছা দমন
গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমিকে আগাছামুক্ত রাখা দরকার, বর্ষার শুরুতে ও বর্ষার শেষে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে আগাছা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
জ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
- ড্রাগন ফল গাছ খরার ও জলাবদ্ধতার প্রতি খুব সংবেদনশীল।
- চারার বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে ১০-১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে।
- ফলন্ত গাছের বেলায় সম্পূর্ণ ফুল ফোটা পর্যায়ে একবার, ফল মটর দানার মত হলে একবার এবং এর ১৫ দিন পর আর এক বার মোট তিনবার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
- সার প্রয়োগের পর সেচ দেয়া ভাল।
- বর্ষার সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি না জমে থাকে তার জন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- এ ছাড়া ফুল আসার ৬-৮ সপ্তাহ আগে সামান্য পানির কষ্ট/পীড়ন দিলে আগাম ও অধিক ফুল ফুটতে দেখা যায়।
ঝ) প্রুনিং ও ট্রেনিং
- ড্রাগন ফল দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মোটা শাখা (ডগা) তৈরি করে।
- একটি এক বছরের গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে এবং ৪ বছর বয়সী একটি ড্রাগন ফলের গাছ ১৩০টি পর্যন্ত প্রশাখা তৈরি করতে পারে। তবে শাখা-প্রশাখা উৎপাদন উপযুক্ত ট্রেনিং ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে।
- একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে।
- ফল সংগ্রহের পর ৪০-৫০ টি প্রধান শাখায় প্রত্যেকটিতে ১/২ টি সেকেন্ডারি শাখা অনুমোদন করা হয়। তবে এ ক্ষেতের টারসিয়ারি ও কোয়াটরনারি প্রশাখা কে অনুমোদন করা হয় না।
- ট্রেনিং এবং প্রুনিং এর কার্যক্রম দিনের মধ্য ভাগে করা ভালো।
- ট্রেনিং ও প্রুনিং করার পর অবশ্যই যে কোন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন প্রকার রোগ বালাই আক্রমণ করতে পারে।
ঞ) ফল সংগ্রহ ও ফলন
- গোলাকার থেকে ডিম্বাকার উজ্জ্বল গোলাপী থেকে লাল রঙের ফল। যার ওজন ২০০-৭০০ গ্রাম।
- এ ফলগুলো ৭-১০ সেমি চওড়া এবং ৮-১৪ সেমি লম্বা হয়।
- ভিতরের পাল্প সাদা, লাল, হলুদ ও কালো রঙের হয়। পাল্পের মধ্যে ছোট ছোট কালো নরম অনেক বীজ থাকে। এই বীজগুলো দাঁতের নিচে পড়লে সহজেই গলে যায়।
- এ ফলগুলো হালকা মিষ্টি। এর মিষ্টতা (টি.এস.এস./ব্রিক্স ১৬-২৪%) ফলগুলো দেখতে ড্রাগনের চোখের মতো রঙ ও আকার ধারণ করে।
- ফলটির সামনের শেষের দিকে হালকা গর্তের মতো থাকে। এ ফলের চামাড়ার উপরে আনারসের মতো স্কেল থাকে।
- পূর্ণ বয়স্ক একটি গাছে ২৫-৩০টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২০-২৫ টন।
ট) সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
- ড্রাগন ফল নন ক্লাইমেটারিক ফল হওয়ায় সংগ্রহোত্তর ইথিলিন উৎপাদন ও শ্বসনের হার কম থাকে। এই কারণে ফল পরিপক্ক অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়।
- সাধারণত ফল ও স্পাইনলেটের রঙ লালচে বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করতে হবে।
- অপরিপক্ক ফলে মিষ্টতা ও অন্যান্য গুণাবলী পরিপক্ক ফলের তুলনায় অনেক কম থাকে। ভাল বাজারমূল্য পাওয়ার জন্য ফল লালচে বর্ণ ধারণ করার ৫-৭ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা ভাল।
- গাছে ফল অতিরিক্ত পাকিয়ে সংগ্রহ করলে ফলের চাসরা ফেটে যেতে পারে এবং ফলের সংরক্ষণকাল ও স্বাদ কমে যায়। অধিক পরিপক্ক ফল খুব দ্রুত আর্দ্রতা হারায় এবং নষ্ট হতে থাকে।
[সূত্র: বিএআরআই]