(১) জলপাই এর জাত পরিচিতি
বারি জলপাই-১:
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারি জলপাই-১’ নামে একটি জাত উদ্ভাবন করেছে।
এর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-
- উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত।
- গাছ মধ্যম আকৃতির, ছড়ানো ও কিছুটা ঝোপালো।
- কার্তিক মাসের শেষার্ধ থেকে পৌষ মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়।
- ফল তুলনামূলকভাবে বড় (গড় ওজন ৪৬.৩৩ গ্রাম), পাকা ফলের রঙ হালকা সবুজ, শাঁস সাদা, এবং মধ্যম টক (টিএসএস ৬.২০%)।
- বীজ খুব ছোট, খাদ্যোপযোগী অংশ ৮৪.৯৯%।
- বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষযোগ্য।
- গাছপ্রতি ১,৯০০-২,০০০টি ফল ধরে যার গড় ওজন ১২৫ কেজি।
(২) জলপাই চাষ পদ্ধতি ও চারা/গাছ লাগানোর নিয়মসমূহ
ক) জমি নির্বাচন ও তৈরি
বন্যার পানি দাঁড়ায় না এমন ধরনের উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি জলপাইয়ের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
বাগান আকারে চাষ করার ক্ষেত্রে চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে জমি তৈরি করতে হবে।
দীর্ঘজীবী আগাছা বিশেষ করে উলু ঘাস সমূলে অপসারণ করতে হবে।
খ) বংশ বিস্তার
- বীজের মাধ্যমে সাধারণত বংশ বিস্তার করা হয়ে থাকে। বীজাবরণ খুব শক্ত বিধায় বীজ ২৪-৩০ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত হয়।
- বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় মাতৃ গাছের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে না এবং এতে ফল আসতেও অধিক সময় লাগে। পক্ষান্তরে কলমের চারায় মাতৃ গাছের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে এবং এতে তাড়াতাড়ি ফল আসে।
- সাধারণত ১২-১৩ মাস বয়সের আদিজোড়ের সাথে ৩-৪ মাস বয়সের উপজোড় ভিনিয়ার/ফাটল পদ্ধতিতে কলম করা হয়।
- ফেব্রুয়ারি-মার্চ বা মে- জুন মাস কলম করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
- এক বছর বয়সী সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
গ) চারা রোপণের সময়
মে-অক্টোবর মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা রোপণ করা যেতে পারে।
ঘ) গর্ত তৈরি
- কলম রোপণের অন্তত ১৫-২০ দিন পূর্বে ৭ মিটার ⨉ ৭ মিটার দূরত্বে ১ মিটার ⨉ ১ মিটার ⨉ ১ মিটার আকারের গর্ত করে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখতে হবে।
- কলম রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে গর্তপ্রতি ১৫-২০ কেজি পচা গোবর, ৩০০-৪০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০-৩০০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট সার গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রেখে দিতে হবে।
- মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ) চারা রোপণ ও পরিচর্যা
গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারাটি গর্তের ঠিক মাঝখানে এমনভাবে বসাতে হবে যেন চারার গোড়া ঠিক খাড়া থাকে এবং কোনভাবে আঘাত পাবার সম্ভাবনা না থাকে।
চারা রোপণের পরপর পানি দিতে হবে এবং খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর ১-২ দিন অন্তর পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চ) বেল গাছে সার প্রয়োগ
গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও কাঙ্খিত ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে।
বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ:
সারের নাম | গাছের বয়স ১-৪ (বছর) | গাছের বয়স ৫-১০ (বছর) | গাছের বয়স ১১-১৫ (বছর) | গাছের বয়স ১৫ এর উর্দ্ধে (বছর) |
গোবর (কেজি) | ১০-১৫ | ১৫-২০ | ২০-৩০ | ৩০-৪০ |
ইউরিয়া (গ্রাম) | ৩০০ | ৭৫০ | ১০০০ | ১২০০ |
টিএসপি (গ্রাম) | ৩০০ | ৪৫০ | ৯০০ | ১২০০ |
এমওপি (গ্রাম) | ৩০০ | ৪৫০ | ৬০০ | ৭৫০ |
জিপসাম (গ্রাম) | ১০০ | ২০০ | ২৫০ | ৩০০ |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
- উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি চৈত্র-বৈশাখ মাসে (ফল আহরণের পর), দ্বিতীয় কিস্তি ফল বাড়ন্ত পর্যায়ে (আষাঢ়-শ্রাবন মাসে) এবং শেষ কিস্তি আশ্বিন-কার্তিক মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
- সারগুলো একত্রে মিশিয়ে গাছের চারদিকে গোড়া থেকে ০.৫-১.০ মিটার জায়গা ছেড়ে দিয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত এলাকা পর্যন্ত ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর সার ছিটানো জায়গার মাটি কুপিয়ে সারগুলো মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর অবশ্যই সেচ দিতে হবে।
ছ) সেচ প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাশন
- যেহেতু জলপাই গাছ শুকনো আবহাওয়া ও খরা সহ্য করতে পারে, সেজন্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, মাটি ও গাছের বয়সের উপর ভিত্তি করে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
- শীতকালে ৪-৫ সপ্তাহ ও গরমকালে ২-৩ সপ্তাহ পর পর সেচ দিলে ভাল হয়।
- ফল ধরার পর কমপক্ষে দুবার সেচ দিতে হবে।
- বর্ষা মৌসুমে গাছের গোড়ায় যাতে জলবদ্ধতা না হয় সে জন্য দ্রুত পানি নিষ্কশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
জ) ফল সংগ্রহ
- বর্ষার প্রারম্ভে এপ্রিল-মে মাসে গাছে ফুল আসে এবং শীতের পূর্বে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফল পরিপক্ক হয়।
- পাকার পরও ফল সবুজ থাকে। তাই ফলের আকার বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে ফল সংগ্রহ করতে হবে।
- ডালপালায় ঝাকুনি দিয়ে ফল মাটিতে ফেললে ফল আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তবে গাছের নিচে জাল ধরে শাখায় ঝাকুনি দিয়েও ফল সংগ্রহ করা যায়।
- ভাল যত্ন নিলে পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে প্রতি বছর ২০০-২৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়।
(৩) জলপাই চাষে পুষ্টিজনিত সমস্যা
বোরনের অভাবে ফলের গায়ে দাদের মত খসখসে দাগ পড়ে। এত ফলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় এবং বাজার মূল্য হ্রাস পায়।
প্রতিকার:
- বর্ষার শেষের দিকে সার প্রয়োগের সময় গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম হারে বরিক এসিড বা ১০০ গ্রাম হারে বোরাক্স প্রয়োগ করতে হবে।
- ফলন্ত গাছে ০.২% হারে বরিক এসিড স্প্রে করলেও উপকার পাওয়া যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]