আমড়া একটি জনপ্রিয় ও উপাদেয় ফল। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির আমড়া পাওয়া যায়। যেমন, বিলাতি আমড়া (Golden apple) ও দেশি আমড়া (Hogplum)।
বিলাতি আমড়া দেশের প্রায় সব স্থানেই কম বেশি জন্মে তবে বরিশাল অঞ্চলে এর চাষ বেশি হয়।
আমড়া একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল। আমড়াতে প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে ৮৩ ভাগ পানি, ১.১ গ্রাম আমিষ, ১৫.০ গ্রাম শ্বেতসার, ০.১০ গ্রাম স্নেহ, ৮০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন, ০.২৮ মিলিগ্রাম থায়াসিন, ০.০৪ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লাবিন, ৯২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৫৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৩.৯ মিলিগ্রাম লৌহ থাকে।
বিলাতি আমড়া কাঁচা খাওয়া হয়। এটি খেতে টক-মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে।
বিলাতি এবং দেশি ২ ধরনের আমড়া থেকেই সুস্বাদু আচার, চাটনী ও জেলী তৈরি করা হয়।
(১) আমড়া ফলের জাত পরিচিতি
ক) বারি আমড়া-১ (বারমাসি আমড়া)
প্রায় সারা বছর ফল ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘বারি আমড়া-১’ একটি নতুন জাতের আমড়া। বিদেশ থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০০৩ সালে অবমুক্ত করা হয়।
- এ জাতের আমড়ায় মধ্য-ফাল্গুন (মার্চ-এপ্রিল) থেকে ফুল আসা আরম্ভ হয় এবং মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর) মাস পর্যন্ত ক্রমাগত ফুল আসে।
- মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মাস ব্যতিরেখে বছরের দশ মাসেই গাছে ফুল বা ফল পাওয়া যায়।
- ‘বারি আমড়া-১’ জাতের আমড়ায় ১ বছর বয়সের গাছে ফুল ও ফল আসতে দেখা যায় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফলন বৃদ্ধি পায়।
- এর গাছ বামন আকৃতির হয়।
- ফল ছোট (৬০ গ্রাম), ডিম্বাকার, দৈর্ঘ্য ৫.৫ সেমি, প্রস্থ ৪.৫ সেমি।
- ফলের শাঁস হালকান্ডসাদা, মধ্যম রসালো ও টক-মিষ্টি (টিএসএস ৭.০%)।
- ফলের খোসা পাতলা ও মসৃণ।
- বীজ ছোট, ভক্ষণযোগ্য অংশ ৭৩%।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-১৭ টন।
- দেশের সব এলাকায় চাষোপযোগী।
খ) বারি আমড়া-২
দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বারি আমড়া-২ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০০৭ সালে অবমুক্ত করা হয়।
- জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং প্রতি বছর ফল প্রদান করে।
- গাছ লম্বাকৃতির, ফল বড়, অত্যন্ত সুস্বাদু (টিএসএস ৯%) এবং ফলের গড় ওজন ৯৫-১০০ গ্রাম।
- এর খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৬০ শতাংশ।
- হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১৬-১৮ টন।
- জাতটি দেশের উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের সব এলাকায় চাষোপযোগী।
(২) আমড়া চাষের পদ্ধতি বা আমড়া গাছ চাষ
ক) মাটি ও জলবায়ু
গভীর, সুনিষ্কাশিত, ঊর্বর দোআঁশ মাটি আমড়া চাষের জন্য উত্তম। আমড়া চাষে উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। গ্রীষ্ম মন্ডলীয় জলবায়ুতে আমড়া ভাল হয়। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু আমড়া চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
খ) বংশ বিস্তার
- বীজ বা কলমের মাধ্যমে আমড়ার বংশ বিস্তার করা হয়।
- পরিপক্ক আমড়া বীজ থেকে শাঁস ছাড়িয়ে নিয়ে বালিতে রোপণ করতে হয়।
- চারা গজানোর পর ছোট অবস্থায় চারাগুলো তুলে কম্পোস্ট ও ভিটি বালি মিশ্রিত অন্য টবে স্থানান্তর করতে হয়।
- একটি বীজ থেকে এক বা একাধিক চারা হতে পারে।
- কম্পোস্ট ও ভিটিবালি মিশ্রিত টবে একবারে বীজ লাগিয়েও এই চারা উৎপাদন করা যায়। তবে এক্ষেত্রে চারার অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়।
- বীজের চারাতেও বংশগত গুণাগুণ ঠিক থাকে।
- কলমের মাধ্যমেও আমড়ার বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে দেশি আমড়ার চারা রুটস্টক হিসেবে ব্যবহার করে ক্লেফট পদ্ধতিতে আমড়ার কলম করা হয়।
গ) জমি তৈরি
- ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছমুক্ত করে নিতে হবে।
- চারা রোপণের জন্য সমতল ভূমিতে বর্গাকার, আয়তাকার বা কুইনকান্স এবং পাহাড়ি জমিতে কন্টুর বা ম্যাথ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
- আমড়া চারা রোপণের জন্য ৬০ ⨉ ৬০ ⨉ ৬০ সেমি গর্ত করে ২০ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
- বৃষ্টির মৌসুমের প্রারম্ভে অর্থাৎ বৈশাখন্ডজ্যৈষ্ঠ মাস (এপ্রিল-মে) চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে অন্য সময়ও চারা লাগানো যায়।
- বারি আমড়া-১ জাতের আমড়া বামন আকৃতির হওয়ায় ৪-৫ মিটার দূরত্বে লাগানো উত্তম।
- গর্ত তৈরির ১৫-৩০ দিন পর চারার গোড়ার বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে।
- চারা রোপণের পর হালকা সেচ, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ) সার প্রয়োগ
আমড়া গাছে বছরে ২ বার সার প্রয়োগ করা উচিত। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে (এপ্রিল-মে) এবং ২য় কিস্তি বর্ষার শেষে মধ্য-শ্রাবণ থেকে মধ্য-ভাদ্র (আগস্ট- সেপ্টেম্বর) দিতে হবে।
মাটিতে ‘জো’ অবস্থায় সার প্রয়োগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির সাথে সারের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
গাছের বয়স | জৈব সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিপসাম (গ্রাম) |
১-২ বছর | ৫-১০ | ১০০ | ১৫০ | ১০০ | ৫০ |
৩-৪ বছর | ১০-১৫ | ১৫০ | ২০০ | ১৫০ | ৬০ |
৫-৬ বছর | ১৫-২০ | ২০০ | ২৫০ | ২০০ | ৭৫ |
৭-১০ বছর | ২০-২৫ | ২৫০ | ৩০০ | ২৫০ | ৯০ |
১০ বছর তদুর্ধ্ব | ২৫-৩০ | ৩০০ | ৩৫০ | ৩০০ | ১০০ |
ঙ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
দুই-তিন মাস অন্তর ৪ কিস্তিতে (বৈশাখ, আষাঢ়, আশ্বিন ও অগ্রহায়ণ) উপরোক্ত সার প্রয়োগ করতে হবে। বারি আমড়া-২ এর ক্ষেত্রে সারের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে এবং বছরে দুই কিস্তিতে (বৈশাখ ও অগ্রহায়ণ) সার প্রয়োগ করতে হবে।
চ) সেচ প্রয়োগ
- গাছের বৃদ্ধির জন্য শুকনা মৌসুমে সেচ প্রয়োগ করা উত্তম।
- ফলন্ত গাছের বেলায় আমড়ার ফুল ফোঁটার শেষ পর্যায়ে এবং মটর দানার সময়ে একবার, স্প্রিংকলার বা বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
- গাছে সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ প্রয়োগ করা হলে সুফল পাওয়া যায়।
ছ) ফুল ও ফল ছাঁটাই
১-২ বছর পর্যন্ত গাছে কোন ফল না রাখাই উত্তম। তাই এ সময় ফুল ধারণ করলেও ফুল ফেলে দেয়া হলে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয়। ২ বছর পর গাছে প্রচুর পরিমাণ ফল হয়।
বারি আমড়া-১ এর গাছে ফলের আধিক্য থাকে বলে ২০-৩০% ফল ছাঁটাই করে ফেলা উচিত। এতে গাছের অন্যান্য ফলের বৃদ্ধি বেশি হয় এবং ফলের গুণগত মানও উন্নত হয়।
জ) ফল সংগ্রহ
খাওয়ার জন্য পুষ্ট ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ফল পুষ্ট হলে আমড়ার রং সবুজ এবং গায়ে হালকা বাদামী প্যাচ সৃষ্টি হয়।
চারা তৈরির জন্য আমড়া গাছে পাকিয়ে নেয়াই উত্তম। পাকা হালকা হলুদ রং ধারণ করে। পুষ্ট ফলের বীজ থেকেও চারা তৈরি করা যায়।
(৩) অন্যান্য পরিচর্যা
হগপাম বিটল পোকা দমন:
এ পোকা কচি পাতা খেয়ে গাছকে পত্রশূণ্য করে ফেলে। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং ফলন কমে যায়।
এ পোকার গায়ে লালচে ফোঁটারমতো দাগ দেখা যায়। এপ্রিল-আগস্ট পর্যন্ত এ পোকার প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে।
প্রতিকার:
- পোকার সংখ্যা কম হলে হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলা যায়।
- কীড়া অবস্থায় গুচ্ছাকারে থাকার সময় পাতাসহ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সুমিথিয়ন ৫০ ইসি অথবা রগর ৪০ ইসি প্রতি
- লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করে এই পোকা দমন করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]