মিষ্টি লেবু কমলা, মাল্টা ও বাতাবি লেবুর মতই একটি মিষ্টি পাল্পযুক্ত লেবু জাতীয় ফল। বিদেশে মিষ্টি লেবুর রস ফল প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়।
(১) মিষ্টি লেবুর জাত ও বৈশিষ্ট্য
বারি মিষ্টি লেবু-১:
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারি মিষ্টি লেবু-১’ নামে ২০১৩ সালে মিষ্টি লেবুর একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
- এ জাতের পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় সবুজ এবং খেতে সুস্বাদু।
- বেশ রসাল এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ।
- জাতটি নিয়মিত ফলদানকারী এবং উচ্চ ফলনশীল।
- গাছ খাটো, ছড়ানো ও অত্যধিক ঝোপালো।
- মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র পর্যন্ত গাছে ফুল আসে এবং আশ্বিন কার্তিক মাসে ফল আহরণ উপযোগী হয়।
- ফল গোলাকার, মাঝারী আকৃতির (১৪০-১৫০ গ্রাম)।
- ফলের দৈর্ঘ্য ৮ সেমি এবং প্রস্থ ৭ সেমি।
- ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও শাঁসের সাথে সংযুক্ত।
- শাঁস হলুদাভ, রসালো ও সুস্বাদু (ব্রিক্সমান ৭.৫%)।
- খাদ্যোপযোগী অংশ ৫৫-৬০%।
- গাছপ্রতি ৩০০-৫৮০টি ফল ধরে।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৪০ টন।
- বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পঞ্চগড়সহ দেশের সব অঞ্চলের জন্য উপযোগী।
(২) মিষ্টি লেবু চাষের পদ্ধতি
ক) জলবায়ু ও মাটি
- শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মিষ্টি লেবু চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত মিষ্টি লেবুর ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে।
- শুষ্ক আবহাওয়ায় ফলের স্বাদ উন্নত মানের হয়। আর্দ্র জলবায়ুতে রোগ ও ক্ষতিকর পোকার উপদ্রব বেশি হয়।
- মিষ্টি লেবু গাছ আলো পছন্দ করে এবং ছায়ায় গাছের বৃদ্ধি ও ফলের গুণগত মান কমে যায়।
- সব ধরনের মাটিতে জন্মালেও সুনিষ্কাশিত, ঊর্বর, মধ্যম থেকে হাল্কা দোআঁশ মাটি মিষ্টি লেবু চাষের জন্য উত্তম।
- মধ্যম অম্ল থেকে সামান্য ক্ষারীয় মাটিতে মিষ্টি লেবু জন্মে তবে ৪.০-৯.৫ অম্লতায় (pH) ভাল জন্মে।
- মিষ্টি লেবু দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা মোটেও সহ্য করতে পারে না।
খ) বংশ বিস্তার
কলমের মাধ্যমে মিষ্টি লেবুর বংশ বিস্তার করা হয়। পরিপক্ক ফলের বীজ সংগ্রহ করে কয়েক দিনের মধ্যেই নার্সারিতে স্থাপন করে চারা উৎপাদন করা হয়।
বীজের চারায় মাতৃ গাছের গুণাগুণ বজায় থাকে না বিধায় কলমের মাধ্যমে চারা তৈরি করাই উত্তম।
কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করলে মাতৃগুণাগুণও ঠিক থাকে ও দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বলিষ্ঠ শিকড় সমৃদ্ধ আদিজোড়ের উপর কলম করার ফলে গাছের জীবনকাল ও ফলন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
গ) জোড় কলম
- গ্রাফটিং-এর জন্য প্রথমে রুটস্টক (আদিজোড়) উৎপাদন করতে হবে।
- রুটস্টক হিসেবে বাতাবিলেবু, রাফলেমন, কাটা জামির, রংপুর লাইম প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। অতঃপর কাঙ্খিত মাতৃগাছ হতে সায়ন (উপজোড়) সংগ্রহ করে রুটস্টকের উপর স্থাপন করে মিষ্টি লেবুর গ্রাফটিং তৈরি করা হয়।
- রুটস্টক হিসেবে ১.০ হতে ১.৫ বছর বয়সের সুস্থ, সবল ও সোজাভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত চারা নির্বাচন করতে হবে।
- নির্বাচিত মাতৃগাছ হতে সায়ন তৈরির জন্য দুটি চোখসহ ৫-৬ সেমি লম্বা ও ৮-৯ মাস বয়সের শাখা সংগ্রহ করতে হবে।
- মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-ভাদ্র (মে থেকে আগস্ট) মাস পর্যন্ত গ্রাফটিং করা যায়।
- ভিনিয়ার ও ক্লেফট গ্রাফটিং উভয় পদ্ধতিতেই মিষ্টি লেবুর কলম তৈরি করা যায়।
- সাধারণত কলম করার ১০-১৫ দিনের মধ্যে রুটস্টক ও সায়নের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয় এবং সায়নের চোখ ফুটে কুশি বের হয়।
- কলম হতে একাধিক শাখা বের হলে সুস্থ সবল ও সোজাভাবে বেড়ে উঠা ডালটি রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে হবে।
- আদিজোড় থেকে উৎপন্ন কুশি নিয়মিতভাবে অপসারণ করতে হবে।
ঘ) জমি নির্বাচন ও তৈরি
- সারাদিন রোদ পড়ে এবং বৃষ্টির পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি মিষ্টি লেবু চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
- নির্বাচিত জমিটি পর্যায়ক্রমিক চাষ ও মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে।
- জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং আশে পাশে উঁচু গাছ থাকলে তার ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে।
ঙ) রোপণ পদ্ধতি ও সময়
সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা ষড়ভুজী পদ্ধতিতে এবং পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর পদ্ধতিতে চারা/কলম রোপণ করা হয়।
সাধারণত মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-ভাদ্র (মে-আগস্ট) মাসের মধ্যে মিষ্টি লেবুর চারা লাগানো উত্তম। তবে পানি সেচ নিশ্চিত করা গেলে বছরের অন্যান্য সময়ও কলম লাগানো যেতে পারে।
চ) চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা
গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত কলমটি গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে রোপণ করতে হবে।
রোপণের পরপর খুটি দিয়ে কলমটি খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। অতঃপর প্রয়োজনমতো পানি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ) গাছে সার প্রয়োগ
গাছের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময়মত, সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
বয়সভেদে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ:
গাছের বয়স (বছর) | গোবর সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিংক সালফেট (গ্রাম) | বরিক এসিড (গ্রাম) |
১-২ | ১০-১২ | ২০০-৩০০ | ১০০-১৫০ | ১০০-১৫০ | ১০ | ১০ |
৩-৪ | ১২-১৫ | ৩০০-৪৫০ | ১৫০-২০০ | ১৫০-২০০ | ১৫ | ১২ |
৫-৭ | ১৫-১৮ | ৪৫০-৬০০ | ২০০-৩০০ | ২০০-২৫০ | ২০ | ১৫ |
৮-১০ | ১৮-২০ | ৬০০-৭০০ | ৩০০-৪৫০ | ২৫০-৩০০ | ২৫ | ১৮ |
১০ এর অধিক | ২০-২৫ | ৭৫০ | ৫০০ | ৪৫০ | ৩০ | ২২ |
প্রয়োগ পদ্ধতি:
প্রতিবছর মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মার্চ), বর্ষার পূর্বে মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-জ্যৈষ্ঠ (মে) এবং বর্ষার পর মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাসে তিন কিস্তিতে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তবে সেচের ব্যবস্থা না থাকলে বর্ষার আগে ও পরে দুই কিস্তিতে সার প্রয়োগ করা ভালো।
জ) আগাছা দমন ও মালচ প্রয়োগ
বর্ষার শেষে সার প্রয়োগের পর গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে বিভিন্ন লতাপাতা বা খড় দ্বারা বৃত্তাকারে মালচ করে দিলে আগাছা দমনসহ শুষ্ক মৌসুমে আর্দ্রতা সংরক্ষিত হয়।
সাধারণত বর্ষার শুরুতে ও বর্ষার শেষে সম্পূর্ণ বাগানে হালকা চাষ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
ঝ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
ভাল ফলনের জন্য খরার সময় বা শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সেচ দেয়া একান্ত দরকার। বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সে জন্য দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
ঞ) ডাল ছাঁটাইকরণ
- মিষ্টি লেবু গাছের জন্য ডাল ছাঁটাই অপরিহার্য। গাছ লাগানের পর ফল ধরার পূর্ব পর্যন্ত ধীরে ধীরে ডাল ছেঁটে গাছকে নির্দিষ্ট আকার দিতে হবে যাতে গাছ চারদিকে ছড়াতে পারে। কারণ পার্শ্ব ডালগুলিতে কম বেশি ধরে।
- কান্ডের ১ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত সব ডাল ছাঁটাই করতে হবে। ডাল ছাঁটাই করার পর ডালের কাটা অংশে বর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে।
- এছাড়া, পানি তেউড় বা Water sucker উৎপন্ন হওয়ামাত্র কেটে ফেলতে হবে।
- মরা, শুকনা এবং রোগ ও পোকামাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে।
ট) ফল পাতলাকরণ ও ব্যাগিং
‘বারি মিষ্টি লেবু-১’ এর গাছে প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক ফল আসে। সমস্ত ফল রাখা হলে ফল আকারে ছোট ও নিম্ন মানের হয়। এজন্য প্রতি পুষ্প মঞ্জরীতে সুস্থ ও সতেজ দেখে দু’টি করে ফল রেখে বাকিগুলো ছোট থাকা অবস্থায়ই (মার্বেল অবস্থা) ছাঁটাই করা দরকার।
কলমের গাছ প্রথম বা দ্বিতীয় বছর থেকে ফল দিতে শুরু করে। গাছের বৃদ্ধির জন্য ১ম বছর ফল না রাখাই ভাল, দ্বিতীয় বছর অল্প সংখ্যক ফল রাখা যেতে পারে। এভাবে পর্যায়ক্রমে গাছের অবস্থা বিবেচনা করে ফল রাখতে হবে।
ফলের বর্ণ সবুজ হওয়ায় পাখি ও পোকার আক্রমণ কম হয়। তবে পরিপক্কতার পূর্বে ব্যাগিং করলে অবাঞ্ছিত পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]