বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে আনারস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আনারস একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল।
আনারস ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’, ও ‘সি’ এর একটি উত্তম উৎস।
বাংলাদেশে আনারস ফলের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৪-১৫ টন।
বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং টাঙ্গাইল জেলায় আনারসের ব্যাপক চাষ হয়। ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, দিনাজপুর জেলাতেও আনারসের চাষাবাদ হয়ে থাকে।
মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।
(১) আনারসের উন্নত জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য
ক) হানিকুইন
- পাকা আনারসের শাঁস হলুদ বর্ণের হয়।
- চোখ সুচালু ও উন্নত।
- গড় ওজন ১ কেজি।
- পাতা কাঁটা বিশিষ্ট ও পাটল বর্ণের।
- হানিকুইন সবচেয়ে মিষ্টি আনারস।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন।
- বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ জাতের আনারস বেশি চাষ হয়।
- জাতটি রপ্তানিযোগ্য।
খ) জায়েন্ট কিউ (কেলেঙ্গা)
- বাংলাদেশে আবাদকৃত আনারসের মধ্যে জমি এবং উৎপাদনের দিক থেকে ‘জায়েন্ট কিউ’ জাতটির অবস্থান সবার উপরে।
- পাকা আনারস সবুজাভ ও শাঁস হালকা হলুদ। চোখ প্রশস্ত ও চ্যাপ্টা।
- গড় ওজন ২ কেজি।
- গাছের পাতা সবুজ, প্রায় কাঁটাবিহীন।
- ফল খেতে টক-মিষ্টি স্বাদের।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০-৪০ টন।
- বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার ও টাঙ্গাইল জেলায় এ জাতের আনারস বেশি চাষ হয়।
গ) ঘোড়াশাল
- পাকা আনারস লালচে এবং ঘিয়ে সাদা হয়।
- চোখ প্রশস্ত এবং গড় ওজন ১.২৫ কেজি।
- পাতা কাঁটাবিশিষ্ট, চওড়া ঢেউ খেলানো থাকে।
- ঢাকা ও নরসিংদী জেলায় এ জাতটির চাষ সীমাবদ্ধ। সঠিক পরিচর্যার অভাব এবং অন্যান্য ফসলের চাপে এ জাতের আওতাধীন জমি দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে।
ঘ) জলঢুপি
- পাকা অনারস লালচে ও ঘিয়ে সাদা রঙের হয়ে থাকে এবং চোখ প্রশস্ত।
- গড় ওজন ১.০-১.৫ কেজি।
- পাতা কাঁটা বিশিষ্ট, চওড়া ও ঢেউ খেলানো থাকে।
- জাতটি প্রক্রিয়াজাতকরণ উপযোগী।
(২) আনারস চাষ পদ্ধতির বর্ণনা
ক) মাটি ও জমি তৈরি
- আনারস চাষের জন্য দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি বেশ উপযোগী।
- ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও জমি সমতল করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি কোন স্থানে জমে না থাকতে পারে।
- জমি থেকে ১৫ সেমি উঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে।
- এক বেড থেকে অপর বেডের মাঝে ৪০-৫০ সেমি নালা রাখতে হবে।
খ) চারা রোপণের উপযুক্ত সময়
মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস) আনারসের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাছাড়া সেচের সুবিধা থাকলে মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি মাস) পর্যন্ত চারা লাগানো যায়।
- ১ মিটার প্রশস্ত বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হবে।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সেমি রাখতে হবে।
গ) সারের পরিমাণ
সারের নাম | সারের পরিমাণ/গাছ |
পচা গোবর | ২৯০-৩১০ গ্রাম |
ইউরিয়া | ৩০-৩৬ গ্রাম |
টিএসপি | ১০-১৫ গ্রাম |
এমওপি | ২৫-৩৫ গ্রাম |
জিপসাম | ১০-১৫ গ্রাম |
ঘ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- গোবর, জিপসাম ও টিএসপি সার বেড তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- ইউরিয়া ও পটাশ সার চারা রোপণের ৪-৫ মাস পর থেকে শুরু করে ৫ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- সার বেডে ছিটিয়ে ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঙ) পরিচর্যা
- শুষ্ক মৌসুমে আনারস ক্ষেতে সেচ দেওয়া খুবই প্রয়োজন।
- বর্ষা মৌসুমে অতি বৃষ্টির সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সে জন্য নালা কেটে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
- চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেমি পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে।
- আনারসের জমি সর্বদা আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন।
চ) ফল সংগ্রহ
সাধারণত চারা রোপণের ১৫-১৬ মাস পর মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-চৈত্র (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মাসে আনারস গাছে ফুল আসে এবং মধ্য-জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য-ভাদ্র (জুন থেকে আগস্ট) মাসে আনারস পাকে।
ছ) ফলন
প্রতি হেক্টর জমিতে হানিকুইন আনারস ২৫-৩০ টন এবং জায়েন্ট কিউ ৩০-৪০ টন হয়।
(৩) হরমোন প্রয়োগে সারা বছর আনারস চাষের পদ্ধতি
ক) আনারস চাষের ক্ষেত্রে হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা
i) সারা বছর আনারস উৎপাদন
বাংলাদেশে যে পরিমাণ আনারস উৎপাদিত হয় তার অধিকাংশই মধ্য-জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য-ভাদ্র (জুন থেকে আগস্ট) মাসের মধ্যে আহরিত হয়ে থাকে।
এ সময়ে অন্যান্য ফল যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জাম প্রভৃতি ফলেরও মৌসুম। কাজেই এ সময় আনারসের দাম কমে যায়।
এমনকি এক সময়ে প্রচুর পরিমাণ আনারস পাকার ফলে এবং বৃষ্টির দিনে পরিবহনের অভাবে অনেক ফল পচে যায়।
বছরের অন্যান্য সময়ে এর চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন না থাকাতে তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। ফলে দামও বেড়ে যায়। এতে অমৌসুমে জনসাধারণ আনারস খেতে পারে না।
হরমোন প্রয়োগে সারা বছর আনারস উৎপাদন করে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।
ii) প্রায় শতভাগ গাছে একসাথে ফুল
এছাড়া আনারসের জমিতে সব গাছে এক সাথে ফুল/ফল আসে না। যার দরুণ দীর্ঘদিন যাবৎ জমি আটকে থাকে। এতে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় ও ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
হরমোন প্রয়োগে প্রায় শতভাগ গাছে একসাথে ফুল আসে।
খ) হরমোন প্রয়োগের সুবিধা
হানিকুইন জাতের আনারস একটি রপ্তানিযোগ্য ফল। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এক কেজি অথবা অর্ধ কেজি ওজনের ফল উৎপাদন করা আবশ্যক।
চারার নয় মাস বয়স অথবা ২২ পাতা পর্যায়ে হরমোন প্রয়োগ করা হলে ফল হবে আধা কেজি ওজনের।
আবার চারার ১৩ মাস বয়স অথবা ২৮ পাতা পর্যায়ে হরমোন প্রয়োগ করা হলে ফল হবে এক কেজি ওজনের।
গ) হরমোন প্রয়োগ পদ্ধতি
- আনারস চারা রোপণের ৯-১৩ মাস পর প্রতি মাসে বৃষ্টিহীন দিনে ক্রমানুসারে ইথ্রেল ৫০০ পিপিএম বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ১০,০০০ পিপিএম (বা ১%) দ্রবণ প্রতি গাছে ৫০ মিলি পরিমাণে সকালে গাছের কান্ডে ঢেলে দিতে হবে।
- হরমোন প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টি হলে এর কার্যকারিতা কমে যায়।
- সারা বছর আনারস পেতে হলে জমিকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে প্রতি মাসেই এক একটি ব্লকে আনারস চারা রোপণ করতে হয় অথবা একবার রোপণ করে ৩-৪টি ব্লকে ভাগ করে ক্রমান্বয়ে প্রতিমাসে হরমোন প্রয়াগ করা যেতে পারে।
- হরমোন প্রয়োগের ২০-৪০ দিন পর গাছে ফুল আসে এবং ৫-৬ মাস পর ফল আহরণ করা যায়।
ঘ) মুকুট ব্যবস্থাপনা
ফলের মুকুট থাকা আবশ্যক। কিন্তু বৃহৎ মুকুট বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।
ফুল আসার ৬৫-৭৫ দিন পর মুকুটের কেন্দ্রীয় মেরিস্টেম লোহার তৈরি অগারের সাহায্যে অপসারণ করা হলে ফলের বৃদ্ধি ব্যাহত না করে মুকুট ক্ষুদ্র থাকবে।
[সূত্র: বিএআরআই]