পেঁপে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফল। বাংলাদেশেও পেঁপে খুবই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
পেঁপের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত এটা স্বল্পমেয়াদী, দ্বিতীয়ত ইহা কেবল ফল নয় সবজি হিসেবেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে, তৃতীয়ত পেঁপে অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং ঔষধী গুণসম্পন্ন।
আমের পরই ভিটামিন ‘এ’ এর প্রধান উৎস হল পাকা পেঁপে। কাঁচা পেঁপেতে প্রচুর পেপেইন নামক হজমকারী উপাদান থাকে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও যশোরে উৎকৃষ্ট মানের পেঁপে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশে পেঁপের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৭ টন।
এখানে আমরা আধুনিক উপায়ে পেঁপে চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হব।
(১) পেঁপে চাষ করার জন্য উন্নত জাত নির্বাচন
শাহী পেঁপে:
রাজশাহী অঞ্চল হতে সংগৃহীত স্থানীয় জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পেঁপের উন্নত জাত ‘শাহী পেঁপে’ উদ্ভাবন করা হয়। জাতটি ১৯৯২ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্ত হয়।
- শাহী পেঁপে একটি এক লিঙ্গিক জাতের পেঁপে। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা গাছে ধরে। স্ত্রী গাছের প্রতিটি পত্র কক্ষের একটি বোঁটায় ৩টি করে স্ত্রী ফুল আসে। অপর পক্ষে পুরুষ গাছে লম্বা বোঁটায় একসঙ্গে অনেক পুরুষ ফুল ধরে।
- গাছ হালকা সবুজ বর্ণের। তবে পাতার রং গাঢ় সবুজ। চারা লাগানোর ৩-৪ মাস পর ফুল আসে।
- কান্ডের খুব নিচু হতে ফল ধারণ শুরু হয়। ফুল আসার ৩-৪ মাস পর পাকা পেঁপে সংগ্রহ করা যায়।
- জাতটি দেশের সর্বত্রই চাষোপযোগী।
- গাছের উচ্চতা ১৬০-২০০ সেমি, পাতার সংখ্যা ১৭-২০টি, পাতার বোঁটার দৈর্ঘ্য ২৪-২৮ সেমি, পাতার দৈর্ঘ্য ২৩-২৭ সেমি এবং প্রস্থ ২৪-২৮ সেমি।
- ফলের আকার ডিম্বাকৃতির, প্রতিটি ফলের ওজন ৮৫০-৯৫০ গ্রাম, ফলের দৈর্ঘ্য ১৩-১৫ সেমি ও প্রস্থ ৯-১১ সেমি।
- ফলে শাঁসের পুরুত্ব ২ সেমি, শাঁসের রং গাঢ় কমলা, ফলপ্রতি বীজের সংখ্যা ৫০০-৫৩০টি, সদ্য সংগৃহীত বীজের ওজন ৩৫-৪০ গ্রাম, শুকনা শত বীজের ওজন ১.০-১.২ গ্রাম। বীজ ডিম্বাকৃতির এবং বীজের রং ভেলভেট কালো হয়।
- জাতটি প্রায় সারা বছরই ফল দিয়ে থাকে এবং রোপণের ৮-৯ মাসের মধ্যে পাকা ফল পাওয়া যায়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০-৬০ টন।
- উৎকৃষ্ট মানের সবজি হিসেবে সারাদেশে কাঁচা ফলের চাহিদা আছে। তাই শাহী পেঁপের চাষ অত্যন্ত লাভজনক।
(২) পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি
সুনিষ্কাশিত, উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে।
উপযুক্ত পরিচর্যার দ্বারা প্রায় সব ধরনের মাটিতেই পেঁপের চাষ করা যায়। তবে উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম।
খ) বীজের হার
দুই মিটার দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ২ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করলে ১ হেক্টর জমিতে ২৫০০ গাছের জন্য ৭৫০০ চারার প্রয়োজন হয়।
সদ্য সংগৃহীত বীজ হলে ১৪০-১৬০ গ্রাম বীজ দিয়ে প্রয়োজনীয় চারা তৈরি করা যায়।
গ) চারা তৈরি
- বীজ থেকে বংশ বিস্তার করা হয়। পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করলে রোপণের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- ১৫ ⨉ ১০ সেমি আকারের ব্যাগে সমপরিমাণ বালি, মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ ভর্তি করে ব্যাগের তলায় ২-৩টি ছিদ্র করতে হবে।
- তারপর এতে সদ্য সংগৃহীত বীজ হলে ১টি এবং পুরাতন হলে ২-৩টি বীজ বপন কতে হবে।
- একটি ব্যাগে একের অধিক চারা রাখা উচিত নয়।
- ২০-২৫ দিন বয়সের চারায় ১-২% ইউরিয়া স্প্রে করলে চারার বৃদ্ধি ভাল হয়।
ঘ) জমি নির্বাচন ও তৈরি
- পেঁপে গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই পেঁপের জন্য নির্বাচিত জমি হতে হবে জলাবদ্ধতামুক্ত এবং সেচ সুবিধাযুক্ত।
- জমি বার বার চাষ ও মই দিয়ে উত্তম রূপে তৈরি করতে হবে।
- দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে বেড পদ্ধতি অবলম্বন করা উত্তম। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেমি চওড়া এবং ২০-২৫ সেমি গভীর নালা থাকবে।
- নালাসহ প্রতিটি বেড ২ মিটার চওড়া এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।
ঙ) গর্ত তৈরি
- চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে ৬০ ⨉ ৬০ ⨉ ৪৫ সেমি আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে।
- গর্ত প্রতি ১৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম বরিক এসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মেশাতে হবে।
- সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত পূরণ করে সেচ দিতে হবে।
চ) পেঁপে চাষের উপযুক্ত সময়
বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) এবং পৌষ (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) মাস পেঁপের বীজ বপনের উত্তম সময়।
বপনের ৪০-৫০ দিন পর চারা রোপণের উপযোগী হয়।
ছ) পেঁপে চারা রোপণ পদ্ধতি
- চারা লাগানোর পূর্বে গর্তের মাটি উলট-পালট করে নিতে হয়।
- প্রতি গর্তে ৩০ সেমি দূরত্বে ত্রিভুজ আকারে ৩টি করে চারা রোপণ করতে হয়।
- বীজ তলায় উৎপাদিত চারার উন্মুক্ত পাতাসমূহ রোপণের পূর্বে ফেলে দিলে রোপণকৃত চারার মৃত্যু হার কমবে এবং চারা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হবে।
- পলিব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে পলিব্যাগটি খুব সাবধানে অপসারণ করতে হবে যাতে মাটির বলটি ভেঙ্গে না যায়।
- পড়ন্ত বিকাল চারা রোপণের সর্বোত্তম সময়।
- রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে চারার গোড়া যেন বীজতলা বা পলিব্যাগে মাটির যতটা গভীরে ছিল তার চেয়ে গভীরে না যায়।
জ) গাছে সার প্রয়োগ
- ভাল ফলন পেতে হলে পেঁপেতে সময়মতো সার প্রয়োগ করতে হবে।
- চারা রোপণের এক মাস পর হতে প্রতি মাসে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- গাছে ফুল আসার পর এই মাত্রা দ্বিগুন করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
- উপরি হিসেবে গাছপ্রতি ৪৫০-৫০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৪৫০-৫০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
ঝ) প্রয়োজনীয় পরিচর্যা
পেঁপের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করতে গিয়ে মাটি যাতে বেশি আলগা হয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
পানি সেচ ও নিকাশ:
- শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হবে।
- সেচে ও বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে জন্য পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে।
অতিরিক্ত গাছ অপসারণ:
- চারা লাগানোর ৩-৪ মাস পর গাছে ফুল আসলে প্রতি গর্তে একটি করে সুস্থ সবল স্ত্রী গাছ রেখে বাকিগুলো তুলে/কেটে ফেলতে হবে।
- তবে সুষ্ঠু পরাগায়ণ ও ফল ধারণের জন্য বাগানের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে শতকরা ৫টি পুরুষ গাছ থাকা অপরিহার্য।
ফল পাতলাকরণ:
- পেঁপের অধিকাংশ জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রকক্ষ থেকে একাধিক ফুল আসে এবং ফল ধরে। ফল কিছুটা বড় হওয়ার পর প্রতি পত্রকক্ষে সবচেয়ে ভাল ফলটি রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
- দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী বছরে যে পেঁপে হয় সেগুলো খুব ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে। ফলে ঠিকমতো বাড়তে পারে না এবং এদের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো ছাঁটাই করতে হবে।
(৩) পেঁপে চাষ করত এর রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা
ক) চারা ঢলে পড়া (ড্যাম্পিং অফ) ও কান্ড পচা রোগ দমন
পেঁপের ঢলে পড়া রোগে বীজতলায় প্রচুর গাছ মারা যায়। তাছাড়া এ রোগের জীবাণুর আক্রমণে বর্ষা মৌসুমে কান্ড পচা রোগও হয়ে থাকে।
পিথিয়াম এ্যাফানিডারমাটাম নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়।
বর্ষা মৌসুমে ঢলে পড়া রোগের প্রকোপ খুব বেশি দেখা যায়। বৃষ্টির পানিতে অথবা সেচের পানিতে এ রোগের জীবাণু ছড়ায়।
প্রতিকার:
- এ রোগ প্রতিকারের তেমন সুযোগ থাকে না। তাই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা উত্তম।
- আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে বীজতলা তৈরি করতে হলে বীজ বপনের পূর্বে বীজতলার মাটি ভালভাবে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
- সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক ২-৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- জমি তৈরির পর ৬ সেমি পুরু করে শুকনো কাঠের গুঁড়া বা ধানের তুষ বীজতলায় বিছিয়ে পোড়াতে হবে। পরে মাটি কুপিয়ে বীজ বপন করতে হবে।
- বীজতলায় হেক্টরে ৫ টন হারে আধাপচা মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে ১৫-২১ দিন জমিতে বিষ্ঠা পচানোর পর বীজ বপন করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
- প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে সিকিউর মিশিয়ে ড্রেঞ্চিং করে এ রোগের বিস্তার কমানো যায়।
- চারা লাগানোর ৩ সপ্তাহ পূর্বে হেক্টরপ্রতি ৩ টন আধা পচা মুরগির বিষ্ঠা অথবা ৩০০ কেজি খৈল জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশাতে হবে। এতে কান্ড পচা রোগের উপদ্রব কম হবে।
খ) মিলি বাগ
সাম্প্রতিক সময়ে মিলি বাগ পেঁপের একটি মারাত্মক পোকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মত আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের পাতা ও ফলে শুঁটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ মারা যেতে পারে।
প্রতিকার:
- আক্রমণের প্রথম দিকে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা/কান্ড সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে অথবা পুরাতন টুথ ব্রাশ দিয়ে আঁচড়িয়ে পোকা মাটিতে ফেলে মেরে ফেলতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবান পানি অথবা এডমায়ার ২০০ এমএল ০.২৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]