Skip to content

লিলিয়াম ফুল চাষ পদ্ধতি

লিলিয়াম ফুল চাষ পদ্ধতি

লিলিয়াম লিলিয়েসি (Liliaceae) পরিবারভুক্ত একটি বর্ষজীবী কন্দজ জাতীয় ফুল। কাটফুল হিসেবে বাজারে এর চাহিদা অনেক।

(১) লিলিয়ামের ফুলের জাত ও বৈশিষ্ট্য

ক) বারি লিলিয়াম-১:

জাতটি ২০১৯ সালে অবমুক্ত করা হয়।

বারি লিলিয়াম-১
বারি লিলিয়াম-১
  • ফুলের রঙ বাদামী সাদা, পাপড়ীর ভিতরের দিকের রং হলুদাভ সবুজ এবং বিক্ষিপ্তভাবে কিছু খয়েরী ছিটা (spot) দেখা যায়।
  • ফুলের স্টিকের দৈর্ঘ্য ৭৫-৮৫সেমি. এবং প্রস্থ ১৫-২০সেমি. হয়ে থাকে।
  • প্রতি স্টিকে ফুলের বারি লিলিয়াম-১ সংখ্যা ১০-১২টি।
  • ফুলের সজীবতা প্রায় ১০-১২ দিন।
  • প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৩০-৪০টি ফুলের স্টিক পাওয়া যায়।

খ) বারি লিলিয়াম-২:

জাতটি ২০১৯ সালে অবমুক্ত করা হয়।

বারি লিলিয়াম-২
বারি লিলিয়াম-২
  • ফুলের রঙ আকর্ষণীয় হলুদ।
  • ফুলের স্টিকের দৈর্ঘ্য ৫৫-৬৫ সেমি. এবং প্রস্থ ১৮-২২ সেমি. হয়ে থাকে।
  • প্রতি স্টিকে ফুলের সংখ্যা ৫-৮ টি।
  • ফুলের সজীবতা প্রায় ১২-১৪ দিন।
  • প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৩০-৪০ টি ফুলের স্টিক পাওয়া যায়।

(২) লিলিয়াম ফুল চাষ পদ্ধতি

ক) জলবায়ু ও মাটি

লিলিয়াম চাষের জন্য মৃদু আবহাওয়া প্রয়োজন। ভালো মানের ফুল উৎপাদনের জন্য দিনের তাপমাত্রা ২০-২৫০ সে. এবং রাতের তাপমাত্রা ১০-১৫০ সে. হওয়া বাঞ্ছনীয়।

অধিকাংশ লিলিয়াম আংশিক ছায়ায় মানসম্পন্ন ফুল প্রদান করে। ৫০% আলো প্রতিরোধ করতে পারে এমন UV পলিথিন/শেড নেট ব্যবহার করলে ভালো মানের ফুল উৎপাদন করা যায়।

সুনিষ্কাশিত এবং পর্যাপ্ত জৈবসার সমৃদ্ধ বেলে দো-আঁশ মাটি লিলিয়ামের জন্য উপযোগী। সাধারণত এশিয়াটিক লিলিয়ামের জন্য মাটির pH ৬-৭ এবং অরিয়েন্টাল লিলিয়ামের জন্য pH ৫.৫-৬.৫ থাকা ভাল।

খ) বংশবিস্তার

বীজ, কন্দ, শল্ক, গুঁড়ি কন্দ ও বুলবিল এর মাধ্যমে লিলিয়ামের বংশবিস্তার করা যায়। সাধারণভাবে চাষের জন্য ‘কন্দ’ রোপণ করা হয়। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বৎসরের সংগৃহীত ও সংরক্ষিত আস্ত কন্দ মাটিতে বপণ করা হয়।

গ) জমি তৈরি

  • জমিতে ৪০-৪৫ সেমি. গভীর করে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি পর পর কয়েকটি চাষ দিয়ে জমিটি ঝুরঝুরা করে তৈরি করতে হবে।
  • জমি তৈরির সময় মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমান কোকোডাষ্ট (প্রতি বর্গ মিটারে প্রায় ১০-১৫ কেজি) মিশাতে হবে যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে।
  • লিলিয়াম চাষের জন্য বেডের প্রস্থ ১.০-১.২ মি. এবং উচ্চতা ৩০-৩৫ সেমি. হলে ভাল হয়।
  • বিভিন্ন অন্তর্বর্তী পরিচর্যা এবং জমির পানি নিস্কাশনের সুবিধার্থে দুই বেডের মাঝখানে ৩০ সেমি. জায়গা খালি রাখতে হবে।

ঘ) সার প্রয়োগ

লবনাক্তের প্রতি সংবেদনশীলতার কারনে লিলিয়ামের জমিতে সার প্রয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে কন্দ বপনের প্রথম ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত কোন সার মাটিতে প্রয়োগ না করাই ভাল।

কন্দ বপনের প্রথম ৩ সপ্তাহ পর NPK ৩০:২০:২০ গ্রাম/প্রতি বর্গ মিটারে প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তী ৩ সপ্তাহ পর প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ১ কেজি ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ৬ সপ্তাহ পর প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ১ কেজি পটাসিয়াম নাইট্রেট প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়

নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দিলে ফুল কাটার ৩ সপ্তাহ পূর্বে প্রতি ১০০ বর্গ মিটারে ১ কেজি পরিমান অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উপরিপ্রয়োগ করা প্রয়োজন।

ঙ) কন্দ বপণ

বাংলাদেশে অক্টোবর-নভেম্বর মাস লিলিয়াম কন্দ লাগানোর উপযোগী সময়। লিলিয়াম কন্দ ১৫ সেমি. ⨉ ১৫ সেমি. দূরত্বে এবং ১০-১২ সেমি. গভীরে বপণ করা হয়।

চ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা

  • লিলিয়াম চাষে পানি সেচ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়মিত পানি সেচ ভাল ফুল নিশ্চিত করে। ড্রিপ সেচ পদ্ধতি লিলিয়ামের জমিতে সেচ প্রদানের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
  • গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
  • গাছ লম্বা হলে যেন হেলে না যায় এজন্য সঠিক সময়ে লিলিয়াম গাছে নাইলনের তৈরী সাপোর্টিং নেট দেয়া প্রয়োজন। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সাপোর্টিং নেটকেও উপরে উঠিয়ে দিতে হবে।
  • এছাড়া মালচিং লিলিয়ামের জমিকে ঠান্ডা, ঝুরঝুরে ও আগাছা মুক্ত রাখে এবং এর ফলে মাটি বাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমনও কম হয়। সাধারনত মালচিং-এর জন্য খড়, কচুরিপানা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ছ) ফুল সংগ্রহ

  • বীজ বপণের ৯০-১২০ দিন পরে ফুল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
  • দূরবর্তী বাজারে ফুল প্রেরনের ক্ষেত্রে স্টিকের নিচের দিকের ২-৩ টি ফ্লোরেটে হালকা রং দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ফুল সংগ্রহ করা উচিত।
  • ফুল পুরোপুরি ফোটার পর ফুল সংগ্রহ করলে পরিবহনের সময় ফুল নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য যখন ১-২ টি ফুলের পাঁপড়ি খুলতে শুরু করে তখন ফুলের স্টিক কাটা উচিত।
  • মাটির নিচে বাল্বের যথোপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য ভূমি থেকে স্টিকের ১০-১২ সেমি. উপরে কাটতে হবে।

জ) সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা

  • ফুল সংগ্রহের পর ফুলের সজীবতা ধরে রাখতে দ্রুত ছায়ায় এনে কর্তিত কান্ড থেকে প্রায় ১০ সেমি. অংশের পাতা অপসারন করতে হবে।
  • রোগাক্রান্ত, পোকাক্রান্ত, নষ্ট ফুলের স্টিক বাছাই করে স্পাইক ও রেকিসের দৈর্ঘ্য, প্রতি স্পাইকে ফ্লোরেটের সংখ্যা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস করে বাজারের চাহিদা অনুসারে আঁটি বাধতে হবে। সাধারণত একটি আঁটিতে ৮/১০ টি ফুলের স্টিক থাকতে পারে।
  • সুবিধামত আঁটি তৈরি করে ফুলের নিচের দিকের ৪-৫ সেমি. অংশ বালতিতে চিনিসহ পানিতে (২-৪%) ২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে ফুল অনেকক্ষন সজীব থাকে।
  • মাঠ তাপমাত্রা (Field heat) কে কমানোর জন্য সংগ্রহের পর ফুল ২-৫০ সে. তাপমাত্রায় প্রাক-শীতলীতরনের ব্যবস্থা করলে সংক্ষণকাল বেড়ে যায়। সাধারন পানিতে জাত ভেদে লিলিয়াম ফুল প্রায় ৫-১৫ দিন পর্যন্ত তাজা থাকে।

ঝ) কন্দ সংরক্ষণ

  • গাছে ফুল দেয়া শেষ হলে ভালো মানের বাল্ব তৈরীর জন্য বাল্বকে ৪-৫ সপ্তাহ মাটিতে রেখে দিতে হবে। বিশেষ করে যখন পরিত্যাক্ত কান্ড শুকিয়ে যায় তখনই বাল্ব তোলার উপযুক্ত সময়।
  • মাটি থেকে শুকনো কান্ডসহ কন্দ এমনভাবে তুলতে হবে যাতে কন্দ কোনভাবেই আঘাত প্রাপ্ত না হয়।
  • তোলার পর বড়, রোগমুক্ত ভালো কন্দসমূহকে সংরক্ষণের জন্য বাছাই করে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ছায়ায় শুকাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হয় যেন শুধুমাত্র কন্দের উপরিভাগের আর্দ্র বা জলীয় অংশটুকুই শুধু শুকায়, কোনো অবস্থাতেই যেন অধিক শুকানোর জন্য কন্দ কুঁচকে বা কুঁকড়ে না যায়।
  • শুকানোর পরপরই কন্দ প্লাষ্টিক ক্রেটে আর্দ্র কোকোডাষ্ট-এ রেখে কোল্ড স্টোরেজে ২-৩০ সে. তাপমাত্রায় ৬-৮ সপ্তাহ সংরক্ষন করা যেতে পারে। বেশীদিন সংরক্ষন করতে হলে উক্ত তাপমাত্রায় ২ সপ্তাহ রেখে পরবর্তীতে -১০ সে. এ রাখা প্রয়োজন।

(৩) রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা

ক) বট্রাইটিস ব্লাইট

Botrytis নামক ছত্রাকদ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে, যা মূলত: লিলিয়ামের পাতায় আক্রমণ করে।

অতিরিক্ত আর্দ্রতা এবং গরম আহাওয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

প্রাথমিক অবস্থায় পাতার এক পাশে ছোট বাদামী বা ধূসর দাগ দেখা দেয় এবং আক্রান্ত টিস্যু ধীরে ধীরে মারা যায়। ফুলের পাঁপড়িতেও মাঝে মাঝে ছোট থেকে বড় পানির মত ভিজা দাগ দেখা যায়।

তীব্র আক্রমণের কারণে পুরোপাতা ও কান্ড আক্রান্ত হয় এবং সম্পূর্ন গাছ পঁচে যায় এবং ঢলে পড়ে।

দমন ব্যবস্থ্যা:

  1. আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা অপসারণ করতে হবে।
  2. রাসায়নিকভাবে দমনের জন্য অটোস্টিন @ ২.০ গ্রাম/লিটার হারে গাছ শুষ্ক থাকা অবস্থায় প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়।

খ) শল্ক ও কন্দ পঁচা রোগ

এ রোগে প্রথমে মাটির নিচে শল্কে বাদামী দাগ দেখা যায় যা পরবর্তীতে কন্দে ছড়িয়ে পড়ে এবং কন্দ পঁচে যায়।

আক্রান্ত কন্দ থেকে জন্মানো গাছ খাটো হয়, পাতা ধুসর বর্ণের হয় এবং ভালো মানের ফুল পাওয়া যায় না।

দমন ব্যবস্থ্যা:

  1. কন্দ লাগানোর পূর্বে মাটিকে শোধন করে নিতে হবে।
  2. আক্রান্ত শল্ক এবং কন্দ সরিয়ে ফেলতে হবে।
  3. মাটির তাপমাত্রা যথাসম্ভব কমিয়ে রাখতে হবে।
  4. মাটির সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য মাটিকে ঝুরঝুরে ও মালচিং করা যেতে পারে।
  5. লিলিয়াম শেডে পর্যাপ্ত বায়ূ চলাচলের ব্যবস্থা করে শেডের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতে হবে।

গ) জাবপোকা

লিলিয়ামের ক্ষতিকারক পোকার মধ্যে জাবপোকা অন্যতম। এ পোকা গাছের রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতিকরে এবং ভাইরাস ছড়ায়।

আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায়, নতুনকুঁড়ি ও পাতা কুঁকড়ে যায়। অনেক সময় কুঁড়ি ঝরে পড়ে বা ফুল ভালভাবে ফুঁটতে পারে না।

দমন ব্যবস্থ্যা:

  1. প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত পাতা বা কচি ডগা বা ফুল ছিঁড়ে ফেলে পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে।
  2. এ পোকা দমন করার জন্য হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
  3. সাবান পানি ৫ গ্রাম/প্রতিলিটার হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ডাইমেথয়েট জাতীয় কীটনাশক (পারফেকথিয়ন/সানগর/ টাফগর ৪০ ইসি) ২.০ মিলি./লি. পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে

ঘ) পাতাখেকো পোকা বা বিটল

লিলিয়ামের পাতা খেকো পোকা বা বিটল পাতা, কুঁড়ি এবং ফুলের ক্ষতি করে।

পূর্ণ বয়স্ক পোকা পাতার নিচে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে কীঁড়া বের হয়ে পাতা এবং পুরো গাছে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতা ছিদ্র ছিদ্র হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

দমন ব্যবস্থ্যা:

  1. পূর্ণবয়স্ক পোকা এবং কীঁড়া দেখা মাত্র হাত দিয়ে সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
  2. লিলিয়ামের ও আশেপাশের জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে যাতে পোকার বংশ বৃদ্ধি হতে না পারে।
  3. আক্রমণ বেশি হলে কুইনালফস ২৫ ইসি/কিনালাক্স ২৫ইসি/ডেভিকুইন ২৫ইসি বা ফেনিট্রোথিয়ন (সুমিথিয়ন/ফলিথিয়ন/এগ্রোথিয়ন) ১৫ মিলি./লি. হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২ বার স্প্রে করতে হবে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts