পুদিনা (Green Mint) লেমিয়েসী (Lamiaceae) পরিাবারের অন্তর্ভূক্ত বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। ইহা সুগন্ধি জাতীয় মসলা ফসল হিসেবে পরিচিত। ইহার বৈজ্ঞানিক নাম (Mentha spicata Linn.)।
সারা বছর চাষ করা যায়। কান্ড গোলাকৃতির, হালকা খয়েরী বর্নের। ইহা মসলা ফসল হিসাবে সালাত, সুপ, চা, বোরহানী ইত্যাদি তৈরিতে এবং পানের সাথে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ইহাতে ম্যানথল (Menthol) নামক রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান যা চকলেট, শ্যম্পু, চাটনি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ইহা খাদ্য পরিপাকে এবং হজমে সাহায্য করে। ইহা জ্বর, সর্দি, চর্মরোগ ও কাশির ঔষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে এই ফসলটি এখনো বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হয় না। তবে অল্পপরিসরে দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটানোর জন্যে পুদিনা চাষ করা হয়ে থাকে।
পুদিনার উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগন পুদিনার বেশ কয়েকটি লাইনের উপর গবেষণা চালিয়ে ‘বারি পুদিনা-১’ এবং ‘বারি পুদিনা-২’ নামে ২টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যা কম বেশী সারা দেশে চাষ করা সম্ভব। জাত ২টির বৈশিষ্ট ও উৎপাদন প্রযুক্তি নিম্নে বর্ননা করা হলো।
(১) পুদিনার জাত ও বৈশিষ্ট্য
ক) বারি পুদিনা-১
জাতটি বাংলাদেশ থেকে প্রবর্তিত এবং মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়ার গবেষণা মাঠে M004 নামে লাইনটি যাচাই করা হয়। পরবর্তীতে মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়া; আ লিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র মাগুড়া ও মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, ফরিদপুরে পরীক্ষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের বাংলাদেশে পুদিনা ফসলের কোন জাত নেই। ইহাতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় এবং উচ্চ ফলনশীল বিধায় লাইনটি (M004) বারি পুদিনা-২ জাত হিসেবে ২০১৮ সালে অবমুক্ত করা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- ইহা বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ এবং সারা বছর চাষ উপযোগী।
- গাছের উচ্চতা ২০-৩০ সে.মি.।
- কান্ড খাট, গোলাকৃতির, হালকা খয়েরী বর্নের ও ছোট রোমযুক্ত।
- পাতা গাঢ সবুজ বর্ণের, খাটো, গোলাকৃতি, পাতার অগ্রভাগ ভোতা।
- পাতার দৈর্ঘ্য ৩-৪ সে.মি. ও প্রস্থ ২.৫-৩.০ সে.মি.।
- ইহার ফুল সাদা-পার্পল বর্ণের।
- ইহাতে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।
- ইহার বংশ বিস্তার বীজ, কান্ড ও ধাবকের (Runner) মাধ্যমে করা যায়।
- ফলন ১০-১২ টন/হেক্টর (ডগা ও পাতাসহ)।
- এই জাতের জীবন কাল ১৩০-১৫০ দিন।
খ) বারি পুদিনা-২
জাতটি চীন দেশ থেকে প্রবর্তিত এবং মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়ার গবেষণা মাঠে M001 নামে লাইনটি যাচাই করা হয়। পরবর্তীতে মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়া; আ লিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র মাগুড়া ও মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, ফরিদপুরে পরীক্ষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। ইহাতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় এবং উচ্চ ফলনশীল বিধায় লাইনটি (M001) বারি পুদিনা-২ জাত হিসেবে ২০১৯ সালে অবমুক্ত করা হয়। এটি সারা বছর চাষ করা যায়। তবে গ্রীষ্মকালে এদের বৃদ্ধি ও
ফলন বেশি হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- নির্বাচিত জাতটি/লাইনটি সারা বছর চাষ উপোযোগী।
- এই জাতটি একবার লাগালে সারা বছর সেখান থেকে পাতাসহ ডগা সংগ্রহ করা যায়।
- ৬০-৭০ দিন পর পর ডগা সংগ্রহ করা যায়।
- এই জাতটির উচ্চতা ৪০-৫০ সেমি পাতার দৈর্ঘ্য ৫-৬ সেমি ও প্রস্থ ৩-৪ সেমি।
- ইহার পাতা ডিম্বাকৃতির, কিনারা সিরেট (Serrate) প্রকৃতির (করাতের মত খাজ কাটা)।
- পাতার সারফেস মসৃন, পাতার অগ্রভাগ সরু।
- ইহার ফুল সাদা থেকে পার্পল বর্ণের হয়।
- জাতটিতে পোকা ও রোগের আক্রমণ কম।
- ফলন ১৩-১৬ টন (ডগা ও পাতাসহ)।
(২) পুদিনা চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
সব রকম মাটিতেই পুদিনার চাষ করা যায়। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে-দোআঁশ থেকে এঁটেল-দোআঁশ মাটি পুদিনা চাষের জন্য উত্তম।
মাটির pH ৬-৭ হলে পুদিনার ফলন ভাল হয়।
বেশী ঠান্ডা বা গরম পড়ে না এবং বছরে ৮০০-১০০০ মিলি মিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় এমন স্থানে পুদিনা ভাল হয়। সাধারণত ২১ ডিগ্রি সে. থেকে ২৪ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা পুদিনা চাষের জন্য উপযোগী।
খ) জমি তৈরি
জমি তৈরী করতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিতে হবে। মাটি ঝুর ঝুরে করে জমি তৈরী করতে হবে। জমির দুই ব্লকের মাঝে পানি নিস্কাশনের জন্য নালা রেখে জমি তৈরী করতে হবে।
গ) রোপন সময়, বীজ হার ও রোপন দুরত্ব
বাংলাদেশে সারা বছর চাষ করা সম্ভব। তবে পুদিনা লাগানোর উপযোগী সময় এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত। প্রতি হেক্টরে ১২০০০০-২০০০০০ কাটিং লাগে।
প্রতিটি কাটিং ২৫-৩০ সেন্টিমিটার (সারিসারি) দুরত্বে, ও ২০-২৫ সেন্টিমিটার (কাটিং-কাটিং) দূরে ও ৫-৬ সেন্টিমিটার গভীরে রোপন করতে হবে।
প্রতিটি গর্তে ২টি করে কাটিং রোপন করতে হবে।
ঘ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের পরিমাণ:
সার | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে: ১ম কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে: ২য় কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে: ৩য় কিস্তি |
গোবর/ভার্কিম্পোস্ট | ৫ টন/হেক্টর | সব | – | – | – |
ইউরিয়া | ২২৫ কেজি | – | ৭৫ কেজি | ৭৫ কেজি | ৭৫ কেজি |
টিএসপি | ২৭৫ কেজি | সব | – | – | – |
এমওপি | ১৮০ কেজি | সব | – | – | – |
জিপসাম | ১১০ কেজি | সব | – | – | – |
প্রয়োগ পদ্ধতি:
সম্পূন গোবর, টিএসপি, এমপি, জিপসাম জমি তৈরীর সময় দিতে হবে।
ইউরিয়া ৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম ভাগ কাটিং লাগানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে, ২য় ভাগ কাটিং লাগানোর ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
সাধারনত সকাল বেলা কিংবা বিকাল বেলা জমিতে সার প্রয়োগ করতে হয়।
প্রতি কিস্তি সার জমিতে সেচ দেওয়ার পর পানি বের করে দিয়ে অর্থাৎ জমিতে সেচ দেওয়ার পর যখন কোন পানি জমিতে জমে না থাকে সে সময় সার প্রয়োগ করতে হবে। কারন সেচের পর জমিতে সার প্রয়োগ করলে সার তাড়াতাড়ি মাটির সাথে মিশে যায়। এভাবে সার প্রয়োগ করলে সারের অপচয় কম হয়।
ঙ) আন্তঃপরিচর্যা
পুদিনার কাটিং লাগানোর পর একটি প্লাবন সেচ দিতে হবে।
কাটিং লাগানো এবং সেচের পর জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মাতে পারে। আগাছা জমির রস ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত করে। এই জন্য ২-৩ বার বা ততোধিক নিড়ানী দিয়ে জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
জমির জোঁ অবস্থা দেখে ২৫-৩০ দিন পর পর৩-৪টি সেচ দিতে হবে।
চ) ফসল সংগ্রহ
চারা লাগানোর ৭০-৮০ দিন পর থেকে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
গাছের গোড়া থেকে ২-৩ ইি উপরে পাতাসহ ডগা কেটে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ফসল সংগ্রহের পর বাজার জাতকরনের জন্য পাতা/ ডগা ভালভাবে পরিস্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।
বছরে ৫-৬ বার ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ছ) ফলন
পাতা ও ডগাসহ প্রতি হেক্টরে ১২-১৬ টন ফলন পাওয়া যায়।
(৩) পুদিনা চাষে রোগ ও পোকা ব্যবস্থাপনা
পুদিনায় রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয়।
পাতা পোড়া রোগ দেখা দিলে এমিস্টারটপ (১মিলি/লিটার) ৭দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
অনেক সময় পাতায় পোকা আক্রমণ করে এবং পাতা খেয়ে ফেলে। এক্ষেতে রিপকর্ড (০.৫মিলি/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]