আলুবোখারা বা প্লাম (Prunus domestica) রোজেসি (Rosaceae) পরিবারভুক্ত বাংলাদেশের স্বল্প ব্যবহৃত একটি উচ্চ মূল্যের ফল জাতীয় মসলা ফসল।
এটি পিচ, চেরী ও বার্ত চেরী এর সমগোত্রীয় ফল প্রধানত মসলা হিসাবে ও আচার বা চাটনীতে ব্যবহার করা হয়।
শুকনা আলুবোখারা (যা প্রুন নামে পরিচিত) মিষ্টি, রসালো এবং এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। পাকা ফল ডিপ ফ্রীজে সারা বছর রেখে তা থেকে সরবত বা চাটনি তৈরি করে খাওয়া যায়।
(১) আলুবোখারা গাছের জাত ও বৈশিষ্ট্য
বারি আলুবোখারা-১:
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত বারি আলুবোখারা-১ জাতটি ২০১৩-১৪ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এর গাছ মাঝারি আকারের, ৫-৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে শাখা ছাটাই না করলে এর গাছ ১২ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে।
- ফেব্রুয়ারি মাসে এ জাতটিতে ফুল আসে আর জুন মাসে ফল পাকে।
- আকর্ষণীয় উজ্জ্বল লাল রঙের মাঝারী আকারের (৮.৬৬ গ্রাম/ফল) সুগন্ধিযুক্ত ফল।
- এর ফলের খাদ্যাংশ বেশি (৯৭%) এবং মাঝারী টক মিষ্টি স্বাদের (টিএসএস ১১.০)।
- গাছে প্রচুর ফল ধরে (গড়ে ১,৪০০টি), ১১.৩ কেজি বা হেক্টরপ্রতি ৭.০৩ টন।
- এ জাতটিতে রোগবালাই এর আক্রমণ অনেক কম।
(২) আলুবোখারা চাষ পদ্ধতি ও গাছের যত্ন
ক) আবহাওয়া ও মাটি
- সাধারণত শীত প্রধান ও অবউষ্ণ আবহাওয়া আলুবোখারা চাষের জন্য উপযোগী। তার ০-৭.২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
- আলুবোখারা রৌদ্র উজ্জ্বল আবহাওয়া ও সুনিষ্কাশিত উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভাল হয়।
- পাহাড়ের ঢালে ও পাহাড়ের উপরে ভাল বায়ু চলাচল উপযোগী পর্যাপ্ত সূর্যালোকে এর উৎপাদন ভাল হয়।
খ) রোপণ পদ্ধতি ও সময়
সমতল ভূমিতে আলুবোখারা চারা সাধারণত বর্গাকার বা ষড়ভুজী প্রণালীতে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ে কন্টুর রোপণ প্রণালী অনুসরণ করতে হবে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত আলুবোখারা চারা রোপণ করা যায়।
গ) রোপণ স্থান
সারি-সারি ৪-৫ মিটার, চারা-চারা ৩-৪ মিটার।
ঘ) বংশ বিস্তার
- বীজ থেকে উৎপাদিত চারা বা কলমের মাধ্যমে আলুবোখারার বংশ বিস্তার করা যেতে পারে। মাতৃ গাছের গুণগত মান বজায় রাখা ও দ্রুত ফলন পাওয়া যায় বলে কলমের চারাই উত্তম।
- ২,০০০-৪,০০০ পিপিএম মাত্রার ইনডোল বিউটাইরিক এসিড (আইবিএ) প্রয়োগে গুটি কলম এর সাফল্য বাড়ে।
- মাতৃগাছ থেকে আলাদা করা কলম পাতা ও শাখা ছাটাই করে পলিব্যাগে ২/১ মাস রেখে ভালভাবে শিকড় ও পাতা গজানোর পরে জমিতে লাগানো যেতে পারে।
- বীজ থেকে উৎপাদিত চারার উপর ক্লেফ্ট বা ভিনিয়ার কলম করে সহজেই কলমের চারা উৎপাদন করা যায়।
ঙ) মাদা তৈরি
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৪-৫ মিটার দূরের সারিতে ৪ মিটার দূরে দূরে ৭৫ × ৭৫ × ৬০ সেমি আকারের গর্ত তৈরি করে উপরের মাটি একপাশে ও নিচের মাটি অন্য পাশে রাখতে হবে।
প্রতি গর্তে পচা গোবর অথবা কম্পোস্ট ১০-১৫ কেজি, ৩-৫ কেজি ছাই, টিএসপি ৩০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ গ্রাম, ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, জিপসাম ১৫০ গ্রাম, দস্তা ১০ গ্রাম ও বোরন ১ গ্রাম পরিমাণে ভালভাবে উপরের মাটির সাথে মিশিয়ে উপরের মাটি নিচে আর নিচের মাটি উপরে দিয়ে গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে।
গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে।
চ) চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা
- ভাল উৎপাদন ও আগাম ফলন পেতে আলুবোখারার এক বছর বয়সী সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত কলমের চারা রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
- গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা/কলমটি গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগিয়ে তারপর চারদিকে মাটি দিয়ে চারার গোড়ায় মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে।
- রোপণের পরপর খুটি দিয়ে চারা/কলমটি খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। অতঃপর প্রয়োজনমতো পানি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- শুকনা মৌসুমে গাছে নিয়মিত সেচ ও আগাছা হলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছ) গাছে সার প্রয়োগ
আশানুরূপ গুণগত মানসম্পন্ন ফল পেতে হলে আলুবোখারা নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছে সার প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি গাছের জন্য সারের পরিমাণ নিম্নরূপ হবে।
সারের নাম | সারের নাম: ১-৩ বছর | গাছের বয়স: ৪-৭ বছর | গাছের বয়স: ৮-১০ বছর | গাছের বয়স: ১০ বছর এর উর্ধ্বে |
গোবর/কম্পোস্ট | ১০-১৫ | ১৫-২০ | ২০-২৫ | ২৫-৩০ |
ইউরিয়া (গ্রাম) | ২০০-৩০০ | ৩০০-৪০০ | ৫০০-৮০০ | ১০০০ |
টিএসপি (গ্রাম) | ১৫০-২০০ | ২০০-৩০০ | ৩০০-৪০০ | ৫০০ |
এমওপি (গ্রাম) | ১৫০-২০০ | ২০০-৩০০ | ৩০০-৪০০ | ৫০০ |
সবটুকু সার তিন ভাগ করে বৈশাখন্ডজ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র-আশ্বিন ও মাঘ-ফাল্গুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতিবার সার দেওয়ার পর প্রয়োজনে পানি দিতে হবে।
জ) আগাছা দমন
গাছের গোড়া নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পাহাড়ের ঢালে, বাড়ির আঙ্গিনা, রাস্তার ধার বা পুকুর পাড়ে লাগানো গাছের গোড়ায় আগাছা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে।
ঝ) সেচ প্রয়োগ
চারা রোপণের প্রথমদিকে প্রয়োজনমতো সেচ দেয়া দরকার। খরা বা শুকানো মৌসুমে পানি সেচ দিলে ফল ঝরা কমে, ফলন বৃদ্ধি পায় এবং ফলের আকার ও অন্যান্য গুণাগুণ ভাল হয়।
ঞ) ডাল ছাঁটাইকরণ
চারা অবস্থায় গাছকে সুন্দর কাঠামো দেয়ার জন্য অবাি ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করে রাখতে হবে। ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ও পোকামাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে।
ট) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- আলুবোখারার ফল নন-ক্লাইমেক্টরিক হওয়ায় গাছ থেকেই ভালভাবে পাকার পর তা সংগ্রহ করতে হয়। আলুবোখারার ফল ভালভাবে পেকে গাঢ় লাল বা হালকা খয়েরী রং ধারণ করলে এবং ফল নরম হলেই সংগ্রহ করা উচিৎ।
- হালকা লাল বা হলুদ আবস্থায় সংগ্রহ করা হলে তা অত্যন্ত টক বা হালকা তেতো স্বাদেরও হতে পারে।
- বারি আলুবোখারা -১ এর বা এ জাতের প্রতি পূর্ণবয়স্ক (১০-২০ বছর) গাছে দেড় থেকে তিন হাজার পর্যন্ত ফল পাওয়া যেতে পারে।
- হেক্টরপ্রতি ৭ থেকে ১০ টন ফ্রেশ পাকা ফল পাওয়া যেতে পারে।
(৩) আলুবোখারা চাষে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
‘বারি আলুবোখারা-১’ এ কোন পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়নি। শুধুমাত্র পাতার দাগ বা লিফ স্পট রোগ দেখা গেছে। ম্যানকোজেব বা এ জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করেই তা দমন করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]