মেথী Fabaceae পরিবার ভূক্ত একটি বর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় গাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম Trigonella foenum-graecum L.। এটির উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেথীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। যেমন- Fenugreek, Greek hay, Greek clover, Bird’s foot, Hu lu ba, Trigonella এবং Bockshornklee।
মেথীর সবুজ কঁচি পাতা ও কান্ড সুস্বাদু সবজি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মেথী শাক খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ সমৃদ্ধ। মেথীর বীজ নানা প্রকার তরকারী, আচার, চাটনী ইত্যাদির স্বাদ ও সুগন্ধ বৃদ্ধির উপকরণ হিসাবে বেশ জনপ্রিয়।
মেথীর যথেষ্ট ঔষধি মূল্য রয়েছে। বহুমুত্র রোগ নিয়ন্ত্রনে মেথী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দুর করে এবং হজম শক্তি ও রুচি বৃদ্ধি করে। মেথীর বীজ, পাতা, কান্ড আমিষ ও শর্করা সমৃদ্ধ।
(১) মেথীর জাত ও গাছের বৈশিষ্ট্য
ক) বারি মেথী-১
- গাছের উচ্চতা ৫৫-৬০ সেমি।
- প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৪-৫টি।
- প্রতি গাছে পডের সংখ্যা ৪০-৪৫টি।
- প্রতিটি পডের দৈঘ্য ৭-৯ সেমি।
- প্রতিটি পডে ১০-১২টি বীজ থাকে।
- বীজগুলো শুষ্ক ও হলুদাভ বাদামী বর্ণের।
- এই জাতে রোগবালাই নেই বললেই চলে।
- প্রতি হেক্টরে এর ফলন ১.২-১.৫ টন।
খ) বারি মেথী-২
- গাছের উচ্চতা ৬০-৭০ সেমি।
- প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৬-৭টি।
- মেথীর ফলকে ‘পড’ বলে।
- প্রতি গাছে পডের সংখ্যা ৬০-৬৫টি।
- প্রতিটি পডের দৈর্ঘ্য ৯-১০ সেমি যার প্রতিটিতে ১০-১২টি বীজ থাকে।
- বীজ হলুদাভ বাদামী বর্ণের।
- এই ফসলের রোগবালাই কম।
- প্রতি হেক্টরে ফলন ১.৮-২.১ টন।
গ) বারি মেথী-৩
- বারি মেথী-৩ এর গাছ মাঝাড়ি উচ্চতা বিশিষ্ট্য (৬০-৭০ সেমি) হওয়ায় গাছ মাটিতে নুইয়ে পরেনা।
- গাছ ঝোপালো হওয়ায় প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৮-১০ টি।
- মেথীর ফলকে ‘পড’ বলে। প্রতি গাছে পডের সংখ্যা ৭০-৮০ টি। প্রতিটি পডের দৈর্ঘ্য ১০-১১ সেমি যার প্রতিটিতে ১২-১৫টি বীজ থাকে।
- বীজ হলুদাভ বাদামী বর্ণের।
- এই ফসলের রোগবালাই কম।
- বারি মেথী-৩ এর জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন হওয়ায় এটি বারি মেথী-১ ও বারি মেথী-২ এর তুলনায় ১৫-২০ দিন পূর্বে কর্তন করা যায়।
- প্রতি হেক্টরে ফলন ২.০-২.৩ টন।
(২) মেথী চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি
মেথী রবি মৌসুমে চাষ করা হয়। প্রায় সব প্রকার মাটিতে চাষ করা সম্ভব।
তবে পলি দোআঁশ মাটি থেকে বেলে দোআঁশ মাটি মেথী চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত।
মেথী গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য মাটির অম্লতা (পিএইচ ৬-৭) পরিমিত মাত্রায় হলে ভাল হয়।
খ) জমি তৈরি ও বীজ বপন পদ্ধতি
মেথী চাষের জন্য জমি খুব ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে যাতে কোন প্রকার ঢেলা না থাকে। মাটি ও জমির প্রকারভেদে ৪-৬টি চাষ ও মই দেয়া প্রয়োজন হতে পারে।
মাটিতে সরাসরি বীজ বুনে মেথী চাষ করা যায়। আবার তৈরিকৃত জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি বজায় রেখে বীজ বপন করা যায়।
পরে যখন চারা গাছ ৪-৫ পাতা বিশিষ্ট হয় তখন গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫ সেমি বজায় রেখে চারা পাতলা করে দিতে হবে।
সাধারণত ১ মিটার প্রস্থ ভিটিতে বীজ বপন করতে হয়। সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধার জন্য পাশাপাশি দুটি ভিটির মাঝখানে ৫০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
গ) বপনের সময়
কার্তিক (মধ্য আগস্ট-মধ্য নভেম্বর)।
ঘ) বীজের পরিমাণ
হেক্টরপ্রতি ১৫-২০ কেজি (ছিটিয়ে বোনার ক্ষেত্রে) ও ১০-১৫ কেজি (সারিতে বপনের ক্ষেত্রে)।
ঙ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
উচ্চ ফলন পাওয়ার জন্য সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের মাত্রা জমির ঊর্বরতার উপর নির্ভরশীল।
প্রতি হেক্টরে নিম্নলিখিত পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয়।
সারের নাম | পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | পরবর্তী পরিচর্যা |
গোবর | ৫ টন | সব | – |
ইউরিয়া | ১৭৫ কেজি | ৮৮ কেজি | ৮৭ কেজি |
টিএসপি | ১৭৫ কেজি | সব | – |
এমওপি | ১৩৫ কেজি | সব | – |
জিপসাম | ১১০ কেজি | সব | – |
সম্পূর্ণ গোবর সার, টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম এবং অর্ধেক ইউরিয়া শেষ চাষের সময় দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া লাগানোর ৩০ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
চ) আন্তঃপরিচর্যা
গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধির সময় আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে এবং ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪টি নিড়ানী দিতে হবে।
সেচের পর ‘জো’ আসা মাত্র মাটির উপরের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। এতে মাটির ভিতর আলো বাতাস প্রবেশ করে এবং মাটি অনেকদিন রস ধরে রাখতে পারে যা পরবর্তী সময়ে গাছের দ্রুত বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে থাকে।
মাটির প্রকারভেদে জমির সেচ প্রয়োগ করতে হবে। অতিরিক্ত পানি নালা দিয়ে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ছ) ফসল সংগ্রহ
বীজ বপনের পর থেকে ১১০-১৩৫ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত চৈত্র মাসে (মধ্য মার্চ-মধ্য এপ্রিল) যখন শুঁটিসমূহ (পড) হলদে বাদামী ও কালচে বর্ণ ধারণ করে তখন গাছ কাটা হয়।
জ) মাড়াই-ঝাড়াই ও সংরক্ষণ
ফসল কর্তনের পর গাছ ১-২ দিন ছায়ায় রাখতে হয়। এরপর মাড়াই করার জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই করা হয়।
মাড়াই এর পর বীজ ঝেড়ে পলিব্যাগে বায়ুরুদ্ধ ভাবে সিল করে কাচ, প্লাস্টিক, টিন বা মাটির পাত্রে বায়ুরুদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়। বীজের রং, সুগন্ধ ও গুনাগুন বজায় রাখার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা উচিত।
(৩) মেথী চাষে রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
‘বারি মেথী-১’ ও ‘বারি মেথী-২’ এ কোন মারাত্মক রোগ হয় না বললেই চলে। তবে জমিতে রস বেশি থাকলে গোড়া পচা রোগ দেখা যায়। ছোট চারায় এই রোগ বেশি হয় বলে চারা যথা সময়ে পাতলা করে দিতে হবে।
রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা রিডোমিল বা রোভরাল কার্বেন ডাজিম মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
এ জাতে তেমন কোন পোকার আক্রমণ হয় না।
[সূত্র: বিএআরআই]