গোল মরিচ বহুবর্ষজীবী লতা জাতীয় গাছ। চির সবুজ পাতা অনেকটা পানের মতো। গোল মরিচ গাছের আপন আকর্ষি দিয়ে সহায়ক গাছকে আকড়িয়ে থাকে। ইহা ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের চির হরিৎ বন ভূমির একটি দেশিয় গাছ।
(১) গোলমরিচের জাত পরিচিতি
জৈন্তিয়া গোলমরিচ:
জৈন্তিয়া গোলমরিচ জাতটি মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকা থেকে আনা বিভিন্ন জাত থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৯২ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কতৃক অনুমোদিত হয়।
- এ জাতটি ভাল বাওনী পেলে ১০-১১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
- প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয়।
- স্বাদ ঝাল, দানা পুষ্ট ও বড় আকৃতির।
- গাছপ্রতি ফলন ১.২৫-১.৫০ কেজি শুকনা গোল মরিচ।
- হেক্টর প্রতি ফলন ১.৫-২.০ টন/হেক্টর (শুকনা মরিচ)।
(২) গোলমরিচ চাষ পদ্ধতি/কৌশল
ক) চারা উৎপাদন
কেবল অযৌন পদ্ধতিতে গোলমরিচের বংশ বিস্তার হয়। সেন্ট্রাল সিডার যা প্রধান গাছের গোড়া থেকে গজায় এমন লতা থেকে চারা (কাটিং) সংগ্রহ করাই উত্তম।
কমপক্ষে ৩-৪টি গিঁটসহ ৩০-৪৫ সেমি লম্বা শাখা কাটিং হিসেবে নিতে হবে।
কাটিংগুলো সরাসরি সহায়ক গাছের গোড়ায় লাগানো যেতে পারে এতে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়।
বীজতলায় কাটিং লাগালে ২০-৩০ দিনের মধ্যে নতুন কুঁড়ি বের হতে শুরু করে। এক বছর বয়সের কাটিং বাগানে লাগানো উত্তম।
খ) জমি তৈরি
গোলমরিচের জন্য পাহাড়ী ঊর্বর দোআঁশ মাটি প্রয়োজন এবং দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
গ) চারা রোপণ
মে-আগস্ট মাসে প্রত্যেক সহায়ক বৃক্ষের পাশে তৈরি গর্তে ২-৩টি কাটিং লাগাতে হবে এরপর পানি দিতে হবে।
কাটিংগুলি সহায়ক বৃক্ষের উত্তর পার্শ্বে লাগানো হলে সূর্যের তাপ কম লাগবে। সূর্য তাপ হতে প্রাথমিকভাবে রক্ষার জন্য পাতাওয়ালা গাছের ডাল বা অন্য কোনভাবে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
কাঁঠাল, সুপারী, জিগা, সজিনা, শিমুল ইত্যাদি সহায়ক আশ্রয়দাতা গাছ বৃক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঘ) রোপণ দূরত্ব
গাছ রোপণের দূরত্ব ৪ মি. ও প্রতি বেডে সারির দূরত্ব ৪ মি.। গাছের গোড়ার গর্তের আকার ৩০ ⨉ ৩০ ⨉ ৩০ সেমি।
ঙ) সারের পরিমাণ
গাছের বৃদ্ধি এবং ভাল ফলন পেতে হলে সময়মতো প্রয়োজনীয় সার উল্লিখিত হারে প্রয়োগ করতে হবে।
রোপণের সময় সারের পরিমাণ (১নং টেবিল):
সারের নাম | প্রতি গর্তে সারের পরিমাণ | গাছপ্রতি সার: প্রথমবার (বর্ষার শুরুতে) | গাছপ্রতি সার: দ্বিতীয়বার (বর্ষার শেষে) |
গোবর বা কম্পোস্ট (কেজি) | ১০ | – | – |
খৈল (গ্রাম) | ২৫০ | – | – |
টিএসপি (গ্রাম) | ১১৫ | – | – |
ইউরিয়া (গ্রাম) | – | ৫০ | ৫০ |
মিউরেট অব পটাশ (গ্রাম) | ১১৫ | – | – |
বয়স অনুযায়ী গাছপ্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগের সময় নিচে দেয়া হল (২নং টেবিল):
সারের নাম | ১ম বছর | ২য় বছর | ৩য় বছর | ৪র্থ বছর |
গোবর বা কম্পোস্ট (কেজি) | – | ৫ | – | ৫ |
টিএসপি (গ্রাম) | – | ২৫০ | – | – |
ইউরিয়া (গ্রাম) | ৭৫ | ৭৫ | ৭৫ | ৭৫ |
মিউরেট অব পটাশ (গ্রাম) | ৫০ | ৫০ | ৫০ | ৫০ |
চ) সার প্রয়োগ
প্রথমবার সার প্রয়োগ করতে হবে বর্ষা শুরু হওযার পূর্বে অথবা বৈশাখ মাসে (মধ্য-এপ্রিল থেকে মধ্য-মে) এবং ২য় বার বর্ষার শেষে অর্থাৎ আশ্বিন (মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য-অক্টোবর) গর্তগুলি ১০-১২ দিন খোলা রাখার পর প্রতি গর্তে উক্ত গোবর ও সার (১নং টেবিল) গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে পূর্ণ করে রাখতে হবে।
ছ) পানি সেচ
রোপণের সময় মাটি শুকনো থাকলে সেচ দিতে হবে। খরা মৌসুমে এমনভাবে সেচ দিতে হবে যাতে মাটিতে সব সময়ে রস থাকে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি একটি ছিদ্রযুক্ত কলসি অথবা ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগ পানি ভর্তি করে সহায়ক গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ছিদ্র দিয়ে সারাক্ষণ ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে থাকলে গাছের বৃদ্ধি এবং ফলের জন্য সবচেয়ে উপকারী।
অতি বৃষ্টির সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেজন্য নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
জ) ছাঁটাইকরণ
গোলমরিচ গাছের শাখা-প্রশাখা বেড়ে অতিরিক্ত ঝোপ হয়ে গেলে তা সামান্য পরিমাণে ছেঁটে পাতলা করে দিতে হবে।
প্রথম পাঁচ বছর গোলমরিচ গাছের তেমন কোন ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয় না। তবে ফসল সংগ্রহের সুবিধার জন্য লতার আগা কেটে দেয়া যেতে পারে। এতে পার্শ্ব শাখাগুলো মজবুত এবং অধিক ফল দেয়।
বর্ষা মৌসুমে গোলমরিচ গাছ যেন প্রচুর আলো-বাতাস পায় সেজন্য প্রয়োজনমতো সহায়ক গাছ বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ছেঁটে দিতে হবে।
ছ) রোগ ও পোকা দমন
গোলমরিচের গোড়া পচা রোগ দেখা দিলে ডায়াথেন ৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২-৫ গ্রাম হারে ৭ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গোলমরিচে লাল ও কালো পিপড়ার আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এদের ধ্বংস করতে হবে।
জ) মাড়াই ও ফলন
লতা রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যে ফসল ধরা শুরু হয়। একটি গাছ পূর্ণ উৎপাদনের অবস্থায় আসে ৭-৮ বছর বয়সে এবং ২০ বছর পর্যন্ত ভাল ফলন দেয়।
গোলমরিচ গাছে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথমার্ধে ফুল আসে। ১০-১৫ সেমি লম্বা গুচ্ছে খুব ছোট হলুদ ফুল ফোটে যা পরবর্তী সময়ে পাকা বেরিতে (ফল) রূপান্তরিত হয়। ডিসেম্বর (মধ্য-অগ্রহায়ণ থেকে মধ্য-পৌষ) মাসের শেষ ভাগে যখন ২-১টি ফল লাল হয় তখনই সম্পূর্ণ গুচ্ছটি কেটে নিত হয়।
পূর্ণবয়স্ক একটি গাছ গড়ে ২.৫-৩ কেজি কাঁচা গোল মরিচ ফলন দেয় যা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শুকানোর পর গড়ে ১.২৫-১.৫০ কেজি হয়।
ঝ) ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ
সংগ্রহের পর ফলগুলো গুচ্ছ থেকে আলাদা করে একটি পাত্রে জমা করতে হবে। তারপর দানাগুলো ফুটন্ত পানিতে ১০ মিনিট সিদ্ধ করে পানি ঝরা দিয়ে ফলগুলো রোদে শুকাতে হবে।
যে পানিতে দানাগুলো সিদ্ধ করা হয়েছে সেই পানি কিছুক্ষণ পর পর দানাগুলোর উপর ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে শুকনা গোল মরিচের রং সুন্দর হয়, সুগন্ধ অটুট থাকে এবং ঝাল নষ্ট হয় না। এভাবে ৬-৭ দিন ভালভাবে রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]