বিশ্বে শুধুমাত্র পাতা ব্যবহারের জন্য অনেক প্রজাতির পেঁয়াজের গাছ চাষ করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে পাতা খাওয়ার জন্য Japanese bunching onion (Allium fistulosum) নামের প্রজাতিটি চাষ করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যকে রুচিকর সুগন্ধপূর্র্ণ করার মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য পাতা পেঁয়াজ খাদ্যাদিতে মেশানো হয়। বিভিন্ন প্রকার সুপের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ও সালাদ তৈরি করতে এটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূলছাড়া গাছের সমস্ত অংশ (Tops and long leaf base) সালাদ বা সবজির সাথে খাওয়া হয়।
(১) পাতা পেঁয়াজের জাত পরিচিতি
বারি পাতা পেঁয়াজ-১:
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত ‘বারি পাতা পেঁয়াজ-১’ জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০১৩ সালে অনুমোদিত হয়েছে।
- এ জাতটির একটি গাছ থেকে অনেকগুলি কুশি (Tiller) উৎপাদন হয়ে থাকে।
- সাধারণ পেঁয়াজের মত বাল্ব হয় না। বাল্বের স্থানে balanced predostem উৎপন্ন হয়।
- এর গাছের উচ্চতা মাঠে পাতা পেঁয়াজ (বামে) ও সংগ্রহকৃত পাতা পেঁয়াজ (ডানে) ৪৩-৬০ সেমি।
- প্রতিটি গাছ ৬-৮টি কুশি উৎপাদন করে যার প্রতিটিতে ১০-১২টি আকর্ষণীয় গাঢ় সবুজ রঙের পাতা থাকে। পাতা ব্যাস ১.৬-১.৮ সেমি হয়ে থাকে।
- এ জাতটি একবার রোপণ করে নভেম্বর পর্যন্ত ৩-৪ বার পাতা সংগ্রহ করা যায়।
- বারি পাতা পেঁয়াজ-১ এর হেক্টরপ্রতি পাতার ফলন ১৪-১৫ টন এবং বীজের ফলন ৮০০-১,০০০ কেজি।
- বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ভালভাবে খাপ খাওয়ানো এ জাতটিতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব নাই।
(২) পাতা পেঁয়াজ চাষের পদ্ধতি বর্ণনা
ক) আবহাওয়া ও মাটি
- পাতা পেঁয়াজ ঠান্ডা ও গরম উভয় তাপমাত্রায় জন্মাতে পারে। তবে ঠান্ডা থেকে মধ্যম তাপমাত্রা বিরাজমান দেশেই বেশি ভাল হয়ে থাকে।
- পাতা পেঁয়াজ সকল ধরনের মাটিতে জন্মে থাকে তবে বেলে-দোআঁশ ও পলি-দোআঁশ মাটিতে ভাল ফলন দিয়ে থাকে।
- মাটির pH ৫.৮-৬.৫ থাকা ভাল। মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ থাকা ভাল।
- পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্চনীয়।
খ) বংশ বিস্তার
বীজ বা কুশি (tiller) এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয়। তবে বীজের মাধ্যমেই বেশি হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৫-৬ কেজি বীজের প্রয়োজন।
গ) বীজ বপন ও চারা উত্তোলন
- জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়।
- বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পরে ১২ ঘণ্টা শুকনা কাপড়ে বেধে রেখে দিলে বীজের অঙ্কুর বাহির হয়।
- বীজতলায় পচা গোবর সার দিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করা হয়।
- বিভিন্ন ধরনের পোকা ও কৃমি দমনের জন্য বীজতলায় ফুরাডান ব্যবহার করাই ভাল।
- পরে বীজতলায় বীজ বপন করে হাত দিয়ে বীজতলায় চাপ দিতে হয়।
- বীজতলায় আগাছা নিড়ানো সহ অন্যান্য পরিচর্যা করা হয়।
- চারা উত্তোলন করতে ৪৫-৫০ দিন সময় লাগে।
ঘ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ
- জমিতে ৩-৪টি চাষ মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।
- চাষের আগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পচা গোবর সার দিতে হয়।
- চারা ১৫ ⨉ ১০ সেমি দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করা হয়।
- চারা একটু গভীরে লাগানো ভাল। মাঝে মাঝে পেঁয়াজের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হয়।
ঙ) সার প্রয়োগ
পাতা পেঁয়াজের জীবনকাল দীর্ঘ (১৫০-১৬৫) দিন। সেজন্য সারের প্রয়োজন অনেক বেশি।
হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ:
সার | মাট পরিমাণ | শেষ চাষে | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ১ম কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ২য় কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ৩য় কিস্তি |
গোবর | ১০ টন | সব | – | – | – |
টিএসপি | ২৭৫ কেজি | সব | – | – | – |
এমওপি | ১৫০ কেজি | ৫০ কেজি | ৩৪ কেজি | ৩৩ কেজি | ৩৩ কেজি |
ইউরিয়া | ২৫০ কেজি | ৭০ কেজি | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি |
জিপসাম | ১১০ কেজি | সব | – | – | – |
জিংক সালফেট | ১০ কেজি | সব | – | – | – |
বোরিক এসিড | ১০ কেজি | সব | – | – | – |
প্রয়োগ পদ্ধতি:
জমিতে শেষ চাষের পূর্বে সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক ও বোরন সার ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর ইউরিয়া ও এমপি সার যথাক্রমে শেষ চাষে, প্রথম কিস্তি গাছের বয়স ২৫-৩০ দিন, ২য় কিস্তির গাছের বয়স ৫০-৫৫ দিন এবং ৩য় কিস্তি গাছের বয়স ৭০-৭৫ দিন হলে উপরের ছকে উল্লেখিত পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করতে হবে।
চ) আগাছা নিড়ানো ও পানি সেচ
- আগাছা দেখা দিলে নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। আগাছা নিড়ানো ও গোড়ায় মাটি দেওয়া ৩-৪ বার প্রয়োজন হতে পারে।
- সার প্রয়োগের পরপর বা অন্য কোন সময় পানি দরকার হলে জমিতে সেচ দিতে হবে।
- জমিতে অতিরিক্ত পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
ছ) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহকালীন সময় মাটির উপরের সম্পূর্ণ অংশ সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে।
- বাজারজাত করার জন্য হাত দিয়ে সমস্ত গাছটি টেনে তুলতে হয়। তুলে মূল কেটে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়।
- ২০-২৫ দিন পরপর মাটির উপরের অংশ কেটে খাওয়া যায়।
- পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহের সাথে সাথেই বাজার জাত করা উচিত। ছোট ছোট আটি বেধে বাজারে বিক্রয় করা যায়।
- মূল ব্যতীত সমস্ত গাছের ওজন হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ টন যার মধ্যে খাদ্যোপযোগী পাতা ১০-১২ টন থাকে।
জ) বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
- বীজ যখনই বপন করা হউক না কেন ডিসেম্বর মাসে পাতা পেঁয়াজের ফুল আসে। ফুল আসার সময় হেক্টর প্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি করে ইউরিয়া এবং পটাস সার প্রয়োগ করতে হবে।
- সাধারণত জুন-জুলাই মাসে বীজ মাড়াই করা যায়।
- সকল আম্বেলের বীজ একসাথে পরিপক্ক হয় না। তাই কয়েক দিন পরপর পরিপক্ক আম্বেল সংগ্রহ করা হয়। একটি আম্বেলের মধ্যে শতকরা ১৫-২০টি ফল ফেটে কালো বীজ দেখা গেলে আম্বেলটি কেটে বা ভেঙ্গে সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে মাঠে ঘুরে ঘুরে আম্বেল সংগ্রহ করতে হবে। মাঠে সমস্ত আম্বেল সংগ্রহ করতে ৩-৪ দিন লাগতে পারে।
- বীজ আম্বেল সংগ্রহ করার পর রোদে শুকিয়ে হালকা লাঠি দ্বারা পিটিয়ে বীজ বাহির করতে হবে। পরে বীজ রোদে ভালভাবে শুকিয়ে ছিদ্রবিহীন পলিথিন বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
- হেক্টরপ্রতি ১,০০০-১,২০০ কেজি বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে।
(৩) পাতা পেঁয়াজের চাষে রোগ বালাই দমন ব্যাবস্থাপনা
পাতা পেঁয়াজ পার্পল ব্লচ ও অন্যান্য ব্লাইট রোগের প্রতিরোধী। তবে কোন রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেন এম-৪৫/রোভরাল এর যে কোন একটি বা একাধিক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা যেতে পারে।
থ্রিপ্স পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। আগাছা পরিষ্কার, আবর্জনা আগুনে পোড়া, শস্য আবর্তন করা উত্তম। পোকা দমনের জন্য সর্বশেষে ম্যালাথিয়ন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
[সূত্র: বিএআরআই]