Skip to content

 

উচ্চফলনশীল গমের জাত ও গম চাষ পদ্ধতি: উপযোগী মাটি, উপযুক্ত সময় ও সার প্রয়োগ এবং অন্যন্য পরিচর্যা

উচ্চফলনশীল গমের জাত ও গম চাষ পদ্ধতি, উপযোগী মাটি, উপযুক্ত সময় ও সার প্রয়োগ এবং অন্যন্য

আলোচ্য বিষয়:

বাংলাদেশে খাদ্য ফসল হিসেবে গম দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে গম চাষ এত দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, গমের চাষ সহজ, সেচ পানির চাহিদা কম এবং রোগ ও পোকার আক্রমণের তেমন সমস্যা নেই।

গম আটার প্রতি ১০০ গ্রাম আটায় আমিষ ১২.১ গ্রাম, শর্করা ৬৯.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ১১.৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ২৯ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.৪৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.২৯ মিলিগ্রাম, আঁশ ১.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ২.৭ গ্রাম এবং জলীয় অংশ থাকে ১২.২ গ্রাম।

গম ফসল, ইনসেটে গমের দানা
গম ফসল, ইনসেটে গমের দানা

গম সাধারণত মানুষের রুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গমের কুঁড়া গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে অধিক আবাদকৃত গম জাতের মধ্যে ‘বারি গম-২৫’, ‘বারি গম-২৬’, ‘বারি গম-২৭’, ‘বারি গম-২৮’, ‘বারি গম-২৯’,‘বারি গম-৩০’,‘বারি গম-৩১’, ‘বারি গম-৩২’ এবং ‘বারি গম-৩৩’ ইত্যাদি অন্যতম রোগ প্রতিরোধী উচ্চ ফলনশীল জাত।

(১) উচ্চ ফলনশীল গমের জাত সমূহ ও উক্ত গম গাছের বৈশিষ্ট্য

ক) বারি গম-৩১

গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি
গম-৩১ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। KAL/BB, YD এবং PASTOR নামক ৩টি CIMMYT জাতের সংগে সংকরায়ণের মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। বিভিন্ন আবহাওয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিএডাব্লিউ ১১৮২ নামে এ জাতটি নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন নার্সারি ও ফলন পরীক্ষায় এ কৌলিক সারিটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়।

বারি গম-৩১
বারি গম-৩১

বৈশিষ্ট্য:

  • জাতটি তাপ সহনশীল, দানা সাদা ও আকারে মাঝারী।
  • আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্যও এ জাতটি উপযোগী।
  • চার থেকে ছয়টি কুশি বিশিষ্ট গাছের উচ্চতা ৯৫-১০০ সেন্টিমিটার।
  • পাতা চওড়া ও গাঢ় সবুজ।
  • শীষ বের হতে ৫৯-৬৫ দিন এবং বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৫-১০৯ দিন সময় লাগে।
  • শীষ লম্বা এবং প্রতি শীষে দানার সংখ্যা ৪৫-৫২টি।
  • দানার রং সাদা, চকচকে ও আকারে মাঝারী (হাজার দানার ওজন ৪৬-৫২ গ্রাম)।
  • জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং তাপ সহিষ্ণু।
  • উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪৫০০-৫০০০ কেজি।
  • জাতটি আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্য উপযোগী।

খ) বারি গম-৩২

গম গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি গম-৩২ একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত। গমের প্রচলিত জাত SHATABDI এবং GOURAB জাতের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। বিভিন্ন আবহাওয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিএডাব্লিউ ১২০২ নামে এ জাতটি নির্বাচন করা হয়।

বিভিন্ন নার্সারি ও ফলন পরীক্ষায় এ কৌলিক সারিটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়। গত ফেব্রুয়ারি ২০১৭ প্রস্তাবিত জাতটি বারি গম-৩২ হিসেবে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তক অনুমোদন লাভ করে।

বারি গম-৩২
বারি গম-৩২

আমন ধান কাটার পর দেরিতে বপনের জন্যও এ জাতটি উপযোগী।

গ) বারি গম-৩৩

KACHU এবং SOLALA জাতের মধ্যে সিমিটে সংকরায়নকৃত এজাতটি হারভেস্ট প্লাস ট্রায়ালের মাধ্যমে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

বিভিন্ন আবহাওয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিএডব্লিউ ১২৬০ নামে কৌলিক সারিটি প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়।

পরবর্তীতে বিভিন্ন নার্সারি ও ফলন পরীক্ষায়ও এ কৌলিক সারিটি ভাল বলে প্রমাণিত হয়। জাতটি ২০১৬ ও ২০১৭ সালের ল্যাবরেটরি ও মাঠ পরীক্ষায় ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

এ কৌলিক সারিটি ২০১৭ সালে বারি গম-৩৩ হিসেবে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্ত করা হয়।

বারি গম-৩৩
বারি গম-৩৩

এটি একটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত।

(২) গম চাষ পদ্ধতি, উপযোগী মাটি উপযুক্ত সময় ও সার প্রয়োগ ও অন্যন্য পরিচর্যা

ক) গম চাষে উপযোগী মাটি ও উপযুক্ত সময়

উঁচু ও মাঝারি দোআশ মাটি গম চাষের জন্য বেশী উপযোগী। লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয়।

See also  গম চাষ পদ্ধতি pdf + গম চাষে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা + অন্যান্য পরিচর্যা

নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত (অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত) গম বপনের উপযুক্ত সময়। তবে তাপসহনশীল জাত ডিসেম্বর মাসে ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত বুনলেও অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশি ফলন দেয়।

খ) বীজের পরিমাণ

গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ ও তার বেশি হলে হেক্টরপ্রতি ১২০ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে।

গ) বীজ শোধন

প্রোভেক্স-২০০ নামক ছত্রাক নাশক (প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে) মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে বীজ বাহিত রোগ দমন হয় এবং বীজ গজানোর ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চারা সবল ও সতেজ হয়। বীজ শোধন করলে ফলন শতকরা ১০-১২ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।

ঘ) বপন পদ্ধতি

সারিতে অথবা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপনের জন্য জমি তৈরির পর ছোট লাঙ্গল বা বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে ২০ সে. মি. বা ৮ ইি দূরে দূরে সারিতে এবং ৪-৫ সে. মি. গভীরে বীজ বুনতে হবে।

ধান কাটার পর পরেই পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্পতম সময়ে গম বোনা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে একসঙ্গে জমি চাষ, সারিতে বীজ বপন ও মইয়ের কাজ করা যাবে।

ঙ) সার প্রয়োগ

  • জমি চাষের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৭.৫-১০ টন গোবর/কম্পোস্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম।
  • জৈব সার প্রয়োগ করার পর সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১৫০-১৭৫ কেজি ইউরিয়া, ১৩৫-১৫০ কেজি টিএসপি, ১০০-১১০ কেজি পটাশ ও ১১০-১২৫ কেজি জিপসাম সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে চারার তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি হেক্টরে ৭৫-৯০ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • উল্লেখ্য যে, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। তবে সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির পর জমি ভেজা থাকা অবস্থায় উপরি প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত ইউরিয়া প্রয়োগ করা ভালো।
  • জমিতে প্রায়শ বোরন সারের ঘাটতি দেখা যায় বলে প্রতি হেক্টরে ৬.৫ কেজি হারে বরিক এসিড শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
  • যেসব জমিতে দস্তা সারের ঘাটতি রয়েছে এবং পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা প্রয়োগ করা হয়নি সে সব জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ১২.৫ কেজি দস্তা সার যথা জিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট শতকরা ৩৬ ভাগ জিংক সম্বলিত) শেষ চাষের সময় অন্যান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রয়োগ করা ভালো।
  • জমিতে অম্লীয় মাত্রা ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টরপ্রতি ১০০০ কেজি হারে ডলোচুন গম বপনের কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩ বছরে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।

চ) সেচ প্রয়োগ

  • মাটির প্রকারভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭-২১ দিন পর), দ্বিতীয় সেচ শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর) এবং তৃতীয সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে।
  • তবে মাটির প্রকারভেদে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাল ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা একাধিক সেচ দেয়া ভাল। প্রথম সেচটি খুবই হালকাভাবে দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ এবং চারা সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • সেচের পর পরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।

ছ) অন্যান্য পরিচর্যা

  1. বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বীজ বা চারার সংখ্যা সঠিক থাকে।
  2. বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে ‘জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানী দিতে হবে। নিড়ানীর ফলে মাটি আলগা হবে এবং আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
  3. চওড়া পাতা জাতীয় আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য ২,৪ ডি এমাইন বা এফিনিটি জাতীয় আগাছা দমনকারী ঔষধ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩৫ মিলিলিটার হিসেবে ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে মেঘমুক্ত দিনে একবার প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। সময়মত আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
  4. ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ (জিঙ্ক ফসফাইড বা ল্যানিরেট) দিয়ে দমন করতে হবে।

জ) ফসল সংগ্রহ

গম গাছ সম্পূর্ণরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে কাটার উপযুক্ত সময় হিসেবে গণ্য হবে। গম পাকার পর বেশি দিন ক্ষেতে থাকলে ঝড়/শিলা বৃষ্টিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

See also  গম চাষ পদ্ধতি

রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সকালের দিকে গম কেটে দুপুরে মাড়াই করা উত্তম। মড়াই যন্ত্রের সাহায্যে সহজে গম মাড়াই করা যায়।

ঝ) বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

  • বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণের জন্য শীষ বের হওয়ার পর হতে পাকা পর্যন্ত কয়েকবার অন্য জাতের মিশ্রণ, রোগাক্রান্ত গাছ এবং আগাছা গোড়াসহ উঠিয়ে ফেলতে হবে।
  • বীজ সংগ্রহের জন্য গম পাকার পর হলুদ হওয়া মাত্রই কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে আলাদা করে মাড়াই করতে হবে এবং মাড়াইয়ের পর কয়েক দিন বীজ শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে রাখতে হবে। দানা দাঁতের নিচে চাপ দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে যে, উক্ত বীজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত। সংরক্ষণের পূর্বে পুষ্ট বীজ চালানি দিয়ে চেলে বাছাই করে নিতে হবে।

(৩) গম চাষে রোগবালাই দমনে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা

ক) গমের পাতার মরিচা রোগ দমন

পাক্সিনিয়া রিকন্ডিটা নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতার উপর ছোট গোলাকার হলদে দাগ পড়ে। শেষ পর্যায়ে এই দাগ মরিচার মত বাদামি বা কালচে রঙে পরিণত হয়। হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা ঘষা দিলে লালচে মরিচার মত গুঁড়া হাতে লাগে।

এ রোগের লক্ষণ প্রথমে নিচের পাতায়, তারপর সব পাতায় ও কান্ডে দেখা যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিকার:

  1. রোগ প্রতিরোধী গমের জাত বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২ এবং বারি গম-৩৩ চাষ করতে হবে।
  2. সুষম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
  3. টিল্ট-২৫০ ইসি ছত্রাক নাশক (০.০৫%) ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

খ) গমের পাতার দাগ রোগ দমন

বাইপোলারিস সরোকিনিয়ানা নামক ছত্রাক এ রোগ ঘটায়। গাছ মাটির উপর আসলে প্রথমে নিচের পাতায় ছোট ছোট বাদামি ডিম্বাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীকালে দাগসমূহ আকারে বাড়তে থাকে এবং গমের পাতা ঝলসে যায়। রোগের জীবাণু বীজে কিংবা ফসলের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে।

বাতাসে অধিক আর্দ্রতা এবং উচ্চ তাপমাত্রা (২৫ ডিগ্রি সে.) এ রোগ বিস্তারের জন্য সহায়ক।

প্রতিকার:

  1. রোগমুক্ত জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
  2. গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  3. প্রতি কেজি গম বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম প্রোভেক্স-২০০ মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
  4. টিল্ট-২৫০ ইসি (০.০৪%) ১ মিলি প্রতি ২.০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

গ) গমের গোড়া পচা রোগ দমন

স্কেলেরোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাক দ্বারা গমের এ রোগ হয়। এই রোগের ফলে মাটির সমতলে গাছের গোড়ায় হলদে দাগ দেখা যায়। পরে তা গাঢ় বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং আক্রান্ত স্থানের চারদিকে ঘিরে ফেলে। পরবর্তীকালে পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়।

রোগের জীবাণু মাটিতে কিংবা ফসলের পরিত্যক্ত অংশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। সাধারণত বৃষ্টির পানি কিংবা সেচের দ্বারা এক জমি হতে অন্য জমিতে বিস্তার লাভ করে।

প্রতিকার:

  1. রোগ প্রতিরোধী বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১ এবং বারি গম-৩২ জাতের চাষ করতে হবে
  2. মাটিতে সবসময় পরিমিত আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন।
  3. প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউপি নামক ঔষধ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

ঘ) গমের আলগা ঝুল রোগ দমন

আসটিলেগো ট্রিটিসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। গমের শীষ বের হওয়ার সময় এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। উক্ত ছত্রাকের আক্রমণের ফলে গমের শীষ প্রথম দিকে পাতলা পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। পরে তা ফেটে যায় এবং দেখতে কালো ঝুলের মত দেখায়।

ছত্রাকের বীজকণা সহজেই বাতাসের মাধ্যমে অন্যান্য গাছে এবং অন্য জমির গম গাছে সংক্রমিত হয়। রোগের জীবাণু বীজের ভ্রুণে জীবিত থাকে। পরবর্তী বছর আক্রান্ত বীজ জমিতে বুনলে বীজের অঙ্কুরোদগমের সময় জীবাণু সক্রিয় হয়ে উঠে।

প্রতিকার:

  1. রোগ প্রতিরোধী বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২ এবং বারি গম-৩৩ জাতের চাষ করতে হবে।
  2. রোগমুক্ত জমি হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
  3. প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউপি ঔষধ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

ঙ) গম বীজের কালো দাগ রোগ দমন

ড্রেক্সলেরা প্রজাতি ও অলটারনারিয়া প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা গমের এ রোগ হয়। এ রোগের ফলে গমের খোসায় বিভিন্ন আকারের বাদামি অথবা কালো দাগ পড়ে। বীজের ভ্রুণে দাগ পড়ে এবং পরবর্তীকালে দাগ সম্পূর্ণ বীজে ছড়িয়ে পড়ে।

See also  বীজের অঙ্কুরোদ্গম পরীক্ষা

এ রোগের জীবাণু বীজের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে থাকে।

প্রতিকার:

  1. সুস্থ বীজ সংগ্রহ করে বপন করতে হবে।
  2. প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউপি ঔষধ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

চ) গমের ইঁদুর দমনে বিষ টোপের ব্যবহার

ইঁদুর গমের একটি প্রধান শত্রু। গম ক্ষেতে বিশেষ করে শীষ আসার পর ইঁদুরের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। গম পাকার সময় ইঁদুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।

বিএআরআই উদ্ভাবিত ২% জিংক সালফাইড বিষটোপ ইঁদুর দমনে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিষটোপ প্রস্তুত প্রণালী:

  1. একটি এলুমিনিয়ামের পাত্রে বার্লি ও ১০০ গ্রাম পানি মিশিয়ে ২-৩ মিনিট জ্বাল দিতে হবে।
  2. বার্লি আঠালো হয়ে গেলে পাত্রটি নামিয়ে ফেলতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার পর ২৫ গ্রাম জিংক ফসফাইড আঠালো বার্লির সাথে ভালোভাবে মিশাতে হবে।
  3. জিংক ফসফাইড মিশানোর পর ৯৬৫ গ্রাম গমের দানা পাত্রে ঢেলে এমনভাবে মিশাতে হবে যেন প্রতিটি গমের দানার গায়ে কালো আবরণ পড়ে।
  4. এরপর গম দানা এক ঘন্টা রোদে শুকালে তা বিষটোপে পরিণত হবে। পরে তা ঠান্ডা করে পলিথিন ব্যাগ বা বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।

এক কেজি বিষটোপ তৈরির জন্য নিম্নরূপ হারে দ্রব্যাদি মিশাতে হবে।

উপাদানপরিমাণ
গম৯৬৫ গ্রাম
বার্লি১০ গ্রাম
জিংক ফসফাইড (সক্রিয় উপাদান ৮০%)২৫ গ্রাম
পানি১০০ গ্রাম

ব্যবহার পদ্ধতি:

  • গমের জমিতে সদ্য মাটি উঠানো গর্ত সনাক্ত করতে হবে। ৩-৫ গ্রাম জিংক ফসফাইড বিষটোপ কাগজে রেখে শক্ত করে পুটলি বাঁধতে হবে।
  • গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে এ পুটলি ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা সতেজ গর্তের আশে পাশে কাগজে বা মাটির পাত্রে বিষটোপ রেখে দিতে হবে।
  • বিষটোপ খেলে ইঁদুর সাথে সাথে মারা যাবে।

ছ) গমের ব্লাস্ট রোগ ও তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা

গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনাপোরথি অরাইজি (পাইরিকুলারিয়া অরাইজি) প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম।

গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের আক্রমণ ঘটে।

রোগটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায় এবং পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা ইত্যাদি দেশে এর বিস্তার হয়।

বাংলাদেশে প্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় আনুমানিক ১৫০০০ হেক্টর জমিতে এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় যা সেই সময়ের মোট গম আবাদী জমির প্রায় ৩% ছিল।

আক্রান্ত গম ক্ষেতের ফলন শতকরা ২৫-৩০ ভাগ হ্রাস পায়। ক্ষেত্র বিশেষে এ রোগের কারণে ক্ষেতের সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট হতে পারে।

ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত দানা
ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত দানা
ব্লাস্টে আক্রান্ত শীষ (বামে) এবং আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ (ডানে)
ব্লাস্টে আক্রান্ত শীষ (বামে) এবং আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ (ডানে)
গমের ক্ষেতে ব্লাস্টের প্রাথমিক লক্ষণ (বামে) এবং পুরো ক্ষেত আক্রান্ত লক্ষণ (ডানে)
গমের ক্ষেতে ব্লাস্টের প্রাথমিক লক্ষণ (বামে) এবং পুরো ক্ষেত আক্রান্ত লক্ষণ (ডানে)

গমের ব্লাস্ট রোগ চেনার উপায়:

  • শীষ বের হওয়ার পর গম ক্ষেতের কোন এক স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সারা ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে।
  • প্রধানত গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। তবে শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়।
  • আক্রান্ত শীষের দানা অপুস্ট হয় ও কুচকিয়ে যায় এবং দানা ধুসর বর্ণের হয়ে যায়।
  • পাতায়ও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এক্ষেত্রে পাতায় চোখের ন্যয় ধুসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।

রোগের বিস্তার যেভাবে ঘটে:

  • আক্রান্ত বীজের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়।
  • বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২-২৪ ঘণ্টা ভেজা ও তাপমাত্রা ১৮০ সে. অথবা এর অধিক হলে এরোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
  • ব্লাস্ট রোগের জীবাণু কিছু কিছু ঘাস জাতীয় পোষক আগাছার (যেমন- চাপড়া, শ্যামা, আংগুলি ঘাস) মধ্যে বাস করতে পারে; তবে সেখানে রোগের লক্ষণ সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না।

গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়:

  1. ব্লাস্ট মুক্ত গম ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
  2. অপেক্ষাকৃত কম সংবেদনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে।
  3. উপযুক্ত সময়ে (অগ্রহায়ণের ০১ হতে ১৫ তারিখ) বীজ বপন করতে হবে যাতে শীষ বের হওয়ার সময়ে বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়।
  4. বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের সাথে ৩ গ্রাম হারে প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউপি অথবা ৩ মিলি হারে ভিটাফ্লো-২০০ এফএফ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধন করলে গমের অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
  5. গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
  6. প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং ১২-১৫ দিন পর আর একবার ছত্রাকনাশক দ্বারা প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে স্প্রে করতে হবে।
  7. প্রতি শতাংশ জমিতে ৬ (ছয়) গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি অথবা নভিটা ৭৫ ডব্লিউ জি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ ইত্যাদি দমন হবে।

বি.দ্র. ছত্রাকনাশক ব্যবহারের সময় হাতে গ্লোবস এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে যাতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি শরীরের সংস্পর্শে না আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Tags:

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page