জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। তাই জমিতে শক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং বাংলাদেশের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ফসলের জন্য লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এবং দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাওয়ার টিলার পাওয়া যায় বলে শক্তি-চালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে একদিকে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে, অন্যদিকে কৃষকগণ অল্প খরচে শক্তি-চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছেন। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
উৎপাদিত শস্য ঠিকমতো প্রক্রিয়াজাতকরণ না করলে শস্য সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে এর বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ব্যবহার করে ফসলের পরিমাণগত ও গুণগত মান বাড়ানো যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত অনেকগুলো কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত প্রস্তুতকারকগণ উৎপাদন ও বিপণন করছে। ফলে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং যন্ত্রপাতিগুলোর চাহিদাও বাড়ছে। বারি কর্তৃক এ যাবৎ যত আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে তার কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো।
নিম্নে ১৭টি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির নাম, ছবি, সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য, মূল্য/দাম ও কার্যপ্রণালী তুলে ধরা হলো-
(১) বারি বীজ বপন যন্ত্র
সারিতে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। এত সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সারিতে বীজ বোনা কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
সারিতে বীজ বুনতে হলে লাঙ্গলের ফলা বা অনুরূপ কিছু দিয়ে লাইন করে গর্ত করতে হয়, হাত দিয়ে ধীরে ধীরে সারিতে বীজ ফেলতে হয় এবং একটি চাপ দিয়ে লাইন করা গর্ত ঢেকে দিতে হয়। এ কাজগুলো করা কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ বলেই সারিতে বীজ বোনা ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
বর্তমানে পাওয়ার টিলার জমি চাষে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব পাওয়ার টিলার দিয়ে যাতে বীজ বোনা যায় সে জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজবপন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বারি দুই ধরনের বীজ বপন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। একটি জমি চাষ করার পর ব্যবহার করতে হয় (মডেল-১)। অপরটি চাষ বিহীন অবস্থায় ব্যবহার করা যায় (মডেল-২)।
উভয় মডেলের বীজ বপন যন্ত্র দ্বারা গম, ভুট্টা, পাট, ধান, তৈলবীজ ও ডাল শস্য সারিতে বপন করা যায়।
ক) সুবিধা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ
- যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত।
- এ যন্ত্র বীজকে নির্দিষ্ট স্থানে ও সঠিক গভীরতায় সুষমভাবে বপন করে।
- বীজের মান ভাল হলে ভাল অঙ্কুরোদগম এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক চারাগাছ নিশ্চিত করা যায়।
- এটি ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে এবং ফলনও ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
- সারিবদ্ধভাবে বীজ বপনের ফলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ফলে আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগ সহ অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যা করার জন্য প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ সময় ও খরচ কম লাগে।
প্রশস্ততা: | ৬০-১২০ সেমি |
গভীরতা: | ২-৪ সেমি (নিয়ন্ত্রণযোগ্য) |
গতিবেগ: | ২-২.৫ কিমি/ঘণ্টা |
দক্ষতা: | ৭০ শতাংশ |
মডেল-১ এর কার্যক্ষমতা: | ০.১৪-০.২৫ হেক্টর/ঘণ্টা (২৮-৬০ শতাংশ/ঘণ্টা) |
মডেল-২ এর কার্যক্ষমতা: | ০.১২-০.২০ হেক্টর/ঘণ্টা (৩৬-৪৮ শতাংশ/ঘণ্টা) |
খ) মূল্য/দাম
মডেল-১ এর মূল্য: ৪৫,০০০ টাকা (রোটারি বাদে) (২০২৩ খ্রিঃ)।
মডেল-২ এর মূল্য: ৭৫,০০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- মডেল-১ বীজ বপন যন্ত্রটি ব্যবহার করার আগে জমি ভালভাবে চাষ করে মই দিয়ে সমান করে নিতে হয়।
- মডেল-১ বীজ বপন যন্ত্রের জন্য রোটাভেটরের প্রয়োজন নেই বলে এর লিভারটি নিউট্রাল অবস্থানে রেখে পাওয়ার টিলারের পিছনে নাট বোল্ট দিয়ে যন্ত্রটি লাগাতে হয়।
- মডেল-২ বীজ বপন যন্ত্রের জন্য রোটাভেটর খুলে যন্ত্রটি পাওয়ার টিলারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়।
- ফসল অনুযায়ী ফারো ওপেনারের সাহায্যে সারি থেকে সারির দূরত্ব ও বীজের গভীরতা ঠিক করে নিতে হয়।
- জমির এক প্রান্তে (উত্তর বা দক্ষিণ হলে ভাল হয়) পাওয়ার টিলার নিয়ে জমির জো ও বীজের ধরন অনুসারে চাষের গভীরতা ঠিক করে নিতে হয়।
- বীজ হার ঠিক করার জন্য নির্দিষ্ট ফসলের জন্য নির্ধারিত বীজ প্লেট ও পিনিয়ামে চেইন সংযুক্ত করে নিতে হয়।
- বীজ বপন যন্ত্রে পরিমাণমতো বীজ ঢেলে পাওয়ার টিলারের গিয়ার ২ নাম্বারে রেখে (গতি ২ থেকে ২.৫ কিমি/ঘণ্টা) যন্ত্রটি চালানো শুরু করলে প্লাস্টিক টিউবের মধ্য দিয়ে সারিতে বীজ পড়তে থাকে।
- ঠিকমতো বীজ পড়ছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে।
- জমির শেষ মাথায় গিয়ে পাওয়ার টিলার ঘোরানোর সময় এর হাতলের সাহায্যে বপন যন্ত্রটি উঁচু করে ঘোরাতে হয় এবং পাশের সারিতে বীজ বোনা শুরু করা হয়।
- মিটারিং ডিভাইস ঠিকমতো ঘুরছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
(২) বারি বেড প্লান্টার
আমাদের বাংলাদেশে আলু, ভুট্টা, মরিচ, সব্জিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ-ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের নিকট যেতে পারে। ফলে গাছ বাতাস থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
বেড পদ্ধতিতে নালায় পানি সেচ দিলে সহজেই অল্প সময়ে অনেক জমিতে পানি সেচ দেওয়া যায়। এতে পানির পরিমাণ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় কম লাগে। এই পদ্ধতিতে শুকনা বা রবি মৌসুমে পানি যেমন কম লাগে তেমনি বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে নালা দিয়ে সহজেই পানি বেড় হয়ে যায়।
ফসলের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশের কৃষকের অনেক
আগ থেকেই জন্মগতভাবে বেড-নালা পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে। তাই আলু, ভুট্টা, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল বেড-নালা পদ্ধতিতে আবাদ করে আসছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে কোদাল ব্যবহার করে আলু, ভুট্টা, সব্জির জমিতে বেড তৈরি করে থাকে। কোদাল দিয়ে হাতে বেড তৈরি করা কষ্টকর, সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কৃষকের কষ্টের বিষয়টি চিন্তা করে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে পাওয়ার টিলার চালিত বেড প্লান্টার উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- বেডে ফসল ফলালে উৎপাদন খরচ কমে, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও দূষণ মুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়।
- এই যন্ত্রের দ্বারা ১-২ চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়।
- বেড প্লান্টার দ্বারা গম, ভুট্টা, আলু, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন প্রকার সব্জি বীজ সফলভাবে বপন করা সম্ভব। স্থায়ী বেডেও বীজ বপন করা যায়।
- বেডে ফসলের অবশিষ্টাংশ রেখেই শূন্য চাষে বীজ বপন করা যায়।
- স্থায়ী বেডে কেঁচো বাস করে বিধায় জমির উর্বরতা বাড়ে।
- স্থায়ী বেডে কয়েক বছর চাষ করলে জমিতে জৈব সারের পরিমাণ বাড়ে।
- বেডে ফসল করলে ইঁদুরের উৎপাত কমে।
- বেডে ফসল করলে সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
বেডের উচ্চতা: | ১২-১৫ সেমি |
বেড থেকে বেডের মধ্যবর্তী নালা: | ৩০ সেমি চওড়া |
মাঠ দক্ষতা: | ০.১১-০.১৫ হেক্টর/ঘণ্টা (২৭-৩৭ শতাংশ) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ৪৫,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া) (২০২৩ খ্রিঃ)।
খ) কার্যপ্রণালী
- যন্ত্রটি পাওয়ার টিলারের পেছনে চারটি নাট দ্বারা যুক্ত করতে হয়।
- চাকার শ্যাফ্টের সাথে স্প্রোকেট স্থাপন করে চাকার শ্যাফ্টের স্প্রোকেট ও মিটারিং শ্যাফ্টের মধ্যে চেইন দ্বারা সংযোগ দিতে হবে এবং বীজ হার ঠিক রাখতে হবে।
- বীজ হার ঠিক করার জন্য ফসলের জন্য নির্ধারিত প্লেট লাগাতে হয়। প্লেটের উপরের নাট খুলে সহজেই প্লেটকে পরিবর্তন করে নেয়া সম্ভব।
- বেড শ্যাপারের পরিবর্তনক্ষম অংশ নাড়াচাড়া করে ৫৬-৬০ সেমি এর কাঙ্খিত বেড সাইজ ঠিক করতে হবে। সাধারণত এইভাবে তৈরিকৃত বেডে গম, ধান, মুগ, তিল বাদামের ২ লাইনে ও ভুট্টার ১ লাইন করা যায়।
- সবগুলো নাট ঠিকমতো টাইট করে জো সম্পন্ন মাঠে যন্ত্রটিকে নিয়ে প্রথমে পাওয়ার টিলার চালু করতে হবে।
- চাষের গভীরতা নির্ধারক দন্ডের ছিদ্র সমন্বয় করে নিতে হবে। অতঃপর রোটারিতে শক্তি সরবরাহ করতে হবে।
- চাকার গতি সঞ্চালনের পূর্বেই বীজের লিভারটি চালু করতে হবে।
- জমির এক প্রান্তে পাওয়ার টিলার নিন এবং বীজবপন যন্ত্রে পরিমাণ মতো বীজ ঢালুন।
- পাওয়ার টিলারের গিয়ার ২ নম্বরে রেখে (গতি ২ থেকে ২.৫ কিমি/ঘণ্টা) যন্ত্রটি চালানো হয় এবং প্লাস্টিক টিউবের মধ্য দিয়ে সারিতে ঠিকমতো বীজ পড়ছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হয়।
- জমির শেষ মাথায় গিয়ে পাওয়ার টিলার ঘোরানোর সময় এর হাতলের সাহায্যে বপন যন্ত্রটি উঁচু করে ঘোরাতে হয় এবং পাশের সারিতে বীজ বোনা শুরু করা হয়।
- বীজ প্লেট ঠিকমতো ঘুরছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
- ‘জো’ সম্পন্ন অচাষকৃত জমিতে এক বারেই চাষ, বেড তৈরি ও বেডে বীজ বপন করা যায়। কিন্তু প্রথমে জমি তৈরি করে নিয়ে তারপর যন্ত্র দিয়ে বেড করলে বেডের উচ্চতা বেশি হয়।
- সবজি চাষের জন্য বেড তৈরিতে প্রথমে জমিতে এক চাষ দিয়ে নেয়া ভালো।
(৩) বারি স্ট্রিপ টিল প্লান্টার
দেশের জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ জমির পরিমাণ প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। এ বাড়তি জনসংখ্যার মুখে খাদ্য তুলে দিতে একমাত্র পতিত জমি ব্যবহার ছাড়া গত্যান্তর নাই।
এ দেশের কৃষি পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পতিত জমি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্ট্রিপ টিলেজ যন্ত্র তৈরি করেছে।
স্ট্রিপ টিলেজ পদ্ধতি একটি প্রকৃত সংরক্ষণশীল কৃষি পদ্ধতি Conservation Agriculture)। এ পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন করা হয়। স্বাভাবিক পদ্ধতির মতো চাষ-মইয়ের প্রয়োজন হয় না।
যেহেতু অধিক কর্ষিত জমির রস দ্রুত উড়ে যায় তাই বৃষ্টি নির্ভর পরিবেশে যেখানে ফসল উৎপাদনের জমির প্রান্তিক আর্দ্রতা ও বৃষ্টির পানি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে স্ট্রিপ টিলেজ একটি আদর্শ চাষ পদ্ধতি। সংরক্ষণশীল কৃষির উপযোগী যন্ত্র ব্যবহারে মাঝারি মানের মাল্চ ও নাড়া সংযোজিত ফসলের জমিতেও স্ট্রিপ টিলেজ পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- পূর্ববর্তী ফসলের খড় বা নাড়া থাকায় মাটির রস ধীরে ধীরে শুকায় যা ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- শুধুমাত্র ফালি বা সরু চাষ হয় ফলে মাটির রস সংরক্ষণ করে এবং মাটির বুনট ঠিক রাখে।
- ফসলকে খরা সহনশীল করে তোলে। খরা প্রবণ এলাকায় এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী।
- পূর্ববর্তী ফসল কাটার পর মাটির অবশিষ্ট রসকে কাজে লাগিয়ে বীজ বপন কাজ করা যায়।
- একই সাথে বীজ ও সার প্রয়োগ করা যায় বলে সার ব্যবহারের কার্যকারী দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
- গম, ভুট্টা এবং অন্যান্য ফসলের ফলন শতকরা ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
- প্রচলিত বীজ বপন পদ্ধতির চেয়ে মাঠ দক্ষতা শতকরা ১৯ ভাগ বাড়ে এবং জ্বালানী খরচ ২১ ভাগ কমে।
- স্ট্রিপ টিলেজ ৬০% বপন খরচ কমায়।
কার্যক্ষমতা | প্রতি ঘণ্টায় ০.১২ হেক্টর (ঘণ্টায় ৩০ শতাংশ) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ৪৭,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার বাদে) (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- স্ট্রিপ টিলেজ পদ্ধতিতে সরু স্ট্রিপ তৈরির জন্য বপন লাইনের সামনে যন্ত্রের ৪টি ফাল এমনভাবে সাজানো থাকে যে ২টি ফাল বাম থেকে ডানে এবং অপর ২টি ডান থেকে বামে মুখোমুখি থাকে। এতে করে ঘূর্ণায়মান ফাল মাটি কেটে স্ট্রিপ তৈরি করে এবং ঐ স্ট্রিপে ওপেনারের মাধ্যমে পরিমিত বীজ ও সার প্রয়োগ করে।
- পরবর্তীতে প্রেস হুইল স্ট্রিপের উপর দিয়ে হালকাভাবে চাপ দিয়ে গড়িয়ে যায় এবং বীজ ঢেকে দেয়।
- ক্ষেত্র বিশেষে বীজ ঢেকে দেয়ার জন্য প্রেস হুইলের পরিবর্তে প্রেস রোলার ব্যবহার করা হয়।
- স্ট্রিপ টিলেজ যন্ত্রটি একটি পাওয়ার টিলারের পিছনে সংযুক্ত থাকে। স্ট্রিপ টিলেজে ফসলের বীজ ও সার নির্দিষ্ট গভীরতায় পড়ে ফলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- দুই লাইনের মধ্যবর্তী অংশে জমি চাষ হয় না এবং নাড়া বা খড় স্বাভাবিক ভাবে থাকে।
- ফসলের প্রকার ও জমির রসের উপর ভিত্তি করে স্ট্রিপ টিলেজে গভীরতা কম বেশি হয়ে থাকে।
(৪) বারি জিরো টিল প্লান্টার
জিরো টিলেজ বলতে কোন জমিকে সম্পূর্ণ চাষ না করে মাটিকে প্রয়োজন অনুসারে ফারো ওপেনারের মাধ্যমে ২-৩ সেন্টিমিটার উন্মুক্ত করে বীজ এবং সার প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন করাকে বোঝায়।
মাটিকে একাধিকবার চাষ না করার কারণে মাটির গুণগত মান বজায় থাকে এবং মাটিতে বিভিন্ন ধরনের উপকারী অণুজীবের বংশবৃদ্ধি ঘটে যা মাটিকে উর্বরা রাখতে সহায়তা করে।
শূন্য চাষে মাটিতে যথেষ্ট রস বজায় থাকে যা বীজ গজানো থেকে প্রাথমিক গাছের বৃদ্ধিতে ঐ রস সহায়তা করে এবং অনেকাংশে প্রথম সেচের দরকার হয় না।
এ দেশের কৃষি পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জমির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জিরো টিল প্লান্টার তৈরি করেছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- পূর্ববর্তী ফসলের খড় বা নাড়া থাকায় মাটির রস ধীরে ধীরে শুকায় যা ফসল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- শুধুমাত্র সরু চাষ হয় ফলে মাটিতে রস সংরক্ষণ করে।
- ফসল খরা সহনশীল করে তোলে এবং খরাপ্রবণ এলাকায় এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী।
- পূর্ববর্তী ফসল কাটার পর মাটির অবশিষ্ট রসকে কাজে লাগিয়ে বপন কাজ করা যায়।
- একই সাথে বীজ ও সার প্রয়োগ করা যায় বলে সার ব্যবহারের কার্যকরী দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
- গম, ভুট্টা, মুগ, মসুর, ছোলা এবং অন্যান্য ফসলের ফলন শতকরা ১০-১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
- প্রচলিত বীজ বপন পদ্ধতির চেয়ে মাঠ দক্ষতা শতকরা ১৯ ভাগ বাড়ে এবং জ্বালানী খরচ ২১ ভাগ কমে।
- জিরো টিলেজ ৬০% বপন খরচ কমায়।
কার্যক্ষমতা: | প্রতি ঘণ্টায় ০.১০ হেক্টর (ঘণ্টায় ২৫ শতাংশ) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ৩০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার বাদে) (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- পাওয়ার টিলারকে পাওয়ার ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- পাওয়ার টিলারের পিছনে নাট-বোল্ট এর মাধ্যমে যন্ত্রটি সংযুক্ত করা হয়। বপন লাইনের সামনে বিশেষ ধরনের ফারো ওপেনার লাগানো থাকে।
- আমন ধান কাটার পর জমিতে রস থাকাবস্থায় ফারো ওপেনার মাধ্যমে প্রয়োজনানুসারে উন্মুক্ত করে সারিতে বীজ বপন, সার দেয়া ও বীজ ঢেকে দেয়ার কাজ একসঙ্গে এই যন্ত্র দ্বারা সম্পন্ন করা যায়।
- আগাছা বেশি থাকলে বপনের ২-৩ দিন পূর্বে রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে রাউন্ড আপ আগাছানাশক, জমিতে ১০০ মিলি /১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে এই মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।
- জিরো টিলেজ যন্ত্রের সাহায্যে দানাদার সার (ডিএপি, টিএসপি ইত্যাদি) ও বীজ একই সাথে বোনা যায়।
(৫) বারি সৌর পাম্প
সেচ যন্ত্রের স্বল্পতা, জ্বালানী সংকট, বিদ্যুতের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেক জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। বোরো ধানে সেচের জন্য মোট উৎপাদনের প্রায় এক পঞ্চমাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়।
সেচ মৌসুমে গ্রামীণ এলাকায় কৃষককে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে জ্বালানী তেল ক্রয় করতে হয় এবং অনেক সময় জ্বালানী তেল দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হওয়ায় অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে সৌরশক্তির প্রাচুর্যতা রয়েছে। সৌর আলোক শক্তির মাত্রা প্রতিদিন প্রতি বর্গমিটারে ৪.০ থেকে ৬.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং প্রখর সূর্যালোক প্রতিদিন ৬-৯ ঘণ্টা এর মধ্যে উঠানামা করে।
বর্তমানে সৌর কোষ (Photovoltaic cell) অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা কম। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রসরতায় এর বারি সৌর পাম্প মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। যেখানে বিদ্যুৎ সুবিধা নাই, সেখানকার একটা সুবিশাল অঞ্চল সেচের আওতায় আনা প্রয়োজন। এই এলাকাগুলোতে ভাল ফসল উৎপাদনের জন্য সৌর পাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে।
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সংকটে সেচ ব্যবস্থার সমস্যা সমাধানের জন্য সৌরচালিত সেচ পাম্প বিকল্প সেচ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- বারি উদ্ভাবিত সৌর পাম্প ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সেচের জন্য উপযোগী।
- পাম্প দ্বারা সর্বোচ্চ ২৫ ফুট গভীরতা থেকে পানি তোলা যায়।
- পাম্প চালনায় কোন প্রকার তেল ও জ্বালানী লাগে না।
- পাম্প ৯০০ ওয়াট সোলার প্যানেল দ্বারা চালনা করা হয়।
- পাম্পে কোন ব্যাটারি লাগে না।
- রাতে বা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে পাম্প চালনা করা যায় না।
পাইপের ব্যাস: | ৩৮ মিমি (১.৫ ইি) |
মোটরের শক্তি: | ৯০০ ওয়াট |
মোটরের প্রকৃতি: | ডিসি |
ঘূর্ণন গতি: | প্রতি মিনিটে ৩,০০০ বার |
প্যানেল শক্তি: | ১০০০ ওয়াট |
বিভব পার্থক্য: | ৪৮ ভোল্ট |
গড় পানি নির্গমন ক্ষমতা: | প্রতি মিনিটে ১৮০ লিটার |
খ) মূল্য/দাম
সৌর পাম্পের মোট মূল্য: ৭৫,০০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)
(৬) বারি এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প
এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প (এএফপি) এক ধরনের লো লিফ্ট পাম্প (এলএলপি) যা কম হেডে অধিক পানি উত্তোলনের উপযোগী। এটি ১৬ ফুট বা ৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় খাল-বিল বা খোলা জলাশয়ের পানি উঠাতে পারে।
সমান ক্ষমতার এলএলপি’র তুলনায় এটি প্রায় ৩ গুণ পর্যন্ত পানি তুলতে পারে এবং জ্বালানী (ডিজেল) খরচ প্রায় অর্ধেক হয়।
এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি যা সাধারণত ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে যেখানে ভূ-উপরস্থ পানিকে ১-৩ মিটার উচ্চতায় সেচ দিতে হয় বা নিষ্কাশন করতে হয় অথবা ছোট থেকে বড় মাপের মৎস্য খামারের কাজে এ পাম্প ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
তিন মিটারের চেয়ে নিচের উচ্চতায় এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প পানি প্রবাহের ক্ষমতা ও জ্বালানী দক্ষতা সমআকারের সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি।
এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প দিয়ে পানি তোলা ও প্রবাহ করার জন্য এর ইমপেলার অবশ্যই পানির নিচে ডুবানো রাখতে হবে। এ পাম্পে প্রাইমিং এর প্রয়োজন হয় না।
এক্সিয়াল ফ্লো পাম্পের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটি লম্বা ও পাম্প একটি ফাকা পাইপ যার ভিতর ঘূর্ণায়মান শ্যাফট রয়েছে। এই শ্যাফটগুলো প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের হতে পারে। কিছু পাম্প ৭.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
জ্বালানী খরচ কমানো ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দ্বারা সেচের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে বাংলাদেশে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের বিপরীতে শক্তি ব্যবহারে দক্ষ। এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প বোরো ধান ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের জন্য বিকল্প হিসেবে পরিণত হচ্ছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি উত্তোলনের জন্য উপযোগী। পাঁচ মিটার গভীরতা থেকে পানি উত্তোলন করা যায়।
- চার মিটার বা কম উচ্চতায় সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের তুলনায় ৩০% বেশি পানি উত্তোলন হয় ও ৩০% জ্বালানী সাশ্রয়ী হয়।
- ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের পাম্পের গড় পানি উত্তোলন ক্ষমতা (Discharge) প্রতি সেকেন্ডে যথাক্রমে ১৫, ২৬, ও ৪৫ লিটার।
- বারি উদ্ভাবিত এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প হাওড় ও দক্ষিণা লে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সেচের ও মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
খ) মূল্য/দাম
ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের পাম্পের মূল্য (ইঞ্জিন ছাড়া) যথাক্রমে ১৫,০০০, ২০,০০০, ও ২৫,০০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- যে পুকুর বা খাল হতে পানি উঠাতে হবে, সেখানে পাম্প ও ইঞ্জিন নিতে হবে। এরপর পাম্পের জালিযুক্ত পানি প্রবেশ অংশ পানির ভিতর এমন ভাবে ডুবাতে হবে যাতে ইম্পেলারসহ সম্পূর্ণ জালি পানির মধ্যে ডুবে থাকে কিন্তু মাটি স্পর্শ না করে।
- পাম্পের নিম্নাংশ ও উপরাংশ বাঁশের খুটির সাথে এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে পাম্প চলাকালীন সময়ে কোন প্রকার নড়াচড়া করতে না পারে। এরপর পাম্পের ডেলিভারি প্রান্তের শ্যাফটের সাথে ৭৬ মিমি (৩”) ব্যাসের পুলি লাগাতে হবে।
- পাম্প চালনার জন্য ইঞ্জিন পাম্পের সমান্তরালে শক্ত করে স্থাপন করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ৭৬ মিমি (৩”), ১০২ মিমি (৪”), ও ১৫০ মিমি (৬”) ব্যাসের মধ্যে যথাক্রমে ১০, ১২.৫ ও ১৪ অশ্বশক্তির ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হবে।
- ভি-বেল্টের দ্বারা পাম্পের সাথে ইঞ্জিনের কাপলিং করতে হবে।
- বেল্টের টেনশন টানটান হতে হবে যাতে বেল্টের স্লিপ কম হয়।
- যেখানে পানি তুলতে হবে সেই মাপের প্লাস্টিক বা ফিতা পাইপ পাম্পের ডেলিভারি পাইপের সংযোগ করতে হবে।
- ইঞ্জিন চালুর পূর্বে ইঞ্জিনের জ্বালানী তেল ও পানি পরীক্ষা করতে হবে। এরপর ইঞ্জিন চালুর সাথে সাথেই পাম্প হতে সবেগে পানি প্রবাহিত হতে থাকবে।
- ইঞ্জিনের এক্সিলেটর কমিয়ে বা বড়িয়ে পাম্পের পানি প্রবাহের পরিমাণ কম বা বেশি করা যায়। তবে পাম্পের ঘূর্ণনের গতি প্রতি মিনিট ১৭০০-১৮০০ তে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
- এই পাম্পের সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের মত প্রাইমিং এর প্রয়োজন হয় না।
- কাজ শেষে পাম্প ও ইঞ্জিনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরিষ্কার করে শুকনা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
(৭) বারি মোবাইল ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র
বর্তমানে দেশের অনেক এলাকায় ব্যাপকভাবে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা সম্প্রসারিত হবে। বারি শক্তিচালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র বাংলাদেশে ব্যাপক অবদান রাখছে। কিন্তু যন্ত্রটি টানার জন্য মাঝে মাঝে পাওয়ার টিলারের প্রয়োজন হয় এবং মাঠে নিয়ে তা সেট করাও কঠিন। এ অসুবিধাগুলো দূর করার জন্যই বারি মোবাইল ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। বারি মোবাইল ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র দিয়ে কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং জমিতে বসিয়ে খুবই সহজে ভুট্টা মাড়াই করা সম্ভব। এ যন্ত্র দ্বারা সময় এবং খরচ উভয়ই সাশ্রয় হয়।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- পাওয়ার টিলার চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, পাওয়ার টিলারের অগ্রভাগে সংযুক্ত অবস্থায় পরিবহন ও ভুট্টা মাড়াই করা যায়।
- যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ। এর মেরামত করার প্রয়োজনীয়তা কম।
- দুই জন শ্রমিক সহজেই যন্ত্রটি পরিচালনা করতে পারে। যন্ত্রটির মাড়াই খরচ তুলনামুলকভাবে কম।
- যন্ত্রটি খুবই সহজে পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে সহজে স্থানান্তর করা যায়। ইঞ্জিন/মোটর ভি-পুলি ও ভি-বেল্টের সাহায্যে মাড়াই সিলিন্ডার ঘোরানো হয়।
- এটা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫- ২.০ টন ভুট্টা মাড়াই করতে পারে।
খ) মূল্য/দাম
যন্ত্রটির মূল্য ২০,০০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- বারি মোবাইল ভুট্টা মাড়াই যন্ত্রটি একটি অত্যাধুনিক ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র। এই যন্ত্রটি পাওয়ার টিলারের সম্মুখে নাট বোল্টের সাহায্যে স্থাপন করতে হয়।
- যন্ত্রটির বেইজ ফ্রেমের নিচে একটি নমনীয় স্ট্যান্ড থাকে যা মাড়াই যন্ত্রকে সমতল পজিশনে রাখতে সাহায্য করে।
- মাড়াই যন্ত্রটি টিলারের ইঞ্জিনের পুলির সাথে ভি-বেল্টের মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
- পাওয়ার টিলার রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিনের এক্সিলেটর টেনে প্রয়োজনীয় আরপিএম যন্ত্রে দেওয়া হয়।
- এবার মাড়াই যন্ত্রটিকে পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে সুবিধাজনক শুকনা ও উচু স্থানে স্থাপন করতে হবে।
- মাড়াই শুরু করার আগে শুকনো ভুট্টার মোচাগুলো যন্ত্রের কাছে একস্থানে জমা করতে হবে। এ অবস্থায় ঝুড়িতে করে ভ্ট্টুার মোচা হপারের মাধ্যমে ফিডিং সিলিন্ডারে প্রবেশ করাতে হবে।
- ভুট্টার দানা মোচা থেকে পৃথক হয়ে নিচে পড়ে যাবে এবং অবশিষ্টাংশ আউটলেট টিউব দ্বারা নিক্ষিপ্ত হবে। যন্ত্রের সামনে জমাকৃত ভুট্টার দানা কিছুক্ষণ পরপর বস্তায় ভরতে হবে।
(৮) বারি গার্ডেন বুম স্প্রেয়ার
সঠিক সময়ে পোকামাকড় দমন, রোগবালাই আক্রমণ ও আগাছা দমন না করলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। অধিকাংশ উন্নত দেশে খাদ্যের গুণগতমান ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফসলকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে কৃষকেরা উচ্চ মূল্য পাওয়ায়, ঝুঁকি কম হওয়ায়, বাজারজাত সহজীকরণের দরুণ মাঠ ফসলের তুলনায় উদ্যান ফসল উৎপাদনের প্রতি আগ্রহী।
বাংলাদেশে বর্তমানে বালাইনাশক স্প্রে করার জন্য প্রধানত নেপসেক স্প্রেয়ার, পাওয়ার ডাস্টার এবং ফুট পাম্প স্প্রেয়ার ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ স্প্রেয়ারই ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও উপাদান দিয়ে তৈরি।
ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও বালাইনাশক প্রয়োগের ভুল পদ্ধতির কারণে প্রয়োগকৃত বালাইনাশকের ৫০-৮০% নষ্ট হয়ে যায়। তারই প্রেক্ষিতে উদ্যান ফসলে সঠিক পদ্ধতিতে, পরিমিত উপায়ে এবং অল্প খরচে পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা দমনের জন্য বিএআরআই উদ্ভাবিত বুম স্প্রেয়ার খুবই কার্যকরী যা তিন চাকার রিক্সা ভ্যানে সংযোগ করায় চলাচল সহজসাধ্য হয়েছে। এ বুম স্প্রেয়ার দ্বারা আম, লিচু গাছে বালাইনাশক স্প্রে করা যায়।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- এর মাধ্যমে রাসায়নিক বালাইনাশক ক্ষুদ্র আয়তনে তরল আকারে খুব দক্ষতার সাথে স্প্রে করা হয়।
- বুম স্প্রেয়ারের মাধ্যমে অল্প পরিমাণ কীটনাশক সমভাবে ফলবাগানে স্প্রে করা সম্ভব।
- এতে নির্দিষ্ট মাপের ছিদ্রযুক্ত নজেল আছে যা লম্বা গাছে স্প্রে করতে সহায়তা করে। এর প্রেসার এ সমতা রয়েছে।
- এটা জোরে ও এলোমেলো বাতাস প্রবাহিত হলে সমস্যা হয় না।
- একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক ট্যাংকের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে ট্যাংকের ভিতর বালাইনাশকের লেভেল পর্যবেক্ষণ করা যায়।
- সমস্ত এসেম্বলি একটি রিক্সা ভ্যানে চালকের সিটের পিছনে লাগানো থাকে।
- বাগানে বুম স্প্রেয়ার চালানোর জন্য প্রতিদিন ৫৯৫ টাকা খরচ হয় যা ফুট পাম্প স্প্রেয়ারে ১,০২৯ টাকা।
- প্রতি হেক্টর জমিতে বুম স্প্রেয়ার দিয়ে বালাইনাশক প্রয়োগে সময় লাগে মাত্র তিন ঘণ্টা যা ফুট পাম্প স্প্রেয়ারে লাগে ১০ ঘণ্টা। অর্থাৎ তিনগুণ সময় সাশ্রয় হয়।
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ৩০,০০০ টাকা(২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- বারি গার্ডেন বুম স্প্রেয়ার একটি স্বল্প মূল্যের পাওয়ার স্প্রেয়ার। স্প্রেয়ারটির পাম্প, নজেল, বালাইনাশক ট্যাংক একটি রিক্সাভ্যানের উপর স্থাপিত।
- যে বাগানে বা গাছে বালাইনাশক স্প্রে করতে চান সেখানে স্প্রেয়ারটি সমতল ও শুকনা জায়গায় স্থাপন করুন।
- বুম নজেল গাছের Canopy থেকে ২/৩ ফুট পরে স্থাপন করুন।
- রিক্সাভ্যানের উপর স্থাপিত ট্যাংকে পরিমাণমতো বালাইনাশক মিশ্রিত করে ট্যাংকে ভর্তি করুন।
- এরপর আপনি কি পরিমাণ স্প্রে করতে চান সেই অনুপাতে বুম নজল সেট করুন।
- আপনি যদি বালাইনাশক মিস্ট আকারে স্প্রে করতে চান তাহলে যন্ত্রটি নজলের নিকটবর্তী পয়েন্টে স্থাপন করুন।
- এমনিভাবে যদি স্প্রে ফোঁটা থেকে পানির মতো স্প্রে করতে চান তাহলে লিভারটি নিচের দিকে পর্যায়ক্রমে সেট করুন।
- এরপর ইঞ্জিনটি চালু করুন।
- ইঞ্জিন চালু করার পূর্বে হাইপ্রেসার নবটি চালু (On) অবস্থায় রাখুন। তাহলে ইঞ্জিন চালু করতে সহজ হবে।
- ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর হাইপ্রেসার নবটি বন্ধ রাখুন।
- এবার বুমটি যে দন্ডে লাগানো আছে সে দ-টি উপরের দিকে উঠিয়ে গাছের নিকট নিতে হবে।
- হাইপ্রেসার নবটি অন করে সুবিধামতো স্প্রে করতে থাকুন।
- বুমটি যদি ভূমির বরাবর রাখতে চান তাহলে হাইপ্রেসার পাইপটি ঢিলা করে দন্ডটির সাথে বেধে নিন। আর যদি ধীরে ধীরে বুমটি উলম্ব/খাড়া করতে চান তাহলে হাইস্প্রেসার পাইপটি নিচের দিকে টেনে দন্ডটির সাথে বেধে নিন। এইভাবে স্প্রে দন্ড ধরে ঘুরে ঘুরে উঁচু নিচু করে স্প্রে সুষমভাবে করুন।
- স্প্রে কাজ শেষে দন্ডটি সুবিধামতো জায়গায় রেখে ইঞ্জিনটি বন্ধ করুন।
- কাজ শেষে সমস্ত কিছু পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে রাখুন।
- মনে রাখতে হবে স্প্রে শুরু করার আগে আপনাকে স্প্রে ইউনিফরম পড়তে হবে এবং মুখোশ পড়ে নিতে হবে যা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।
(৯) বারি আলু রোপণ যন্ত্র
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া আলু চাষের উপযোগী। উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব জেলা ও মুন্সিগঞ্জে আলু বেশি চাষ হয়। প্রতি বছর প্রায় ৪.৭৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। আলু চাষ পদ্ধতি বিশেষ করে আলু রোপণ শ্রমিক নির্ভরশীল, সময় সাপেক্ষে এবং ব্যয়বহুল পদ্ধতি। গ্রাম এলাকায় কৃষি শ্রমিক দিন দিন হ্রাস পাওয়ার ফলে আলু রোপণ মৌসুমে কৃষক শ্রমিকের অভাবে সময়মতো আলু রোপণে ব্যর্থ হয়। অথচ কাঙ্খিত ফলন পাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে আলু লাগানো একটি পূর্বশর্ত। পাওয়ার টিলার বাংলাদেশের কৃষিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এ পাওয়ার টিলারকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আলু রোপণ যন্ত্র তৈরি
করেছে যা ছোট আকারে এবং সহজে ব্যবহার করা যায়।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত।
- একসাথে মাটি কর্ষণ, নির্ধারিত দূরত্বে বীজ স্থাপন, আলু বীজ ঢেকে দেওয়া এবং বেড তৈরি করে।
- একসারিতে বীজ রোপণ করে যেখানে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২০-২৫ সেমি বজায় রাখা যায়।
- যন্ত্রটি উচ্চ মাত্রার শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ী (৯৪%)।
কার্যক্ষমতা | ০.০১ হেক্টর/ঘণ্টা (২.৫ শতাংশ) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য- ৪০,০০০ টাকা (ইঞ্জিন ছাড়া)(২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- পাওয়ার টিলারের ঘূর্ণায়মান ফাল পূণর্বিন্যাস করে ২৪ টি ফাল সংযোগ করা হয়েছে। যার ১২ টি ফাল বাম থেকে ডানে এবং ১২ টি ফাল ডান থেকে বামে মুখ করে সাজানো থাকে।
- ঘুর্ণায়মান ফাল জমি চাষ করে ফারো তৈরি করে।
- মিটারিং ডিভাইস একটা করে আলু তোলে নির্দিষ্ট দূরে স্থাপন করে, বেড মেকার বেড তৈরি ও ঐ আলু বীজ ঢেকে দেয়। ইহা এক সঙ্গে আলু রোপণ এবং বেড তৈরি করে।
(১০) বারি আলু উত্তোলন যন্ত্র
বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভূতাত্ত্বিক সমস্যার কারণে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশ অনেক স্বল্প উন্নত দেশের চাইতেও অনেক পিছিয়ে আছে। গ্রামাঞ্চলে মৌসুমী ফসল উত্তোলনকালে ভয়াবহ শ্রমিক স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে আলু উত্তোলন অত্যন্ত ধীর, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতিতে প্রথমে দেশীয় লাঙ্গল দ্বারা আলুর বেড উন্মুক্ত করা হয় এবং আলুকে হাতের সাহায্যে মাটি থেকে তোলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিঘা প্রতি (৩৩ শতাংশ) প্রায় আট জন শ্রমিক প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে বিবেচনাযোগ্য পরিমাণ (৮-৯%) আলু মাটির অভ্যন্তরেই রয়ে যায় যা কৃষকের আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি করে। এ সমস্যা সমাধানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আলু উত্তোলনের যান্ত্রিক সমাধানের উদ্দেশ্যে ট্রাক্টর উপবিষ্ট কিছু সংখ্যক ভারি ও ব্যয়বহুল যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।
বাংলাদেশের কৃষিতে ট্রাক্টর উপবিষ্ট আলু উত্তোলন যন্ত্র বোনার জন্য ছোট খন্ড জমি ও কৃষি জোট প্রধান সমস্যা। এছাড়াও দেশের বেশির ভাগ কৃষকের এ সকল উচ্চ ক্রয় মূল্যের ব্যয়বহুল ভারী যন্ত্র ক্রয়ের সক্ষমতা নেই। তাই ট্রাক্টর উপবিষ্ট আলু উত্তোলন যন্ত্র এ দেশের কৃষির জন্য অনুকূল নয়।
সুতরাং আমাদের কৃষকদের প্রয়োজন স্বল্প মূল্যের আলু উত্তোলন যন্ত্র যা পাওয়ার টিলার দ্বারা চালানো সম্ভব। যা আলু সহজে উত্তোলন করতে পারে, শ্রমিক নির্ভরশীলতা কমায় ও মাটি থেকে আলুর সর্বাধিক উত্তোলন সু-নিশ্চিত করে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত।
- প্রচলিত আলু উত্তোলনের চেয়ে প্রায় ৬৫% শ্রমিক ও ৫১% খরচ সাশ্রয়ী।
- আলুর বাহ্যিক ক্ষতি ১.৫% এর কম, মাটির নিচে আলু থাকে না।
কার্যক্ষমতা | ০.১২ হেক্টর/ঘণ্টা (৩০ শতাংশ) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য- ৬০,০০০ টাকা (পাওয়ার টিলার ছাড়া) (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) র্কাযপ্রণালী
- বারি উদ্ভাবিত আলু উত্তোলন যন্ত্র পাওয়ার টিলারের সাথে সংযুক্ত হয়ে আলুকে মাটির গভীর থেকে উপড়িয়ে মাটির পৃষ্ঠে উন্মুক্ত করে। সার্বিকভাবে লম্বায়, প্রশস্ততায় ও উচ্চতায় এ যন্ত্রের মাপ যথাক্রমে, ৯০০ মিমি, ৮৫০ মিমি ও ৮৫০ মিমি।
- ফ্লাট আয়রন কলাম ব্লেডের উপর উলম্বভাবে ঝালাই করা থাকে যা মাটির সাথে ২০ কোণে আনত থাকে। ব্লেডটি ৫৪০ মিমি লম্বা, ৩২৫ মিমি প্রশস্ত ও ধারালো অংশটি সামনের দিকে ৬ মিমি আগানো থাকে।
- যন্ত্রের পেছন দিকে নিচে ৫০ ⨉ ৫০ ⨉ ৬ মিমি এর একটি লোহা (এ্যাঙ্গেল আয়রন) লাগানো থাকে যা যন্ত্রটির বেকে যাওয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে।
- সিঙ্গেল রিজ ওপেনিং ডিভাইসকে বোল্ট দ্বারা লাগানো হয় যথাক্রমে ৩১০ বা ২১০ মিমি দূরত্বে।
- কনভেয়ার চেইনের সামনে একটি উচ্চ মাত্রার কার্বন সম্বলিত স্টিল এর বেলচা বোল্ট দ্বারা লাগানো থাকে।
- যন্ত্রের কার্যপদ্ধতিতে রিজ কাটার ব্লেড বেডের নিচে রিজের অভ্যন্তরে আলু জন্মানোর স্থানে প্রবেশ করে রিজকে ফালিতে বিভক্ত করে।
- বিভক্তিকৃত রিজ কন্দাল সহকারে দ্রুতগামী মইয়ের কনভেয়ার বেল্টের সহিত বাইরে বের হয়ে আসে ও বেশিরভাগ মাটির চাকতি ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় এবং গুঁড়ো হওয়া মাটির চাকতি কনভেয়ার বেল্ট স্টিকের ফাকের মাঝে পড়তে থাকে ফলে আলু মাটি থেকে আলাদা হয়ে যায়।
- যন্ত্রটি আলগা হওয়া আলুকে যন্ত্রের পেছনে নরম মাটিতে ছুড়ে ফেলে।
(১১) বারি ফল শোধন যন্ত্র
বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে ফল উৎপন্ন হয়। প্রধান ফলের মধ্যে আম, কলা, পেপে, পেঁয়ারা, কাঁঠাল ও আনারস ইত্যাদি রয়েছে।
এ ফলগুলোর জীবনকাল খুব কম ও উচ্চ পচনশীল। যেমন আম ও কলা এ্যানথ্রাকনোস রোগের মাধ্যমে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আম ৭/৮ দিনের বেশি স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা যায় না। তদ্রƒপ কলাও ৬/৭ দিনের বেশি রাখা যায় না।
আমাদের বাংলাদেশে ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় ২০-৩০%। ফলে প্রতি বছর বিরাট অংশের টাকার ফল অপচয় হচ্ছে। এ অপচয় রোধে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও পরিবেশ দূষণ করে।
এদের জীবনকাল বাড়ানোর ও অপচয় কমানোর জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়া গরম পানিতে শোধন করে উক্ত উদ্দেশ্য সম্পন্ন করা যায়। এ লক্ষ্যে বিএআরআই এর এফএমপিই বিভাগ ফল শোধন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্য
- মডেল ১ যন্ত্রে ২ কিলোওয়াটারের ১০টি বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে পানিকে গরম করা হয়।
- মডেল ২ যন্ত্রে ২ কিলোওয়াটারের ৬ টি বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটারের মাধ্যমে পানিকে গরম করা হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা হয়।
- ফলভর্তি প্লাস্টিক ক্রেট বহনের জন্য মোটরচালিত কনভেয়ার রোলার ব্যবহার করা হয়। যন্ত্র চালানোর জন্য ৪ (চার) জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
- যন্ত্রটি দ্বারা আমকে সুষমভাবে ৫৩ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৫ থেকে ৭ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা হয়। যন্ত্রটি দ্বারা কলা সুষমভাবে ৫৩ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৫ থেকে ৯ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা হয়।
- শোধনকৃত আম ৭-৮ দিনের পরিবর্তে ১০-১২ দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে এবং আমের গায়ের রং উজ্জ্বল হয়।
- শোধনকৃত কলাকে ৬-৭ দিনের পরিবর্তে ৮-১০ দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে এবং কলার গায়ের রং উজ্জ্বল হয়। যন্ত্রটি পরিচালনা করা খুবই সহজ।
- উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতি কেজির শোধন খরচ খুবই কম।
- শোধন খরচ হয় আমের জন্য ০.৬০ টাকা/কেজি (বড়), ০.৮৩ টাকা/কেজি (ছোট) ও কলার জন্য ০.৭০ টাকা/কেজি (বড়), ০.৯০ টাকা/কেজি (ছোট) (২০২৩ খ্রিঃ)।
আমের ক্ষেত্রে কার্যক্ষমতা | ১০০০ কেজি/ঘণ্টা (বড়) ও ৫০০ কেজি/ঘণ্টা (ছোট) |
কলার ক্ষেত্রে কার্যক্ষমতা | ৬০০ কেজি/ঘণ্টা (বড়) ও ৩০০ কেজি/ঘণ্টা (ছোট) |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ২,৫০,০০০ টাকা (বড়) ও ১,৭০,০০০ টাকা (ছোট) (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- পরিষ্কার পানি দিয়ে চৌবাচ্চাটি এমনভাবে পূর্ণ করুন যেন চৌবাচ্চার উপর থেকে ১০ সেন্টিমিটার খালি থাকে।
- হিটারগুলো বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে প্যানেল বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত করুন।
- পানির তাপমাত্রা কাঙ্খিত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বজায় রাখার জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক নব ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেট করুন।
- বৈদ্যুতিক প্যানেল বোর্ডের সাহায্যে হিটারগুলো চালু করুন। যা দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পানি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওঠে।
- রোলার চালানোর জন্য মোটর চালু করুন।
- এবার জলাধারের এক প্রান্ত থেকে ফলভর্তি প্লাস্টিকের ঝুড়ি পানির মধ্য দিয়ে রোলারের উপর বসিয়ে দিন। ঝুড়িটি সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রের অন্য প্রান্তের দিকে চলা শুরু করবে।
- পুনরায় ফল ভর্তি ঝুড়ি রোলারের উপর বসিয়ে দিন। এভাবে অনবরত ফল ভর্তি ঝুড়ি রোলারের উপর বসাতে থাকুন।
- অন্য প্রান্তে পৌঁছার পর ঝুড়ি পানি থেকে তুলে ফল শুকানোর জন্য রাখা প্লাস্টিক শিটের উপর ছড়িয়ে দিন।
- দ্রুত ফল শুকানোর জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করা যেতে পারে।
- শুকানোর পর যথাযথ পদ্ধতিতে ফল প্যাকিং করুন।
(১২) বারি আলু গ্রেডিং যন্ত্র
বাণিজ্যিকভাবে এবং কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণ ও বাজারে বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজে আলু ভাগ করতে হয়।
বর্তমানে আলু গ্রেডিং এর কাজটি কোল্ডস্টোরের শ্রমিক ও কৃষকগণ হাতের সাহায্যে করে থাকেন। এর জন্য প্রচুর শ্রমিক লাগে এবং অনেক সময় ব্যয় হয়। সেজন্য গ্রেডিং এর কাজে খরচ পড়ে অনেক বেশি।
কম খরচে, অল্প সময়ে আলু বিভিন্ন সাইজে ভাগ করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক শক্তিচালিত আলু গ্রেডিং যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লোহার সামগ্রী দিয়ে এ যন্ত্রটি তৈরি করা যায়।
- যন্ত্রটি চালানোর জন্য ৩ জন লোকের দরকার হয়।
- স্বল্প সময়ে ও কম খরচে আলুকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
- ভাগ করা আলু সরাসরি বস্তায় জমা করা যায়।
- যন্ত্রটি চারটি চাকার উপর বসান থাকে যাতে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
কার্যক্ষমতা | ১.৩ টন/ঘণ্টা |
খ) মূল্য/দাম
মূল্য: ৪০,০০০ টাকা (মোটরসহ) (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- আলু গ্রেডিং যন্ত্রটি একটি সমতল স্থানে এমনভাবে স্থাপন করুন যেন যন্ত্রটি চালু করলে নড়াচড়া না করতে পারে।
- যন্ত্রটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বলে একজন লোক শুধু হপারে আলু ঢালার জন্য প্রয়োজন হয়, বাকি দু’জন বস্তায় আলু ভরা, সরানো এবং চালুনির উপর আটকে পড়া আলু সরিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন হয়।
- ইঞ্জিন বা মোটর চালু করুন। সিলিন্ডারটি ঘুরতে শুরু করবে।
- এবার হপারে আলু ঢেলে দিন।
- ছোট আকারের (২৮ মিলিমিটার ব্যাসের) আলু সিলিন্ডারের প্রথম অংশ দিয়ে বের হয়ে গড়িয়ে নেমে বস্তার মধ্যে পড়বে।
- তার চেয়ে বড় আলুগুলো (২৮-৪০ মিমি) দ্বিতীয় অংশে চলে যাবে এবং বের হয়ে গড়িয়ে নেমে বস্তার মধ্যে পড়বে।
- বড় আকারের (৪০ মিলিমিটারের বেশি ব্যাসের) আলু সিলিন্ডারের ভিতর গড়িয়ে গিয়ে শেষ নালা দিয়ে বস্তার মধ্যে পড়বে।
- এভাবে সাইজ অনুযায়ী আলু ৩ ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।
(১৩) বারি মূলজাতীয় সবজি ধৌতকরণ যন্ত্র
বাংলাদেশে সারা বছর প্রায় সব ধরনের সবজি বাজারে পাওয়া যায়। বর্তমানে বিদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি রপ্তানি করা হয়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে কৃষকগণ কায়িক পরিশ্রমসহ পা-দিয়ে গাজর ধুয়ে থাকেন যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাস্থ্যকর। এই পদ্ধতিতে গাজর যেভাবে ধোয়া হয় তাতে সময়, অর্থ ও কায়িক শ্রম বেশি লাগে। তাছাড়া বর্তমানে শ্রমিক সংকট রয়েছে।
এইসব বিষয়ে বিবেচনা করে বিএআরআই এর এফএমপিই বিভাগ যন্ত্রটি স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে, অল্প খরচে ও কম পরিশ্রমে গাজর ধোয়া যায়। যার ফলে ধুলাবালি মুক্ত নিরাপদ, টাটকা সবজি ভোক্তাগণ খেতে পারবেন এবং কৃষক ও ব্যবসায়ীগণ পাশাপাশি ভাড়া খাটিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন এমনকি যুবক/মহিলাদের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- শাকসবজি ধোয়ার ফলে সবজির গায়ে লেগে থাকা ময়লা, ধুলাবালি, জীবাণু দূরীভূত হয় এমনকি E-coli ও Salmonella দূর হয়।
- যন্ত্র দুইটি একটি ২ অশ্বশক্তির ইলেকট্রিক মোটর ও অন্যটি ৪.৫ অশ্বশক্তির ইঞ্জিন দ্বারা চালনা করা হয়।
- প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ৬৭% অর্থ সাশ্রয় হয়। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় সময় বাঁচে ৪০%। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় কষ্ট লাঘব হয়। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় শ্রমিক সাশ্রয় হয় ৬৭%।
- যন্ত্র দিয়ে প্রতি ব্যাচে ১২০ কেজি (বড়), ২৫ কেজি (ছোট) ধোয়া যায় যাতে সময় লাগে মাত্র ৫-৬ মিনিট।
খ) মূল্য/দাম
যন্ত্রটির মূল্য: ২,০০,০০০ টাকা (বড়), ১,০০,০০০ টাকা (ছোট)।
গ) কার্যপ্রণালী
- যন্ত্র সমতল স্থানে এমনভাবে স্থাপন করুন যেন যন্ত্রটি চালু করলে নড়াচড়া না করতে পারে।
- মোটর চালিত যন্ত্রটি যেখানে বিদ্যুৎ লাইন ও পানির ব্যবস্থা আছে সেই জায়গায় স্থাপন করুন।
- যন্ত্রটি চালু করার পূর্বে বিয়ারিং ঠিক আছে কিনা, চেইন-স্প্রোকেট সংযোগ ঠিক আছে কিনা, বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ সঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে নিন।
- এরপর পানির ট্যাঙ্কে পানি ভর্তি করে নিন।
- চালানোর পূর্বে আরেকটি কাজ করতে হবে, মোটর ও পাম্প চালু করে দেখতে হবে রোলারগুলো চলে কিনা, পানি স্প্রে ঠিকমতো হয় কিনা।
- ডিজেল ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রের ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের ডিজেল, মবিল ও পানি চেক করে নিতে হবে।
- বেল্ট-পুলি ঠিকমতো টাইট আছে কিনা এবং নাট-বোল্ট টাইট আছে কিনা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
- উভয় যন্ত্রের ক্ষেত্রে, ইঞ্জিন/মোটর চালু করে মাঠ থেকে ধূলাবালি ও ময়লাযুক্ত গাজর ঘূর্ণায়মান রোলারের উপর পরিমাণমতো ঢেলে দিতে হবে।
- কিছুক্ষণ ঘূর্ণনের পর আস্তে আস্তে পরিমাণমতো পানি ঢালতে থাকুন।
- আপনার চাহিদামতো পরিষ্কার হলে পানি বন্ধ করে মেশিন চালু অবস্থায় মেশিনের ঢাকনা খুলে দিলে অধিকাংশ গাজর আপনা আপনি বের হয়ে যাবে।
- মেশিন বন্ধ করে বাকি গাজর হাত দিয়ে সরিয়ে বের করে নিতে হবে।
- আবার মেশিন চালু করে মাঠ থেকে সংগ্রহকৃত গাজর মেশিনে ঢেলে দিন। এভাবে যন্ত্রটি পরিচালনা করতে হবে।
(১৪) বারি নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো যন্ত্র
নারিকেল বাংলাদেশের খুব সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ফল। ইহা উপকূলীয় অঞ্চলে অধিক হারে উৎপাদিত হয়।
সাধারণত গ্রামাঞ্চলে দা এর সাহায্যে, ধারালো লোহা অথবা সাঁড়াশির সাহায্যে নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো হয় যা সময় সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। এই কাজের জন্য দক্ষ শ্রমিকেরও প্রয়োজন।
ফলে সকল আকারের ও স্বল্প সময়ে অধিক হারে নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানোর জন্য শক্তিচালিত নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো যন্ত্রের প্রয়োজন। বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানোর যন্ত্রের বর্ণনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- যন্ত্রটি দিয়ে সহজে ও দ্রুত সকল আকারের নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো যায়।
- যন্ত্রটি স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত লৌহ সামগ্রী দিয়ে স্থানীয় প্রকৌশল কারখানায় তৈরি করা যায়।
- এই যন্ত্র দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো যায়।
- যন্ত্রটি প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ৫৭% খরচ এবং ৫০% সময় সাশ্রয় হয়।
- যন্ত্রটি ২.২ কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে পরিচালিত হয়।
- একশত নারিকেলের খোসা ছাড়াতে খরচ হয় ৪০ টাকা।
- বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত কৃষক এই যন্ত্র ব্যবহার করে সময় ও অর্থ বাঁচাতে পারবে।
যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা | প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টি নারিকেল |
খ) মূল্য/দাম
যন্ত্রটির মূল্য: ৭০,০০০ টাকা(২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- যন্ত্রটিকে একটি সমতল, খোলা ও ছায়াযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে হবে।
- বৈদ্যুতিক মোটরকে অন-অফ সুইচের মাধ্যমে চালু করে যন্ত্রটিকে চালনা করতে হবে।
- অতঃপর চালককে একের পর এক নারিকেল দুই রোলারের মাঝে দিতে হবে এবং সাথে সাথে যন্ত্রের উপরের ঢাকনাকে লিভারের মাধ্যমে নারিকেলের উপর চাপ দিয়ে ধরতে হবে।
- রোলারের বিপরীতমুখী ঘূর্ণনের ফলে নারিকেলের ছোবড়া সহজেই ছাড়ানো যায়।
- নারিকেল ও ছোবড়াগুলো নির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে যায়।
(১৫) বারি মোবাইল তেল নিষ্কাশন যন্ত্র
স্বল্প মেয়াদী ও উচ্চ ফলনশীল তৈলবীজ ফসলের প্রচলনের ফলে বর্তমানে তৈলবীজের উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কৃষকেরা অর্থকরী ফসল হিসেবে তৈলবীজ আবাদ করে থাকেন।
ফসল ওঠার সাথে সাথে বেশির ভাগ তৈলবীজ তেল মিল মালিকদের নিকট বিক্রয় করে দেন। অধিকাংশ কৃষক নিজ উৎপন্ন তৈলবীজ বিক্রয় করে বাজার থেকে সয়াবিন তেল ক্রয় করে খেয়ে থাকেন। আবার অনেক কৃষক তৈলবীজ ভাঙ্গানোর অভাবে তৈলবীজ বিক্রয় করে তৈল ক্রয় করেন।
বাজারে প্রচলিত তৈল মিলের ধারণক্ষমতা বেশি (কমপক্ষে ১০ কেজি) হওয়ায় অনেক কৃষক অল্প পরিমাণ তৈলবীজ ভাঙ্গাতে পারেন না। তাছাড়া বাণিজ্যিক তেল মিলগুলো শহর বা উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত। গ্রামাঞ্চলে তেলের মিল বিরল। ফলে কৃষকগণ তৈলবীজ উৎপাদন করা সত্ত্বেও নিজের ক্ষেতের উৎপন্ন বিশুদ্ধ তেলের স্বাদ থেকে বিরত হন।
কৃষক যাতে তার উৎপন্ন অল্প পরিমাণ (কমপক্ষে ২ কেজি) তৈলবীজ তার এলাকায় ভাঙ্গিয়ে বিশুদ্ধ তেল গ্রহণ করতে পারেন তার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক একটি মিনি ও মোবাইল তেল নিষ্কাশন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
- বারি উদ্ভাবিত নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো যন্ত্র দিয়ে নারিকেলের ছোবড়া ছাড়ানো হচ্ছে যন্ত্রটি রিক্সাভ্যানের উপর স্থাপন হওয়ায় সহজে স্থানান্তরযোগ্য।
- যন্ত্রটি দিয়ে সহজে অল্প সময়ে ও কম খরচে সরিষা, বাদাম, সূর্যমুখী, তিল, কালোজিরা প্রভৃতির বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করা সম্ভব।
- স্থানীয় কারখানায় যন্ত্রটি তৈরি করা যায়।
- একটি গিয়ার বক্সের মাধ্যমে ইঞ্জিনের ঘুর্ণায়মান গতিকে যন্ত্রের কাঙ্খিত গতিতে হ্রাস করা হয়।
- বিভিন্ন প্রকারের তৈলবীজের ধরণ অনুযায়ী যন্ত্রটির প্রতি ঘণ্টায় তৈলবীজ ভাঙ্গানো ক্ষমতা ১২-২০ কেজি।
- যন্ত্রটির তেল নিষ্কাশন ক্ষমতা ৩০-৩৫%।
- যন্ত্রটি দ্বারা চাষী অথবা বাসা বাড়ির লোকজন স্বল্প পরিমাণ তৈলবীজ ভাঙ্গাতে পারেন যা দ্বারা পরিবারের পুষ্টিমান নিশ্চিত করা যায়। সেবা প্রদানকারীগণ যন্ত্রটি ভাড়া খাটিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
খ) মূল্য/দাম
যন্ত্রটির মূল্য (ভ্যানসহ): ৬৫,০০০.০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)।
গ) কার্যপ্রণালী
- প্রথমে ইঞ্জিন চালু করে ইঞ্জিনের পুলির গতিকে এমনভাবে সামঞ্জস্য করতে হবে যাতে যন্ত্রের পুলির গতি ১৫ আরপিএমএ ঘোরে।
- কমপক্ষে দুই কেজি সরিষা অথবা অন্য তেলের বীজকে ফিডিং হপারে ঢালতে হবে।
- তেলের বীজ প্রথমে হপার থেকে ধীরে ধীরে রোটর সিলিন্ডারে প্রবেশ করবে, যেখানে বীজগুলো চূর্ণ হবে।
- রোটর সিলিন্ডারে একটি স্পাইরাল স্ক্রু আছে যা তেলের বীজকে সামনের দিকে চূর্ণ হওয়ার জন্য ঠেলে দেয় ফলে বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন হয়।
- প্রথমবারে ফিডিং এ তেলের বীজ থেকে যে খৈল বের হয় তা দ্বিতীয়বারে ফিডিং হপারে দেওয়া হয়।
- ফিডিং হপারে অবস্থিত ঘূর্ণায়মান প্লেট খৈলগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে পুনরায় রোটর সিলিন্ডারে প্রেরণ করে। রোটর কেসিং এর নিচে তেল সংগ্রহ করা হয়।
- যখন বীজ খৈলে রুপান্তরিত হয় তখন তা কোণের বাইরের অংশ দিয়ে রোটর কেসিং থেকে বেরিয়ে আসে।
- তেল নিষ্কাশন যন্ত্রের গতি পর্যায়ক্রমে ১২-১৫ আরপিএম হয় যা তেল নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত।
- আংশিকচূর্ণ বীজ থেকে প্রাপ্ত খৈল ২-৩ বার রোটর কেসিং এ তেল নিষ্কাশনের জন্য প্রবেশ করানো হয়।
(১৬) বারি হ্যান্ডি সোলার ড্রায়ার
আলু দ্রুত পচনশীল হওয়ায় বৃষ্টি বা মেঘলা আবহাওয়ায় আলুর চিপস নষ্ট হয়ে যায়। আলুর চিপস শুকিয়ে সংরক্ষণের জন্য সম্প্রতি বিএআরআই কর্তৃক হ্যান্ডি সোলার ড্রায়ার তৈরি করা হয়েছে।
ক) প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
সোলার ড্রায়ার সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও বসতবাড়িতে ব্যবহারযোগ্য। গ্রামে বাড়ির আঙ্গিনায় এবং শহরে বিল্ডিং এর ছাদে এটি ব্যবহার করা যায়।
এক কেজি আলু শুকানোর পর প্রায় ২৫০ গ্রামচিপস পাওয়া যায়।
খ) মূল্য/দাম
ড্রায়ারে তৈরি খরচ ২৫,০০০ টাকা।
গ) কার্যপ্রণালী
- আলুর খোসা ছড়ানোর পর স্লাইসার দ্বারা ১-২ মিলিমিটার পুরুত্বে স্লাইস করে সাধারণ পানিতে রাখা হয় যাতে বাতাসের সংস্পর্শে এসে অক্সিডেশন না হয়।
- এরপর ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে স্লাইসগুলি ৪ মিনিট সিদ্ধ করার পর পুনরায় নরমাল পানিতে ধোয়া হয়।
- স্লাইসগুলো সোলার ড্রায়ারের ট্রের উপর একক স্তরে বিছিয়ে দেয়া হয় যাতে একটির উপর আরেকটি না পড়ে।
- ড্রায়ারটি ২০০ সেমি লম্বা, ৮০ সেমি চওড়া এবং সামনে ও পিছনের উচ্চতা যথাক্রমে ১০০ সেমি ও ১৩০ সেমি (২৩.৫ ডিগ্রী ঢালু)। ১৯ মিমি ⨉ ১৯ মিমি এমএস ফ্রেম ও ৩ মিমি স্বচ্ছ প্লাস্টিক শীট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
- ড্রায়ারে দু’টি ট্রে আছে যার উপর আলুর চিপস বিছিয়ে শুকানো হয়। প্রতিটি ট্রে ৮৭ সেমি লম্বা, ৭২ সেমি চওড়া এবং এমএস ফ্রেম ও প্লাস্টিক নেট দিয়ে তেরি।
- ড্রায়ারের নিচে ২০০ সেমি লম্বা ও ৮০ সেমি চওড়া কালো রং করা ঢেউটিন সোলার কালেক্টর হিসেবে কাজ করে।
- দশ (১০) ওয়াট সোলার প্যানেল দ্বারা ৪ ওয়াট ক্ষমতার ডিসি ব্লোয়ারের মাধ্যমে ড্রায়ারে বাতাস প্রবাহিত করা হয়।
- ড্রায়ারের ওজন প্রায় ৪৫ কেজি এবং চাকার সাহায্যে সহজে স্থানান্তর করা যায়।
- এই ড্রায়ারে ৪৫-৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২.৫ কেজি আলুর চিপস ৬-৮ ঘণ্টায় শুকানো যায়।
- শুকানোর পর (মচমচে হলে) স্লাইসগুলো সংগ্রহ ও ঠান্ডা করে পলিথিন প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়।
(১৭) বারি ব্যাটারি চালিত নিড়ানী যন্ত্র
আগাছা ফসলের সাথে স্থান, সূর্যালোক, মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পানি এবং পুষ্টি উপাদান নিয়ে প্রতিযোগীতা করে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে ফলন হ্রাস করে।
জমিতে নিড়ানী দেয়া খুবই শ্রমঘন এবং ব্যয়বহুল কাজ। অন্যদিকে তীব্র শ্রমিক সংকটের কারণে জমিতে নিড়ানী দেয়া আরোও ব্যয় সাপেক্ষ ও কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে আগাছা নাশক দ্বারা আগাছা দমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এমতাবস্থায়, কৃষকেরা যান্ত্রিক নিড়ানী যন্ত্রের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।
- যান্ত্রিক নিড়ানী যন্ত্র দ্বারা স্বল্প সময়, অল্প খরচে, তাড়াতাড়ি অধিক পরিমাণ জমিতে নিড়ানী দেয়া যায়।
- বারি ব্যাটারি চালিত নিড়ানী যন্ত্রটি এক অশ্বশক্তির (৭৪৬ ওয়াট) ডিসি মোটর দ্বারা চালিত হয়। আর মোটরটি চারটি ১২ ভোল্টের রিচার্জেবল ব্যাটারি দ্বারা চালিত হয়ে থাকে।
- জমি নিড়ানোর জন্য ঘূর্ণায়মান ফাল ব্যবহার করা হয়েছে। একটি দন্ডের উপর ১৪টি ফাল সর্পিলাকারে সজ্জিত থাকে। ফালগুলো ইংরেজী ঔ অক্ষরের আকৃতির এবং প্রতিটি ফালের দৈর্ঘ্য ৭৫ মিমি এবং প্রস্থ ১৮ মিমি।
- মোটরের ঘূর্ণন গতি ৭০০ আরপিএম যা কমিয়ে ফালে ৩৫০ আর পিএম এ আনা হয়েছে।
- ঘূর্ণনের ফলে জমিতে অবস্থিত আগাছা উপড়ে পড়ে এবং টুকরা টুকরা হয়ে জমিতে মিশে যায়।
- একজন চালক একদিনে ৩.৫ বিঘা জমিতে নিড়ানী দিতে পারে অর্থাৎ ঘণ্টায় ১৪ শতাংশ জমিতে নিড়ানী দেয়া যায়।
- এ যন্ত্র দিয়ে এক হেক্টর জমিতে নিড়ানী খরচ ২,৭৩৮ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ), যা হাতে নিড়ানী দিতে খরচ হয় ৭,৫০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ উপাদন খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব। এক বছরের মধ্যেই বিনিয়োগের টাকা উঠে আসে।
- অফ-সিজনে ব্যাটারি এবং মোটর অন্য কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
[সূত্র: বিএআরআই]