(১) লাক্ষা কি?
লাক্ষা এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র পোকা ক্যারিয়া লাক্ষা কর্তৃক নিঃসৃত লালা বা আঠালো রস রজন জাতীয় পদার্থ। লাক্ষা পোকার ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে আঠালো রস নিঃসৃত হয় যা ক্রমশ শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। পোষক গাছের ডালের এই আবরণ লাক্ষা বা লাহা নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে ডালের সেই আবরণ ছাড়িয়ে ও শোধিত করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।
লাক্ষা একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল। সাধারণত লাক্ষা চাষের জন্য পৃথক কোন জমির প্রয়োজন পড়ে না। লাক্ষার পোষক গাছসমূহ জমির আইল বসতবাড়ির আশেপাশে, খালের পাড়, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে পরিত্যক্ত স্থানসমূহে লাগানো যায়। এ ছাড়াও লাক্ষার বহুবিধ ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই লাক্ষা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া লাক্ষা চাষের আওতায় এনে প্রচুর পরিমাণে লাক্ষা উৎপাদনের পাশাপাশি বিশাল কর্মহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সম্ভব।
লাক্ষা চাষ করতে হলে পোষক গাছের প্রয়োজন হয়। যে সকল গাছের রস শোষণ করে লাক্ষা পোকা জীবনধারণ করে ও বংশ বিস্তার করে তাদেরকে লাক্ষা পোকার পোষক গাছ বলে। লাক্ষা চাষের জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পোষক গাছ হচ্ছে কুল, কড়ই, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর ইত্যাদি।
দুই ধরনের লাক্ষা পোকা বিভিন্ন ধরনের লাক্ষা ফসল উৎপাদনের সাথে জড়িত। যেমন-
- কুল, পলাশ, বাবলা ইত্যাদি পোষক গাছসমূহে যে সমস্ত পোকা লাক্ষা উৎপাদন করে তাদের রং লাল বলে তাদের রঙ্গিনী পোকা বলে।
- অন্যদিকে আর এক ধরনের লাক্ষা কীট কেবলমাত্র কুসুম গাছে ভালভাবে বৃদ্ধিলাভ ও বংশ বিস্তার করতে পারে এবং যে লাক্ষা উৎপাদন করে তাদের রং হলুদ বা কুসুমী বলে এরা কুসুমী পোকা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ কুসুমী পোকার অপর্যাপ্ততার কারণে সাধারণত রঙ্গিনী পোকা দ্বারা লাক্ষার চাষ করা হয়। যে মাসে লাক্ষা ফসল কাটা হয় সে মাসের নাম অনুসারেই ফসলের নাম করণ করা হয়ে থাকে।
রঙ্গিনী পোকা থেকে বৎসরে দুই বার, বৈশাখ মাসে ও কার্তিক মাসে ছাড়ানো লাক্ষা পাওয়া যায়। বৈশাখী ফসল পেতে প্রায় ৮ মাস সময় লাগে, অন্যদিকে মাত্র ৪ মাসেই কার্তিকী ফসল পরিপক্কতা লাভ করে। বীজের জন্য কার্তিকী ফসল এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বৈশাখী ফসল করা উত্তম।
(২) লাক্ষার ব্যবহার
গাছের ডালে লাক্ষা নি:সৃত রস শক্ত হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পর সেই বাকল অর্থাৎ কাঁচা লাক্ষা তুলে নেয়া হয়।
পরে ভালো করে ধুয়ে এগুলো রোদে শুকানো হয়। শুকিয়ে যাওয়ার পর এক ধরণের আঠা মিশিয়ে আগুনে তাপ দিতে হয় থান কাপড়ে মুড়িয়ে। তাপের কারণে ময়লা মাটিসহ অপ্রয়োজনীয় যা থাকে তা কাপড়ের সাথে থেকে যায় আর রয়ে যায় মূল ছাড়ানো লাক্ষা। কখনো দানা আকারে বা কখনো ছাড়ানো লাক্ষা টুকরো করে আমরা বাজারে বিক্রি করা হয়ে থাকে।
লাক্ষা ব্যবহার করা হয়-
- কাঠের আসবাবপত্র বার্নিশ করা, বিভিন্ন ধরনের বার্নিশ, পেইন্ট ইত্যাদি ও পিতল বার্নিশ করার কাজে।
- অস্ত্র ও রেলওয়ে কারখানায়।
- বৈদ্যুতিক শিল্প কারখানায় অপরিবাহী বার্নিশ পদার্থ হিসেবে।
- বিভিন্ন অটোমোবাইল ইঞ্জিন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে আঠালো বন্ধনকারী পদার্থ হিসেবে।
- চামড়া রং করার কাজে।
- স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণে।
- লবণাক্ত পানি হতে জাহাজের তলদেশ রক্ষা করার কাজে বার্নিশ হিসেবে।
- লাক্ষার উপাদান, আইসো এমব্রিটোলিডি, পারফিউম শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
- লাক্ষা হতে নিগর্ত আরেকটি উপাদান, এ্যালুউরিটিক এসিড, পারফিউম শিল্পে, পোকার যৌন আকৃষ্টকরণ পদার্থ (Sex pheromone) তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
- ডাকঘরের চিঠি, পার্সেল ইত্যাদি সীলমোহর করার কাজে।
- পুতুল, খেলনা, আলতা, নখরঞ্জন, শুকনা মাউন্টিং টিস্যু পেপার ইত্যাদি তৈরির কাজে।
- ঔষধ শিল্পে ক্যাপসুলের কোটিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- আপেল, কমলা ইত্যাদি ফলের সংরক্ষণ গুণ বাড়ানোর জন্য কোটিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- চকলেট, চুইংগাম ইত্যাদির কোটিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- ইউরিয়া সারের কোটিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
(৩) লাক্ষা চাষ পদ্ধতি
লাক্ষা ফসল চাষের সাধারন উপায়:
- সময়মতো পোষক গাছ ছাঁটাই করা লাভজনক লাক্ষা উৎপাদনের পূর্বশর্ত। সাধারণত কার্তিকী ফসলের জন্য মধ্য-ফেব্রুয়ারি এবং বৈশাখী ফসলের জন্য মধ্য-এপ্রিল পোষক গাছসমূহ ছাঁটাই করার উপযুক্ত সময়।
- গাছ ছাঁটাই করার পর কচি ডালের বয়স কার্তিকী ফসলের ক্ষেত্রে ১০৫ থেকে ১২০ দিন এবং বৈশাখী ফসলের ক্ষেত্রে ১৬০ থেকে ১৮০ দিন হলে তা লাক্ষা লাগাবার উপযুক্ত হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় বীজ লাক্ষা (লাক্ষা পোকাসমেত খন্ড খন্ড পোষক ডাল) পোষক গাছের ডালে এমনভাবে আটকিয়ে দিতে হবে যাতে কাঠির দু’প্রান্তই কচি ডালের সাথে ভালভাবে লেগে থাকে।
- রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া হলে ৩-৭ দিনের মধ্যে লাক্ষা পোকা কচি ডালে বসে যাবে। লাক্ষা বীজ লাগানোর ৪ সপ্তাহ পরে যদি সংক্রমিত ডালগুলি সাদা তুলার মত আবরণে আবৃত হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে লাক্ষা ফসল ভাল অবস্থায় রয়েছে।
- লাক্ষা সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পরই ফসল কাটা উচিত। কার্তিকী ফসল কার্তিক মাসে এবং বৈশাখী ফসল বৈশাখ মাসে কাটার উপযুক্ত সময়। তবে বীজ লাক্ষা পেতে হলে লাক্ষা পোকা ঝাঁক বেঁধে বের না হওয়া পর্যন্ত ফসল কাটা যাবে না। সাধারণত কার্তিকী ফসলে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং বৈশাখী ফসলে আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শিশু লাক্ষা পোকা ঝাঁক বেঁধে বের হতে দেখা যায়।
- লাক্ষা ফসল কাটার পর দা বা হাঁসুয়ার সাহায্যে কাঠি হতে লাক্ষা ছড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজ লাক্ষা যত শীঘ্র সম্ভব নতুন গাছের কচি ডালে লাগতে হবে। নতুন গাছে লাক্ষা পোকা বসে গেলে লাক্ষাসমেত বীজ লাক্ষার কাঠিগুলোকে গাছ থেকে নামিয়ে পোষক ডাল হতে পরিপক্ক লাক্ষা দা বা হাঁসুয়ার সাহায্যে ছাড়ানো হয় যা ‘ছাড়ানো লাক্ষা’ নামে পরিচিত। ছাড়ানো লাক্ষা বেশি দিন ঘরে না রেখে দ্রুত প্রক্রিয়াজাতকরণ করা ভাল।
লাক্ষাকীটের পোষক গাছ:
কুলগাছে কুল উৎপাদনের পাশাপাশি লাক্ষা চাষ করা যায়। কুল গাছে লাক্ষা চাষ করলে যদিও কুলের ফলন শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কম হয়। তবুও কুলের চেয়ে কুল ও লাক্ষার চাষ একত্রে অধিক লাভজনক। কুলছাড়াও শিরিস, বট, পাকুর, পলাশ, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর, অড়হর, কসুম এসব গাছেও লাক্ষা ভালো জন্মে।
পোষক গাছ ছাঁটাইকরণ:
লাক্ষা কীটসমূহ কেবলমাত্র গাছের কচি ডগা বা ডাল হতে রস শোষন করতে পারে সেজন্য যে পোষক গাছে লাক্ষা কীট চাষ করা হবে তার পাতা ও কচি ডগা খাবে তা আগেই ছাঁটাই করা উচিত।
শিশু কীট সংক্রমণ:
ভালো লাক্ষার ফলন কীট সংক্রমণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সে কারণে যেসব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে।
তাহলো-
- রোগবালাইমুক্ত; পরিপক্ক ও স্বাস্থ্যকর বীজ লাক্ষা ব্যবহার করা;
- বীজলাক্ষা গাছ হতে কাটার পর পরই সংক্রমণ করা;
- সংক্রমণের জন্য সঠিক পরিমাণ বীজলাক্ষা ব্যবহার করা;
- বীজলাক্ষা সমেত টুকরাটি এমনভাবে শোষক গাছের ডালে বাঁধতে হবে যেন সেটা গাছের ডালের সাথে বেশ ভালোভাবে লেগে থাকে। বীজ লাক্ষাগুলো কচি ডালের যত কাছাকাছি বাঁধা যায় ততই ভালো;
- বীজলাক্ষা লাগানোর পর শিশু কীটগুলো গাছের কচি ডালে বসে গেলে যতশীঘ্র সম্ভব বীজলাক্ষার টুকরাগুলো সরিয়ে নিতে হবে।
কূপ পদ্ধতিতে লাক্ষা চাষ:
চক্রাকারে লাক্ষা চাষের মাধ্যমে পোষক গাছকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেয়া দরকার। কূপ পদ্ধতির মাধ্যমে একটি এলাকার পোষক গাছসমূহকে তিন বা চারভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত কোনো একটি কূপের সকল গাছে পোকা সংক্রমণ করা হয়। যখন ফসল পরিপক্ক হয় তখন অন্য কূপের গাছ সমূহকে সংক্রমিত করা হয়। এভাবে আগের কূপটির গাছসমূহকে নতুন পাতা ও ডগা বের হওয়ার যথেষ্ট সময় পায় ও সম্পূর্ণ প্রাণশক্তি ফিরে পায়।
নতুন ডালে লাক্ষা তৈরি:
নতুন ডালে অবস্থান নেয়ার পর শিশুকীটগুলো তাদের চুলের মতো লম্বা শুর গাছের বাকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ও প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে। ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে এরা পাতলা উজ্জল রঙের রস নি:সরণ শুরু করে যা লাক্ষা নামে পরিচিত।
ফসল কাটা, লাক্ষা ছাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণ:
- লাক্ষা সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ক হওয়ার পর কাটা দরকার। জুন-জুলাই মাসে (আষাঢ়) বীজ লাক্ষা লাগালে অক্টোবর-নভেম্বর (কার্তিক) মাসে ফসল সংগ্রহের সময় হয়।
- অক্টোবর-নভেম্বর (কার্তিক) মাসে বীজ লাক্ষা লাগালে এপ্রিল- মে (বৈশাখ) মাসে ফসল সংগ্রহের সময় হয়।
- পোষক ডাল হতে পরিপক্ক লাক্ষা দা বা কাঁচির সাহায্যে ছাড়াতে হয় যা ছাড়ানো লাক্ষা নামে পরিচিত। ছাড়ানো লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে চাঁচ, টিকিয়া ও গালা তৈরি করা হয়। একশ কেজি ছাড়ানো লাক্ষা হতে ৬০ কেজি চাঁচ/ টিকিয়া/গালা পাওয়া যায়।
লাক্ষার সাথী ফসল:
- কুল,পলাশ, বাবলা, খয়ের কড়ই এসব গাছে সফলতার সাথে লাক্ষা চাষ হয়ে আসছে। পোষক গাছ জমিতে থাকলে সেখানে ছায়া পড়বে। তাই লাক্ষার সাথী ফসল হিসেবে ঐ সমস্ত শস্যকেই বেছে নিতে হবে যেগুলো ছায়াযুক্ত বা আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে ভালো জন্মাতে পারে।
- লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা যেসব ফসলকে লাক্ষার উপযোগী সাথী ফসল হিসেবে তাহলো আদা, হলুদ, মুখীকচু, মিষ্টি আলু,ধান, গম এসব।
- দেশের ভূমিহীন কিংবা প্রন্তিক চাষিরা নিজের এলাকার সরকারি, বেসরকারি সড়ক কিংবা মাঠঘাট প্রান্তরে জন্মানো পোষক গাছে লাক্ষা চাষ করে নিজেদের দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাক্ষা চাষ হলে দেশও এগিয়ে যেতে পারে অনেকদূর।
(৪) লাক্ষা চাষে আয়-ব্যয় (২০২৩ খ্রিঃ)
পোষক গাছের নাম | লাক্ষা উৎপাদনে গাছপ্রতি খরচ | গাছপ্রতি ছাড়ানো লাক্ষা উৎপাদন | গাছপ্রতি আয় | নিট মুনাফা |
কুল | ৪০০ টাকা | ১০ কেজি | ২,৫০০ টাকা | ২,১০০ টাকা |
শিরিষ | ১,৫০০ টাকা | ৪০ কেজি | ১০,০০০ টাকা | ৮,৫০০ টাকা |
পলাশ | ৪০০ টাকা | ৭ কেজি | ১,৭৫০ টাকা | ১,৩৫০ টাকা |
বাবলা | ৪০০ টাকা | ৫ কেজি | ১,২৫০ টাকা | ৮৫০ টাকা |
[সূত্র: বিএআরআই]