Skip to content

 

প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদন ও ফসল উৎপাদনে বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষার কৌশল

প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদন ও ফসল উৎপাদনে বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষার কৌশল

এখানে প্রথমে প্রতিকূল পরিবেশ কী প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- খরা, লবণাক্ত ও বন্যাপ্রবণ এলাকার শস্য, মৎস্য ও পশুপারি উৎপাদন কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে ফসল উৎপাদনে বিরূপ আবহাওয়া যেমন- জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি থেকে শস্য, মৎস্য ও পশুপাখি রক্ষার কৌশল ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে।

(১) ফসল উৎপাদনে প্রতিকুল পরিবেশ

জলবায়ু ও পরিবেশগত উপাদান স্বাভাবিক থাকলে ফসলের বৃদ্ধি ও বিকাশ স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে। তবে প্রকৃতি সব সময় স্বাভাবিক থাকে না। কিছু কিছু অঞ্চলে উৎপাদন মৌসুমে ফসলকে জলবায়ু ও পরিবেশগত নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ অবস্থাকে প্রতিকূল পরিবেশ বলে।

এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ বা অবস্থায় ফসল জৈব-রাসায়নিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একে ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বলে।

আমরা জানবো জলবায়ু ও পরিবেশের কোন উপাদানগুলো ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে।

প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টিকারী জলবায়ুগত উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে-

  1. বন্যা বা জলাবদ্ধতা
  2. অনাবৃষ্টি বা খরা
  3. উচ্চ তাপ
  4. নিম্ন তাপ

আর পরিবেশগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে-

  1. মাটির লবণাক্ততা
  2. মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি • বাতাসে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি

বাংলাদেশের কৃষিতে প্রতিকূল পরিবেশজনিত সমস্যা অনেক আগে থেকেই ছিল। বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিকূল পরিবেশজনিত সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাতে ৩টি আশঙ্কাজনক ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে-

  1. খরা
  2. লবণাক্ততা
  3. বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিপাত অনিয়মিতভাবে হচ্ছে। বোরো মৌসুমে এবং আমন মৌসুমে খরার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টিনির্ভর আমন মৌসুমে সাধারণত চাষিদের সেচ দেওয়ার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না। ফলে নীরব খরায় ধানের ফলন হ্রাস পাচ্ছে।

বরিশাল ছিল একসময় শস্যভাণ্ডার। এখন সেই বরিশাল খাদ্য ঘাটতি এলাকা। মাটি ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর এরও বেশি আমন আবাদি জমি চাষেরকৃষি ও জলবায়ু অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছর বন্যা হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে ব্যাপক ফসলহানি হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে এ দেশে দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ বন্যায় তিন লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হ্রাস পায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বোরো ধান পাকার সময় তলিয়ে যায়।

আবার বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের বিস্তৃত অঞ্চলে আমন ধান রোপণের সময় বা রোপণ পরবর্তী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভয়াবহ বন্যায় ২০০৭ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৬০% এলাকা প্লাবিত হয় এবং ৮ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। বন্যায় আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই আবার আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৩ লক্ষ টন।

এছাড়াও ২০০৪ সালে বন্যায় ১.৩ মিলিয়ন হেক্টর, ২০০৭ সালে বন্যায় ৮.৯ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয় এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে ২য় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ১% হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে ১.৩৯% হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলাও করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে আমাদের প্রতিকূল পরিবেশে ফসল উৎপাদনের কলাকৌশল জানতে হবে।

(২) খরা অবস্থায় ফসল উৎপাদন কৌশল

ফসল উৎপাদনে প্রাকৃতিক বিপত্তিসমূহের মধ্যে খরা অন্যতম। বাংলাদেশে প্রায় সব মৌসুমেই ফসল খরায় কবলিত হয়।

খরা অবস্থা তখনই বিরাজ করে যখন কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হয় বা দীর্ঘদিন ধরে কোনো বৃষ্টিপাত হয় না। এতে করে মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দেহে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি অবস্থা বিরাজ করে এ অবস্থাকে খরাকবলিত অবস্থা বলা হয়।

খরার কারণে ফসলের ১৫-৯০ ভাগ ফলন হ্রাস পেতে পারে। খরা কবলিত অঞ্চলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল চাষ করলে লাভজনকভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়।

ব্যবস্থাপনাগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-

  • উপযুক্ত ফসল বা ফসলের জাত ব্যবহার: খরা শুরু হওয়ার আগেই ফসল তোলা যাবে এমন স্বল্পায়ু জাতের অথবা খরা সহ্য করতে পারে এমন জাতের চাষ করতে হবে, যেমন- আমন মৌসুমে বিনা ধান ৭, থ্রি যান ৩৩ এক মাস আগে পাকে। ফলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মানের ধরা থেকে ফসল রক্ষা করা যায়। আবার আমন মৌসুমের ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৫৭ যেমন স্বল্পায়ু জাত তেমন ২১-৩০ দিন খরা সহ্য করতে পারে।
  • খরা সহনশীল জাত চাষ করা: বিষয়, প্রদীপ ও সুফী হলো গমের তিনটি খরা সহনশীল জাত। খরা প্রবণ এলাকায় আগাম জাতের আমন চাষ করে ফসল কাটার পর জমিতে রস থাকতেই ছোলা, মসুর, খেসারি, সরিষা, তিল ইত্যাদি খরা সহনশীল ফসল চাষ করে একটি অতিরিক্ত কাল তোলা যাবে। স্কুল খাছ খরা সহনশীল বলে এসব অঞ্চলে কুল বাগানও করা যেতে পারে।
  • মাটির ভিন্ন নষ্টকরণ: খরা প্রবণ এলাকার বৃষ্টির মৌসুম শেষ হওয়ার পর মাটিতে লো আসার সাথে সাথে অগভীর চাষ দিয়ে রাখতে হবে। এতে মাটির উপরিভাগের সূত্র ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সূর্যের তাপে মাটির রস শুকিয়ে যাবে না।
  • অগভীর চাষ: জমি চাষের সময় মাটির আর্দ্রতা কম মনে হলে অমিকে হালকা চাষ নিতে হবে। প্রতি চাষের পর মই দিয়ে মাটিকে আঁটসাঁট অবস্থায় রাখতে হবে। এতে মাটিতে পানির সাশ্রয় হবে।
  • জাবড়া প্রয়োগ: মালচিং শুকনা খড়, লতাপাতা, কচুরিপানা দিয়ে বীজ বা চারা রোপণের পর মাটি ঢেকে দিলে রস সরক্ষিত থাকে। কারণ সূর্যের ভাগে পানি বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। অনেক দেশে কালো পলিথিনও ব্যবহার করা হয়। এতে আগাছার উপদ্রবও কম হয়।
  • পানি ধরা: যে অঞ্চলে বৃষ্টি খুব কম হয়, সে অঞ্চলে বৃষ্টির মৌসুমে জমির বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট নালা বা গর্ত তৈরি করে রাখা হয়। এর ফলে পানি গড়িয়ে জমির বাইরে চলে যায় না। পানি সংরক্ষণের এ পদ্ধতিকে পানি ধরা বলা হয়। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে জমি চাষ দিয়ে ফসল বুনে সংরক্ষিত এ পানি সফলভাবে ব্যবহার করা যায়।
  • আঁচড়ানো: মাটির রস দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকলে বীজ গজানোর পর পর উপরের মাটি হালকা করে আঁচড়ে দিলে মাটির ভিতরে রস সংরক্ষিত থাকে।
  • সারির দিক পরিবর্তন: খরা প্রবণ এলাকায় সূর্যালোকের বিপরীত দিকে সারি করে ফসল লাগানো উচিত। এতে গাছ একটু বড় হলে ফসলের ছায়া দুইসারির মাঝে পড়ে। ফলে মাটিস্থ পানির বাষ্পীভবন কম হয়। পানির অপচয় কম হয়।
  • জৈব সার ব্যবহার: জমিতে বেশি করে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গঠন উন্নত হয়, মাটি ঝুরঝুরে হয়। ফলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
See also  কৃষি মৌসুম কাকে বলে? কৃষি মৌসুম কয়টি? মৌসুমের সময়কাল ও কোন মৌসুমের ফসল কোনটি/নাম/কি কি? এবং বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে কোন ফসল ভালো জন্মে তার তালিকা

(৩) লবণাক্ত অঞ্চলে ফসল উৎপাদন কৌশল

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা একটি বড় সমস্যা।

আমরা জানি সমুদ্রের পানি লবণাক্ত। এ অঞ্চলের জমি সমুদ্রের পানি দ্বারা প্লাবিত হয়। যার কারণে মাটিতে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ক্লোরাইড ও সালফেট লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। মাটিতে লবণের ঘনত্ব বেড়ে গেলে ফসলের মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান ও পানি শোষণ বাধাগ্রস্থ হয় ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে লবণ ধুয়ে যায় বলে লবণাক্ততা একটু কম থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা আরও বেড়ে যায়। কারণ শুষ্ক মৌসুমে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানির সাথে লবণ উপরে উঠে আসে।অনেক এলাকায় মাটির উপরিভাগে লবণের আস্তর পড়ে যায়।

নিচে লবণাক্ত মাটিতে ফসল উৎপাদন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো-

ক) লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলের চাষ

লবণাক্ত অঞ্চলে চাষের জন্য আমাদের লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলের জাত নির্বাচন করতে হবে।

উত্তম লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলগুলো হলো- নারিকেল, সুপারি, সুগার বিট তুলা, শালগম, ধৈঞ্চা, পালংশাক ইত্যাদি।

মধ্যম লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলগুলো হলো- আমড়া, মিষ্টি আলু, মরিচ, বরবটি, মুগ, খেসারি, ভুট্টা, টমেটো, পেয়ারা ইত্যাদি।

গম, কমলা, নাশপাতি কম লবণাক্ততা সহিষ্ণু।

লবণাক্ত এলাকায় আমন মৌসুমে চাষের জন্য অনুমোদিত জাত হলো- বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান ৪০, ব্রি ধান ৪১, ব্রি ধান ৪৬, ব্রি ধান ৫৩, ব্রি ধান ৫৪ ইত্যাদি। স্থানীয় আমন জাতের মধ্যে রয়েছে রাজাশাইল, কাজলশাইল, বাজাইল ইত্যাদি। বোরো মৌসুমে চাষের জন্য অনুমোদিত জাত ব্রি ধান ৪৭, ব্রি ধান ৫৫।

খ) সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা

জমির চারপাশে আইল দিয়ে ভারী সেচ দিলে মাটির দ্রবণীয় লবণ চুইয়ে ফসলের মূলাঞ্চলের নিচে চলে যায়। আবার মূলাঞ্চলের নিচ বরাবর গভীরতায় যদি নিষ্কাশন নালা তৈরি করে জমির পানি বের করে দেওয়া যায় তাহলে মূলাঞ্চলের নিচের লবণও ধুয়ে জমির বাইরে চলে যায়। এ অবস্থায় মাটিতে জো আসার সাথে সাথে জমি চাষ দিয়ে ফসল বুনতে হবে। হালকা বুনটের মাটিতে এ পদ্ধতি বেশি কার্যকর।

গ) পানির বাষ্পীভবন হ্রাসকরণ

লবণাক্ত জমির মাটিতে লবণ ফসলের মূলাঞ্চলের নিচে রাখতে পারলে ফসল ভালোভাবে চাষ করা যায়।

সূর্যালোকের কারণে ভেজা অবস্থায় মাটির উপরিভাগের ছিদ্রের মাধ্যমে পানির বাষ্পীভবন হয়। ফলে বাষ্পীভবনের সাথে লবণ মাটির উপরের দিকে চলে আসে। তাই লবণাক্ত মাটির উপরের স্তরের ছিদ্র বন্ধ করে দিতে হয়। মাটির উপরিভাগে কোদাল, নিড়ানির সাহায্যে মাটি আলগা করে দিলে ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায় এবং লবণ মাটির নিচের স্তরেই থেকে যায়।

লবণাক্ত এলাকায় মাঠের আমন ধান কেটে নেওয়ার পর জমি ভেজা থাকতেই চাষ দিয়ে রবি ফসল আবাদ করা যায়। তবে বীজ গজানোর বা চারা রোপণের পর ঘন ঘন নিড়ানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

লবণাক্ত জমিতে প্রতি সেচ বা বৃষ্টিপাতের পর পরই নিড়ানি দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে উপরের স্তরে লবণ জমতে পারে না।

ঘ) সঠিকভাবে জমি তৈরি

আমন ধান কাটার পর যদি রবি ফসল চাষ করতে দেরি হয় তবে সে সময়ে লবণ মাটির উপর উঠে আসে। তাই তাড়াতাড়ি জমি চাষ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি লাঙলের চেয়ে পাওয়ার টিলার ব্যবহার করা উত্তম।

শেষ চাষের সময় জমি ভালোভাবে সমান করতে হবে। সমান জমিতে বীজ ভালো গজায়। জমি উঁচু নিচু থাকলে নিচু স্থানে লবণ জমতে পারে

ঙ) বপন পদ্ধতির পরিবর্তন

লবণাক্ত জমিতে বীজ ছিটিয়ে বুনলে লবণ তাড়াতাড়ি উপরে আসে এবং বীজ কম গজায়। তাই গর্ত তৈরি করে বীজ মাটির একটু গভীরে বপন করা উচিত। অথবা জমিতে এক মিটার পর পর অগভীর নালা তৈরি করে কয়েক দিন সেচ দিতে হবে। ফলে আইলের মাটির লবণ ধুয়ে নালায় চলে আসবে। এবার আইলের মাটি কোদাল দিয়ে হালকা চাষ দিয়ে বীজ বুনলে ভালো গজাবে।

(৪) বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে ফসল উৎপাদন কৌশল

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছর বন্যা হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে ব্যাপক ফসলহানি হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ বন্যায় তিন লক্ষ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হ্রাস পায়।

এছাড়াও ২০০৪ সালে বন্যায় ১.৩ মিলিয়ন হেক্টর, ২০০৭ সালে বন্যায় ৮.৯ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয় এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে দ্বিতীয় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়।

বন্যার সময় পানির উচ্চতার উপর ভিত্তি করে বন্যাপ্রবণ জমিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন-

  • মধ্যম উঁচু জমি: বন্যার সময় পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ০.৯০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • মধ্যম নিচু জমি: বন্যার সময় পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ১.৮০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • নিচু জমি: বন্যার সময় পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩.০০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • অতি নিচু জমি: বন্যার সময় পানির উচ্চতা ৩.০০ মিটারের বেশি হয়ে থাকে।

এসব বন্যাপ্রবণ জমিতে মৌসুম ও এলাকাভেদে বোনা আমন, গভীর পানির আমন রোপা আমন, বোনা আউশ রোপা আউশ, বোরো ধান চাষ করা হয়ে থাকে।

বন্যাপ্রবণ এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য প্রধানত দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে, যেমন-

ক) বন্যা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা

বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য নদী বা খালের দুই তীর দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়। নদী বা খালে সুইস গেট নির্মাণ করে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে পানি ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করতে না পারে। তবে এ সব নির্মাণের আগে পরিবেশগত দিক ভালোভাবে বিবেচনা করতে হয়।

See also  বিরূপ আবহাওয়া-সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত

খ) কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থা

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাপ্রবণ এলাকায় বোরো ধান উঠার সময় হঠাৎ করে বন্যা দেখা দেয়।

এসব অঞ্চলে-

  1. আগাম জাতের বোরো ধান চাষ করে ফসল রক্ষা করা যায়। ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ৩৬ আগে পাকে বলে এ অঞ্চলে চাষ করা উচিত।
  2. জানুয়ারি মাসে জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে ৬০ দিন বয়সের চারা রোপণ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
  3. এসব জাতের ধান ১৪০-১৫০ দিনের মধ্যে পাকে। ফলে এপ্রিলের শেষে সংগ্রহ করে বন্যা এড়ানো যায়।
  4. এ অঞ্চলে রোপা আমন হিসাবে ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান ৫২ দুইটি অনুমোদিত বন্যা সহনশীল জাত। এ জাত দুইটির ১০-১৫ দিন পানির নিচে ডুবে থাকার ক্ষমতা আছে।
  5. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় চাষিরা স্থানীয় জাতের গভীর পানির আমন ধানও চাষ করে থাকে।

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে আমন ধান রোপণের আগে বা পরে বন্যা দেখা যায়। অনেক সময় আগাম বন্যার কারণে কৃষকেরা ধানের বীজতলা তৈরি করার জমি পায় না।

সে ক্ষেত্রে-

  1. বাড়ির উঠানে, কোনো উঁচু স্থানে বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে।
  2. এক্ষেত্রে বীজতলার উপর কলাপাতা বা পলিথিন শিট বিছিয়ে দিয়ে হালকা কাদার প্রলেপ দিয়ে ৫-৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা বীজ ঘন করে বুনে দিতে হয়।
  3. এ পদ্ধতিতে এক বর্গমিটার বীজতলায় ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বপন করা হয়। একে সাপোগ বীজতলা বলে।
  4. দুই সপ্তাহের মধ্যে মূল জমিতে বন্যার পানি নেমে পেলে চারা রোপণ করতে হয়।

বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে নাবি জাতের আমন ধান, যেমন- নাইজারশাইল, বিআর ২২, বিআর ২৩ চাষ করা উচিত।

দাপোগ পদ্ধতিতে দ্রুত চারা উৎপাদনের আরও একটি উপায় আছে। বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভেজানোর পর একটু ফাটলে বস্তা বা মাটির কলসে ২৪-৭২ ঘণ্টা রেখে দিলে তারা গজিয়ে যায়। এভাবে উৎপাদিত চারা বন্যার পানি নামার সাথে সাথে ছিটিয়ে বপন করা হয়

(৫) প্রতিকূল পরিবেশে পশুপাখি উৎপাদন

প্রাণি তার পারিপার্শ্বিক গাছপালা, পুকুর, নদ-নদী, আবহাওয়া ও জলবায়ু ইত্যাদি নিয়ে গঠিত একটি পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে। পরিবেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর আচরণ যখন পতপাখি পালনের উপযোগী থাকে না তখন তাকে প্রতিকূল পরিবেশ বলে। লবণাক্ততা, বন্যা ও খরা পতপাখি উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

পশুপাদির উপর প্রতিকূল পরিবেশের প্ৰতাৰ নিম্নে দেওয়া হলো-

  1. প্রতিকূল পরিবেশে পশুপাখির খাদ্যাভাব দেখা যায়।
  2. বিশেষ করে বন্যা ও খরার সময় ঘাসের অভাব হয়।
  3. লবণাক্ত জমিতে ফসল ও ঘাস জন্মায় না।
  4. পশুর বৃদ্ধি ও সুখ উৎপাদন অনেক কমে যায়।
  5. গত পুষ্টিহীনতায় আনা হয়।
  6. অনেক পশুপাখি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

ক) বন্যার সময় করণীয়

  1. এ সময় পশুপাখিকে কোনো উঁচুস্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
  2. যেসব এলাকায় প্রতিবছর বন্যা দেখা দেয়, সেখানে কোনো উঁচুস্থানে স্থায়ীভাবে পশুপাখির ঘর তৈরি করতে হবে।
  3. বন্যাপীড়িত এলাকায় লেয়ার মুরগির খামার না করে ব্রয়লার বা হাঁসের খামার করতে হবে। কারণ মাত্র ০১ মাস পালন করে ব্রয়লার বাজারজাত করা যায়।
  4. বন্যার সময় পশুকে কচুরিপানা, বিভিন্ন গাছের পাতা, ধানের খড়, কলাগাছ ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে সরবরাহ করতে হবে।
  5. দেশি মুরগির জন্য আগেই কিছু গম বা ভুট্টা কিনে রাখতে হবে। কারণ মুরগি পানিতে নামে না।
  6. এ সময় ছাগল ও ভেড়াকে কলার ভেলা ও নৌকায় রেখেও কিছুদিনের জন্য পালন করা সম্ভব।
  7. বন্যার সময় পশুর রোগ ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
  8. পশুর ঘরে যেন কাদামাটি না জমে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
  9. বন্যার আগেই পশুকে সম্ভাব্য রোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য টিকা প্রদান করতে হবে।

খ) খরার সময় করণীয়

  1. এ সময় প্রকৃতিতে ঘাস উৎপাদন কমে যায়। এ ক্ষেত্রে পশুকে সুবিধামতো বিভিন্ন গাছের পাতা খাওয়াতে হবে।
  2. পশুকে অতি গরমের কারণে খোলাস্থানে বেঁধে রাখা ঠিক নয় ভাই গরমের সময় পশুকে গাছের নিচে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
  3. এ সময় পশুকে প্রচুর খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে।
  4. অন্যান্য খাদ্যের সাথে দানাজাতীয় খৈল, ভূসি, ভাত গোলানো মাড় খেতে দিতে হবে।
  5. পশুকে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক টিকা প্রদান করতে হবে।

লবণাক্ততা, বন্যা ও খরাপীড়িত এলাকায় পশুর জন্য নেপিয়ার, পারা, জার্মান জাতের ঘাস চাষ করা যায়। তা ছাড়া খরার সময় সংরক্ষিত সবুজ ঘাস, আখের উপজাত, কলাগাছ, ইপিল ইপিল গাছের পাতা ইত্যাদি গো-খাদ্য হিসেবে বেশ উপযোগী।

বর্তমানে বিশেষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত আ্যজোলা বা সবুজ শৈবালও পশুকে খাওয়ানো হচ্ছে। তাই খরার সময় এ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

(৬) প্রতিকূল পরিবেশে মৎস্য উৎপাদন ও বিরূপ আবহাওয়ায় মৎস্য রক্ষার কৌশল

যেসব অঞ্চলে সারা বছরই পুকুরে কিছু না কিছু পানি থাকে, বন্যার প্রবণতা কম বা একেবারে নেই; সেই সব এলাকা মাছ চাষের জন্য অধিক উপযোগী।

কিন্তু অনেক অঞ্চল রয়েছে সেখানকার পরিবেশ মাছ চাষের জন্য খুব অনুকূল নয়, যেমন- বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাছ চাষ করলে বন্যার সময় চাষের পুকুর ডুবে গিয়ে মাছ ভেসে যাওয়ার ভয় থাকে। এতে চাষি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অন্যদিকে যেসব এলাকায় খরা বেশি সেখানে খরার সময়ে পুকুরের পানি শুকিয়ে যায় ও মাটির নিচের পানির স্তর অনেক নেমে যায় বলে মাছ চাষ দূরূহ হয়ে পড়ে।

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলোর উজানে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সাগর স্ফীতির জন্য লোনা পানি নদীর অনেক ভেতর পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। ফলে এ সমস্ত এলাকার পুকুরের পানিরও লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এতে এসব এলাকায় স্বাদু পানির মাছ আর আগের মতো ফলন দিচ্ছে না।

মৃগেল মাছ লোনা পানি সহ্য করতে পারে না। বুই, কাতলাও আশানুরূপ আকারের হচ্ছে না। প্রতিকূল পরিবেশই শুধু নয় বিরূপ আবহাওয়া যেমন- অতিবৃষ্টি, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসও মাছ উৎপাদন ব্যাহত করছে।

যেমন- ২০০৭ সালের সিডরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৭৮টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, চাষি হারিয়েছে ৬ হাজার ৫১১ মেট্রিক টন মাছ যার বাজার মূল্য ছিল ৪৭৮ মিলিয়ন টাকা। জাল ও নৌকা হারিয়েছে ৭২১ মিলিয়ন টাকা মূল্যের।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ‘নার্গিস’, ২০০৯ সালের ‘আইলা’, ২০১৩ সালের মহাসেন, ২০১৫ সালের ‘বোমেন’, ২০১৬ সালের ‘রোয়ানু’, ২০১৭ সালের ‘মেরো’ এবং ২০১৯ সালের ফনি বুলবুল- এ ফসল, মৎস্য ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়।

See also  ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উক্ত প্রেক্ষাপটে অভিযোজন কলাকৌশল

প্রতিকূল পরিবেশ ও বিরূপ আবহাওয়ায় মাছ উৎপাদন ও রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতে পারে-

  1. খরাপ্রবণ এলাকায় বড় পোনা ছাড়া যেতে পারে যেন অল্প সময়ে ফলন পাওয়া যায়। আবার যেসব মাছ স্বল্প সময়ে ফলন দেয় যেমন- তেলাপিয়া, খরাপ্রবণ এলাকায় চাষ করা যেতে পারে। চার-পাঁচ মাসেই এর ফলন পাওয়া যায়। এসব অঞ্চলে দেশি মাগুরেরও চাষ করা যেতে পারে।
  2. বন্যাপ্রবণ এলাকায় একই পুকুরে একটি দীর্ঘ ও একটি স্বল্পমেয়াদি মাছ চাষ পদ্ধতি নেওয়া যায়। এ সমস্ত এলাকার পুকুরের পাড় উঁচু করে বাঁধতে হবে এবং যে সময় বন্যা থাকে না। ঐ সময়ে পোনা মজুদ করা যায়।
  3. উপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা সহনশীল চাষযোগ্য মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন- ভেটকি, বাটা, পারশে। এসব জলাশয়ে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের উদ্যোগ নেওয়া যায়। তেলাপিয়াও এক্ষেত্রে ভালো ফলন দেবে।
  4. প্রতিকূল পরিবেশ ও বিরূপ আবহাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এসব এলাকায় পরিকল্পিত মাছ চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ ও কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে ওই পানিকে কাজে লাগানো যায়
  5. অতিবৃষ্টির কারণে পুকুর ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পুকুরের পাড় বরাবর চারপাশে বাঁশের খুঁটির সাহায্যে জাল দিয়ে আটকে দেওয়া যায়। এতে মাছ বাইরে বের হয়ে যেতে পারে না।
  6. গ্রীষ্মের সময় পুকুরের পানির উচ্চতা কমে গেলে ও পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সেচ বা পাম্পের মাধ্যমে পুকুরে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে মাছ পর্যাপ্ত পানি পাবে ও পরিবেশও ঠাণ্ডা থাকবে।

(৭) বিরূপ আবহাওয়ায় ফসল রক্ষার কৌশল

এ প্রথমে আমরা প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে জেনেছি। প্রতিকূল পরিবেশে জলবায়ু ও পরিবেশগত অন্যান্য উপাদান ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের অনুকূলে থাকে না। এ অবস্থা সম্পর্কে মানুষের আগাম ধারণা থাকে। ফলে মানুষ ফসল নির্বাচন থেকে শুরু করে ফসলের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আগে থেকেই সজাগ থাকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ফসল উৎপাদনকালীন সময়ে যদি আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ফসলের ক্ষতি হয় তখন তাকে আমরা বিরূপ আবহাওয়া বলি।

বিরূপ আবহাওয়া একটি স্বল্পস্থায়ী অবস্থা। কিন্তু এ স্বল্পস্থায়ী অবস্থায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অকাল জলাবদ্ধতা, অভিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, উচ্চ তাপমাত্রা, নিম্ন তাপমাত্রা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, তুষারপাত ইত্যাদি বিরূপ আবহাওয়ার উদাহরণ।

এখন আমাদের বাংলাদেশের কিছু বিরূপ আবহাওয়া এবং সে আবহাওয়ায় ফসল রক্ষার কৌশল নিচে আলোচনা করা হলো-

ক) জলাবদ্ধতা

অতিবৃষ্টি বা বন্যার কারণে কোনো স্থান জলাবদ্ধ হয়ে পড়াকে জলাবদ্ধতা বলে।

পাহাড়ি ঢলের কারণে জলাবদ্ধতায় হাওর অঞ্চলে বোরো ধান পাকার সময় তলিয়ে যেতে পারে।

  1. বাঁধ ভেঙে জমির ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বাঁধ মেরামতের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
  2. সুযোগ থাকলে নিষ্কাশন নালা কেটে জলাবদ্ধ জমি থেকে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে আগাম বন্যায় কোনো এলাকার আমন রোপণ ব্যাহত হলে বন্যামুক্ত এলাকায় চারা উৎপাদন করে ঐ এলাকার পানি নেমে গেলে রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে।
  3. বন্যা পরবর্তী কৃষকরা যাতে দ্রুত অন্য ফসল চাষাবাদে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, চারা ও সার সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।

খ) অতিবৃষ্টি

বাংলাদেশে জুন থেকে অক্টোবর মাসে বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে। এ সময়ে কখনো কখনো একটানা কয়েকদিন অতি বৃষ্টি হয়ে থাকে।

অতিবৃষ্টির ফলে মাঠ-ঘাট, ফসলের জমিতে পানি জমে যায়। অনেক ফসলের গাছ গোড়া নড়ে নেভিয়ে বা হেলে পড়ে।

  1. এ ধরনের আবহাওয়ায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারার গোড়ায় মাটি দিয়ে সোজা করে বাঁশের খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।
  2. এ সময় শাকসবজির মাঠ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শাকসবজির মাঠ থেকে দ্রুত পানি বের করে দিতে হবে। এ জন্য নিষ্কাশন নালা কোদাল দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
  3. এ মৌসুমে শাকসবজি চাষ করলে সাধারণত উঁচু বেড করে চাষ করা হয়। দুইটি বেডের মাঝে ৩০ সে.মি. নালা রাখা হয়

গ) অনাবৃষ্টি

যদি শুষ্ক মৌসুমে একটানা ১৫ দিন বা এর বেশি বৃষ্টি না হয় তখন আমরা তাকে অনাবৃষ্টি বলি।

অনাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য আমরা সেচ দিয়ে থাকি।

  1. বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান চাষের ক্ষেত্রে যদি অনাবৃষ্টি দেখা দেয় তবে জমিতে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
  2. জমিতে নিড়ানি দিয়ে মাটির ফাটল বন্ধ করে রাখতে হবে। তাহলে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানি কম বের হবে রবি মৌসুমে সবজি ক্ষেতে জাবড়া প্রয়োগ করে পানি সংরক্ষণ করতে হবে।
  3. অনাবৃষ্টির কারণে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে পাট, ধান ও শাকসবজির জমিতে বীজ বপনের জো পাওয়া না গেলে বীজ বুনে সেচ দিতে হবে অথবা সেচ দিয়ে জো এলে বীজ বুনতে হবে।

বিরূপ আবহাওয়া একটি স্বল্পস্থায়ী অবস্থা। কিন্তু এ স্বল্পস্থায়ী অবস্থায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অকাল জলাবদ্ধতা, অভিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, উচ্চ তাপমাত্রা, নিম্ন তাপমাত্রা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, তুষারপাত ইত্যাদি বিরূপ আবহাওয়ার উদাহরণ।

যেহেতু বিরূপ আবহাওরা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়, তাই এ সমস্যাকে মোকাবেলার জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, ফলে এর সমাধান কঠিন হয়ে পড়ে।

বিরূপ আবহাওয়া হঠাৎ সৃষ্টি হলেও তা কখন হতে পারে এ সম্পর্কে বর্তমানে আবহাওয়াবিদগণ পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। তাই সে মোতাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। বিরূপ আবহাওয়া মোকাবেলা একটি স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রম। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।

বিরূপ আবহাওয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় মানুষ নিজেই অসহায় থাকে। তবুও এ সময় পশুপাখি রক্ষার চেষ্টা করতে হবে।

হঠাৎ জলাবদ্ধতা ও বন্যার সৃষ্টি হলে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে পশুপাখিকে আশ্রয় দিতে হবে। আগেই সংরক্ষণ করা খড়, গাছের পাতা, কচুরিপানা ও দানাদার খাদ্য পণ্ডকে সরবরাহ করতে হবে। অতিবৃষ্টিতে পশুকে ঘরের বাইরে নেওয়া সম্ভব হয় না, তাই এ সময়ও পতকে উল্লিখিত খাদ্য খেতে দিতে হয়। বিশেষ করে ছাগলের জন্য কাঁঠাল পাতা সংগ্রহ করে তার সামনে ঝুলিয়ে দিতে হবে।

শীতের সময় পশুকে অতি ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষার জন্য পশুর ঘরের চারপাশে বাতাস চলাচল বন্ধ করতে হবে। ঘরের মেঝেতে খড় বা নাড়া বিছিয়ে দিতে হবে। গরুর বাছুর যাতে নিউমোনিয়া আক্রান্ত না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মৃত পশুপাখিকে মাটির নিচে চাপা দিতে হবে। পশু ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক বেঁচে থাকা অসুস্থ পশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page