(১) উদ্যান ফসল সংগ্রহ ও বাছাই পদ্ধতি
ফল, শাক-সবজি ও ফুল দ্রুত পচনশীল। এসব পণ্য দেশীয় প্রচলিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ, বাছাই ও বাজারজাত করায় ক্ষেত্র বিশেষে শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। আর্থিক ও পুষ্টির বিবেচনায় এ ক্ষতি অপরিসীম। কিন্তু ফসল তোলা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত একটু সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পণ্যের বাহ্যিক তরতাজা চেহারা, নিজ নিজ স্বাদ, গন্ধ, রং ও গুণগতমান পুরোপুরি বজায় থাকে। ফলে পণ্য নষ্ট কম হয় এবং ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যায়
বিভিন্ন উদ্যান ফসলের ফল, পাতা, কুঁড়ি, অঙ্কুর, মূল, কাণ্ড, কলি ও ফুল ইত্যাদি অংশ আমরা ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করি। ফসল সংগ্রহের জন্য আমাদের বাণিজ্যিক পরিপতাকে বিবেচনা করতে হয় বাণিজ্যিক পরিপক্বতা বলতে ফসলের ব্যবহার্য অংশের এমন অবস্থানে বোঝায় যখন মানুষ তা খাওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারে। যেমন- শসা, লাউ, কুমড়া, বেগুন, শীম, বরবটি, ঢেড়শ, পাতাজাতীয় সবজি ইত্যাদি আমরা বাড়ন্ত অবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে সংগ্রহ ও বাজারজাত করি।
ফলকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের ফল গাছ থেকে তোলার পর ফলের মধ্যে শর্করা থেকে চিনিতে রূপান্তর বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- জাম্বুরা, লেবু, আঙ্গুর, লিচু ইত্যাদি। এসব ফল পাকার পরই তোলা উচিত। আবার আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, বেল ইত্যাদি ফল গাছ থেকে তোলার পরও শর্করা থেকে চিনিতে রূপান্তর হতে থাকে, সুগন্ধ ছড়ায় ও রং ধারণ করে। এসব ফল পাকার আগে গাছ থেকে পাড়া হয়।
ভালো বাজারমূল্য পাওয়ার জন্য উদ্যান ফসল যথাযথভাবে সংগ্রহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ইটিইি, বাছাই, প্যাকিং ও পরিবহন করা প্রয়োজন। সঠিকভাবে এ কাজ না করলে পণ্য থেকে বাষ্পীভবন, প্রস্বেদন ও শ্বসনের মাধ্যমে পানি বের হয়ে কুঁচকে যেতে পারে, তাপমাত্রা বাড়ার ফলে শ্বসন বেড়ে গিয়ে কোষ-কলা নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং রোগ-জীবাণুর আক্রমণে পণ্য পচে যেতে পারে। এসব ক্ষতি থেকে পণ্যকে রক্ষার জন্য আমাদের নিচের বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের সময় নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-
ক) সাবধানতা
ফসল তোলার পদ্ধতি উদ্যান ফসল সাধারণত দুইভাবে তোলা হয়, হাত দিয়ে এবং যন্ত্রের সাহায্যে। ফসল সাবধানে তুলতে হবে যেন গাছের বা তোলা ফসলের কোনোটার ক্ষতি না হয়। তোলার সময় হাতের নখ, চুরি বা যন্ত্রের আঘাতে ফললের পারে ক্ষত সৃষ্টি করা, পাছ মোচড়ানো, মাটিতে ফেলে দেওয়া, পারে মাটি লাগানো, সূর্যের তাপ লাগানো ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।.
খ) পরিপক্বতা
ফসল তোলার সময় ফসল তোলার জন্য আমাদের বাণিজ্যিক পরিপক্বতাকে বিবেচনা করে সঠিক সময়ে ফসল তুলতে হবে।
গ) ফসল রাখার পাত্র
ক্ষেত থেকে ফসল তুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পারো রাখতে হবে। পাত্র এমন হতে হবে যেন পণ্যের কোনো ক্ষতি না হয়। আমরা ফসল রাখার জন্য পাটের বস্তা, প্লাস্টিকের ঝুড়ি, বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকি।
ঘ) মাঠ থেকে পরিবহন
মাঠ থেকে বাছাই করার স্থানে পণ্য নেওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে। পণ্যভর্তি পাত্র আছড়ে ফেলা যাবে না। গাদাগাদি করে বোঝাই করা যাবে না। ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হবে যাতে ঝাঁকুনি কম লাগে।
ঙ) তাপমাত্রা
ক্ষেত থেকে তোলার পর পণাকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করতে হবে। ভাগে পণ্যের উত্তাপ বেড়ে যায়। ফলে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। পণ্য সকালে বা বিকালে তুলতে হবে। তোলার পর যত দ্রুত সম্ভব মাঠ থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
চ) পণ্য বাছাই
পণ্য মাঠ থেকে আনার পর প্রথমে অপ্রয়োজনীয় বা অগ্রহণযোগ্য পণ্য বেছে আলাদা করতে হবে। পরে পণ্যের আকার আকৃতি অনুযায়ী কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে হবে। অতঃপর বাজারজাত করার জন্য পণ্য প্যাকিং করতে হবে। আমরা বস্তা, পলিথিনের শিট, প্লাস্টিকের ঝুড়ি, বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি অথবা কাগজের বা কাঠের বাক্সে প্যাকিং করে থাকি। প্যাক করা পণ্য গন্তব্যস্থানে পাঠানোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অবশ্যই ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হবে।
(২) মাঠ ফসল সংগ্রহ ও বাছাই পদ্ধতি
ফসল পাকার পর কাটা থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক ধাপ পার হয়ে আসতে হয়। এসব ধাপে সঠিক পরিচর্যার অভাবে উৎপাদিত ফসলের মান খারাপ হয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চাষিরা ন্যায্য মূল্য পায় না।
ফসল কাটা থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত নিম্নলিখিত ধাপগুলোতে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষতি সহজেই কমিয়ে আনা যায়-
ক) সঠিক সময়ে ফসল কাটা
বীজ ভালোভাবে পাকার পরই ফসল সংগ্রহ করতে হবে অর্থাৎ ফসল পাকার পর কাটতে হবে। তবে ফসল কাটার সময় আবহাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ ঝড়-বৃষ্টির সময় ফসল সংগ্রহ করা যায় না। আবার সংগ্রহ করলেও মাড়াই ঝাড়াই ও শুকানো যায় না। ফসল জমা করে রাখায় তাপ বেড়ে পচে যেতে পারে, গন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবার ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকলে পুরোপুরি পাকার আগেই অনেক সময় সংগ্রহ করতে হয়।
ফসল কাটার ১৫-২০ দিন আগে পানি সেচ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে ফসলের দৈহিক বৃদ্ধি কম হবে এবং পরিপক্বতা তরান্বিত হবে। ধান কাটার জন্য ফসল সোনালি বর্ণ ধারণ করলে অথবা ৮০% ধান পরিপক্ক হলে ফসল কাটা যাবে। ডাল ও তেল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ মরে হলদেভাব হবে। দানা পুষ্ট হলে ফসল কাটা যাবে। তবে বেশি শুকিয়ে গেলে ফসল কাটা ও পরিবহনের সময় দানা ঝরে পড়বে। ধান, গম ফসল কাঁচি দিয়ে বা যন্ত্রের সাহায্যে কাটা যায়।
খ) মাড়াইকরণ
কাটা ফসল ভালোভাবে শুকিয়ে নিলে দ্রুত মাড়াই করা যায়। মাড়াইয়ের সময় দানা নষ্ট হয় না। ধান-গম মাড়াই করার জন্য পা বা শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক সময় ড্রাম বা মাচার উপর হাত দিয়ে পিটিয়েও দানা আলাদা করা যায়। মাড়াইয়ের স্থানটি ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিতে হবে। ভাল ও তেল ফসল মাড়াই করার আগে খুব ভালো শুকিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ফসলের পরিমাণ বেশি হলে গর্ দিয়ে ফসল মাড়াই করা হয়। অন্যথ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ফসল মাড়াই করা হয়।
গ) ঝাড়াই
ফসল মাড়াই করার পর ফসলের পরিত্যক্ত অংশ দানা থেকে আলাদা করে প্রথমে হালকাভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। অতঃপর কুলা, বাতাস বা শক্তিচালিত ফ্যানের সাহায্যে দানা ঝাড়াই করা হয়। ঝাড়াই করার ফলে দানা থেকে খড়কুটা, চিটা ও অন্যান্য আবর্জনা বাছাই হয়ে যায়।
ঘ) ফসল শুকানো
মাড়াই বাড়াই করার পর দানা ভালোভাবে শুকাতে হবে। দানা শুকানোর মাধ্যমে দানার মধ্যে আর্দ্রতাকে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে আনতে হবে। দানাকে ২-৩টি রোদে এমনভাবে শুকাতে হবে যেন দাঁত নিয়ে চাপ দিলে ‘কট’ করে শব্দ হয়। এ অবস্থায় দানায় আর্দ্রতার মাত্রা ১০-১২% এ চলে আসে। এছাড়া আর্দ্রতা মাপার যন্ত্রের সাহায্যেও এ কাজটি করা যায়। গুদামজাত অবস্থায় দানায় আর্দ্রতার মাত্রা বেশি থাকলে বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পচে যেতে পারে বা মান খারাপ হয়ে যেতে পারে।
ঙ) পরিবহন
ভফানোর পর নানা পরম অবস্থায় বস্তাবন্দি করা ঠিক না। একটু ঠাণ্ডা হওয়ার পর প্লাস্টিক বা চটের বস্তায় ভর্তি করে গুলাম বা গোলা ঘরে নিয়ে যেতে হয়। ছেঁড়া-ফাটা বস্তা পরিহার করতে হবে। ফসল বেশি হলে গাড়িতে পরিবহন করতে হয়। গাড়িতে উঠানো-নামানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বস্তা ছিড়ে দানা নষ্ট না হয়।
চ) গুদামজাতকরণ
যে ঘর বা কক্ষে সংগৃহীত ফসল রাখা হয় তাকে গুদাম ঘর বলে। গুদাম ঘরের মেঝের একটু উপরে বাঁশ বা কাঠের পাটাতন করে তার উপর ফসল রাখা হয়। আমাদের বাংলাদেশে চট বা প্লাস্টিকের বস্তা, বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি ডোল, মাটির মটকা, প্লাস্টিক বা টিনের ড্রামের ভিতর দানাশস্য সংরক্ষণ করা হয়।
গুদাম ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এতে পোকান্ডমাকড় ও ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়। নানা রাখার সময় ভাঁজে ভাঁজে শুকানো নিমপাতা দিলে পোকার আক্রমণ হয় না। গুদাম ঘর মাঝে মাঝে পরিদর্শন করতে হবে। দানার আর্দ্রতা পরীক্ষা করে প্রয়োজনে আবার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।