আপনি কি গমের বেশি ফলন পেতে চান? আপনি কি গম ও বীজ গম সঠিকভাবে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে চান? তাহলে আজকের এই পোষ্টটি আপনার জন্যই।
(১) উচ্চ ফলনশীল গম বীজের নাম
কেন উচ্চ ফলনশীল গম বীজ ও সঠিক জাত ব্যবহার করবেন?
রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত ভাল ফসল জন্মানো যাতে সর্বোচ্চ ফলন এবং লাভজনক হয়।
গমের ভাল জাত কোনগুলি?
এই সবগুলি জাতই তাপ ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী।
বারি গম ২১ (শতাব্দী) |
বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১০৫-১১২ দিন |
দেরিতে বপনের উপযুক্ত |
ফলন: ১৪.৫-২০.০ কেজি/শতাংশ বা ১২.০-১৬.৭ মন/বিঘা |
বারি গম ২৫ |
বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১০২-১১০ দিন |
মাঝারী লবনাক্ত সহনশীল |
দেরিতে বপনের উপযুক্ত |
ফলন: ১৪.৫-২০.০ কেজি/শতাংশ বা ১২.০-১৬.৭ মন/বিঘা |
বারি গম ২৬ |
বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১০৪-১১০ দিন |
কান্ডের মরিচা রোগ সহনশীল |
দেরিতে বপনের উপযুক্ত |
ফলন: ১৪-২০ কেজি/শতাংশ বা ১১.৫-১৬.৭ মন/বিঘা |
বারি গম ২৭ |
বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১০৫-১১০ দিন |
কান্ডের মরিচা রোগ প্রতিরোধী |
ফলন: ১৪-২২ কেজি/শতাংশ বা ১১.৫-১৮.০ মন/বিঘা |
বারি গম ২৮ |
বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১০২-১০৮ দিন |
কান্ডের মরিচা রোগ কিছুটা প্রাতরোধী |
দেরিতে বপনের উপযোগী |
ফলন: ১৬-২২ কেজি/শতাংশ বা ১৩-১৮ মন/বিঘা |
কোথায় উচ্চ ফলনশীল ও মানসম্পন্ন গম বীজ পাবেন?
বিএডিসি এবং বিএআরআই মানসম্পন্ন বীজের বিশ্বস্ত উৎস কৃষক কর্তৃক সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করা যেতে পারে (তবে তা হতে হবে পরিষ্কার, গজানোর হার শতকরা ৮৫ ভাগ এর উপরে এবং ২ বছরের বেশি পুরানো না)।
(২) আধুনিক গম চাষ পদ্ধতি/কৌশল
কিভাবে বীজের হার নির্ধারণ করবেন?
* ১ বিঘা = ৩৩ শতাংশ
গজানোর হার শতকরা ৮৫ ভাগ এর উপরে হলে প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম বীজ ব্যবহার করতে হবে।
গজানোর পরীক্ষা: ১০০টি বীজ মাটি বা কলাপাতার ডগা বা ভিজা চটের মধ্যে সারি ক’রে বসিয়ে হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে, এবং শুকিয়ে গেলে পুনরায় প্রয়োজনীয় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। ৫-৬ দিন পর গুনে দেখতে হবে ১০০টি বীজের মধ্যে শিকড় ও কান্ডসহ মোট কয়টি বীজ ভালভাবে গজিয়েছে।
কখন গমের বীজ বপন কররেন?
বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের ১৫-৩০ তারিখ (অগ্রহায়ণ মাসের ১-১৫ তারিখ) পর্যন্ত।
তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘ শীতের কারণে ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ (অগ্রহায়ন মাসের ২২ তারিখ) পর্যন্ত এবং দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত পানি শুকিয়ে মাটি ‘জো’ অবস্থায় আসতে দেরির কারণে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ (অগ্রহায়ণ মাসের ৩০ তারিখ) পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।
প্রতি শতাংশে কতটুকু পরিমান সার প্রয়োগ করবেন?
উত্তর অঞ্চল |
বপনের সঠিক সময় (১৫-৩০ নভেম্বর) |
দেরিতে বপনের সময় (৭ ডিসেম্বর এর পর) |
চাষের শুরুতে শতাংশ প্রতি গোবর সার ২০ কেজি (যদি থাকে) এবং শেষ চাষে ইউরিয়া ৬৫০ গ্রাম, টিএসপি ৬৫০ গ্রাম, এমপি ৪২৫ গ্রাম, জিপসাম ৪২৫ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। |
এছাড়াও যেখানে ঘাটতি দেখা যায় এবং যখন ডিএই/বিএআরআই/বিএডিসি পরামর্শ দেয় সেখানে শেষ চাষে শতাংশ প্রতি বরিক পাউডার ২৫ গ্রাম, দস্তা সার (জিংক সালফেট) ৫০ গ্রাম এবং বীজ বপনের ৭ দিন আগে ডলোচুন ৪ কেজি মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। |
উপরি প্রয়োগ- চারার ৩ সপ্তাহ বয়সে ইউরিয়া ৩৫০ গ্রাম প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিতে হবে। |
দক্ষিণ অঞ্চল |
বপনের সঠিক সময় (১৫-৩০ নভেম্বর) |
দেরিতে বপনের সময় (১৫ ডিসেম্বর এর পর) |
সারের পরিমান- উত্তর অঞ্চলের মত একই রকম |
চাষের শুরুতে শতাংশ প্রতি গোবর সার ২০ কেজি (যদি থাকে) এবং শেষ চাষে ইউরিয়া ৪৫০ গ্রাম (সঠিক সময়ের পরিমানের চেয়ে শতকরা ৩৩ ভাগ কম), টিএসপি ৬৫০ গ্ৰাম, এমপি ৪২৫ গ্রাম, জিপসাম ৪২৫ গ্রাম মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। |
উপরি প্রয়োগ- চারার ৩ সপ্তাহ বয়সে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ২৩৫ গ্রাম (সঠিক সময়ের পরিমানের চেয়ে শতকরা ৩৩ ভাগ কম) প্রয়োগ করে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। |
কোন পদ্ধতিতে বীজ বপন কররেন?
কৃষকেরা সাধারণত ছিটিয়ে বীজ বপন করে থাকে, তবে মেশিন দ্বারা যেমন- বেড প্লান্টার বা স্ট্রিপ টিলার বা পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার এর মাধ্যমে এক চাষেই বীজ বপন করা উত্তম।
বেড প্লান্টিং (বেড-নালা চাষ পদ্ধতি) এবং এর সুবিধা-
- বেড প্লান্টার এক চাষেই লম্বা বেড-নালা তৈরি করে, এবং একই সাথে সার প্রয়োগ ও ২ সারিতে (২০ সে:মি: দূরত্বে) বীজ বপন করে।
- বেড-নালার মাধ্যমে সহজে সেচ প্রয়োগ করা যায় ফলে প্লাবন বা ভাসিয়ে সেচের তুলনায় সময়, শ্রমিক ও শতকরা ৪০ ভাগ পানি কম লাগে এবং অর্থ সাশ্রয় হয়।
- ফসল প্রয়োজনীয় আলো-বাতাস পায় যা রোগ-পোকমাকড়ের প্রকোপ কমায়।
স্ট্রিপ/ফালি চাষ পদ্ধতি এবং এর সুবিধা-
- জমিতে শুধুমাত্র সরু লাইনে/ফালিতে চাষ হবে যেখানে একই সময়ে সার প্রয়োগ এবং ৬ সারিতে (২০ সে:মি: দূরত্বে) বীজ বপন করা হয়, তবে এই পদ্ধতিতে চাষের জন্য আগেই জমি আগাছা মুক্ত ক’রে নিতে হয়।
- পূর্ববর্তী ফসলের ২০-৩০ সে:মি: দাড়ানো নাড়া জমিতে রেখে দিতে হবে, এটি মাটির রস সংরক্ষণ।
- করে এবং পঁচে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে, এছাড়া আগাছা দমনে এবং ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- স্ট্রিপ চাষ আগাম বীজ বপনে সাহায্য করে, এবং জালানী ও অর্থ সাশ্রয় করে।
পিটিওএস (পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার) এবং এর সুবিধা-
- পিটিওএস দ্বারা একই সময়ে জমি চাষ, সার প্রয়োগ এবং ৬ সারিতে (২০ সে:মি: দূরত্বে) বীজ বপন করা যায়।
- এটি বীজ ও সার সাশ্রয় করে এবং ছিটিয়ে বীজ বপনের তুলনায় খরচ কম হয়।
কিভাবে আগাছা দমন করবেন?
বীজ বপনের ২১ দিনের মধ্যে এবং ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের পূর্বেই নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
গম চাষে কয়টি সেচ দিবেন?
অধিক ফলনের জন্য গম চাষে সর্বোচ্চ ৩টি সেচ প্রয়োজন হয়-
- ১ম সেচ: চারার ৩ পাতার সময় (বপনের ২১ দিনের মধ্যে) ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের পরপরই।
- ২য় সেচ: শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর)।
- ৩য় সেচ: দানা গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর।
উল্লেখ্য যে, দক্ষিণাঞ্চলের জন্য শুধুমাত্র ১টি সেচ প্রয়োজন হতে পারে যদি পানির অবস্থান ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১.৫ মিটারের মধ্যে থাকে।
প্রতি শতাংশে কি পরিমান গমের ফলন আশা করেন?
প্রতি শতাংশে ২০-২২ কেজি পর্যন্ত ফলন হয় যদি উপযুক্ত পরিবেশে, সময়মত সঠিক জাতের মানসম্পন্ন বীজ বপন ও যথাযথ পরিচর্যা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২৫শে নভেম্বরের পরে বীজ বপন করলে প্রতি ১ দিন দেরির জন্য
প্রতিদিন শতকরা ১.৫ ভাগ ফলন কমে যায়, এবং উত্তরাঞ্চলে ৭ ডিসেম্বরের পরে বীজ বপন করলে প্রতি ১ দিন দেরির জন্য প্রতিদিন শতকরা ০.৮৯ ভাগ ফলন কমে যায়।
(৩) বীজ গম সঠিকভাবে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নিয়ম
আপনি কি গম ও বীজ গম সঠিকভাবে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে চান?
তাহলে সময়মত সংগ্রহ এবং সঠিক পদ্ধতিতে মাড়াই-ঝাড়াই, শুকানো, বাছাই ও সংরক্ষণ করুন।
গম বা বীজ গম কর্তন
- গমের শীষ, পাতা ও গাছ সম্পূর্ণরূপে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে গম কাটার উপযুক্ত সময় হবে।
- পাকা গম বেশি দিন ধরে মাঠে শুকানো উচিত নয়, রৌদ্রোজ্জল দিনে গম কাটতে হবে এবং বৃষ্টিতে ভেজার আগেই মাঠ থেকে সংগ্রহ করা উত্তম।
- গম এবং বীজ গম আলাদাভাবে মাঠ থেকে কেটে আনতে হবে যাতে কোনভাবেই একটির সাথে অন্যটি মিশে না যায়।
- বীজ গম জাত অনুযায়ী আলাদাভাবে মাঠ থেকে সংগ্রহ করতে হবে যাতে এক জাতের সাথে অন্য জাতের মিশ্রণ না ঘটে।
- সাধারণতঃ কাঁচি দ্বারা গম কাটা হয়, তবে শক্তিচালিত যন্ত্র (যেমন – রিপার বা কম্বাইন্ড হারভেষ্টার) দ্বারা অল্প সময়ে বেশি পরিমান গম কাটা যায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়-বৃষ্টি) জনিত ক্ষতি এড়ানো যায়।
গম মাড়াই-ঝাড়াই
- গম এবং বীজ গম আলাদাভাবে মাড়াই-ঝাড়াই করতে হবে যাতে কোনভাবেই একটির সাথে অন্যটি মিশে না যায়।
- বীজ গম জাত অনুযায়ী আলাদাভাবে মাড়াই-ঝাড়াই করতে হবে যাতে এক জাতের সাথে অন্য জাতের মিশ্রণ না ঘটে।
- সকালে সংগ্রহকৃত বীজ গম দুপুরেই মাড়াই করে ফেলা উত্তম।
- পা-চালিত যন্ত্র দ্বারা গম মাড়াই করা যায়, তবে শক্তি চালিত যন্ত্র দ্বারা একইসাথে মাড়াই-ঝাড়াই অথবা কর্তনসহ মাড়াই-ঝাড়াই করা যায়।
গম শুকানো
- কংক্রিটের মেঝেতে অথবা চাটাই বা পলিথিনের উপর গম এবং বীজ গম আলাদা আলাদাভাবে শুকাতে হবে।
- রৌদ্রে ২-৩ দিন এমনভাবে শুকতে হবে যাতে দাঁতের নিচে দিয়ে চাপ দিলে ‘কট’ শব্দ করে ভেঙ্গে যায়, এ অবস্থায় দানায় শতকরা ১২ ভাগ আর্দ্রতা থাকে।
গমের বীজ বাছাইকরণ (গ্রেডিং)
- বীজ গম কুলা দিয়ে ঝেড়ে পুষ্ট বীজ বাছাই করা হয় এবং এসময় সরু ও কুচকানো দানাগুলি বেছে ফেলে দিতে হবে
- এছাড়া চালুনি (১.৫-২.৫ মি:মি: ছিদ্রবিশিষ্ট) দিয়ে চেলে পুষ্ট বীজ বাছাই বা গ্রেডিং করা যায়
- বানিজ্যিকভাবে শক্তি-চালিত যন্ত্র (গ্রেডিং মেশিন) দ্বারা পুষ্ট বীজ বাছাই বা গ্রেডিং করা হয়।
গম সংরক্ষণ পদ্ধতি
- গম বা বীজ গম রৌদ্রে শুকানোর পর ছায়ায় রেখে ভালভাবে ঠান্ডা করে ব্যাগে বা পাত্রে রাখতে হবে, অন্যথায় ব্যাগ বা পাত্রের ভিতর তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বীজ গমের গজানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- ছিদ্রবিহীন ও ঢাকনাযুক্ত পরিস্কার টিন বা প্লাস্টিক ড্রামে গম বা বীজ গম সংরক্ষণ করা যায়। পাত্রে গমের পরিমান কম হলে ফাঁকা জায়গা শুকনো বালি/তুষ/কাঠের গুড়া দিয়ে ভরে ঢাকনা দিয়ে ভালভাবে আটকাতে হবে এবং ঢাকনার চারপাশ কাদামাটি বা পলিথিন দিয়ে বায়ুরোধী করে দিতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ হবে না এবং বীজের আর্দ্রতাও ঠিক থাকবে।
- চটের বস্তার ভিতরে ছিদ্রবিহীন পলিথিন ব্যাগে গম বা বীজ গম ভর্তি করে মুখ ভালভাবে বায়ুরোধী করে বেঁধে সংরক্ষণ করা যায়।
- পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ৫০ কেজি পরিমাণ বীজের ভিতর ২-৪টি ফসটক্সিন বড়ি বা ২-৪টি ন্যাপথলিন বল পাত্রের ভিতর ব্যবহার করা যায়। উল্লেখ্য যে, ফসটক্সিন বা ন্যাপথলিন ব্যবহার করলে ঐবীজ কখনই খাবার গম হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
- সব ধরনের সংরক্ষণ পাত্রই মাচার উপরে এবং ঘরের বেড়া/দেয়াল থেকে দুরে রাখতে হবে, যাতে পাত্রগুলি মাটির সংস্পর্শে না আসে, অন্যথায় বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গিয়ে বীজ নষ্ট হয়ে যাবে।
- সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীজ বর্ষাকালেও রৌদ্রে শুকানোর প্রয়োজন হয় না এবং পরবর্তী রোপন মৌসুম পর্যন্ত ভাল থাকে।
[সূত্র: বিএআরআই]