কৃষিকাজ করার জন্য যেসব ধারণা, পদ্ধতি, যন্ত্র বা জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই হচ্ছে কৃষি প্রযুক্তি।
কৃষির যেমন বিভিন্ন শাখা আছে, তেমনি শাখাভিত্তিক প্রযুক্তিও উদ্ভাবন হচ্ছে। কতকগুলো প্রযুক্তি আছে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আবার কতকগুলো প্রযুক্তি আছে যা দশ বছর আগে ছিল, এখন তার জায়গায় এসেছে নতুন প্রযুক্তি।
লাঙল-জোয়াল প্রাচীন কৃষিযন্ত্র হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার এখনও চলছে। আবার মালা একটি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত হলেও এর জায়গা এখন দখল করেছে আরও উচ্চ ফলনশীল ধানের অন্যান্য জাত। এভাবেই প্রযুক্তি উদ্ভাবন হতে থাকবে এবং ব্যবহার চলবে।
এখানে আমরা কৃষি প্রযুক্তির ধারণা, কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সহজলভ্য কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা, স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ এবং কৃষি প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির অবদান উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।
(১) কৃষি প্রযুক্তির ধারণা
পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা আরও বেশি হারে বাড়ছে। বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি খাবার দরকার। আবার অন্যান্য কৃষিপণ্যেরও বেশি দরকার। এই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য সব সময় মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে আসছে। ফলে যুগে যুগে চাষাবাদের জন্য মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ভাবন করছে নতুন নতুন কৌশল বা প্রযুক্তি।
তা হলে প্রযুক্তি কী? যখন মানুষ কৃষিকাজ শেখেনি তখন তারা পশু-পাখি শিকার করে মাংস খেত। বনজঙ্গল থেকে ফল-মূল কুড়িয়ে খেত। এক সময় তারা দেখল পশু-পাখি শিকার করে ও কুড়ানো ফল, মূলে তাদের ক্ষুধা মেটে না। তারা সমস্যায় পড়ে গেল। হঠাৎ তারা দেখল, মাটিতে বীজ পড়লে চারা বের হয়, গাছ বড় হয়, ফুল ও ফল হয়। আর এই ফল খাওয়া যায়। এভাবে তারা প্রথম প্রযুক্তি হিসেবে কৃষি উদ্ভাবন করল। অর্থাৎ তারা ফসল উৎপাদন শুরু করল। এরপর তারা বনের পশুদেরও পোষ মানিয়ে গৃহে পালনের কৌশল লাভ করল। এতে বোঝা গেল, ফসল উৎপাদন ও পশু পালন কৃষির আদি প্রযুক্তি।
আদি মানুষেরা ফসল উৎপাদন কীভাবে করত? এ জন্য আদি মানুষেরা চোখা কাঠি দিয়ে অল্প জায়গায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি আলগা করে ফসল ফলাত। তখন এই চোখা কাঠিই ছিল জমি চাষের উপযুক্ত প্রযুক্তি। চোখা কাঠির অল্প জমি চাষে যে ফসল ফলে তাতে মানুষের খাবারের চাহিদা পূরণ করতে পারতো না। প্রয়োজন হলো এমন এক প্রযুক্তি, যা দ্বারা অধিক জমি চাষ করা যায়। মানুষ গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল। চিন্তার ফসল হিসাবে উদ্ভাবন হলো কাঠের লাঙল, লোহার লাঙল, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ইত্যাদি।
কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণালদ্ধ জ্ঞান ও কলাকৌশলকে কৃষি প্রযুক্তি বলা হয়।
কৃষি প্রযুক্তির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-
- এর মধ্যে নতুনত্ব থাকবে:
- কৃষিকাজ সহজ করবে;
- অধিক উৎপাদনের নিশ্চয়তা থাকবে।
- খরচ কম কিন্তু লাভ বেশি হবে এবং
- সময় কম লাগবে।
কৃষি এখন শুধু ফসল উৎপাদনের ব্যাপার নয়। শুধু পশু-পাখি পালনও নয়। কয়েকটি উৎপাদন ক্ষেত্র নিয়ে কৃষির বিকাশ ঘটেছে। তেমনি প্রত্যেকটি উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রযুক্তিও বিকাশ লাভ করেছে। ফসল উৎপাদন, পশু-পাখি পালন, মৎস্য চাষ, বনায়ন-এসব বিষয় নিয়েই কৃষি। কৃষির উন্নয়ন অর্থই হচ্ছে এসব বিষয়ের সঠিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সঠিক ব্যবহার।
অতএব নিচের ছকে কৃষির বিষয়ভিত্তিক কলাকৌশল বা প্রযুক্তির পরিচয় দেওয়া হলো-
কৃষি বিষয় | প্রযুক্তি |
ফসল উৎপাদন | বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত, লবণ সহনশীল জাত, গোবর সার, জীবাণু সার, রাসায়নিক সার, সার ব্যবহারের মাত্রা, কীটনাশক, কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা, সাথী ফসল, সবুজ সার, পাওয়ার টিলার, লোলিফট পাম্প, গভীর নলকূপ, সেঁউতি, দোন ইত্যাদি। |
গৃহপালিত প্রাণী পালন | উন্নত জাতের গবাদি পশু, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, গরু মোটাতাজাকরণ, কাঁচা ঘাস সংরক্ষণ, একত্রে হাঁস-মাছ-ধান চাষ, হাঁস-মুরগির সুষম খাদ্য, উন্নত পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন, উন্নত পদ্ধতিতে ডিম সংরক্ষণ, পশু-পাখির রোগ দমন ইত্যাদি। |
মৎস্য চাষ | খাঁচায় মাছ চাষ, মাছ ধরার বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন: পলো, জাল, বড়শি, পুকুরের পানি শোধন, তেলাপিয়া ও নাইলোটিকার চাষ, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি। |
বনায়ন | সামাজিক বনায়ন, কৃষিবনায়ন, বৃক্ষ ও মাঠ ফসল চাষ পদ্ধতি, বনজ ও ফলদ উদ্ভিদ চাষ পদ্ধতি, বৃক্ষ ও গো-খাদ্য চাষ পদ্ধতি, চারা উৎপাদন পদ্ধতি ইত্যাদি। |
(২) কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার
কৃষি প্রযুক্তি কৃষি কার্যক্রমকে অনেক সহজ করেছে। তাই কৃষি এখন লাভজনক পেশা।
বর্তমানে কৃষকেরা দেশি লাঙলের পরিবর্তে কলের লাঙল নিয়ে জমি চাষ করছেন। এতে কৃষকের অর্থ, সময় ও শ্রমের সাশ্রয় হচ্ছে।
খাদ্যঘাটতি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা, উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ করে কৃষকেরা এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন। এছাড়া কৃষির কর্মকাণ্ডের জন্যই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটেছে যেমন: জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জৈব সার, রাসায়নিক সার ও সবুজ সার ব্যবহার করা হচ্ছে।
বীজ বপন, ফসল কাটা, ফসল মাড়াই-ঝাড়াই এর জন্য হস্ত ও শক্তি চালিত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে কৃষকেরা কৃষিকাজ অনেক সহজে করতে পারছেন।
কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক। কৃষির প্রতিটি ক্ষেত্রে আবহমানকাল ধরেই কৃষকেরা কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছেন। দিন দিন কৃষকদের সমস্যা জটিল হচ্ছে আর কৃষি প্রযুক্তিগুলোও আধুনিক হচ্ছে। যেমন: কৃষকেরা জমি চাষে দেশি লাগুল ব্যবহার করেন। কিন্তু ইদানীং বেশিরভাগ কৃষকই দেশি কাঠের লাঙলের পরিবর্তে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন।
নিচে আরও কায়েকটি কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারের উদাহরণ উল্লেখ করা হলো-
ক) বসতবাড়িতে বৃক্ষরোপণ প্রযুক্তি: বসতবাড়ির চারপাশে সবাই বৃক্ষরোপণ করে। কিন্তু বসতবাড়ির কোন স্থানে কোন বৃক্ষটি রোপণ করা দরকার, তা অনেকেই জানেনা। বসতবাড়িতে বৃক্ষরোপণের জন্য কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হয়। এসকল নিয়মাবলি মেনে বসতবাড়িতে বৃক্ষরোপণ করলে বাড়িতে পর্যাপ্ত আলোবাতাস পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে আমরা অন্য কোন পোষ্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি, তাই এখানে আর তা করা হলো না।
খ) শূন্য চাষে ভুট্টা চাষ: জমি চাষ না করেও ভুট্টা চাষ করা যায়। বর্ষার পানি নেমে গেলে জমি কাদাময় থাকে। সেই জমিতে ভুট্টার বীজ রোপণ করলে ভালো ফলন হয়। এতে অর্থ আয় হয় এবং শ্রম কম লাগে।
গ) মাটির হাঁড়িতে ডিম সংরক্ষণ: সাধারণত ডিম ৫-১০ দিনের বেশি ভালো থাকে না। ঘরের মেঝেতে গর্ত করে সেই গর্তে হাঁড়ি বসিয়ে ডিম রাখা হয়। গর্তে হাঁড়ির চারদিকে কাঠ কয়লা রেখে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে ডিম ঠাণ্ডা থাকে এবং ২০-২৫ দিন ডিম ভালো থাকে।
(৩) কৃষি যন্ত্রপাতির ধারণা
কৃষিকাজ একটি কারিগরি কাজ। কৃষির অধিকাংশ কাজই যন্ত্রের সাহায্যে করতে হয়।
কৃষিকাজ একক কোনো কাজ নয়। এটা একটা প্রক্রিয়া, অনেকগুলো কাজের সমাহার। একটা কাজের সাথে আরেকটা কাজের ধারাবাহিকতা আছে। যেমন: জমি চাষ কৃষিকাজের শুরু আর ফসল মাড়াই-ঝাড়াই করে গোলাজাত করা কৃষিকাজের শেষ। জমি চাষ থেকে ফসল গোলাজাত পর্যন্ত সব কাজই যন্ত্রনির্ভর।
কৃষিকাজ সম্পাদন করার জন্য যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা-ই হচ্ছে কৃষি যন্ত্রপাতি।
বাংলাদেশের একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে জমির পরিমাণ কমে আসছে। অল্প জমি থেকে বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য সঠিক যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার দরকার। শুধু ভালো বীজ, সার, পানি বা ঔষধ ব্যবহারই ফসল উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতিরও দরকার।
কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার যত সঠিক হবে, ফসল উৎপাদনও তত ভালো হবে। জমিতে ফসল জন্মাতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুধু এখন নয়, প্রাচীন যুগেও ছিল। তখন কাঠের, হাড়ের বা পাথরের চোখা যন্ত্রের সাহায্যে মাটি খুঁড়ে আগাছা পরিষ্কার করে ফসলের বীজ বপন হতো। এরপর ক্রমান্বয়ে মানুষ ফসল উৎপাদনের কাজে গরু, মহিষ, ঘোড়া ও যান্ত্রিকশক্তি ব্যবহার করতে লাগল। কৃষিকাজ ভেদে এবং ফসল ভেদে যন্ত্রপাতির ব্যবহারও ভিন্ন ভিন্ন।
ফসল উৎপাদনের কৃষিকাজগুলো হলো- জমি চাষ, বীজ বপন, চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, আগাছা দমন, পোকামাকড় ও রোগ দমন, পানিসেচ দেওয়া, ফসল তোলা, মাড়াই-ঝাড়াই করা, শুকানো ও গোলাজাত করা। প্রত্যেকটি কাজের সাথেই যন্ত্রের ব্যবহার আছে।
যেসব যন্ত্র দ্বারা জমি চাষ, বীজ বপন, আগাছা দমন, পোকামাকড় দমন, পানি সেচ দেওয়া, ফসল তোলা, মাড়াই-ঝাড়াই করা হয় সেগুলোই কৃষি যন্ত্রপাতি। কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর কিছু হস্তচালিত, আর কিছু শক্তিচালিত।
(৪) হস্তচালিত উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার
হস্তচালিত কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোকে কালক্রমে উন্নত করা হয়। নিচে হস্তচালিত উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির কয়েকটির ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
ক) বারি লাঙল
পুরো জমি প্রস্তুত করার জন্য দেশি লাওলের চেয়ে অর্ধেক সময়ের প্রয়োজন হয় এবং প্রথম চাষে কোনো জমি চাষ ছাড়া থাকে না।
এর সুবিধা-
- বারি লাঙল মাটি কেটে উল্টে দেয়;
- চাষের গভীরতা ও প্রশস্ততা দেশি লাঙলের চেয়ে বেশি
- শুকনা ও ভেজা উভয় প্রকার জমি চাষ করা যায়।
খ) মোল্ড বোর্ড লাঙল
মোল্ড বোর্ড লাঙল দেশি লাঙলের চেয়ে অধিকতর কার্যকর।
এর সুবিধা-
- এই লাঙলের সকল অংশই লোহার তৈরি;
- এই লাঙল জমির মাটিকে আয়তাকার টুকরা করে চাষ করে এবং উল্টে দেয়।
গ) বারি বীজ বপন যন্ত্র
এটি একটি হাতে চাপিত বীজ বপন যন্ত্র।
এর সুবিধা-
- বীজ ঠিক দূরত্বে ও গভীরতায় বপন করা যায়;
- এর দ্বারা বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়; এবং
- বীজের পরিমাণ কম লাগে।
ঘ) ঔষধ ছিটানো যন্ত্র: ন্যাপস্যাক স্পেয়ার
স্প্রেয়ার ফসলের রোগ ও পোকা দমনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে পানি মিশ্রিত ঔষধ ভর্তি করে ট্রিগারের সাহায্যে নির্দিষ্ট উচ্চতার ছিটানো হয়।
স্প্রেয়ারের প্রধান প্রধান অংশ হচ্ছে-
- নজল;
- ট্রিগার;
- পাম্প করার বাল্ব;
- ব্যারেল; এবং
- ঔষধ ছিটানোর প্যাডেল প্রেসার।
ঙ) প্যাডেল প্রেসার
এটি একটি উন্নত হস্তচালিত ধান বা গম মাড়াই যন্ত্র। এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে টাইনযুক্ত একটি ড্রাম, ড্রামের সাথে যুক্ত একটি প্যাডেল। প্যাডেলের সাহায্যে ড্রামটিতে ঘূর্ণন সৃষ্টি করা হয় এবং যাতে ফসলের শীর্ষ রাখলে টাইনের আঘাতে শস্য মাড়াই হয়। এটি ধান বা গম মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি করা হয়।
চ) বারি পাম্প
বারি পাম্প একটি লোলিফট পাম্প। স্থানীয়ভাবে তৈরি করা যায়। এটি একটি আধুনিক সেচ প্রযুক্তি।
এর সুবিধা-
- অনেক বেশি পানি উঠানো যায়,
- এটা নিয়ে মাটির নিচ এবং উপর থেকে পানি উঠানো যায়।
(৫) শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার
কৃষিকাজকে আরও সহজ করার জন্য শক্তিচালিত নানান কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি যন্ত্রপাতির ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
ক) পাওয়ার টিলার
এর উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ঘূর্ণি লাগুল। চাষের সময় লাভলটি প্রচণ্ড গতিতে ঘোরে। আর তাতে গভীরভাবে জমি চাষ হয়। এতে মাটি ঝুরঝুরে হয় ও আগাছা ধ্বংস হয়। ঘূর্ণি লাঙল চালাতে সুবিধা হলো, এর সাথে চাকতি বা ফালি লাঙল ও রোটারি লাঙল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। পাওয়ার টিলার যারা দ্রুত ও গভীরভাবে জমি চাষ করা হয়।
খ) বারি শস্য ঝাড়াই যন্ত্র
স্থানীয়ভাবে এটি তৈরি করা যায়।
বারি শস্য ঝাড়াই যন্ত্র ব্যবহারে নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো পাওয়া যায়-
- ঘরের ভিতর খারাপ আবহাওয়ার ব্যবহার করা যায়;
- অল্প সময়ে ও অল্প খরচে ঝাড়াই ও পরিষ্কার করা যায়।
- এটা চালানো সহজ।
গ) সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প
এটি শক্তিচালিত সেচযন্ত্র। এর সাহায্যে লোলিফট পাম্প, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপ চালানো হয়। লেলিফট পাম্প দ্বারা নদী বা খাল-বিল হতে আর অগভীর বা গভীর নলকূপ দ্বারা মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে ফসলের মাঠে সেচ দেওয়া হয়।
সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের সুবিধা-
- সহজে পানি তুলে সেচ দেওয়া যায়;
- অশ্বশক্তির মাত্রার পানি উঠে;
- প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো যায়।
ঘ) বারি শস্য মাড়াই যন্ত্র
বারি শস্য মাড়াই যন্ত্র একটি আধুনিক মাড়াই প্রযুক্তি। এর দ্বারা বিভিন্ন রকমের ফসল মাড়াই করা যায়। এর ক্ষমতা প্যাডেল প্রেসারের চেয়ে বেশি।
এর সুবিধা-
- বারি শস্য মাড়াই যন্ত্র দিয়ে ধান, গম ও ডাল মাড়াই করা যায় ;
- কম আর্দ্রতার ফসল হলে যন্ত্রটি ভালো কাজ করে।
(৬) ফসল উৎপাদনের স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার
স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি সবার কাছেই পরিচিত। প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতেই এই স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো দেখা যায়।
স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে জমি চাষের যন্ত্রপাতি যেমন: দেশি লাঙল, জোয়াল, মই ও কোদাল প্রধান।
পশুপালন যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে মুরগির খাবার পাত্র ও পানির পাত্র প্রধান। আবার মাছ ধরার যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে পলো, বড়শি ও জাল প্রধান।
ফসল উৎপাদনের জন্য স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও কোদাল প্রধান। নিচে এগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো।
ক) লাঙল
লাঙল দেশি লাঙল হিসাবেই অধিক পরিচিত। একটি কাঠকে বাঁকা করে কাঠের আগায় লোহার একটি ফলক বা ফাল লাগানো হয়। এই ফলকের সাহায্যেই লাঙল মাটি চিরে জমি চষে। লাঙলের উপরের অংশকে বলা হয় হাতল। এই হাতল চেপে ধরেই কৃষকেরা জমিতে লাঙল চালনা করেন।
লাঙলের মধ্যস্থানে একটি ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্রপথে প্রায় ৮ ফুট লম্বা একটি কাঠ যুক্ত করা হয়, যার আগায় ৪-৫টি দাঁত বা খাঁজ কাটা থাকে। এটাকে ঈশ বলা হয়। ঈদের খাঁজে রশি বেঁধে জোয়াদের সাথে লাঙল লাগানো হয়। ঈশ যাতে লাঙলের সাথে ভালোভাবে আবদ্ধ থাকে সেজন্য ছোট কাঠের একটি খিল ব্যবহার করা হয়।
লাঙল ব্যবহারের সুবিধা-
- লাঙল সহজলভ্য
- লাঙল তৈরি করা ও পরিচালনা সহজ,
- লাঙল ওজনে হালকা বলে বহন করা সহজ।
খ) জোয়াল
জোয়াল হালের গরুর কাঁধে স্থাপন করে লাঙলের সাথে যুক্ত করা হয়। জোয়ালের দুই প্রান্তে দুটি ছিদ্র করা হয়। ছিদ্রপথে ছিদ্রের মাপ অনুযায়ী দুটি শক্ত কাঠি লাগানো হয়। জোয়াল গরুর কাঁধে রেখে কাঠি দুটির সাথে রশি বেঁধে লাঙলের সাথে জোড়া হয়।
জোয়ানের সুবিধা-
- বাঁশ বা কাঠ দিয়ে জোয়াল তৈরি করা যায়:
- জোয়াল তৈরি করা সহজ:
- ওজনে হালকা।
গ) মই
মই প্ৰধানত বাঁশ বা কাঠ দ্বারা তৈরি করা হয়। মোটা একটি বাঁশকে লম্বালম্বি ফালি করে দুই ভাগ করা হয়। অনেক মইয়ে তিনটি ফালি ব্যবহার করা হয়। এক জোড়া গরু হলে লম্বা হবে ৫ ফুট এবং দুই জোড়া গরু হলে লম্বা হবে সাড়ে সাত ফুট।
মইয়ের কাজ হলো-
- মাটির ঢেলা ভাঙা
- মাটি সমতল করা
- আগাছা দমন ও আলাদা করা
- বীজের অঙ্কুরোদগম সহজ করা।
ঘ) কোদাল
কোদাল কৃষিকাজের একটি অতিপরিচিত যন্ত্র। জমির কোনা বা আইল ঘেঁষা ভূমি যেখানে লাঙলের ফলা স্পর্শ করে না তা কোদাল দিয়ে চাষ করা হয়। এছাড়া ছোট ছোট প্লটে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে সবজি চাষ করা হয়। কোদাল যারা গর্ত করে ফলের চারা লাগানো হয়। কোদাল লোহার পাত যারা তৈরি। লোহার পাত মুখের দিকে ২০ সেমি গ্রন্থ হয় এবং ২৮ সেমি লম্বা হয়। প্রায় তিন ফুট লম্বা কাঠের হাতল লাগানো হয়।
কোদালের সুবিধা-
- স্থানীয়ভাবে কামারশালার তৈরি করা যায়।
- মাটি আলগা করা, ঢেলা ভাঙ্গা ও আগাছা দমনেও কোদাল ব্যবহার করা যায়।
ঙ) আঁচড়া বা বিদা
আঁচড়া বা বিদা কাঠ ও বাঁশ বা লোহার খিল দিয়ে তৈরি করা হয়। আঁচড়ার ১.৫ মি. লম্বা একটি দণ্ড থাকে। এই দণ্ডে ১০ সেমি পরপর ছিদ্র থাকে। ছিদ্রপথে বাঁশের বা লোহার খিল লাগানো হয়। এতে হাতল ও ঈশ লাগানো হয়।
আঁচড়ার প্রধান কাজ হলো-
- ফসল পাতলা করা।
- আগাছা দমন করা।
- মাটি আলগা করা।
চ) নিড়ানি
ফসলের জমি হতে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি আলগা করার কাজে নিড়ানি ব্যবহার করা হয়। এর আগার দিক অর্ধ-চন্দ্র আকৃতির লোহার পাত দিয়ে তৈরি করা হয়। আর গোড়ার দিকে সরু হয় এবং কাঠের বাঁট লাগানো হয়।
(৭) মাছ ধরার স্থানীয় যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার
স্থানীয়ভাবে মাছ ধরার অনেক যন্ত্রপাতি আছে। তন্মধ্যে জাল, পলো ও বড়শি প্রধান। প্রায় কৃষকের ঘরেই বিভিন্ন রকম জান, পলো, বড়শি দেখতে পাওয়া যায়।
ক) জাল
জাল এদেশের প্রাচীন মাছ ধরার কৌশল। জাল সুতা দ্বারা তৈরি করা হয়। পুকুর, ডোবা, নদী- নালা, খাল-বিল, এমনকি সমুদ্র থেকেও জাল দ্বারা মাছ ধরা হয়। পানিতে জাল পাতলে বা জাল ফেললে জালের ফাঁসে মাছ আটকা পড়ে। কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করেন। যেমন: ঝাকি জাল, ঠেলা জাল এবং খরা জাল।
i) ঝাঁকি জাল
ঝাঁকি জালের উপরের প্রান্তে সরু রশি বাঁধা থাকে। জালের নিচের দিকে লোহার ছোট ছোট কাঠি যুক্ত করা হয়, যাতে পানিতে জাল ফেললে তাড়াতাড়ি ডুবে যেতে পারে। মাছ ধরার সময় খাল, পুকুর বা নদীর তীর থেকে রশিটি হাতে রেখে জাল পানিতে ছুড়ে মারা হয়। পরে রশি ধরে টেনে আল তোলা হয়। জালের নিচে অনেক ধরনের মাছ আটকা পড়ে। পুঁটি, চিংড়ি, কার্প ও নলা মাছ বেশি ধরা পড়ে।
ii) ঠেলা জাল
ঠেলা জাল তিন কোনা। এটাকে তিন কোনা বাঁশের ফ্রেমে আটকানো হয়। ঠেলা জাল দিয়ে সাধারণত ছোট ছোট মাছ ধরা হয়। ঠেলা জালের হাতল ধরে পানিতে নেমে সামনের দিকে নিলে এই জালে পুঁটি, খলিসা, চিংড়ি, বেলে ইত্যাদি মাছ ধরা পড়ে।
iii) খরা জাল
এটি একটি ত্রিভুজাকৃতির ছাল বা বাঁশের মাচা বা টং থেকে চালানো হয়। জাল ইংরেজী “V” আকৃতির বাঁশের কাঠামোর মাঝখানে বাঁধা থাকে। জালটি নদী বা বিলে মাছের চলাচলের পথে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর জালের পিছনের দিকে বাঁশের গোড়ায় চাপ দিলে জল উপরে উঠে আসে। এর পর জালে আটকা পড়া মাছ সংগ্রহ করা হয়।
খ) পলো
পলো মাছ ধরার একটি প্রাচীন পদ্ধতি। এটি বাঁশের শলাকা ও বেত দিয়ে তৈরি। এর নিচের দিকের মুখ গোলাকার ও বড় এবং উপরের দিকের মুখও গোলাকার কিন্তু ছোট। দুই মুখই খোলা থাকে। পলো উপরের দিকে হাত দিয়ে ধরে অগভীর পানিতে চাপ নিতে হয়। মাছ পলোতে আটকা পড়লে পলোর ভিতরে ছুটাছুটি করতে থাকে। অতঃপর উপরের মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পলোর ভিতর থেকে মাছ ধরা হয়। শোল, গজার ইত্যাদি বড় মাছ পলোতে ধরা পড়ে।
গ) বড়শি
বড়শি লোহার তৈরি। বড়শির জন্য প্রায় ২০০ সেমি লম্বা একটি ছিল দরকার পড়ে। হাটে-বাজারে এমনকি শহরেও মাছ ধরার জন্য বিশেষ ধরনের ছিপ পাওয়া যায়। ছিপের আগায় সুতার এক প্রান্ত বেঁধে অপর প্রান্ত বড়শির সাথে বাঁধা হয়।
বড়শিতে বিভিন্ন ধরনের টোপ লাগিয়ে পানিতে ফেলা হয়। মাছ টোপ দেখে খাওয়ার সময় বড়শিতে আটকা পড়ে। তারপর সুতাটি টেনে বড়শি থেকে মাছ সংগ্ৰহ করা হয়। বড়শি অনেক প্রকারের। ছোট পুঁটি মাছ থেকে শুরু করে বৃহৎ বোয়াল মাছও বড়শিতে আটকা পড়ে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।