প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, তো চলুন আমরা ধান চাষ পদ্ধতি, কিভাবে ধানের পরিচর্যা করতে হয়, ধানের জাত, ধানের বৈশিষ্ট্য, ধানের উপকারিতা ইত্যাদিসহ আরও ধান সম্পর্কিত আনুষাঙ্গিক বিষয় সমূহ বিন্তারিতভাবে জেনে নিই।
(১) ধানের বৈশিষ্ট্য
ধান একটি আংশিক জলজ উদ্ভিদ। যেখানে জলাভূমি বা পানির আধিক্য বেশি সেখানে ধানের বিস্তৃতি বেশি। বাংলাদেশের সর্বত্র নদী-নালা, বিল-হাওর-বাঁওড় ছড়িয়ে রয়েছে, যাতে রয়েছে প্রচুর পানি। বছরের অর্ধেক সময় এদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং এ সময় উজান দেশ থেকে নেমে আসে অঢেল বন্যার পানি। বছরের বাকি অর্ধেক সময় অর্থাৎ খরা মৌসুমে ভূ-উপরিস্থিত বা ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সহজেই ক্ষেতে সেচ দেওয়া যায়। পানির এ সহজলভ্যতার কারণে এদেশে সর্বত্র বিস্তৃত রয়েছে ধানের আবাদ। ধান এদেশের প্রধান ফসল।
ধানের Family হলো- Poaceae, Subfamily হলো Oryzoideae এবং Genus হলো Oryza Oryza এর দুইটা Species চাষ করা হয়। একটি Oryza sativa অন্যটি O glaberrima। শেষোক্ত Speciesটি কেবল আফ্রিকা অঞ্চলে চাষাবাদ করা হয়। Oryza sativa এর তিনটি Geographical race রয়েছে। Japonica, Javanica এবং Indica। ইন্ডিকা ধান এ উপমহাদেশ তথা আমাদের দেশে চাষাবাদ হয়ে থাকে।
ধান গাছের জীবনচক্র তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়, যথা-
- দৈহিক বর্ধনশীল পর্যায়: বীজ অঙ্কুরোদগমন স্তর থেকে কাইচথোড় বের হওয়া পর্যন্ত সময়। কাণ্ডের সর্বশেষ গিঁটের উপর ডিগ পাতার গোলের ভিতর যখন ঘোড়ের সৃষ্টি হয় এবং ঘোড় খুব ছোট থাকে তখন তাকে কাইচথোড় বলে।
- প্রজনন পর্যায়: কাইচথোড় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়কে প্রজনন পর্যায় বলে।
- পরিপক্ক পর্যায়: ফুল ফোটার পর থেকে পরিপূর্ণ ধান পাকা অবস্থা পর্যন্ত সময়কে পরিপক্ক পর্যায় বলে।
অধিকাংশ ধান জাতের জীবনকাল ৩-৬ মাসের মধ্যে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে অল্প কিছু ধান আছে যার জীবনকাল এর চেয়ে কম বা বেশি হতে দেখা যায়।
ধান গাছ একটি খাড়া, গোলাকার ফাঁপা কাণ্ডবিশিষ্ট, লম্বা, সরু ও চ্যাপটা মসৃণ কুশি উৎপাদনকারী ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। ধান গাছের বর্ধনশীল অংশ শিকড়, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত। পুষ্পের অংশে রয়েছে শিষ ও লানা। ধানের ফুল ময়ূরিকে স্পাইকলেট বলে। এটি দুইটি পুষ্প মঞ্জুরিপত্র দিয়ে ঢাকা থাকে, যাকে তুষ বলে। ধানের দানায় তুষের নিচে লালচে রঙের একটি পাতলা আবরণ থাকে, যাকে কুঁড়া বলে। পরিপক্ক ধানের তুষ এবং কুঁড়ার অভ্যন্তরে শর্করা দিয়ে তৈরি বড় অংশটিকে এন্ডোসপার্স বলে, যা মূলত চাল।
(২) ধান চাষে আবহাওয়ার ভূমিকা
- বাংলাদেশের আবহাওয়া উচ্চ বৃষ্টিপাত ও উচ্চ তাপমাত্রাসমৃদ্ধ। এ ছাড়াও সূর্যের আলো ও দিবা দৈর্ঘ্য এখানে বছরব্যাপী পরিবর্তনশীল। বাংলাদেশে জুন থেকে অক্টোবর মাসে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয় এবং এ সময় এদেশের ৮০% বৃষ্টিপাত শেষ হয়ে যায়। বৃষ্টি ধানের চারা গজানো বা চারা রোপণকে এবং সেই সাথে জীবনকালকে প্রভাবিত করে।
- বাংলাদেশে মৌসুমভেদে উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে। সাধারণভাবে ২০° সে. থেকে ৩৫°সে. তাপমাত্রা ধানের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়ে কোনো ক্ষতি করে না। তবে এর চেয়ে নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রা আমাদের দেশে বিরাজ করে। তাই আউশ, আমন ও বোরো ধান সঠিক সময় আবাদ করলে ঐ সকল নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রা ধানের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায় যেমন- অঙ্কুরোদগম, চারা উৎপন্ন হওয়া, কুশি হওয়া, ছড়া উৎপন্ন হওয়া, পরাগায়ন হওয়া, ধান পাকা ইত্যাদি পর্যায়কে ব্যাহত করতে পারে না।
- সূর্যালোক ধানের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই মেঘমুক্ত আকাশ থাকায় বোরো মৌসুমে ফলন বাড়ে, অন্যদিকে আকাশে মেঘ থাকায় আমন মৌসুমে ফলন কমে। কারণ সূর্যালোক সালোক সংশ্লেষণে সহায়তা করে।
(৩) ধানের জাত
উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বা আধুনিক জাতের আবিষ্কারের পূর্বে আবহমান কাল ধরে এদেশে যে সকল ধানের জাত আবাদ করা হতো তাদের বলা হয় দেশি বা স্থানীয় জাত। এ সময় বর্তমান বাংলাদেশে ১০,০০০ এর চেয়ে বেশি স্থানীয় জাত আবাদ করা হতো বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ধানের জিনের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে বা প্রাকৃতিকভাবে পরপরাগায়ন হয়ে এবং পরে কৃষক কর্তৃক বাছাই হয়ে হাজার হাজার স্থানীয় জাত তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় ধানের জাতের বৈশিষ্ট্য হলো- এ জাতগুলো লম্বা হয়, পাতা সরু হয়, পাতা হেলে পড়ে, পাতা চিকন হয় এবং এতে কুশি কম হয়। এর কাণ্ড দুর্বল এবং গাছ বড় হয়ে নুইয়ে পড়ে। স্থানীয় জাতের ফলন কম।
কৃত্রিম সংকরায়ণের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ সকল জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ সকল জাতের বৈশিষ্ট্য হলো এরা খর্বাকৃতির, এদের পাতা চওড়া এবং খাড়া, এদের কুশি বেশি, ধান পাকলেও গাছ অনেকটা সবুজ থাকে এবং পাতা এবং এর কাণ্ড নুইয়ে পড়ে না। এদের ফলন বেশি। উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত আবার দুই ধরনের হতে পারে। একটিকে বলা হয় ইনব্রিড, অন্যটিকে বলা হয় হাইব্রিড।
ক) ইনব্রিড ধান
দুইটি জাতের ধানের ফুলের মধ্যে একটির পুংকেশর এবং অন্যটির গর্ভকেশরের মধ্যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরাগায়ন করে কৃত্রিম সংকরায়ণের মাধ্যমে যে গাছ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় F বংশধর।
F1 সংকেতটি First filiam generation বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে প্রথম প্রজন্ম। এই F1 গাছ সর্বদা একরকম থাকে। কিন্তু এই F1 গাছ থেকে যখন পরবর্তী বংশধরের গাছ লাগানো হয় তখন সকল গাছের বৈশিষ্ট্য এক থাকে না। এ সকল গাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত গাছ বাছাই করা হয়। এই প্রক্রিয়া F6 বংশধর পর্যন্ত চললে যে গাছ পাওয়া যায় তা থেকে প্রাপ্ত গাছ সব সময় একই বৈশিষ্ট্যের হয়। এই একই এবং উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যওয়ালা গাছকে জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। যাকে ইনব্রিড জাত বলে। ইনব্রিড জাতের বীজ থেকে ঐ একই ইনব্রিড জাত পাওয়া যায়। ইনব্রিড জাত অবমুক্ত করতে সাধারণত ১৩/১৪ বছর সময় লাগে। এখানে উল্লেখ্য, সকল স্থানীয় জাতও ইনব্রিড জাত।
খ) হাইব্রিড
কৃত্রিম সংকরায়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত F বংশধরের গাছকে যখন জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয় তখন তাকে হাইব্রিড জাত বলে।
হাইব্রিডের জাত সাধারণত ইনব্রিডের চেয়ে ফলন বেশি দেয়। হাইব্রিড ধানের জাত থেকে বীজ রেখে তা পরবর্তী বংশ ব্যবহার করলে আগের প্রজন্মের মতো একই বৈশিষ্ট্যের গাছ পাওয়া যায় না এবং এতে ফলন অত্যন্ত কমে যায়। তাই হাইব্রিড ধানের বীজ কৃষক পর্যায়ে রাখা যায় না। প্রতিবার হাইব্রিড কোম্পানি থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয়।
আধুনিককালে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে Transgenic rice বা Genetically modified ধানের জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। কোনো একটি ভালো ধানের জাতে দূরবর্তী কোনো প্রজাতি যথা অন্য কোনো গাছ বা প্রাণী থেকে যখন কোনো জিন এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তখন যে ধানের জাত তৈরি হয় তাকে ট্রান্সজেনিক বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড ধানের জাত বলে। IRRI তে উদ্ভাবিত Golden rice এ ধরনের ধানের জাত। এ জাতে ভিটামিন এ এর জিন ঢোকানো হয়েছে। এ জিন ধানে পাওয়া যায় না। এ জিন ঢোকানোর ফলে ধান গাছে ভিটামিন এ উৎপন্ন হতে পারছে।
গ) বিভিন্ন পরিবেশ উপযোগী ধানের জাত
অধিক ফলনের জন্য- উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত মৌসুম ও নির্দিষ্ট পরিবেশ উপযোগী করে উদ্ভাবন করা হয়। বৃহত্তর পরিবেশের উপযুক্ত ধানের জাত দেশের ধানের ফলন বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রাখে এবং এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে খাদ্য ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করে। এ সকল জাতের মধ্যে আউশ মৌসুমের ধান ব্রি ধান ৪৮, আমন মৌসুমের ধান বিআর ১১, বোরো মৌসুমের ধান ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান ২৯ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে আবাদযোগ্য অনেক উফশী ধানের জাত রয়েছে।
খরাপ্রবণ এলাকায়- রোপা আমন মৌসুমে শেষের দিকে ধানে প্রান্তিক ধরা পড়ে। এ সকল খরা থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময় সম্পূরক সেচ দেওয়া দরকার হয়। এই সকল পরিবেশের জন্য খরাসহিষ্ণু জাত হলো ব্রি ধান ৫৫।
লবণাক্ত অঞ্চলে- লবণাক্ত সহিষ্ণু ধানের জাত ব্যবহার করতে হয়। এ সকল অঞ্চলে সেচের পানিতেও লবণাক্ততা থাকে বলে সেচ দেওয়া যায় না। লবণাক্ত অঞ্চলের জন্য রোপা আমন মৌসুমের উফশী জাত হলো ব্রি ধান ৪০, ব্রি ধান৪১। এ ছাড়াও বোরো মৌসুমের জন্য উপযুক্ত জাত হলো ব্রি ধান ৪৭।
প্রচুর বৃষ্টি বন্যা অঞ্চলে- প্রচুর বৃষ্টির কারণে বা হঠাৎ বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক অঞ্চলের রোপা আমন ধান ১ থেকে ২ সপ্তাহ সময় পানিতে তলিয়ে গিয়ে মারা যেতে পারে। ডুবে গিয়েও এসব অঞ্চলে যেসব জাত মোটামুটি ভালো ফলন দেয় তা হলো ব্রি ধান ৫১, ব্রি ধান৫২।
নাবিতে রোপা আমন রোপণে- নাবিতে রোপা আমন রোপণ করলে অনেক দীর্ঘ জীবনকালের ধানে আগাম ঠাণ্ডার কারণে ধান চিটা হয়। এসব অঞ্চলের জন্য তীব্র আলোক সংবেদনশীল জাত বিআর ২২, বিআর ২৩ বা ব্রি ধান ৪৬ ব্যবহার করা যায়।
জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জন্য- লম্বা ও শক্ত কাণ্ডবিশিষ্ট ধানের জাত প্রয়োজন হয়। এ পরিবেশের জন্য উপযুক্ত উফশী জাত হলো ব্রি ধান৪৪ যা রোপা আমন মৌসুমে চাষ করা হয়।
সুগন্ধি ধান- আমাদের দেশের সুগন্ধি ধানের জাতের অনেকগুলোই স্থানীয় জাত যাদের ফলন কম। উফশী সুগন্ধি জাতের মধ্যে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৮ উল্লেখযোগ্য।
অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ- এছাড়াও পুষ্টিসমৃদ্ধ ধানের জাত রয়েছে যাতে কোনো নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে। যেমন-জিংকসমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২।
(৪) ধান চাষ পদ্ধতি
ধান চাষাবাদের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে সরাসরি বীজ বপন এবং চারা রোপণ দুইটি মূল পদ্ধতি।
সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে জমি তৈরি করে তাতে বীজ সরাসরি বপন করা হয়। বীজ সারিতে বপন করা যায় বা ছিটিয়ে দেওয়া যায়। জমি তৈরির ক্ষেত্রে জমি শুকনা অবস্থায় তৈরি করে জমিতে জো থাকা অবস্থায় বীজ বপন করা যায় অথবা জমি কাদা করে তৈরি করে তাতে বীজ বপন করা যায়।
ধান চাষের অন্য পদ্ধতি হলো চারা রোপণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বীজতলায় প্রথমে চারা উৎপাদন করা হয়। সেই চারা তুলে এনে কাদা করে জমি তৈরি করে চারা রোপণ করা হয়। রোপণ সাধারণত সারিতে করা হয়। জমি কাদা করে তৈরি করতে সেচ ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়। বোরো মৌসুমে সেচ এবং আমন মৌসুমে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়। আউশের চারা রোপণে সাধারণত সেচের পানি, তবে অনেক স্থানে বৃষ্টির পানিও ব্যবহার করা হয়।
ক) মৌসুম
ধান চাষের তিনটি মৌসুমের কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি মৌসুমে সঠিক সময়ে ধান আবাদ শুরু করলে অযাচিত উচ্চ বা নিম্ন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের তারতম্য, বন্যা, বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তবে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ, শস্য বিন্যাস ইত্যাদি কারণে মৌসুমের মধ্যে ধানের আবাদ আগাম বা দেরি হতে পারে, যেমন- দেরিতে বৃষ্টিপাত হলে রোপা আউশ বা রোপা আমনের বীজতলা বা চারা রোপণ দেরি হতে পারে। যে পরিবেশে অল্প বন্যা হয় সেখানে বন্যার পানি নামার পর রোপা আমন নাবিতে আবাদ করা হয়।
একই জমিতে বছরে পর্যায়ক্রমে যে যে শস্য আবাদ করা হয় তাকে শস্যক্রম বলে। দেশের উত্তরাঞ্চলে অনেক শস্যক্রমে রবি মৌসুমে আলু চাষ করে বোরো ধান আবাদ করা হয়। এতে বোরো চাষ বিলম্বিত হয়।
খ) বীজ বাছাই
বপনের জন্য ভালো ও পুষ্ট বীজ ব্যবহার করা জরুরি। ভালো বীজ হতে সুস্থ-সবল চারা উৎপন্ন হয়। এ জন্য বপনের পূর্বে ভালো বীজ ব্যবহার হচ্ছে কিনা জানা দরকার। অন্যদিকে রোগাক্রান্ত অপুষ্ট বীজ ব্যবহার করলে পরে অসুস্থ ও দুর্বল চারা উৎপন্ন হয়, ফলে ধান গাছ রোগাক্রান্ত হয়।
- বীজ বাছাইয়ের জন্য দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশানো হয়।
- এবার ১০ কেজি বীজ পানিতে ছেড়ে হাত নিয়ে নেড়েচেড়ে দেওয়া হয়।
- পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট, হালকা বীজ ভেসে উঠবে।
- হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলে ভারী ভালো বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যায়।
গ) বীজ তলা তৈরি
- দোআঁশ ও এঁটেল মাটি বীজতলার জন্য ভালো। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন।
- জমিতে ৫-৬ সে.মি. পানি দিয়ে দুইতিনটি চাষ ও মই নিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে এবং পানি ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে।
- আগাছা, খড় ইত্যাদি পড়ে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে।
- এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর এক মিটার চওড়া বেত তৈরি করতে হবে। দুইবেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে।
- নির্ধারিত জমির দুইপাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করা যায়। এরপর বেডের উপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপটা লাঠি নিয়ে সমান করতে হবে।
- বেড তৈরির ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।
- বীজতলা তৈরির জন্য দুইবেডের মাঝে যে নালা তৈরি হয় তা খুবই প্রয়োজন। এ নালা যেমন- সেচের কাজে লাগে তেমনি পানি নিষ্কাশন বা প্রয়োজনে সার/ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োগ করা সহজ হয়।
ঘ) বীজ বপন
বীজ বপন চাষাবাদ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে।
সরাসরি বীজ বপনের ক্ষেত্রে-
- তৈরি জমিতে অঙ্কুরিত বা অ-অঙ্কুরিত বীজ সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করা হয়।
- শুকনা চাষে বীজ সাধারণত অ-অঙ্কুরিত থাকে এবং বীজ ছিটানোর পর তা মই দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
- সরাসরি বপনের ক্ষেত্রে বেশি বীজ লাগে। এক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৫০-৭০ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়।
চারা রোপণের ক্ষেত্রে-
- বীজতলা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলা হয়। বিভিন্ন ধরনের বীজতলা হতে পারে। তবে দেশে সাধারণত ভেজা বীজতলা তৈরি করা হয়। এতে সাধারণত জমি কাদাময় করে তৈরি করে অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
- বীজের হার চাষাবাদ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। এছাড়াও মৌসুম, বপন-রোপণের সময় অর্থাৎ আগাম না নাবি, বীজের ওজন ইত্যাদির উপর বীজের হার নির্ভর করে।
- চারা রোপণের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ২০-৩০ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়। বীজতলায় ৮০-১০০টি ধান প্রতি মিটারে ফেলা হয়।
ঙ) জমি প্রস্তুতকরণ
- সরাসরি বীজ বপনের জন্য জমি ৩-৫ বার মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে তৈরি করা হয়। এভাবে চাষ ও মই দিলে মাটি ঝুরঝুরে হয় এবং ক্ষেতে থাকা আগাছা বাছাই করে নেওয়া যায়।
- চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে তৈরি করা হয়। মাটির প্রকারভেদে জমিতে প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে
- ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে থকথকে করে কাদাময় জমি তৈরি করা হয়। চাষের মাঝে কিছুদিন জমি ফেলে রাখলে আগাছা পচে জমি আগাছামুক্ত হয়।
- শুকনো বা কাদাময় জমি তৈরির সময় জমি যাতে সমতল হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়।
- শেষ চাষ বা মই-এর সময় জমিতে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়।
চ) চারা রোপণ
- সাধারণভাবে আউশে ২০-২৫, বোনা আমনে ২৫-৩০ এবং বোরোতে ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করা হয়।
- রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি রাখা দরকার।
- প্রতি গুছিতে একটি করে সতেজ চারা রোপণ করলেই চলে। গুছিতে একটি চারা রোপণ করলে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। তবে গুছিতে ২-৩টি চারাও রোপণ করা যায়। এতে সে অনুপাতে বীজের হার বেড়ে যাবে।
- মাটির ২-৩ সে.মি. গভীরে চারা রোপণ করা প্রয়োজন। বেশি গভীরে চারা রোপণ করলে এর বাড়-বাড়তি এবং কুশির সংখ্যা কিছুটা কমে যায়।
- চারা সারিতে রোপণ করা উচিত। সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি. এবং প্রতি সারিতে গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি. হতে পারে।
(৫) কিভাবে ধানের পরিচর্যা করতে হয়?
ক) সার ব্যবস্থাপনা
উফশী ধান থেকে ভালো ফলন পেতে হলে মাটিতে সার প্রয়োগ করা অতি আবশ্যক। উফশী ধান ভালো ফলন পাওয়ার জন্য মাটিতে যে পরিমাণ খাদ্য উপাদান থাকা দরকার তা থাকে না বিধায় সার প্রয়োগ করা জরুরি। এছাড়া কিছু কিছু মাটিতে দুই-একটি খাদ্য উপাদানের ঘাটতি থাকলে ঐ খাদ্য উপাদানও সার হিসেবে প্রয়োগ করা দরকার।
খ) সারের নাম ও পরিমাণ
আমাদের দেশে ধান চাষের জন্য পাঁচটি সারের প্রয়োজন হয়। এ পাঁচটি সারের মূল উপাদান হলো নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার বা গন্ধক ও জিংক বা দস্তা। এ সকল খাদ্য উপাদানওয়ালা সার বাজারে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সার নামে পাওয়া যায়।
সার প্রয়োগের জন্য বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে মাটির উর্বরতা, ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন, আবহাওয়া, জাত, শস্যক্রম, জীবনকাল, চাষাবাদ পদ্ধতি ইত্যাদি। এ সব বিষয় বিবেচনা করে সারের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
উল্লিখিত বিষয় বিবেচনা করে এ সকল সারের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। অনেক বিষয়ের উপর সারের মাত্রা নির্ভর করে বলে ধান চাষে কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা উল্লেখ করা যায় না।
তবে উফশী ধানে গড়ে যথাক্রমে-
- বোরো: ৩৫ কেজি ইউরিয়া, ১২ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি এমওপি, ১৫ কেজি জিপসাম, ১.৫ কেজি দস্তা;
- আমন: ২৬ কেজি ইউরিয়া, ৮ কেজি টিএসপি, ১৪ কেজি এমওপি, ৯ কেজি জিপসাম, ০ কেজি দস্তা; এবং
- আউশ: ৮ কেজি ইউরিয়া, ৭ কেজি টিএসপি, ১১ কেজি এমওপি, ০ কেজি জিপসাম, ০ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করা যায়।
ii) সার প্রয়োগের পদ্ধতি
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা অতি জরুরি। তা না হলে ফলন কমে যায় এবং জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। এছাড়াও ভালো ফলন পাওয়ার জন্য উল্লিখিত রাসায়নিক সারের সাথে সাথে মাটিতে জৈবসার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
- জৈবসার হিসেবে পচা গোবর, আবর্জনা পচা সার, মুরগির বিষ্ঠা, সবুজ সার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বিভিন্ন সার ভিন্ন ভিন্নভাবে মাটিতে মিশে, গলে গিয়ে গাছের আহরণযোগ্য মূল খাদ্য উপাদান অবমুক্ত করে। যেমন- ইউরিয়া সার মাটিতে প্রয়োগের সাথে সাথে গলে গিয়ে গাছকে NH বা NO3 সরবরাহ করে। অন্যদিকে এ সার মাটিতে বেশি দিন থাকে না। তাই ইউরিয়া সার ধান গাছের জীবদ্দশায় প্রায় তিনবার প্রয়োগ করা হয়।
- ইউরিয়া সার সমান তিনভাগে ভাগ করে শেষ চাষের সময় অথবা চারা রোপণের ১৪/১৫ দিন পর, কুশি উৎপাদনের মধ্য সময় এবং কাইচথোড় পর্যায়ের পূর্বাবস্থায় দেওয়া হয়।
- অন্যদিকে টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সার একবার প্রয়োগ করলেই চলে।
- টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সার শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করা হয়।
গ) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
- সেচনির্ভর ধানে যথেষ্ট পানি সেচ দিতে হয়। তবে ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই।
- চারা রোপণের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত এবং কাইচথোড় বের হওয়ার সময় এক সপ্তাহ একটু বেশি পানি প্রয়োজন হয়। এ সময় জমিতে ছিপছিপে পানি রাখা আবশ্যক। তবে লক্ষ রাখতে হবে যে জীবদ্দশায় ধান গাছ যেন পানির স্বল্পতায় না পড়ে।
- বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন ধানে উঁচু করে আইল করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হয়। প্রয়োজনে বৃষ্টিনির্ভর এ সকল ধানে সম্পূরক সেচ দেওয়া যেতে পারে।
ঘ) আগাছা দমন
ক্ষেতে ধান ব্যতীত অন্য যে কোনো গাছকেই আগাছা বলা যায়। আগাছা ধান গাছের সাথে জায়গা, আলো, পানি এবং খাদ্য উপাদান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। ফলে আগাছা ধানের বাড়-বাড়তি কমিয়ে ফেলে এবং ধানের ফলন কমিয়ে দেয়। এ জন্য আগাছা দমন করা খুব জরুরি।
- আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৩০-৪০ দিন এবং বোরো মৌসুমের জন্য ২০-৫০ দিন জমি আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। এর পর ধান গাছ বড় হয়ে যায়। ফলে তখন আলো জায়গার অভাবে আগাছ আর তেমন জন্মাতে বা বাড়তে পারে না।
- রোপণ করা জমিতে চারা রোপণের পর ৫-১০ সে.মি. পানি ধরে রাখলে আগাছা কম জনে। এ স জমিতে কমপক্ষে দুইবার আগাছা গমন করা প্রয়োজন।
- ধান রোপণের ১৫-২০ দিন এবং ৩০-৩৫ দিন পর পর আগাছা দমন করা প্রয়োজন। তবে প্রয়োজনে আরও একবার আগাছা দমন করা যায়।
আগাছা সাধারণত তিন ভাবে দমন করা যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি বন্ধের সাহায্যে বা আগাছানাশক ব্যবহার করে।
- সাধারণভাবে হাত দিয়ে তুলে আগাছা দমন করা যায়। নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করলে যন্ত্রটি ধানে দুই সারির মাঝ দিয়ে চালিয়ে আগাছা উপড়ে ফেলা হয়। কিন্তু দুই গুছির মাঝে যে আগাছা থাকে তা আবার হাত দিয়ে তুলে দিতে হয়।
- অন্যদিকে আগাছানাশক ব্যবহার করে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আগাছানাশক হলো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এগুলো সঠিক মাত্রার সঠিক সময়ে প্রয়োগ করে আগাছা মেরে ফেলা যায়। এতে ধান গাছের তেমন ক্ষতি হয় না। পানিতে মিশিয়ে স্প্রে মেশিন দিয়ে অথবা দানাদার আগাছানাশক হাত দিয়েও ছিটিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
ঙ) পোকামাকড় দমন
ধান গাছের কিছু অনিষ্টকারী পোকামাকড় রয়েছে যা গাছের কাও, পাতা, শিষ এমনকি কচি ধান খেয়ে ধানের অনেক ক্ষতি করে। অনেক সময় পোকা বেশি করে আক্রমণ করলে এবং সঠিক সময় এর নি না করলে ক্ষেত থেকে কোনো ধানই আহরণ করা যায় না।
ধানের অনেক অনিষ্টকারী পোকা রয়েছে। মাজরা, পামরি, বাদামি গাছ ফড়িং, গাছি পোকা, লেদা পোকা, চুঙ্গি পোকা, গল মাহি, পাতা মোড়ানো পোকা, পাতা মাহি, ঘাসফড়িং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য পোকা। এসব পোকা সমনে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়, যেমন-
- ধান আবাদের পূর্বে পূর্ববর্তী কালের নাস্তা পুড়িয়ে ফেলা।
- পোকার ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা।
- আলোক ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক পোকা সংগ্রহ করে দমন করা।
- হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলা।
- ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে দিয়ে পোকাখেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করে নেওয়া যাতে পাখি পোকা খেতে পারে।
- আক্রান্ত জমি থেকে পানি সরিয়ে দেওয়া।
- ক্ষেতে পোকার সংখ্যা ফলনের ক্ষতিকর মাত্রার পৌঁছালে উপযুক্ত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা।
চ) রোগ ব্যবস্থাপনা
ধান গাছ বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। রোগের আক্রমণে ধানের ফলন কমে যায়। ধান গাছ ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত হলে ধানের রোগ শনাক্ত করে উপযুক্ত দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ধানের বিভিন্ন রোগের ভিন্ন ভিন্ন দমন ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও রোগ ব্যবস্থাপনার সকল পদ্ধতি কেবল একটি রোগে প্রয়োগ করা হয় না, কেবল প্রযোজ্য দমন পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করা হয়।
নিম্নে ধানের সাধারণ রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করা হলো-
- রোগমুক্ত ভালো বীজ ব্যবহার করা।
- রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
- সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা।
- জমিতে প্রয়োজনে পানি ধরে রাখা বা পানি শুকিয়ে ফেলা।
- মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা।
- সঠিক মাত্রায় পটাশ সার ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনে পটাশ সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করা।
- কোনো কোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা।
- কোনো কোনো রোগের ক্ষেত্রে বাহক পোকা মেরে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া।
- প্রয়োজনে সঠিক বালাইনাশক প্রয়োগ করা।
(৬) ধান কাটা/ফসল সংগ্রহ
ধানের শিষের ৮০% ধান পেকে গেলে দেরি না করে ধান কাটা প্রয়োজন। ধান কাটার পর মাঠে কোনো ধান না রেখে তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের পর ধান ভালোভাবে ঝেড়ে কয়েকটি রোন দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া দরকার।
(৭) ধান চাষে কিছু বিশেষায়িত প্রযুক্তি
সারা বাংলাদেশে এক বা একাধিক মৌসুমে ধান চাষ হয়। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অধিক ফলন ফলানোর জন্য উপযুক্ত জাত ও বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ এবং ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। এ সকল উপকরণের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। তবে এগুলোর বিবেচনাপ্রসূতভাবে সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে পরিমিত ব্যবহার করলে তা পরিবেশের উপরও কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবে না। বরং এ সকল উপকরণ ধানের অধিক ফলন উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে উপকরণবিহীন ধান চাষে ধানের ফলন অনেক কমে যায়। ফলে তা দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে। এতে এদেশের মানুষ ও পরিবেশ আরও বৃহত্তর ঝুঁকিতে পড়বে। তাই এ সকল উপকরণ সঠিকভাবে পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
i) গুটি ইউরিয়া ব্যবহার
গুটি ইউরিয়া হলো, ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি বড় আকারের গুটি যা দেখতে ন্যাপথালিন বলের মতো। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার কম লাগে।
গুটি ইউরিয়া জমিতে একবারই প্রয়োগ করতে হয়। এরপর অব্যাহতভাবে গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোনো সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না।
- গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পূর্বশর্ত হলো ধান রোপণ করতে হবে সারিবদ্ধভাবে। সারি থেকে সারি এবং গোজা থেকে গোছার দূরত্ব হবে ২০ সে.মি. (৮ ইঞ্চি)।
- বোরো মৌসুমে চারা রোপণের ১০-১৫ দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে।
- জমিতে সব সময় প্রয়োজনীয় ২-৩ সে.মি. পানি রাখতে হবে।
- সাধারণত আউশ ও আমন ধানের জন্য ১.৮ গ্রাম ওজনের একটি ৩টি এবং ৰোৱো ধানের জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি গুটি ব্যবহার করতে হবে, যার হেক্টরপ্রতি নাইট্রোজেন মাত্রা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫০ ও ৭৫ কেজি। ফলে আউশ ও আমন মৌসুমে প্রতি হেক্টরে ৬৫ কেজি এবং বোরো মৌসুমে ৮০-১০০ কেজি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়।
ii) সেচের এডব্লিউডি পদ্ধতি
বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানিসাশ্রয়ী আর একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রায়িং বা এডব্লিউডি।
- এ পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন হয় একটি ৭-১০ সে.মি. ব্যাস ও ২৫ সে.মি. লম্বা ছিদ্রযুক্ত পাইপ বা চোঙ।
- এটি চারা রোপণের ১০-১৫ দিনের মধ্যে জমিতে চারটি ধানের গোছার মাঝে খাড়াভাবে স্থাপন করতে হবে যেন এর ছিদ্রবিহীন ১০ সে.মি. মাটির উপরে এবং ছিদ্রযুক্ত ১৫ সে. মি. মাটির নিচে থাকে। এবার পাইপের তলা পর্যন্ত ভিতর থেকে মাটি উঠিয়ে নিতে হবে। মাটি শক্ত হলে গর্ত করে পাইপটি মাটিতে বসানো যেতে পারে।
- যখন পানির স্তর পাইপের তলায় নেমে যাবে তখন জমিতে এমনভাবে সেচ দিতে হবে যাতে দাঁড়ানো পানির পরিমাণ ৫-৭ সে.মি. হয়। আবার ক্ষেতের দাঁড়ানো পানি শুকিয়ে পাইপের তলায় নেমে গেলে পুনরায় সেচ দিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ চলবে জাতভেদে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত।
- যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২-৫ সে.মি. পানি রাখতে হবে।
দেখা গেছে, এডব্লিউডি পদ্ধতিতে বোরো ধানে সেচ দিলে দাঁড়ানো পানি রাখার চেয়ে ৪- ৫টি সেচ কম লাগে এবং ফলনও কমে না। ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়।
(৮) ধান চাষে আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
বিভিন্ন পোকামাকড় বা রোগ-জীবাণু দমনে যথেচ্ছ বালাইনাশক ব্যবহার করলে তা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে বালাই অর্থাৎ পোকামাকড় বা রোগ-জীবাণু ঐ সকল বালাইনাশকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠে। ফলে পূর্বের ন্যায় আর বালাইনাশক তেমন কাজ করে না। ফলে আরও শক্তিশালী বালাইনাশক তৈরি করার প্রয়োজন হয়। এতে করে প্রকৃতিতে অনেক উপকারি যেসব পোকামাকড় বা জীবাণু আছে সেগুলোও ধ্বংস হয়। ফলে খাদ্যে বিষাক্ত বালাইনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং প্রকৃতিতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ থেকে বাঁচার জন্য আইপিএম বা Integrated Pest Management নামক পদ্ধতি প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়। এ পদ্ধতিতে বালাই দমন বা ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা সমন্বিত পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয়। এরপরও বালাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে সর্বশেষ পদ্ধতি হিসেবে রাসায়নিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় কোনো বালাইকে সম্পূর্ণ দমন করার চেষ্টা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে বালাইকে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষতিকর পর্যায়ের নিচে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কতগুলি পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হল-
- বালাই প্রতিরোধী জাত চাষ করা।
- ভালো ও রোগ-জীবাণু ও পোকামাকড় মুক্ত বীজ ব্যবহার করা।
- সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা।
- সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা।
- হাত বা যন্ত্রের সাহায্যে রোগাক্রান্ত বা পোকামাকড় আক্রান্ত ধানের পাতা বা শিষ তুলে ফেলা বা গাছ তুলে ফেলা।
- হাত জাল ইত্যাদি দিয়ে পোকা সংগ্রহ করা।
- আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা।
- রোগাক্রান্ত জমির নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
- ধান ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে দিয়ে পোকাখেকো পাখির সাহায্যে পোকা দমন করা।
- সঠিক মাত্রায় পানি ব্যবস্থাপনা করা অর্থাৎ প্রয়োজনে পানি দেওয়া বা পানি বের করে ফেলা।
- এবং সর্বশেষে যদি বালাই ক্ষতিকর পর্যায়ের উপরে উঠে যায় তবে সঠিক মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ করে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা।
(৯) ধানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ধান কেবল একটি শস্যই নয়, ধান আমাদের জীবন। প্রধান খাদ্য হিসেবে ধান আমাদের পুষ্টি সাধন করে। এছাড়াও আমাদের জীবিকায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ধানের রয়েছে বিরাট ভূমিকা।
আমাদের সংস্কৃতির একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ধান।
আবহমান বাংলার নবান্ন একটি অন্যতম উৎসব। শীতের শুরুতে আমন মৌসুমের ধান উঠে। ধানের গোলা পূর্ণ থাকায় মানুষের মন এই সময় উৎসবে মেতে উঠে। তাই এ সময় ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস রান্না হয়। সবাই আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যায়। ধান থেকে প্রাপ্ত সম্পদের প্রাচুর্যে গ্রামে গ্রামে চলে মেলা, জারি-সারি গান।
নববর্ষের অনুষ্ঠানে থাকে চাল থেকে তৈরি খাদ্যের প্রাচুর্য্য।
সামাজিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় সুগন্ধি চাল। আমাদের প্রাত্যহিক খাবার থেকে উৎসবের সকল খাবারের মধ্যমণি এই চাল। ধান থেকে তৈরি হয় হরেক রকমের খাবার। ভাত, খিচুরি, পোলাও, বিরিয়ানি, খির, পায়েস, শত রকমের পিঠা, মুড়ি, চিড়া, খই, মোয়া আরও কত কী!
এদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ কৃষিজীবী। দেশের ৭৫% জমিতে ধান হয়, তাই ধান চাষই কৃষিজীবীদের মূল পেশা। দেশের অসংখ্য মানুষের জীবিকার উৎস ধান।
ধান উৎপাদনে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার হয়, যেমন ধান বীজ, সার, পানি, বালাইনাশক ইত্যাদি। ধান চাষে ব্যবহার করা হয় অনেক কৃষি যন্ত্রপাতি। সমস্ত দেশের ধান ক্ষেতের জন্য এ সকল উপকরণ ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও সরবরাহ করা একটি বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
ধানের পরিচর্যা এবং কর্তনোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণ বিরাট একটি কর্মকাণ্ড। চাতালে ধান শুকানো, মাড়াই কালে মাড়াই করা, বক্স ও প্যাকেটজাত করে সারা দেশে ভোক্তার জন্য সরবরাহ করায় রয়েছে এক বিরাট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যার সাথে এদেশের অসংখ্য মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
তাই বলা হয়ে থাকে ধানই আমাদের জীবন। অন্যদিকে ধান থেকে প্রাপ্ত উপজাতের বহুল ব্যবহার রয়েছে। যেমন- খড় গোখাদ্য, জ্বালানি বা ঘর ছাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়, তুষ জ্বালানি কাজে ব্যবহৃত হয়, কুড়া থেকে হয় মুরগি বা মাছের খাবার। ইদানীং কুড়া থেকে তৈরি হচ্ছে উৎকৃষ্টমানের ভোজ্যতেল।
(১০) পরিবেশের সাথে ধানের অভিযোজন
ধান পানি পছন্দকারী একটি উদ্ভিদ। সফলভাবে ধান চাষ করতে গেলে এর জীবদ্দশায় প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়।
আমাদের বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই পানিকে কাজে লাগিয়ে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। বর্ষাকালে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এই বন্যার পানির মধ্যে চাষ করা হয় জলি আমন ধান। এভাবে মৌসুমি বৃষ্টি ও বন্যার পানিকে কাজে লাগিয়ে বছরের অর্ধেক সময় ধান চাষ করা হয়।
বৃষ্টি ও বন্যার পানি আবার মাটির ভিতর দিয়ে চুইয়ে গিয়ে মাটির কোনো কঠিন অপ্রবেশ্য স্তরের উপর জমা হয়। পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ এ পানি তুলে বৃষ্টিবিহীন শীত ও গ্রীষ্মকালে ধান চাষ করা যায়। এছাড়াও এ সময়ে নদী-নালা, খাল-বিল থেকে পানি তুলে এনেও সেচকাজে লাগানো যায়।
মূলত দেশের নিম্নাঞ্চলে যেখানে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় রয়েছে বা যেখানে বন্যার পানি আসে, এসব অঞ্চলে সারা বছর ধান চাষ করা যায়। পানি যেখানে বেশি সেখানে এ রকমভাবে অন্য কোনো শস্য চাষ করা যায় না। এ সকল নিম্নাঞ্চলে বন্যার সময় প্রচুর পলি পড়ে মাটিকে উর্বর করে তোলে। তাই ভূগর্ভস্থ পানি ৰা খাল-বিলের পানি ব্যবহার করে এখানে ধান চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
তবে কেবল নিচু জমিই নয় উঁচু জমিতেও আমাদের দেশে প্রচুর ধান চাষ করা হয়। সেখানে মূলত বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানো হয়। যেমন- পাহাড়ের ঢালে।
এখানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জুম চাষের মাধ্যমে এক ধরনের ধান আবাদ করে। পাহাড়ের ঢাল খরাপ্রবণ এবং সেখানে বৃষ্টির পানি আটকায় না। এই জুমে বর্ষার বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় ধান বুনে দেওয়া হয়। পরে মৌসুমি বৃষ্টির পানি দিয়েও ধান চাষ করা হয়। এছাড়া সমতলে সম্পূর্ণ মৌসুমি বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়েও ধান চাষ করা যায়।
আমাদের দেশে বছরে তিনটি মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। এ তিনটি মৌসুমের নাম হলো আউশ, আমন ও বোরো।
আউশ ধান চাষ: বছরের প্রথম দিকের বৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে যে ধান এপ্রিল-মে মাসে চাষ করা হয় তাকে বলে আউশ ধান। তবে বর্তমানে এ ধানটি সেচ দিয়েই মূলত আবাদ শুরু করা হয়। আউশ শব্দটি এসেছে আশু বা আগাম শব্দ থেকে। অর্থাৎ পরবর্তী আমনের আগে আশু হিসেবে এটি চাষ করা হয়। আউশ ধানে প্রথম দিকে বৃষ্টিপাত থাকে না বলে এর খরা সহিঞ্চুতা এবং সেই সাথে এ সময় এ দেশে তাপমাত্রা উচ্চ থাকে বলে এর উচ্চ তাপ সহনশীলতা থাকে। তবে জীবনকালের শেষের দিকে আউশ ধান প্রচুর বৃষ্টিপাত পায়। এ ধান জুলাই-আগস্ট মাসে কাটা হয়। আউশ ধান সরাসরি বপন বা চারা রোপণের মাধ্যমে চাষ করা হয়। এ ধানের জীবনকাল কিছুটা কম হয়।
আমন ধান চাষ: আউশ ধানের পর আমন ধান চাষ করা হয়। আমন শব্দটি এসেছে ‘আমান’ আরবি শব্দ থেকে যার অর্থ নিশ্চিত। আবহমান কাল ধরে মৌসুমি বৃষ্টির উপর নির্ভর করে এ ধান চাষ করা হয়। বর্ষার সময় বৃষ্টিপাত নিশ্চিত। তাই সহজভাবে আমন চাষ করা যায়। আমন ধান প্রচুর বৃষ্টিপাতের সময় আবাদ হয় বলে এ ধান বৃষ্টিনির্ভর। বৃষ্টিপাত যখন বন্ধ হয় তখন এ ধান ফুল-ফল নিয়ে পেকে যায়। আমন মৌসুমের ধান রোপা আমন বা জলি আমন ধান হতে পারে। রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন জুন মাসের মাঝামাঝিতে শুরু হয়। অবস্থাভেদে ২০ থেকে ৫০ দিনের চারা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোপণ করা হয়। রোপা আমন অঞ্চলভেদে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে কর্তন করা যায়। অন্যদিকে জলি আমন ধান বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যার পানি আসার আগে সাধারণত এপ্রিল মাসে বপন করা হয়। বন্যার পানি সরে গেলে নভেম্বর- ডিসেম্বর মাসে ধান কাটা হয়।
বোরো ধান চাষ: বোরো ধান হয় শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালজুড়ে। বাঁওড় শব্দটি থেকে বোরো ধান এসেছে। হাওড়-বাঁওড়ে আবহমান কাল ধরে এ ধানটি চাষ হয় বলে একে বোরো ধান বলে। এ সময় সারা দেশের পানি শুকিয়ে যায় কেবল হাওর-বাঁওড়-বিলে পানি থাকে। তাই এসব অঞ্চলে বোরো ধান ভালো হয়। তবে বর্তমানে এ ধান উঁচু, মধ্যম উঁচু ও নিচু জমিতেও সেচ দিয়ে চাষাবাদ করা হয়। বোরো ধান নিম্ন তাপমাত্রা সহিষ্ণু। বোরো ধানের চারা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তৈরি করা হয় এবং জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে রোপণ করা হয় এবং এপ্রিল-মে মাসে কর্তন করা হয়।
উপরোক্ত ধানের এই তিনটি মৌসুম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ধান বাংলাদেশে সারা বছরই চাষ করা যায়। অন্য কোনো শস্য সারা বছর এমন করে আবাদ করা যায় না। এ জন্য এদেশে ধানের আবাদ এত বেশি।
বাংলাদেশের রয়েছে পাহাড়, রয়েছে সমভূমি, রয়েছে অতি নিচু জমি। এর সর্বত্রই ধান চাষ হয়।
আর মাটির ধরন বিবেচনা করলে দেখা যায় এদেশে রয়েছে উৎকৃষ্ট মানের পলল জমি রয়েছে আদি সময়ে গড়ে উঠা মধুপুর গড় বা বরেন্দ্র ভূমি, রয়েছে লবণাক্ত জমি রয়েছে বন্যাকবলিত অঞ্চল, রয়েছে জোয়ার-ভাটাকবলিত অঞ্চল, সর্বত্রই ধান চাষ করা যায়। অন্যদিকে এ ধান সারা বছরই আবাদ করা যায় বলে কোনো অঞ্চলে এক মৌসুমে ধান না হলেও অন্য মৌসুমে ধান আবাদ করা যায়।
এভাবে দেশের সর্বত্রই ধান চাষ হয়। যদিও হিসাব করলে দেখা যাবে এদেশে দুই শতাধিক শস্যের চাষ হয়, তবু এদেশে গড়ে ৭৫% জমিতে ধান হয়। বাকি সকল শস্য হয় বাকি ২৫% জমিতে।
বাংলাদেশে অনেক পরিবেশ রয়েছে যা শস্য চাষের জন্য কিছুটা প্রতিকূল। তবে ঐ সকল অঞ্চলে ধান সুন্দরভাবে অভিযোজন করে নিয়েছে।উপযুক্ত ধানের জাত এবং বিশেষায়িত কিছু উৎপাদন ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে এ সকল অঞ্চলে সফলভাবে ধান চাষ করা যায়।
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বর্ষাকালে বন্যা হয়। বন্যায় মাঠের পর মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক অঞ্চলে ১-৩ মাস পর্যন্ত ১-৩ মিটার পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে থাকে। প্রথমে শুকনো ক্ষেতে বন্যার পানি আসে, পরে ধীরে ধীরে এ পানির উচ্চতা বাড়ে। বন্যাকবলিত এ সকল অঞ্চলে তেমন কোনো শস্য চাষ করার কথা চিন্তাই করা যায় না। তবে এখানে জলি আমন ধান সফলভাবে চাষ করা যায়।
বন্যার পানি আসার পূর্বে এ ধান বপন করা হয়। পরে বন্যার পানি এলে পানি ও বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধানের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ধান গাছ পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় না। পরে বন্যার পানি সরে গেলে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এ ধান কাটা হয়। এভাবে এ জাত ব্যবহার করে এখানে সফলভাবে ধানের আবাদ করা যায়।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ারের সময় নদী দিয়ে পানি উপরে উঠে আসে এবং ভাটার সময় পানি নেমে যায়। বর্ষার সময় জোয়ারের পানির এ উঠানামায় অধিক পরিমাণে পানি আসে এবং যায়, যার ফলে ক্ষেতে এ সময় কোনো শস্য চাষ করা যায় না কারণ শস্য জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যায় এবং বেশির ভাগ শস্য এত পানি সহ্য করতে পারে না। তবে এখানে সফলভাবে আমন মৌসুমে উপযুক্ত জাতের ধান চাষ করা যায়।
এ সকল অঞ্চলে যে সকল ধানের জাত ব্যবহার করা হয় তার চারা বীজতলায় খুব দ্রুত বাড়ে, চারা খুব লম্বা হয় এবং কাও খুব শক্ত হয়। ফলে এ চারা রোপণ করলে জোয়ারের পানিতে চারা তেমন তলিয়ে যায় না বা জোয়ারের পানির টানে এর তেমন ক্ষতি হয় না। তাই জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে এ ধান সহজে চাষ করা যায়।
সাগরের নিকটবর্তী জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে লবণাক্ত পানি উঠে আসে। লবণাক্ততা শস্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। লবণাক্ততার কারণে এ সকল অঞ্চলে বিভিন্ন শস্য চাষ করা যায় না। ধানের অনেক জাতের মধ্যে লবণাক্ত সহিষ্ণুতা রয়েছে। এ সকল জাত এ সকল অঞ্চলে সফলভাবে চাষ করা যায়।
হঠাৎ করে বেশি বৃষ্টিপাত হলে রোপা আমন ধান পানিতে তলিয়ে যায়। ধান ৬/৭ দিন পানির নিচে থাকলে গাছ মারা যায়। এ অবস্থায় অন্য শস্য তো আবাদই করা যায় না। তবে আকস্মিক বন্যা সহিষ্ণু রোপা আমন জাত চাষ করলে ১৪/১৫ দিন ডুবে থাকা ধান গাছ থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
পাহাড়ের ঢালে জুমে ধান চাষের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। জুমে উপযুক্ত ধানের জাত ব্যবহার করে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী তাদের ধানের চাহিদা পূরণ করে।
পরিবেশের সাথে ধানের এ ধরনের অনেক অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে। তাই বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধান চাষ হয়।
(১১) ধানের উপকারিতা
ধান বাঙালির প্রধান খাদ্য। ধান মূলত শর্করা নামক পুষ্টি সরবরাহ করে যা আমাদের শরীরে তাপ তথা শক্তি উৎপাদন করে। আবহমান কাল ধরেই আমরা তিন বেলা ভাত খাই। ফলে বাঙালি জাতির মূল শারীরিক শক্তির উৎস হলো ধান। এছাড়া ধানে রয়েছে প্রায় ৭% আমিষ, কিছু দেহ, ভিটামিন বি ও ভিটামিন ই এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থ। আমরা পেট পুরে ভাত খাওয়ার চেষ্টা করি বিধায় আমাদের শরীরের আমিষের বড় অংশ ভাত থেকে আসে। আমাদের শরীরের প্রধান দুইটি পুষ্টি উপাদানের উৎসই হলো ধান।
(১২) উপসংহার
ধান আমাদের খাদ্যের প্রধান উৎস। সেই সাথে ধান আমাদের জীবিকা ও সংস্কৃতির অন্যতম উৎস। তাই ধানই আমাদের জীবন।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।