বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বছর বছর জমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
উন্নয়নশীল বা উন্নত বিশ্বের যে কোনো দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো সময়োপযোগী ও বাস্তব বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থাৎ কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলে উৎপাদন ধারা টিকিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতিতে কৃষিপণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিপূরণ ও বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
(১) কৃষি বিপণন কী?
ক) কৃষিপণ্য: যে সব পণ্যসামগ্রী মূলত ভূমি, নদ-নদী, খামার ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন হয় তাকে কৃষিপণ্য বলে তবে পশু বা বিভিন্ন প্রকার জীবজন্তুকেও কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা যায় যে, কৃষিপণ্য সামগ্রী বিভিন্ন প্রকৃতির ও ধরনের হতে পারে।
নিম্নে বিভিন্ন প্রকার কৃষিপণ্যের একটি তালিকা দেওয়া হলো-
- বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী। যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, তেলবীজ, ফলমূল, শাকসবজি প্রভৃতি।
- মৎস্যসম্পদ।
- পশু সম্পদ। যেমন- গরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, উট ইত্যাদি।
- খামারে উৎপাদিত সামগ্রী যেমন- দুধ, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি।
- অন্যান্য সামগ্রী। যেমন- পাট, চামড়া, তামাক ইত্যাদি।
খ) বিপণন: বিপণন হচ্ছে মূলত সময়, স্থান ও মালিকানাজাতীয় উপযোগ সৃষ্টির কাজ। এ ধরনের চিন্তা থেকেই বিপণনকে পণ্যসামগ্রী বিতরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিপণন হচ্ছে সে সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম, যা পণ্য ও সেবা উৎপাদক থেকে ভোক্তার নিকট সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে, যথাযথ অবস্থায় এবং প্রত্যাশিত মূল্যে পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত।
সহজ কথায় বলা যায়, কোনো পণ্য উৎপাদনের পর উৎপাদকের কাছ থেকে ভোক্তার নিকট পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সাথে যত প্রকার ব্যবসায়িক কার্যাবলি জড়িত আছে সবগুলোর সামগ্রিক রূপই হলো বিপণন।
গ) কৃষি বিপণন: কৃষি বিপণন হচ্ছে কোনো কৃষিপণ্য অথবা সেবা প্রারম্ভিক উৎপাদন হতে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী যাবতীয় ব্যবসায়িক কার্যাবলি সম্পাদন।
কৃষি বিপণনের কার্যাবলি শুধু উৎপাদকের কাছ থেকে চূড়ান্ত ভোক্তার কাছে কৃষিপণ্য পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই সীমিত নেই, বরং ঐসব কার্যাবলির সাথে জড়িত পক্ষগুলো যেমন- উৎপাদক, মধ্যস্থতাকারবারি ও ভোক্তাদের উপর কী প্রভাব ফেলছে তার সাথেও সম্পৃক্ত।
(২) কৃষিপণ্য বিপণনের কার্যাবলি
কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর থেকে তা ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়ার মধ্যবর্তী পর্যায়ে সম্পাদিত সকল কার্যই কৃষিপণ্য বিপণনের কার্যবলি বলে বিবেচিত হবে।
কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা ভোক্তার হাতে পৌঁছে দিতে গেলে অনেকগুলো কার্য সম্পাদন করতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, প্যাকেজিং, অর্থসংস্থান, সংরক্ষণ প্রভৃতি।
ব্যাপক অর্থে কৃষিপণ্য বিপণনের কাজ শুরু হয় পণ্য উৎপাদনের আগেই এবং ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়ার পরও তার কাজ বাকি থেকে যায়। অর্থাৎ কৃষিপণ্য উৎপাদন শুরুর পূর্বেই এর বাজার, মূল্য, চাহিদা, বীজ ও উপকরণ সংগ্রহ ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন হয়, যা কৃষি বিপণনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমনিভাবে কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের কার্যাবলি জড়িত।
কৃষিপণ্য বিপণনের কার্যাবলি বলতে যে সব কাজকে বোঝায় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
ক) একত্রীকরণ (Assembling): বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীকে জড় করার নামই একত্রীকরণ। কৃষকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিক্রয়যোগ্য উৎপাদন ব্যবসায়ীরা ক্রয়ের মাধ্যমে এ কাজটি সম্পদান করে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের গ্রাম্য বাজার থেকেই এ কাজটি শুরু হয়। অনেক সময় কৃষকের বাড়ির আঙিনা থেকেও কাজটি শুরু হয়। উৎপাদন মৌসুমে প্রাথমিক বাজারে পণ্যের জোগান দেখে বিপণনকারীরা কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
খ) মোড়কীকরণ (Packaging): পণ্য পরিবহন, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মোড়কীরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যথাযথ মোড়কীকরণের উপর পণ্যমান সঠিক রাখা নির্ভর করে। আমাদের দেশে কৃষিপণ্যের বেলায় মোড়কীকরণের ব্যবস্থা অবৈজ্ঞানিক। এ কারণে ভোক্তা কাঙ্ক্ষিত মানে পণ্য পায় না। তবে বর্তমানে দেশে মোড়কীকরণে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে।
গ) প্রক্রিয়াকরণ (Processing): কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর বিপণনের জন্য নানা ধরনের প্রক্রিয়াকরণ কাজ জড়িত থাকে। পণ্যের প্রকৃতি ভেদে প্রক্রিয়াকরণ কাজও বিভিন্ন হয়। যেমন- ধানকে চালে রূপান্তর করতে হয়। গম, সরিষা, পাট ইত্যাদিকে পরিচ্ছাকরণ, শুষ্ককরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণপূর্বক ভোগযোগ্য করার প্রয়োজন হয়।
ঘ) সংরক্ষণ (Storing): কৃষিপণ্য মৌসুমভিত্তিক উৎপাদিত হয়। অথচ ভোক্তার চাহিদা থাকে বছরব্যাপী। এ ধরনের ভোক্তার চাহিদা পুরণের জন্য কৃষিপণ্যকে মজুত করে রাখা হয়। তবে পণ্যের প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণে সংরক্ষণ ব্যবস্থায়ও বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন- পার্ট যেভাবে সংরক্ষিত হয়, ফলমূলের বেলায় তা চলে না।
ঙ) পরিবহন (Transportation): কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় কৃষি খামারে, প্রধানত গ্রামাঞ্চলে। এসব পণ্যের উৎপাদন পরিমাণ কৃষকদের খামার আয়তনের উপর নির্ভরশীল। আর কৃষিপণ্যের চাহিদা প্রধানত দূরবর্তী শহরাঞ্চলে কিংবা শিল্পে বিরাজ করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের উৎপাদনকে তাই চাহিদা স্থানে প্রেরণের জন্য পরিবহন একটি অনন্য কাজ হিসেবে বিবেচিত।
চ) পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় (Whole selling): কৃষিপণ্য একত্রীকরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় বড় লটে জন্ম- বিক্রয় সংঘটিত হয়, যা পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় নামে পরিচিত।
ছ) অর্থসংস্থান (Financing): কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা কয়েক দফা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে ভোক্তা বা ব্যবহারকারীর নিকট পৌঁছে। বেপারি, ফড়িয়া যারা ক্রয়-বিক্রয়ে জড়িত থাকে তাদের পুঁজির উপর বাজার অবস্থা নির্ভর করে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়।
জ) খুচরা ক্রয়-বিক্রয় (Retailing): কৃষিপণ্যের ভোক্তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে ক্রয় ও ভোগ করে থাকে। কিন্তু উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝে থাকে বিস্তর ব্যবধান। এ ব্যবধানকে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জন্ম নিয়েছে নানা নামের বৃহৎ কারবারি। এরা বড় বড় লটে জন্ম বিক্রয় করে। ফলে ভোক্তার হাতে পণ্য পৌঁছানোর জন্য খুচরা ক্রয়-বিক্রয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঝ) বাজার তথ্য (Market Information): আমরা কথায় কথায় বলতে শুনি এবারে ফসল ভালো হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন আশাব্যস্তক। এটি এক ধরনের বাজার তথ্য। এ ধরনের তথ্য পণ্যমূল্য, পণ্য প্রাপ্তি ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে। তবে বিপণনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আরো গভীরভাবে বিষয়টিকে বিবেচনায় আনে। যেমন- কখন ক্রয় করা লাভজনক হবে। কখন মজুত করা উত্তম হিসেবে বিবেচিত এবং কী পরিমাণে, কত মূল্যে পণ্য বিক্রি করা লাভজনক ইত্যাদি। এ সকল অবস্থা ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে বিপণনকারীকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো বাজার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
ঞ) পণ্য সিদ্ধান্ত (Product Decision): কৃষি খামারে একই সময়ে নানা ধরনের ও জাতের পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোন পণ্য উৎপাদন করা হবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদককে পণ্যের চাহিদা, ভবিষ্যৎ মূল্য, উৎপাদনের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাছাড়া, খামারে আয়তন পণ্য উৎপাদন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকে।
ট) প্রক্রিয়াকরণ উদ্ভাবন (Process Innovation): যে কোনো পণ্যের বিচিত্র ব্যবহার পণ্যের উপযোগ ও চাহিদাকে প্রভাবিত করে। কৃষিপণ্যের বেলায় তা আরও বেশি প্রযোজ্য। যেমন- ডিমের বিচিত্র ব্যবহারের কারণে এ পণ্যের চাহিদা সমাদৃত। ফলে কৃষি বিপণনকারী পণ্যের বিচিত্র ব্যবহার উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। এ সকল প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের মধ্যেই বিপণনকারীর দক্ষতা ও সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল।
ঠ) বিক্রয়োত্তর সেবা (After Sales Service): আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় একজন বিপণনকারী শুধু তার পণ্য বিক্রয় করে তৃপ্ত হয় না। ভোক্তাকে তৃপ্ত রাখা তার অন্যতম লক্ষ্য। ভোক্তার সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমে সে তার পণ্যের বাজার চাহিদা বা অংশ ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে চায়। এ জন্য আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
(৩) কৃষিপণ্যের বিপণন চ্যানেল বা কৃষিজাত পণ্য বণ্টনের প্রণালিসমূহ
উৎপাদক এবং ভোক্তা এ দুইপক্ষের মধ্যে যারা যোগসূত্র স্থাপন করে তাদের বলা হয় মধ্যস্থকারবারী। উৎপাদকের নিকট থেকে কোনো পণ্য ক্রয় করে ভোক্তার নিকট তারা সেই পণ্য বিক্রয় করে। উৎপাদক এবং ভোক্তাকে যদি আমরা একটি সড়কের দুই প্রান্ত মনে করি, তবে এক প্রান্ত থেকে একটি পণ্য অপর প্রান্তে পৌঁছাতে মধ্যস্থকারবারি তৎপর থাকে। যে পথ ধরে পণ্যসামগ্রী উৎপাদকের নিকট থেকে ভোক্তার নিকট পৌছে, পণ্য প্রবাহের সেই পথই হলো কণ্টন প্রণালি বা বিপণন চ্যানেল।
কৃষিপণ্যের বিদ্যমান মার্কেটিং চ্যানেল ও মধ্যস্থকারবারি-
- ধাপহীন চ্যানেল:উৎপাদক → ভোক্তা।
- একধাপ চ্যানেল: উৎপাদক → খুচরা বিক্রেতা।
- বিধাপ চ্যানেল: উৎপাদক → পাইকারি বিক্রেতা → খুচরা বিক্রেতা → ভোক্তা।
- ত্ৰিধাপ চ্যানেল: উৎপাদক → প্রতিনিধি → পাইকারি বিক্রেতা → খুচরা বিক্রেতা → ভোক্তা।
কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনকারীর কাছ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর উপায় বা পদ্ধতিকে আমরা নিম্নলিখিত চারটি উপায়ে প্রকাশ করতে পারি-
- সরাসরি বিক্রয়;
- খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে বিক্রয়;
- পাইকারের মাধ্যমে বিক্রয়;
- প্রতিনিধির মাধ্যমে বিক্রয়।
নিম্নে কৃষিপণ্য বিপণনের পদ্ধতিসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হলো-
ক) সরাসরি বিক্রয়: এ পদ্ধতিতে কৃষক বা উৎপাদনকারী তাদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে স্থানীয় বাজারে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে অবস্থিত বাজারগুলোতে উৎপাদকরা তাদের উৎপাদিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য এভাবেই বিক্রি করে থাকে। দুধ, চাল, শাকসবজি, ডাল, ফলমূল ইত্যাদি এভাবেই বিক্রি হয়ে থাকে।
খ) খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে বিক্রয়: এখানে উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে একটি মাত্র চ্যানেল থাকে। এ পদ্ধতিতে খুচরা কারবারি উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে এসে দাঁড়ায়। এখানে উৎপাদকরা তাদের পণ্য খুচরা কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দেয় (গ্রামের বাজারে এরা ফড়িয়া হিসেবে পরিচিত) এবং তারা আবার ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে। সাধারণত হাটের দিন বা বাজারের দিন এরা কৃষকদের কাছ থেকে বেশি করে কৃষিজাত পণ্য কিনে নেয় এবং সপ্তাহের অন্যান্য দিন তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রয় করে। চাল, তরিতরকারি, ডাল প্রভৃতি সাধারণত এভাবে বিক্রি করা হয়ে থাকে।
গ) পাইকারের মাধ্যমে বিক্রয়: আমাদের দেশের কৃষিজাত পণ্যের একটি বড় অংশই বিক্রি হয় পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে। এখানে উৎপাদকরা পাইকারদের নিয়োজিত দালাল বা বেপারির কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করে। পাইকাররা স্থানীয় বাজার থেকে এভাবে সংগৃহীত কৃষিজাত পণ্য একত্রিত করে তা শহরের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে এবং সর্বশেষ খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই ভোক্তারা পণ্য কিনে নেয়। শহরের অধিকাংশ কাঁচামাল, তরিতরকারি, মাছ, ফলমূল প্রভৃতি এভাবেই বিক্রি হয়ে থাকে। অবশ্য কোনো কোনো পাইকার খুচরা কারবারিদের কাছে পণ্য বিক্রি না করে তা সেকেন্ডারি বা টার্মিনাল মার্কেটে অথবা প্রক্রিয়াকারীর কাছে বিক্রি করতে পারে।
ঘ) প্রতিনিধির মাধ্যমে বিক্রয়: উৎপাদনকারী কখনো কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ নগর ও বন্দরে কোনো প্রতিষ্ঠানকে তাদের এজেন্ট বা প্রতিনিধি নিয়োগ করতে পারে যার মাধ্যমে সে তার পণ্য বিক্রি করে থাকে। এখানে প্রতিনিধির কাছ থেকে পাইকার বা খুচরা কারবারিরা পণ্য কিনে নেয় এবং ভোক্তারা এদের কাছ থেকেই পণ্য পেয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রসেস করা খাদ্যদ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রে এরূপ প্রতিনিধি নিয়োগ করতে দেখা যায়। যেমন- আহমেদ ফুড প্রোডাক্টস্ কোম্পানি তাদের প্রস্তুতকৃত জ্যাম, জেলি প্রভৃতি কোনো এজেন্টের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারে।
(৪) কৃষিপণ্য বিপণনের চ্যালেঞ্জসমূহ
আমাদের দেশে কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যার তীব্রতা ও আঙ্গিক পরিবর্তিত হলেও মূলত এ আধুনিক বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বিপণন সমস্যা এখনও কৃষির অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কৃষিপণ্য বিপণনে এ ধরনের কিছু চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
ক) কৃষক পর্যায়ে সমস্যা: মৌসুমে ফসলের নিম্নমূল্য ফসল গুদামজাতকরণ বা সংরক্ষণে সমস্যা, অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, হাট বাজারে বেশি হারে টোল/খাজনা আদায়, শস্য কর্তনোত্তর প্রযুক্তি জ্ঞান গ্রেডিং, মান নির্ধারণ, মোড়কীকরণের (প্যাকিং) অভাব, শস্য বিমা ও ঋণ সুবিধার অভাব, অপ্রয়োজনীয় সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম, শস্য পরিবহনজনিত অসুবিধা, কৃষক সংগঠনের অভাব, অপর্যাপ্ত বাজার তথ্য ইত্যাদি।
খ) ব্যবসায়ী পর্যায়ে সমস্যা: ফসলের অপর্যাপ্ত জোগান, পরিবহনের অসুবিধা ও অধিক ব্যয়, বিপণন ঋণের অভাব, বাকিতে পণ্য বিক্রয়ে অসুবিধা, অস্থিতিশীল মূল্য, গুদামজাতকরণ ও সংরক্ষণের অসুবিধা, শীতল ব্যবস্থা সংবলিত পরিবহন ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি।
গ) ভোক্তা পর্যায়ে সমস্যা: মৌসুম শেষে কৃষিপণ্যের উচ্চমূল্য এবং বাজার থেকে বাজারে মূল্যের তারতম্য, অস্থিতিশীল সরবরাহ, গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের অভাব ও ভেজাল পণ্য, মোড়কীকৃত পণ্যের অভাব, সময়মতো এবং উপযুক্ত মাধ্যমে বাজার তথ্যের অভাব, বিক্রেতা কর্তৃক ওজনে কারচুপিসহ নানাবিধ অসাধু উপায় অবলম্বন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাজারের অপ্রতুলতা ইত্যাদি।
ঘ) প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়ে সমস্যা: গুণগত মানসম্পন্ন কাঁচামালের অনিয়মিত ও অপ্রতুল সরবরাহ, ব্যাংকঋণের অপর্যাপ্ততা ও ঋণ প্রাপ্তিতে অসুবিধা, ডালকলাই ও তৈলবীজ প্রক্রিয়াকরণে লাগসই প্রযুক্তির অভাব, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার তথ্যের অভাব, মান নিয়ন্ত্রণ সুবিধার অভাব ইত্যাদি।
ঙ) রপ্তানিকারকের সমস্যা: চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের অপ্রতুলতা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মোড়কীকরণ, পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব, রপ্তানি বাজার সম্পর্কিত তথ্যের অভাব, কার্গো সুবিধার অপ্রতুলতা ও উচ্চ কার্গো খরচ, রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রাপ্তি অসুবিধা ও সরকারি নীতি সংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদি।
(৫) কৃষিপণ্য বিপণনের সম্ভাবনা
- বাংলাদেশের জমি খুবই উর্বর। এ দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে সত্য। তবে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। কাজেই উর্বর জমিতে কৃষকরা জমির পরিমাণ না বাড়িয়েই ভালো চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে সামগ্রিক উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
- কৃষকের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঋণসুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রেও কৃষকগণ সরকারি ও এনজিও পর্যায়ে অনেক প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। ফলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার ঘটছে।
- প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠছে। কাজেই তাদের পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেক বিকল্প পন্থা থাকায় তারা দেখেশুনে সুযোগ-সুবিধামতো পণ্য বিক্রয় করতে পারছে। অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠায় পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে তাদের মূলধন বেশি বেশি হাতবদল হওয়ায় মোট লাভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- প্রক্রিয়াজাতকারীর জন্য সম্ভাবনা হচ্ছে একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং জনগণের আয় বাড়ায় তাদের ভোগের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া জনগণের রুচির পরিবর্তন আসায় এবং সুপার স্টোরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রক্রিয়াজাতকৃত এবং প্যাকেটজাতকৃত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে (যেমন- প্রক্রিয়াজাতকৃত মসলা)।
- মোড়কীকরণ প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় প্রক্রিয়াজাতকৃত সামগ্রীর সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে প্রক্রিয়াজাত দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিক বিপণন দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- রপ্তানি ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়াজাতকৃত কৃষিপণ্য ও ফলমূলের একটি বিশাল বাজার আছে। কাজেই এ জাতীয় ফসলের রপ্তানি বৃদ্ধি করে মূল্যবান বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
(৬) কৃষি বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নে করণীয়
ভোক্তার হাতে সহজে পণ্য পৌঁছে দিতে বিপণন ব্যয় হ্রাস বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নে করণীয় প্রধান কাজসমূহ হলো-
- কৃষিপণ্য খামার থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বাজারসমূহে যাতে সহজে স্বল্প ব্যয়ে প্রেরণ করা যায় সেজন্য পল্লী এলাকায় পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। গ্রামের লোকজন সড়ক ও নৌ-পরিবহনের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল বলে এ দুই প্রকার পরিবহনের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে এদের উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত। রাস্তাঘাটসমূহ এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে গ্রামের সাথে মফদ্বল শহরগুলোর সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হতে পারে।
- গ্রাম পর্যায়ে বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ সুবিধার সম্প্রসারণ ঘটলে পণ্যের অপচয় হ্রাস পাবে। আর পণ্যাগার রসিসের ভিত্তিতে কৃষকদের ঋণ সরবরাহের সুবিধা প্রদান করলে তারা মৌসুমে স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রয় না করে গুদামজাত করে রাখতে সক্ষম হবে। ফলে বিপণন ব্যবস্থা দক্ষতর হবে।
- কৃষিপণ্যের বিপণনে অগণিত সংখ্যক মধ্যস্থকারবারির তৎপরতা হ্রাস করে বিপণনে দক্ষতা আনয়নের উদ্দেশ্যে সমবায়ভিত্তিক বিপণন দল অধিক সংখ্যায় গঠন করে উৎপাদকদের সংগঠিত করতে হবে এবং দলগত বিপণনের মাধ্যমে কৃষকদের সাথে ব্যবহারকারীদের বা ভোক্তার বিপণন যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে।
- যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হলে কৃষকরা দূরবর্তী বাণিজ্য কেন্দ্রে গিয়ে পণ্য পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে সক্ষম হবে বলে তখনও কয়েক ধরনের মধ্যস্থকারবারি কটন প্রণালি থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
- উৎপাদক এবং ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির স্বার্থেই সমগ্র দেশব্যাপী একই প্রকার /মানের ভিত্তিতে পণ্য পর্যায়িতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ওজন ও পরিমাপে ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের যাতে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য স্ট্যান্ডার্ড ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। সারা দেশে মেট্রিক পদ্ধতি বাধ্যতামূলকভাবে প্রবর্তন করে ওজনে কারচুপি নিরসন করা অনেকটা সম্ভব।
- মধ্যস্থকারবারি ও ব্যবসায়ীগণ কর্তৃক উৎপাদক-বিক্রেতাদের নিকট থেকে অননুমোদিত মার্কেট চার্জ ও অতিরিক্ত টোল আদায়সহ অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রকার বাটা বা এলাউন্স গ্রহণ করার প্রথা সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
- কৃষকদের নিয়মিতভাবে বাজার তথ্য সরবরাহের জন্য বাজার সংবাদ কর্মসূচি ব্যাপক আকারে গ্রহণ করতে হবে এবং বেশি সংখ্যক কৃষিপণ্য সম্পর্কে যাতে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা যায় সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে যত্নবান হতে হবে।
- কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের সময়োপযোগী বাজার তথ্য প্রদান।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।