Skip to content

 

সেচ ব্যবস্থাপনা

সেচ ব্যবস্থাপনা

(১) সেচের প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি জমিতে পানির ঘাটতি হলে সেচ না দিলে ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। কিন্তু এই সেচের পানিরও অপচয় হয়। সেচের পানির উৎস ভূনিম্নস্থ হোক অথবা ভূউপরিস্থ হোক, সবই কোনো না কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এতে কৃষকের শ্রমের ব্যয় হয় এবং অর্থেরও ব্যয় হয়। তাই কোনোভাবেই সেচের পানির অপব্যয় বা অপচয় যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ সেচের পানির অপচয় রোধ করার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়।

বিভিন্নভাবে সেচের পানির অপচয় হয়। কীভাবে সেচের পানির অপচয় হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

  1. বাষ্পীভবন
  2. পানির অনুস্রবণ
  3. পানি চুয়ানো

বাষ্পীভবন: সূর্যের তাপে প্রতিনিয়ত খাল-বিল, নদী-নালা থেকে যেমন পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে তেমনি ফসলের জমির সেচের পানিও বাষ্পীভূত হচ্ছে। পানির এই বাষ্পীভবন রোধ করা কঠিন ব্যাপার। তবে সময়মতো এবং পরিমাণমতো পানি সেচ দিতে হবে যাতে ফসল নিজ প্রয়োজনে পানি গ্রহণ করতে পারে।

পানির অনুস্রবণ: সেচের পানি মাটির স্তর ভেদ করে সোজাসুজি নিচের দিকে চলে যাওয়াকে পানির অনুস্রবণ বলা হয়। অনুস্রবণের মাধ্যমে সেচের পানির অনেক অপচয় হয়। সেচের নালায় বা জমিতে শক্ত স্তর না থাকলে সহজেই পানির অনুসরণ ঘটে। অতএব, নালা বা জমিতে শক্ত স্তর সৃষ্টি করে পানির অনুস্রবণ রোধ করা যায়।

পানি চুয়ানো: পানি চুয়ানো পানির অনুস্রবণের অনুরূপ। শুধু পার্থক্য হলো অনুস্রবণের মাধ্যমে পানি নিচে চলে যায়। আর চুয়ানোর মাধ্যমে পানি অন্য ক্ষেতে চলে যায়। অনেক ইঁদুর আইলের এপাশ-ওপাশ গর্ত করে। ইঁদুরের গর্তের মাধ্যমেও পানি চুইয়ে অন্যত্র চলে যায়। অতএব, শক্ত মাটি দ্বারা এমনভাবে ক্ষেতের আইল ও নালা করতে হবে যেন পানি চুইয়ে না যায়। জমিতে ইঁদুর যাতে গর্ত করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে পারলে পানি চুয়ানো কমে যাবে।

(২) সেচের কার্যকারিতা বৃদ্ধি

ফসলের প্রয়োজনের সময় সেচ দিলে সেচের পানির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। সেচের পানির কার্যকারিতা বৃদ্ধির প্রযুক্তিসমূহ উল্লেখ করা হলো-

  1. পরিমাণমতো পানি সেচ দিতে হবে।
  2. সময়মতো পানি সেচ দিতে হবে।
  3. জমির চারদিকে ভালোভাবে আইল বেঁধে সেচ দিতে হবে।
  4. বিকেলে বা সন্ধ্যাবেলা পানি সেচ নিতে হবে।
  5. সারিবদ্ধ ফসলের ক্ষেতে দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানে পানি সেচ দিতে হবে।
  6. মাটির বুনট বিবেচনা করে সেচ প্রদান করতে হবে।
  7. সেচ নালা ভালোভাবে মেরামত করে সেচ দিতে হবে অথবা পাকা সেচ নালা তৈরি করতে হবে।
  8. উপযুক্ত পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে।
  9. সেচ নালা ফসলের দিকে ঢালু করে তৈরি করতে হবে।
  10. ইঁদুরের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।
  11. মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে।

(৩) বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সেচ প্রকল্প

বাংলাদেশের প্রধান সেচ প্রকল্প কৃষকের কৃষিকাজের সুবিধার জন্য বাংলাদেশের সরকার অনেকগুলো সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। যেসব এলাকায় সেচ প্রকল্প আছে সেসব এলাকার কৃষকেরা সারা বছর আউশ, আমন, বোরো, পাট, গম, আলু, শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করছেন। আবার শস্য বহুমুখীকরণ কৃষি পদ্ধতিও চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধান সেচ প্রকল্পগুলোর নাম নিচে উল্লেখ করা হলো-

  1. গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জি.কে. প্রজেক্ট)
  2. বরিশাল সেচ প্রকল্প (বি.আই.পি)
  3. ভোলা সেচ প্রকল্প
  4. ঠাকুরগাও গভীর নলকূপ সেচ প্রকল্প
  5. চাঁদপুর সেচ প্রকল্প (সি.আই.পি)
  6. মুহুরী সেচ প্রকল্প (এম.আই.পি)
  7. পাবনা সেচ এবং পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (পি.আই.আর.ডি.পি)
  8. মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প
  9. কর্ণফুলী সেচ প্রকল্প (কে.আই.পি)

(৪) সেচ পদ্ধতি

বিভিন্নভাবে জমিতে পানি সেচ দেওয়া যায়। কীভাবে পানি সেচ দেওয়া হবে তা নির্ভর করে জমির মাটির একর ভূমির প্রকৃতি, পানির উৎস, ফাদের ধরন ইত্যাদির উপর। 

নিচে কয়েকটি সেচ পদ্ধতির নাম উল্লেখ করা হলো-

  1. প্লাবন সেচ
  2. নালা সেচ
  3. বর্ডার সেচ
  4. বৃত্তাকার সেচ
  5. ফোয়ারা সেচ

প্লাবন সেচ: এই পদ্ধতিতে সমতল জমিতে খাল, বিল বা পুকুর হতে আাসা পানি দিয়ে প্রধান নালার সাহায্যে সেচ দেওয়া হয়। সেচের পানি যাতে আাশেপাশের জমিতে যেতে না পারে সেজন্য জমির চারদিকে লাইল বাঁধতে হয়। 

চিত্র- প্লাবন সেচ
চিত্র- প্লাবন সেচ

এভাবে সেচ দিলে-

  1. অল্প সময়ে অধিক জমিতে সেচ দেওয়া যায়।
  2. জমির মধ্যে নাগার দরকার হয় না।
  3. সমতল জমির জন্যে প্লাবন সেচ কার্যকর।
  4. শ্রম ও সময় উত্তরই কম লাগে।
  5. রোগ ফসল বা শস্য ছিটিয়ে বেনা জমিতে প্লাবন সেচ কার্যকর হয়।
  6. জমি যদি ঢালু হয় তবে আইল বেঁষে পানি আটকাতে হয়।

নালাসেচ: নালাসেচ পদ্ধতিতে জমির চাষ অনুযায়ী ভূমির বন্দুরতা বা উঁচু নিচু সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাল তৈরি করা হয়। অতঃপর প্রধান নালার সাথে জমির এ নালাগুলোর সংযোগ করে সেচ দেওয়া হয়। নাগর গভীরতা ও দৈর্ঘ্যজমির উঁচু নিচুর উপর নির্ভর করে। জমি সমতল হলে নাগার দৈর্ঘ্য বেশি হবে আর জমির চাল বেশি হলে দৈর্ঘ্য কম হবে।

চিত্র- নালা সেচ
চিত্র- নালা সেচ

এভাবে সেচ দিলে-

  1. সেচের পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয় ও জলাবদ্ধতার তর থকে না।
  2. সমস্ত জমি সমানভাবে ভিজানো যায়।
  3. পানির অপচয় কম হয়।
  4. মাটির কম হয়।
  5. একই পরিমাণ পানি যক্ষ জমিতে সেচ দেওয়া যায়।

বর্ডার সেচ: বর্ডার সেচ পদ্ধতিতে জমির ঢাল ও বন্ধুরতা অনুযায়ী ফসলের জমিকে কতগুলো খণ্ডে বিভক্ত করা হয়। প্রধান নালা থেকে জমির খণ্ডগুলোতে পানি সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি খণ্ডে প্রধান নালা থেকে পানি প্রবেশের পর আছে। একটি খণ্ডে পানি সেচ দেওয়া হলে এর প্রবেশপথ বন্ধ করে পরবর্তী খণ্ডে পানি সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে অতিরি পানি নিষ্কাশনেরও ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ জমি থেকে ভালের দিকে নালা কেটে পানি নিকাশ করা হয়।

চিত্র- বর্ডার সেচ
চিত্র- বর্ডার সেচ

এই পদ্ধতিতে সেচ দিলে-

  1. পানি ব্যবস্থাপনা সহ হয়।
  2. পানির অপচয় হয় না।
  3. মাটির ক্ষয় কম হয়।

বৃত্তাকার সেচ: এই সেচ পদ্ধতিতে সমস্ত জমিতে সেচ না নিয়ে শুধু যে স্থানে গাছ রয়েছে সেখানেই পানি সরবাহ করা হয়। সাধারণত বহুবর্ষজীবী ফলগাছের গোড়ায় এই পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া হয়। ফল বাগানের মাঝ বরাবর একটি প্রধান নালা কাটা হয়। অতঃপর প্রতি গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার নালা কাটা হয় এবং প্রধান নালার সাথে সংযোগ দেওয়া হয়।

চিত্র- বৃত্তাকার সেচ
চিত্র- বৃত্তাকার সেচ

এই পদ্ধতিতে সেচ দিলে-

  1. পানির অপচয় হয় না।
  2. পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

ফোয়ারা সেচ: ফসলের জমিতে বৃষ্টির মতো পানি সেচ দেওয়াকে ফোয়ারা সেচ বলে। শাক-সবজির ক্ষেতে এই পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে বীজতলায় কিবো চারা গাছে ঝাঝরি নিয়ে যে সেচ দেওয়া হয় তাও কোয়ারা সেচ।

চিত্র- ফোয়ারা সেচ
চিত্র- ফোয়ারা সেচ

(৫) সেচের অতিররিক্ত পানি নিষ্কাশন

পরিমিত পানি সেচ যেমন ফসলের জন্য ভালো তেমনি অতিরিক্ত পানি ফসলের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করাকেই পানি নিষ্কাশন বা পানি নিকাশ বলে।

ফসলের জমিতে জমে থাকা পানি অধিকাংশ ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ধানের জমিতে পানি জমে থাকা উপকারী হলেও পেঁপে গাছ জমে থাকা পানি সহ্য করতে পারে না। ফসলের জমিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় ধরে গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছ মারা যায়। আবার পানি জমে থাকা ফসলের জমি থেকে পানি নিকাশ না করা পর্যন্ত সেখানে বীজ বপন করা যায় না, চারা রোপণ করা যায় না এবং গাছও লাগানো যায় না। সুতরাং পানির অভাব হলে গাছে পানি নিতে হবে। জমিতে বৃষ্টির পানি জমে থাকলে কিংবা সেচের পানি বেশি হলে অতিরিক্ত পানি তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে হবে।

অতিরিক্ত পানি ফসলের ক্ষেতে জমে থাকলে কী কী ক্ষতি হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

  1. মাটিতে ফসলের শিকড় এলাকায় বায়ু চলাচলের বিঘ্ন ঘটে। ফলে অক্সিজেনের অভাবে শিকড় তথা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
  2. দীর্ঘদিন পানি জমে থাকার ফলে মাটির বন্ধ পরিসর পানি পূর্ণ হয়ে পড়ে এতে অক্সিজেন শূন্য হয়ে ফসলের শিকড় পঁচে গাছ মারা যায়।
  3. উপকারী অণুজীবের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অন্যদিকে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের সংখ্যা ও সংক্রমণ বাড়ে।
  4. কোনো কোনো পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা কমে যায়।

পানি নিকাশের উদ্দেশ্য হলো-

  1. মাটিতে বায়ু চলাচল বাড়ানো।
  2. গাছের মূলকে কার্যকরী করা।
  3. উপকারী অণুজীবের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।
  4. মাটির তাপমাত্রা সহনশীল মাত্রায় আনা।
  5. মাটিতে ‘জো’ আনা।
চিত্র- নালা পদ্ধতি দ্বারা পানি নিষ্কাশন
চিত্র- নালা পদ্ধতি দ্বারা পানি নিষ্কাশন
চিত্র- পাকা সেচ নালা যারা পানি নিষ্কাশন
চিত্র- পাকা সেচ নালা যারা পানি নিষ্কাশন

পানি নিকাশের জন্য নিচের ব্যবস্থাগুলি নেওয়া যায়-

  1. কাঁচা নিকাশ নালা তৈরি করা।
  2. পাম্পের সাহায্যে নিকাশ করা।
  3. পাকা সেচ নালা তৈরি করা।
  4. অতিরিক্ত পানির উৎসমুখে বাঁধ দেওয়া।
  5. পানির গতি পরিবর্তন নালা তৈরি করা।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page