উদ্ভিদ তার বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টির জন্য মাটি, বায়ু ও পানি থেকে কতগুলো উপাদান শোষণ করে। এ উপাদানগুলোর অভাবে উদ্ভিদ সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারে না। তাই লাভজনকভাবে অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য এ পুষ্টি উপাদানগুলো সার হিসেবে প্রয়োগ করে এদের অভাব পূরণ করা হয়। এ উপাদানগুলোকেই উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান বলে।
এ পুষ্টি উপাদানগুলোর অভাবজনিত লক্ষণ অন্য কোনো পুষ্টি উপাদান দ্বারা পূরণ করা যায় না। তাই এ পুষ্টি উপাদানগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান বলে।
এখানে আমরা উউদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কয়টি? উদ্ভিদের মুখ্য পুষ্টি উপাদান কয়টি কয়টি এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান কয়টি ও কি কি? উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ও কাজ এবং উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে জানব।
এখানে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের শ্রেণিবিভাগ, কাজ, অভাবজনিত লক্ষণ এবং পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
(১) উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কয়টি? উদ্ভিদের মুখ্য পুষ্টি উপাদান কয়টি এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান কয়টি ও কি কি?
উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কয়টি: উদ্ভিদের মোট পুষ্টি উপাদান ১৭টি।
উদ্ভিদের গ্রহণমাত্রার উপর ভিত্তি করে এ পুষ্টি উপাদানগুলোকে ২টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
ক) উদ্ভিদের মুখ্য পুষ্টি উপাদান কয়টি ও কি কি: উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য এ পুষ্টি উপাদানগুলো অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। মুখ্য পুষ্টি উপাদান ৯টি যথা- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার।
খ) উদ্ভিদের গৌণ পুষ্টি উপাদান কয়টি ও কি কি: উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য এ পুষ্টি উপাদানগুলো অল্পমাত্রায় প্রয়োজন হয়। গৌণ পুষ্টি উপাদান ৮টি। অল্পমাত্রায় ব্যবহৃত হলেও উদ্ভিদের জীবন রক্ষার জন্য এই উপাদানগুলো অত্যাবশ্যক যথা- লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, তামা, দস্তা, বোরন, ক্লোরিন, কোবাল্ট।
উদ্ভিদ ২টি উৎস থেকে ১৭টি পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। যথা- প্রাকৃতিক উৎস ও কৃত্রিম উৎস।
ক) উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের প্রাকৃতিক উৎস: মাটি, বায়ু ও পানি এ তিনটি হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস।
- মাটি: কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন ব্যতীত বাকি ১৪টি পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদ মাটি থেকে পেয়ে থাকে।
- বায়ু: উদ্ভিদ কার্বন ও অক্সিজেন বায়ু থেকে গ্রহণ করে।
- পানি: উদ্ভিদ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পানি থেকে পায়। এছাড়াও উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত খনিজ পদার্থও গ্রহণ করে।
খ) উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের কৃত্রিম উৎস: জৈব সার ও রাসায়নিক সার হচ্ছে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের কৃত্রিম উৎস।
- জৈব সার: উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের সবগুলোই জৈব সারে পাওয়া যায়। গোবর, কম্পোস্ট, আবর্জনা, খড়কুটা ও আগাছা পচিয়ে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- রাসায়নিক সার: ইউরিয়াতে নাইট্রোজেন, টিএসপিতে ফসফরাস, এমওপিতে পটাশিয়াম এবং জিপসামে ক্যালসিয়াম ও সালফারের প্রাধান্য থাকে। এছাড়া জিঙ্ক সালফেটে জিঙ্ক ও সালফার থাকে।
(২) উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ও কাজ
উদ্ভিদের জীবনচক্রে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন কাজ করে থাকে। নিচে উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুষ্টি উপাদানের কার্যাবলি বর্ণনা করা হলো।
উদ্ভিদে নাইট্রোজেন এর কাজ-
- গাছকে ঘন সবুজ রাখে;
- গাছের পাতা, কাণ্ড ও ডালপালার বৃদ্ধি ঘটায়;
- অধিক কুশি সৃষ্টিতে সহায়তা করে;
- শিকড় বিস্তারে সহায়তা করে।
উদ্ভিদে ফসফরাস এর কাজ-
- উদ্ভিদের শিকড় মজবুত করে;
- সময়মতো ফুল ফোটায় ও ফসল পাকায়;
- ফসলের গুণগত মান বাড়ায়।
উদ্ভিদে পটাশিয়াম এর কাজ-
- শক্ত ও মজবুত কাণ্ড গঠনে সহায়তা করে;
- উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়;
- উদ্ভিদের পাতা, কাণ্ড ও ফলের বৃদ্ধি সমুন্নত রাখে;
- গাছের শিকড় বৃদ্ধি করে;
- দানা জাতীয় শস্যের দানা পুষ্ট করে।
উদ্ভিদে গন্ধক (সালফার) এর কাজ-
- তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে;
- শিম জাতীয় ফসলের মূলে নাইট্রোজেন গুটি (নডিউল) উৎপাদনে সাহায্য করে;
- শিকড় বৃদ্ধি ও বীজ উৎপাদনে সহায়তা করে;
- গাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
উদ্ভিদে দস্তা (জিঙ্ক) এর কাজ-
- ফুল ও ফল উৎপাদনে সহায়তা করে;
- উদ্ভিদের সবুজ কণিকা (ক্লোরোফিল) গঠনে সাহায্য করে;
- দানা ও ফলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়ায়;
- বীজ গঠনে অংশগ্রহণ করে;
- পেঁয়াজ, মটর প্রভৃতি ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।
উদ্ভিদে লৌহ (আয়রন) এর কাজ-
- উদ্ভিদের সবুজ কণিকা (ক্লোরোফিল) গঠন করে;
- বীজ উৎপাদনে সহায়তা করে;
- ফসলের গুণগত মান বাড়ায়;
- বাঁধাকপি, শালগম, মুলা ইত্যাদির ফলন বৃদ্ধি করে;
- শিকড় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
উদ্ভিদে ক্যালসিয়াম এর কাজ-
- উদ্ভিদের মূল গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে;
- উদ্ভিদকোষকে শক্তি প্রদান করে;
- ডাল ফসলের ফলন বাড়ায়;
- ফল জাতীয় শস্যের কান্ড শক্ত করে;
- খাদ্যশস্যে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায়।
উদ্ভিদে ম্যাগনেশিয়াম এর কাজ-
- সালোকসংশ্লেষণে সহায়তা করে;
- ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে;
- চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরিতে সাহায্য করে;
- সবুজ রং রক্ষায় সহায়তা করে।
(৩) উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ
পুষ্টির অভাবে রোগাক্রান্ত হলে বিশেষ লক্ষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ তা প্রকাশ করে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ উল্লেখ করা হলো।
উদ্ভিদে নাইট্রোজেন এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- গাছের পাতা হালকা সবুজ থেকে শুরু করে হলুদ বর্ণ ধারণ করে;
- ফলন অনেক কম হয়;
- বীজ অপুষ্ট হয়;
- দানা জাতীয় ফসলের কুশি কম হয়;
- গাছের শিকড়ের বিস্তৃতি কম হয়;
- গাছের পাতা আগাম ঝরে পড়ে;
- বীজের আকৃতি ছোট হয়।
উদ্ভিদে ফসফরাস এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- বিটপ ও মূলের স্বাভাবিক বিকাশ হয় না;
- কোষ বিভাজনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়;
- গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না;
- পাতা কম হয়;
- আমিষের পরিমাণ কমে যায়;
- ফুলের সংখ্যা কমে যায়;
- ফলের আকার ছোট থাকে ও ফল ঝরে যায়।
উদ্ভিদে পটাশিয়াম এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়;
- পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বাড়ে;
- সালোকসংশ্লেষণের হার হ্রাস পায়;
- গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়;
- গাছের পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে;
- খরা সহ্য করার ক্ষমতাও কমে যায়।
উদ্ভিদে সালফার (গন্ধক) এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- গাছ খর্বাকৃতির হয়;
- পাতা ছোট ও বিবর্ণ হয়;
- ফসলের পরিপক্বতা বিলম্বিত হয়;
- কাণ্ড শুকিয়ে সরু হয়ে যায়;
- তেল জাতীয় শস্যের ফলন কমে যায়;
- ধান গাছের বেলায় নতুন পাতা হলদে হয়ে যায়;
- গাছের বৃদ্ধি ও কুশির সংখ্যা কমে যায়।
উদ্ভিদে জিংক (দস্তা) এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- ধান গাছের কচিপাতার গোড়া সাদা হয়ে যায়;
- গাছে ফুল ফুটতে ও ফল ধরতে বিলম্ব হয়;
- ভুট্টা, তুলা, কমলালেবু ইত্যাদি গাছের পাতার শিরার মধ্যবর্তী স্থানে বিবর্ণতা দেখা দেয়;
- পাতার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়;
- লেবু গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়;
- জমিতে কোথাও ধানের চারা বড় হয় এবং কোথাও ছোট হয়;
- উদ্ভিদের মূল ও কাণ্ডের অগ্রভাগ শুকিয়ে যায়।
উদ্ভিদে আয়রন (লৌহ) এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- কচি পাতার সবুজ রং বিবর্ণ হয়;
- প্রথমে পাতার দুই শিরার মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে সমগ্র পাতায় তা ছড়িয়ে পড়ে;
- গাছ খর্বাকৃতির হয়;
- সয়াবিন, কমলালেবু ও সবজি জাতীয় পাতায় পচন ধরে;
- ধানের বীজতলার চারার নতুন পাতা হলুদ হয়ে যায়।
উদ্ভিদে ক্যালসিয়াম এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- কচি পাতার অগ্রভাগের গঠন অস্বাভাবিক হয়;
- পাতার সবুজ রং বিবর্ণ হয়;
- পাতার কিনারায় এবং মাঝখানে হলদে বাদামি রং হয়;
- পাতা ছোট থাকে;
- গাছ খর্বাকৃতির হয়;
- ফুল ও ফলের ঝুড়ি ঝরে যায়;
- শিম জাতীয় ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
উদ্ভিদে ম্যাগনেসিয়াম এর অভাবজনিত লক্ষণ-
- পাতার দুই শিরার মধ্যবর্তী এলাকা হলুদ বর্ণ ধারণ করে;
- পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়;
- গাছের শাখা ও পাতার বোঁটা সরু হয়;
- নতুন পাতা হালকা সবুজ, খাটো এবং সরু হয়;
- শিমের পুরো পাতা হলুদ হয়ে যায়;
- ক্লোরোফিল উৎপাদন ব্যাহত হয়;
- গাছের শাখা ও পাতার বোঁটা সরু হয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, আমাকের এই আলোচনাটি এখানেই সমাপ্ত হেলো। আশা করি আমরা উক্ত আলোচনাটি থেকে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কয়টি? উদ্ভিদের মুখ্য পুষ্টি উপাদান কয়টি কয়টি এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান কয়টি ও কি কি? উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ও কাজ এবং উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণসমূহ জানতে ও বুঝতে পেরেছি। পোষ্ট ভঅলো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করবেন ও আপনার আমার মত প্রকৃতি ও উদ্ভদ প্রেণী ভাই/বোনদের উদ্দেশ্যে স্যেসাল মিডিয়াতে একটা শেয়ার করে দিবেন, যাতে করে তারাও জানতে ও উপকার পেতে পারে। আজকের মত এখানেই বিদায়, ধন্যবাদ।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।