গ্রামে কীভাবে মুরগি পালন করা হয় তা নিশ্চয়ই আমরা জানি। গ্রাম-বাংলায় সম্পূর্ণ মুক্ত বা ছাড়া অবস্থায় মুরগি পালন করা হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক খামারে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন করা হয়। আবার কেউ কেউ ঘেরাও করা জায়গার মধ্যে মুরগি পালন করে থাকে। নিচে মুরগি পালন পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো।
(১) মুরগির ঘর/বাসস্থান
ক) মুক্ত বা ছাড়া পদ্ধতিতে মুরগি পালন
- এ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ মুক্ত বা খোলা অবস্থায় মুরগি পালন করা হয়। অল্প সংখ্যক মুরগি পালনে এ পদ্ধতি খুবই সহজ ও জনপ্রিয়।
- বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে এ পদ্ধতিতে মুরগি পালন করা হয়। এ ক্ষেত্রে মুরগি সারাদিন বসতবাড়ির চারপাশে ঘুরে ফিরে নিজের খাদ্য নিজেই সংগ্রহ করে। এদেরকে বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবারও সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সন্ধ্যার সময় এরা নিজ বাসায় ফিরে আসে।
- এ ক্ষেত্রে বাসস্থানের জন্য তেমন খরচ হয় না। এ পদ্ধতিতে মুরগি পালনে খরচ কম। কারণ এখানে খাদ্য ও শ্রমিক লাগে না। বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালনে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করা লাভজনক।
খ) অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতিতে মুরগি পালন
- এ পদ্ধতিতে মুরগির জন্য নির্দিষ্ট ঘর থাকে। মুরগির ঘরের চারদিকে বেড়া বা দেয়াল দিয়ে অনেকখানি জায়গা ঘেরাও করা হয়। একে রান বলে। মুরগি সারাদিন এ জায়গায় চরে বেড়ায়।
- ঝড় ও বৃষ্টির সময় মুরগি ঘরে গিয়ে উঠে। তাছাড়া রাতে এরা ঘরে আশ্রয় নেয়।
- নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে থাকায় তারা প্রয়োজনমতো খাদ্য ও পানি পায় না। তাই এখানেও এদেরকে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করতে হয়। খাদ্য সরবরাহের কারণে এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ বেশি হয়ে থাকে।
- অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতিতে হাইব্রিড মুরগি পালন না করে উন্নত জাতের কাইওমি, অস্ট্রাল বা রোড আইল্যান্ড রেড জাতের মুরগি পালন করাই গুলো।
গ) আবদ্ধ পদ্ধতিতে মুরগি পালন
- এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় অনেক মুরগি ঘরের মধ্যে পালন করা হয়। এখানে ঘরকে মুরগি পালন উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়। একে মুরগির খামার বলে।
- সাধারণত আবদ্ধ পদ্ধতিতে মেঝেতে মুরগি পালন করা হয়। আবার অনেকে বাঁচায়ও মুরগি পালন করে থাকে। ঘরের মেঝে গেঁতসেঁতে হলে মাচায় মুরগি পালন করা যায়।
- বাণিজ্যিক মুরগি পালনে এ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ পদ্ধতিতে মুরগিকে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা হয়। তাই এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা খরচ বেশি এবং লাভও বেশি।
- উন্নত জাতের ডিম পাড়া মুরগি, ব্রয়লার ও লেয়ার হাইব্রিড মুরগি আবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করা হয়। এ ক্ষেত্রে অল্প জায়গায় একসাথে অনেক বেশি মুরগি পালন করা যায়।
(২) মুরগির খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা
মুরগির খাদ্য ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে অন্যতম প্রধান বিষয়। বসতবাড়িতে মুক্ত বা ছাড়া পদ্ধতিতে পালন করা মুরগি খাবারের বর্জ্য, ঝরা শস্য, পোকামাকড়, শাকসবজি ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। তাই এরা পরিমিত ও সুষম খাবার পায় না। বসতবাড়িতে উন্নত জাতের মুরগি পালন করলে সুষম খাদ্য না দেওয়া হলে প্রত্যাশিত ডিম ও মাংস পাওয়া যাবে না।
খামারে মুরগি পালনে মোট ব্যয়ের ৭০% খাদ্য বাবদ খরচ হয়। মুরগি প্রচুর পরিমাণ পানি পান করে। তাই মুরগির খামারে খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ।
ক) মুরগির পুষ্টি ও খাদ্য উপকরণ
মুরগির দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানগুলো হচ্ছে শর্করা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি। সুষম খাবারে মুরগির দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো উপস্থিত থাকে।
মুরগির পুষ্টির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন খাদ্য উপকরণের তালিকা নিচে দেওয়া হলো-
ক্রম | পুষ্টি উপাদান | খাদ্য উপকরণ |
১ | শর্করা | গম, ভুট্টা, চালের খুদ, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি ইত্যাদি। |
২ | আমিষ | শুঁটকি মাছের গুঁড়া, সয়াবিন মিল, তিলের খৈল, সরিষার খৈল ইত্যাদি। |
৩ | স্নেহ | সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। |
৪ | খনিজ | খাদ্য লবণ, হাড়ের গুঁড়া, ঝিনুক ও শামুকের গুঁড়া, ভিটামিন খনিজ মিশ্রণ। |
৫ | ভিটামিন | শাক-সবজি, ভিটামিন মিশ্রণ ইত্যাদি। |
৬ | পানি | টিউবওয়েল ও কূপের বিশুদ্ধ পানি। |
খ) মুরগির রেশন তৈরি
বাজারে বাণিজ্যিকভাবে মুরগির জন্য ৩ ধরনের খাদ্য পাওয়া যায়-
- লেয়ার মুরগির জন্য বাচ্চার রেশন,
- বাড়ন্ত মুরগির রেশন ও
- ডিম পাড়া মুরগির রেশন পাওয়া যায়।
ব্রয়লার মুরগির জন্য বাচ্চার ব্রেশন, বাড়ন্ত ব্রয়লার রেশন ও ফিনিশার রেশন পাওয়া যায়। তাই মুরগির বয়স ও উদ্দেশ্য অনুসারে রেশন তৈরি করে বা বাজার থেকে কিনে মুরগিকে খাওয়াতে হবে।
দানাদার খাদ্য উপকরণ দিয়ে মুরগির সুষম রেশন তৈরি করা হয়। রেশন তৈরির সময় প্রায় ৪৫-৫৫% গম ও ভুট্টা ভাঙা, চালের কুঁড়া ও গমের ভুসি ১৫-২০%, সয়াবিন মিল ও তিলের খৈল ১০-১৫%, পুঁটকি মাছের গুঁড়া ৬-১০%, হাড়ের গুঁড়া বা ঝিনুক-শামুকের গুঁড়া ২-৬% ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া রেশনে খাদ্য লবণ, ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ যোগ করতে হয়। রেশন তৈরির পর খাদ্য উপকরণ ভালোভাবে মিশ্রিত করতে হয়।
নিচে ডিম পাড়া মুরগির রেশন তৈরির একটি নমুনা দেওয়া হলো-
ক্রম | খাদ্য উপকরণ | শতকরা হার |
১ | গম ভাঙা ও ভুট্টা ভাঙা | ৪৭% |
২ | গমের ভুসি ও চালের গুঁড়া | ১৬% |
৩ | সয়াবিন মিল | ১০% |
৪ | তিলের খৈল | ১০% |
৫ | শুঁটকি মাছের গুঁড়া | ১০% |
৬ | ঝিনুক-শামুকের গুঁড়া | ৬% |
৭ | খাদ্য লবণ | ০.৫% |
৮ | ভিটামিন-খনিজ মিশ্রণ | ০.৫% |
মোট | = | ১০০ |
গ) খাদ্য ও পানি সরবরাহ
- প্রতিটি বাচ্চা মুরগি দিনে ১০-১৫ গ্রাম খাদ্য খায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
- বয়স্ক মুরগিকে দৈনিক প্রায় ১০০-১২০ গ্রাম খাদ্য এবং ২০০ মিলিলিটার জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি দিতে হয়।
- প্রতিদিন খাদ্যের পাত্র ও পানির পাত্র পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে।
(৩) মুরগির রোগ ব্যবস্থাপনা
মানুষের মতো পাখিদেরও বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। মানুষ ও পশুপাদির সাভাবিক স্বাস্থ্যের বিচ্যুতিকে রোগ বলা হয়।
শরীরের অস্বাভাবিক লক্ষণকে রোগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
রোগ ব্যবস্থাপনা বলতে এর প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারকে বোঝায়। প্রাথমিকভাবে বাহ্যিক লক্ষণ দেখে অসুস্থ মুরগি শনাক্ত করা যায়।
নিচে একটি অসুস্থ মুরগির লক্ষণ দেওয়া হলো-
- অসুস্থ মুরগি দগ থেকে আলাদা হয়ে যায়।
- মাটিতে বসে ঝিমাতে থাকে।
- খাদ্য ও পানি গ্রহণ কমে যায় বা ত্যাগ করে।
- মুরগির গায়ের পালকগুলো উসকো খুশকো দেখায়।
- পায়খানা বাতাবিক হয় না।
বিভিন্ন কারণে পাখির রোগ হয়ে থাকে। রোগের প্রধান কারণ জীবাণু। মুরগির ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ খুবই মারাত্মক। ভাইরাসজনিত রোগের চিকিৎসা নেই। তাই রোগ দেখা দিলে মুরগিকে আর বাঁচানো যায় না। তাছাড়া পরজীবীজনিত রোগ মুরগির অনেক ক্ষতি করে থাকে।
মুরগির ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে রক্ষার জন্য নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে। টিকা দেওয়ার পর ঐ রোগের বিরুদ্ধে মুরগির শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে। তাই বাড়ির বা খামারের সকল সুস্থ মুরগিকে একসাথে টিকা দিতে হয়।
নিচে মুরগির কতগুলো রোগের নাম দেওয়া হলো-
- ভাইরাসজনিত রোগ: রাণীক্ষেত, গামবোরো, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি
- ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: ফাউয়েল কলেরা, ফাউয়েল টাইফয়েড, গুলোরাম, যক্ষ্মা, বটুলিজম ইত্যাদি
- পরজীবীজনিত রোগ: মুরগির দেহের ভিতরে ও বাইরেদুই ধরনের পরজীবী দেখা যায়। দেহের বাইরে পালকের নিচে উকুন, আটালি ও মাইট হয়ে থাকে। দেহের ভিতরে গোল কৃমি ও কিতা কৃমি দ্বারা সুরগি বেশি আক্রান্ত হয়। এরা মুরগির গৃহীত পুষ্টিকর খাদ্যে ভাগ বসায়। অনেক কৃমি মুরগির শরীর থেকে রক্ত চুষে নেয়। তাছাড়া প্রায়ই মুরগির রক্ত আমাশয় হতে দেখা যায়। এ রোগটি প্রোটোজোয়া দ্বারা হয়ে থাকে।
গৃহপালিত পশু দীর্ঘদিন খামারে থাকে। তাই রোগ হলে এদের চিকিৎসা যারা সুস্থ করে পুনরায় উৎপাদনে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু বাণিজ্যিক মুরগির খামারে এটা সম্ভব হয় না। তাই মুরগির খামারে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে।
মুরগির খামারে রোগ প্রতিরোধে পদক্ষেপসমূহ-
- মুরগির ঘর ও এর চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা
- মুরগির খামারে বন্য পশুপাখিকে ঢুকতে না দেওয়া
- মুরগিকে সময়মতো টিকা দেওয়া
- মুরগিকে তাজা খাদ্য খেতে দেওয়া
- মুরগিকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা
- মুরগিকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করা
- মুরগির বিছানা শুষ্ক রাখার ব্যবস্থা করা
- মুরগির বিষ্ঠা খামার থেকে দূরে সরক্ষণ করা
মুরগির খামারে রোগ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রথমে একজন পশুচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে অতি দ্রুত নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত-
- অসুস্থ পাখিকে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা
- প্রয়োজন হলে পাখির মলমূত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করা
- মারাত্মক ভাইরাস রোগ হলে সকল মুরগিকে ধ্বংস করা
- মৃত মুরগিকে মাটির নিচে চাপা দেওয়া
- রোগাক্রান্ত মুরগি বাজারে বিক্রি না করা
- পশু ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মুরগিকে চিকিৎসা দেওয়া
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।