Skip to content

সেচ কি? সেচ কাকে বলে? সেচ পদ্ধতি কয়টি? কলস সেচ পদ্ধতি/প্রযুক্তির বর্ণনা

সেচ কি, সেচ কাকে বলে, সেচ পদ্ধতি কয়টি, কলস সেচ পদ্ধতি, প্রযুক্তির বর্ণনা

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মূল উপাদান হলো উন্নতমানের বীজ, সার ও সেচ প্রদান। সেচ ছাড়া উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদন করা যায় না।

বাংলাদেশে ১৯৬০-৬১ সালে শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল প্রায় মাত্র ৩.৫ লক্ষ হেক্টর। বর্তমানে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৫৪ লক্ষ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। ফলে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যেমন: রাস্তাঘাট নির্মাণ, হাট-বাজার স্থাপন, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, নগরায়ণ, শিল্পাঞ্চল সৃষ্টি, বসতবাড়ি তৈরি ইত্যাদি কারণে কৃষিজমি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই কম জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদনের স্বার্থে ফসলে সেচ প্রদান অপরিহার্য।

(১) সেচ কি? সেচ কাকে বলে?

সেচ কি: আমরা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন খাবার গ্রহণ করি। তেমনি জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদিরও খাবার প্রয়োজন হয়। ফসল মাটি হতে খাবার গ্রহণ করে। কিন্তু গাছপালা বা ফসল কঠিন খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। এরা পানির মাধ্যমে তরল খাবার গ্রহণ করে থাকে। সব ফসলের পানির চাহিদা এক নয়। তাই ফসলের ধরন, মাটিতে পানির পর্যাপ্ততা, আবহাওয়া বিবেচনা করে ফসলে কৃত্রিম উপায়ে পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এই কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করাই হলো সেচ।

সেচ কাকে বলে: উদ্ভিদের চাহিদা অনুযায়ী এর পরিপূর্ণ বৃদ্ধি, বিকাশ ও পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পানি মাটিতে সরবরাহ করাকে সেচ বলে।

(২) কখন, কী পরিমাণ সেচ দিতে হয়?

সব ফসলে একই পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয় না। আবার কোনো কোনো ফসলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেচ দিলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। গমে ২/৩ টি সেচ দিলে এর ফলন অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু ধানে অনেক বেশি সেচ দিতে হয়। এজন্য ধানকে পানিপ্রিয় ফসল (Water loving crop) বলা হয়। বর্ষাকালে ফসলে তেমন সেচ দিতে হয় না। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ধানে এর জীবনব্যাপী সেচ প্রদান করতে হয়। বোরো ধানের জীবনকালে ১২০ থেকে ১৪০ সেন্টিমিটার পানি প্রয়োজন হয়। গম ও ভুট্টায় যথাক্রমে ৩০-৪৫ ৪০-৫০ সেন্টিমিটার সেচ প্রদান করতে হয়।

See also  গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে ড্রিপ ফার্টিগেশন সেচ পদ্ধতিতে সার এবং পানি ব্যবস্থাপনা

(৩) সেচের পানির উৎস

পৃথিবী পৃষ্ঠের চারভাগের প্রায় তিনভাগই পানি, এ কথা আমরা সবাই জানি। এর পরেও খাদ্য উৎপাদনে এই পানি সুলভ নয়। পৃথিবীতে যে পরিমাণ পানি আছে তার প্রায় ৯৮% সমুদ্রে এবং প্রায় ২% বরফ আকারে মেরু অঞ্চলে ও পর্বতপৃষ্ঠে। পৃথিবীর মোট পানির তুলনায় খুব সামান্য অংশই গৃহস্থালি ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। 

সেচের পানির পানির উৎস ২টি। যথা-

  1. ভূপৃষ্ঠস্থ পানি;
  2. ভূগর্ভস্থ পানি।

আমাদের দেশে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির দ্বারা মোট সেচের মাত্র ২২% এবং ভূগর্ভস্থ পানির দ্বারা ৭৮% সেচ প্রদান করা হয়।

(৪) সেচ পদ্ধতি কয়টি?

পানির উৎস থেকে পানি উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যথা-

ক) সনাতন পদ্ধতি: যেমন- দোন, সেউতি ইত্যাদি।

খ) আধুনিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতি: এ পদ্ধতির আওতায় ফসলি জমিতে পানি সরবরাহ করার জন্য মনুষ্য শক্তির মাধ্যমে হস্তচালিত সেচযন্ত্র, ট্রেডলপাম্প, রোয়ার পাম্প ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব পাম্প দ্বারা খুব কম পানি উত্তোলন করা যায় বলে বেশি জমি এসব পাম্প দ্বারা সেচের আওতায় আনা যায় না। যান্ত্রিক সেচযন্ত্র ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠের এবং ভূগর্ভস্থ বেশি পরিমাণ পানি উত্তোলন করা যায়। ভূপৃষ্ঠের পানি উত্তোলনের জন্য লো-লিফট পাম্প বা শক্তি চালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য গভীর ও অগভীর সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ফসলি জমিতে সেচ প্রদান বা পানি সরবরাহের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

ফসলের ধরন, ফসলে পানির চাহিদা, মাটির ধরন, ভূমির বন্ধুরতা ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচ পদ্ধতিকে প্রধানত ৩ টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

ক) প্লাবন পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে সমতল ভূমিতে সেচ প্রদান করা হয়। বন্যার মতো ফসলি জমিতে পানি ভাসিয়ে দিয়ে সেচ দেওয়া হয় বলে একে প্লাবন পদ্ধতি বলে। ধানের জমিতে প্লাবন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

চিত্র- ধান ক্ষেতে প্লাবন পদ্ধতিতে চাষ
চিত্র- ধান ক্ষেতে প্লাবন পদ্ধতিতে চাষ

খ) স্প্রিংকলার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পাইপ ও স্প্রিংকলার নজেলের মাধ্যমে জমিতে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বৃষ্টির মতো পানি জমিতে পড়তে থাকে। যেসব ফসলে কম পানি প্রয়োজন হয় অথবা বেলে মাটিতে এই সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। গম ফসলে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকরি।

See also  অল্টারনেট ফারো সেচ পদ্ধতিতে টমেটো ও আলু চাষ
চিত্র- স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ উৎপাদন
চিত্র- স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ উৎপাদন

গ) ড্রিপ পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে বড় পাইপ থেকে ছোট ছোট ব্যাসযুক্ত পাইপের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। ছোট পাইপ হতে গাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেওয়া হয়। ফল বাগানে বা মূল্যবান ফসলে এ ধরনের সেচ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

চিত্র- ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি উৎপাদন
চিত্র- ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি উৎপাদন

(৫) কলস সেচ পদ্ধতি/প্রযুক্তির বর্ণনা

আমরা জানি আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৮টি জেলার প্রায় ১০ লক্ষ ৫৬ হাজার হেক্টর জমির মাটি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। কলস সেচ প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় শুকনো মৌসুমে ফসল উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

ক) কলস সেচ (Pitcher Irrigation ) প্রযুক্তির উদ্দেশ্য

  • মাটির লবণাক্ততার মাত্রা কমিয়ে ফসল চাষ।
  • অল্প পরিমাণে সেচের পানি ব্যবহার করে মাদা ফসল (কুমড়া, তরমুজ, উচ্ছে, ঝিংগা ইত্যাদি) উৎপাদন।
  • সেচের পানির অপচয় রোধ ও সুষম ব্যবহার।
  • উদ্ভিদের খাদ্য উপাদান গ্রহণে মাটিতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।

খ) কলস সেচ (Pitcher Irrigation) প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহ

  • কলস সেচ প্রযুক্তি মাদা ফসল যেমন: কুমড়া, তরমুজ, উচ্ছে, ঝিংগা ইত্যাদির জন্য উপযোগী।
  • যেসব এলাকায় শুকনো মৌসুমে নিরাপদ পানির পর্যাপ্ত উৎস থাকে না
  • যেসব এলাকায় পানি সেচের জন্য শ্রমিকের অভাব দেখা যায়।

গ) কলস সেচ (Pitcher Irrigation) প্রযুক্তির কার্যপ্রণালি

  1. একটি সাধারণ আকারের মাটির কলস সংগ্রহ করতে হবে।
  2. কলসের নিচে ড্রিল মেশিন দ্বারা বল পয়েন্ট কলমের আকারে (পরিধি আনুমানিক ২.২ সেমি) ছিদ্র করতে হবে এবং ঐ ছিদ্রে দেড়-দুই হাত লম্বা পাটের এক প্রান্ত শক্ত করে প্রবেশ করাতে হবে।
  3. পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে এমনভাবে বসাতে হবে যেন ছিদ্রগুলো ও পাটের আঁশ মাটির নিচে থাকে।
  4. কলসের চারপাশে ৩-৪টি বীজ বপন করতে হবে। তাহলে কলসের চারপাশে চারা গজাবে।
  5. কলসের ছিদ্রের সাথে সংযুক্ত পাট ধীরে ধীরে পানি বহন করে নিয়ে গাছের গোড়ায় সরবরাহ করবে। এতে মাদা সবসময় ভিজে থাকবে। ফলে মাটির নিচ স্তর থেকে মাদা এলাকায় (গাছের শিকড় সংলগ্ন এলাকায়) লবণযুক্ত পানি উঠে আসবে না এবং এর ফলে মাদা এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ কম থাকবে। সেই সাথে গাছ পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য উপাদান আহরণ করতে পারবে এবং গাছ সতেজ থাকবে।
See also  পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে সেচ ও মাল্চ প্রযুক্তির ব্যবহার
চিত্র- একটি সাধারণ আকারের মাটির কলস
চিত্র- একটি সাধারণ আকারের মাটির কলস
চিত্র- কলসের নিচে ছিদ্র করে ছিদ্রে পাটের দড়ি প্রবেশ করানো
চিত্র- কলসের নিচে ছিদ্র করে ছিদ্রে পাটের দড়ি প্রবেশ করানো

(কলসের নিচে ছিদ্র করে ছিদ্রে ডেড় দুই হাত লম্বা পাটের এক প্রান্ত শক্ত করে প্রবেশ করানো হয়েছে)

চিত্র-পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে বসানোর পর বীজ বপন  করা হচ্ছে
চিত্র-পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে বসানোর পর বীজ বপন  করা হচ্ছে
চিত্র-পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে বসানো
চিত্র-পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে বসানো

(পাটযুক্ত কলসটিকে মাদার মাঝখানে এমনভাবে বসানো হয়েছে এতে ছিদ্রগুলো ও পাটের আঁশ মাটির নিচে রয়েছে)

ঘ) অর্থনৈতিক হিসাব (ফসল-কুমড়া, জাত-সুইটি)

লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণায় দেখা গেছে কলস পদ্ধতিতে সেচকৃত একটি মাদা থেকে প্রায় ৩০ কেজি কুমড়া উৎপাদন সম্ভব। প্রতি কেজি কুমড়া ৮ টাকা কেজি দরে মাদাপ্রতি বিক্রয় মূল্য ২৪০ টাকা।

কলস, সার, কীটনাশক, পানি ও শ্রমিক খরচ মাদা প্রতি ১২৫ টাকা। অতএব মাদাপ্রতি লাভ (২৪০-১২৫) = ১১৫ টাকা। অন্যদিকে প্রচলিত সেচ পদ্ধতিতে সেচকৃত একটি মাদা থেকে প্রায় ১৮ কেজি কুমড়া উৎপাদন সম্ভব। প্রতি কেজি কুমড়া ৮ টাকা কেজি দরে মাদাপ্রতি বিক্রয়মূল্য ১৪৪ টাকা। সার, কীটনাশক, পানি ও শ্রমিক খরচ ৯৫ টাকা। এ ক্ষেত্রে মাদাপ্রতি লাভ (১৪৪-৯৫) = ৪৯ টাকা।

এছাড়া একটি কলস সাবধানে ব্যবহার করলে কমপক্ষে দুই বছর ব্যবহার করা সম্ভব। এ ধরনের সহজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ত এলাকার কৃষি উৎপাদনে এবং গ্রামীণ জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনয়ন সম্ভব।

চিত্র- মাদায় গাছ সতেজ হয়ে উঠছে
চিত্র- মাদায় গাছ সতেজ হয়ে উঠছে
চিত্র- ক্রমে সমগ্র খামার ফসলে ভরে উঠছে
চিত্র- ক্রমে সমগ্র খামার ফসলে ভরে উঠছে

প্রিয় পাঠক বন্ধু আশা করি উপরোক্ত আলোচনাটিতে থেকে সেচ কি, সেচ কাকে বলে, সেচ পদ্ধতি কয়টি, কলস সেচ পদ্ধতি বা প্রযুক্তি সম্পর্কে কিছু ‍তথ্য জানলাম। পরবর্তী আলোচনায় প্রতিটি সেচ পদ্ধতির বর্ণনা আলাদা আলাদা ভাবে তুলে ধরা হবে, ইংশাআল্লাহ। তত দিন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আমাদের সাথেই থাকুন, ধন্যবাদ।

কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts