আলু এক ধরনের কাজ যা মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে সব জেলাতেই কমবেশি আলুর আবাদ হয়, তবে উত্তরাঞ্চলের জেলা, যেমন- জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, রাজশাহীসহ যশোর ও মুন্সিগঞ্জ জেলায় আলু চাষ বেশি হয়। বর্তমানে সুষ্ঠু পরিকল্পনায় আলুর জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলুর ফলন বর্তমানে প্রায় ২০ টন/হেক্টর (২০১৪-২০১৫)।
প্রিয় পাঠক বন্ধু চলুন আমরা আলু চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিই-
(১) জাত নির্বাচন: এলাকা ও চাষের উদ্দেশ্যের উপর জাত নির্বাচন করতে হবে।
আগাম চাষের জন্য- বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-৩১ (সাগিটা), বারি আলু-২৯ (কারেজ)। খাবার আলু হিসেবে বারি আলু-৭ (ডায়মন্ড), বারি আলু-৮ (কার্ডিনাল), বারি আলু-২৫ (এক্সটেরিক্স), বারি আলু-৩৫, বারি আলু-৩৬, বারি আলু-৩৭, বারি আলু-৪০, বারি আলু-৪১।
প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য- বারি আলু-২৮ (পেডিরোসেটা), বারি আলু- ২১ (কারেজ) এবং রপ্তানির জন্য বারি আলু-১০ (গ্রানোলা), বারি আলু-৪০ (এ্যাটলাস)। মড়ক রোগ প্রতিরোধী জাত হলো বারি আলু-৪৬ ও বারি আলু ৫৩। বারি আলু ৪৮ ও বারি আলু ৬২ সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ উপযোগী।
(২) জমি নির্বাচন: বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য উত্তম।
(৩) জমি তৈরি: গরুর লাঙল, পাওয়ারটিলার/ ট্রাক্টর দ্বারা আড়াআড়িভাবে ৩ ৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করতে হবে।
(৪) রোপণ সময়: নভেম্বর মান আলু লাগানোর উপযুক্ত সময়। বীজ আলুর জন্য ১৫ই নভেম্বর এর মধ্যে বীজ রোপণ করা উত্তম। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আগাম আলু লাগানো যেতে পারে এবং মধ্যাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আলু লাগানো যাবে।
(৫) বীজের পরিমাণ: বিঘায় ২০০-২৫০ কেজি বীজ আলু প্রয়োজন।
(৬) বীজ তৈরি: আলু ফসলের জন্য ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের আন্ত আলু বীজ হিসেবে ব্যবহার করা উত্তম। কেটেও বীজ লাগানো যেতে পারে। প্রতিটি অংশে কমপক্ষে ২টি চোখ থাকতে হবে। বীজ লাগানোর ২ দিন পূর্বে আলু কেটে ছায়া স্থানে রেখে দিলে কাটা অংশের উপর একটা প্রলেপ পড়ে। পরিষ্কার ছাই মেখেও কাজটি করা যেতে পারে। এতে আলু পচন রোধ করা সম্ভব। আগাম আলুর ক্ষেত্রে অবশ্যই একটু ছোট আকারের আন্ত আলু লাগানো উত্তম।
(৭) রোপণ পদ্ধতি: ৬০×২৫ সে.মি. দূরত্বে আস্ত আলু এবং ৬০×১৫/১০ সে.মি. দূরত্বে কাটা আলু রোপণ করে আলুর উপর মাটি তুলে ভেলি বেঁধে দিতে হবে।
(৮) সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি:
সারের নাম | সারের পরিমান (প্রতি হেক্টরে) |
ইউরিয়া | ৩৪০ কেজি |
টিএসপি | ২১০ কেজি |
এমপি | ২৩৫ কেজি |
জিপসাম | ১১০ কেজি |
জিংক সালফেট | ৯ কেজি |
বোরন (প্রয়োজনবোধে) | ৭ কেজি |
গোবর | ১০ কেজি |
(৯) সার প্রয়োগ পদ্ধতি: গোবর ও জিংক সালফেট শেষ চাষের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরন সার রোপণের সময় বীজ রোপণ লাইনের উভয় পাশে ১০-১২ সে.মি. দূরে লাইন টেনে ব্যান্ড পদ্ধতিতে সার দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় প্রয়োগ করতে হবে। এতে সারের সঠিক প্রয়োগ হয়। সার প্রয়োগের পর সাথে সাথে সার ও বীজ মাটি দিয়ে ভেলি তুলে ঢেকে দিতে হবে।
সার প্রয়োগের নালা এবং বীজ আলু রোপণের সারির নকশা নিচে দেখানো হলো-
(১০) সেচ প্রয়োগ: বীজ রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পর সেচ দেওয়া উত্তম। মোট ২-৩টি সেচ প্রয়োগ করা প্রয়োজন হতে পারে (২০-২৫ দিনের মধ্যে স্টোলন বের হওয়ার সময়। ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে গুটি বের হওয়া পর্যন্ত এবং পরে আলু বৃদ্ধির সময়)। জমি থেকে আলু উঠানোর ৭-১০ দিন পূর্বে মাটি ভেদে সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
(১১) অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা: আলু লাগানোর ৩০-৩৫ এবং যদি আলু মাটি থেকে বেরিয়ে আসে তবে ৫৫-৬০ দিন পর গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া প্রয়োজন। মাটি তুলে দেওয়ার পূর্বে আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে।
(১২) রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন: নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও মেঘলা আকাশ আলুর জন্য ক্ষতিকর। এতে আলুর নাবি ধসা রোগ আক্রমণের আশঙ্কা দেখা যায়।
আলু ফসলকে আলুর নাবি ধসা রোগ প্রতিরোধ করার জন্য স্পর্শক (কন্ট্রাক্ট) ছত্রাকনাশক যেমন- ইন্ডোফিল/ডায়থেন এম ৪৫/ম্যানকোজেব/ইন্ডোফিল/মেলোডি ডুও/সিকিউর (২ গ্রাম/প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। জাবপোকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এডমায়ার ২০০ এসএল, ইমিটাফ ২০ এসএল এবং কনফিডেন্ট ২০০ এসএল ব্যবহার করতে হবে।
কাটুই পোকা আলুর কচি গাছ কেটে ফেলে এবং আলু ছিদ্র করে আলুর মান নষ্ট করে ফেলে। এই পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সকালে জমিতে গিয়ে কর্তিত চারার গোড়া খুঁড়ে কিড়াগুলো মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ তীব্র হলে প্রতি লিটার পানির সাথে ৫ মিলি ডারসবান ২০ ইসি জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে চারাগাছগুলির গোড়ায় মাটি ভিজিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করে কাটুই পোকা দমন করা যায়।
(১৩) ফসল সংগ্ৰহ: জাতভেদে আলু লাগানোর ৮০-১০০ দিনের মধ্যে উত্তোলন করা যায়। আলু উত্তোলনের পর পরই বাড়িতে নিয়ে আসা উত্তম।
(১৪) ফলন: জাতভেদে আলুর বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.০ টন ফলন পাওয়া যায়।
(১৫) আলু সংরক্ষণ: আলু সংগ্রহের সাথে সাথে কাটা ও পচা আলু বাদ দিয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় সাত দিন কিউরিং করতে হবে। পরে বস্তায় ভরে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া ঠাণ্ডা জায়গায় ঢেলে রেখে দুই তিন মাস পর্যন্ত কৃষক নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।