আজকের এই আলোনাটিতে আমরা ক্ষুদ্র সেচ কী, সেচের গুরুত্ব, ক্ষুদ্র সেচের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সেচ দক্ষতা কাকে বলে? প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অবগত হব।
তো চলু শুরু করি-
আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫% প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং তারাই এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
কৃষির উন্নতি তথা খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ অন্যতম প্রধান উপকরণ।
কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে সেচের কোনো বিকল্প নেই। সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের নিবিড়তা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সুপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের কৃষকরা কোনো না কোনোভাবে ফসলে সেচ দিয়ে আসছে। বৃষ্টিনির্ভর কৃষির সাথে সনাতন সেচ পদ্ধতির মধ্যে ‘দোন’ এবং ‘সেউতি’ ছিল প্রধান। ষাটের দশকের প্রথম দিকে এ দেশে সেচযন্ত্র এবং সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়।
বর্তমানে দেশে দুই ধরনের সেচ ব্যবস্থাপনা চালু আছে, বৃহৎ সেচ ও ক্ষুদ্র সেচ।
বাংলাদেশের সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ৭.৬ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে সেচযোগ্য জমির প্রায় ৭১% এলাকা শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় এসেছে। বোরো মৌসুমে (ডিসেম্বর-মে) দেশের সেচকৃত জমির প্রায় ৯৫% এলাকা ক্ষুদ্র সেচ এবং অবশিষ্ট ৫% এলাকা বৃহৎ সেচ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
(১) ক্ষুদ্র সেচ কী?
কৃষি উৎপাদন আধুনিকীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সেচ কার্যক্রমে সমন্বয়, দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা, পানির অপচয় রোধ, সেচ খরচ হ্রাস ও অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার নিমিত্ত সাধারণত স্বল্প এলাকা নিয়ে যে সকল সেচ স্কিম এককভাবে গঠিত হয়, তাই ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প। যে ব্যবস্থাপনায় এ সকল প্রকল্প পরিচালিত হয়, তাই ক্ষুদ্র সেচ।
খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বরোপিট ইত্যাদি জলাশয়, পাহাড়ি ছড়ার প্রবাহমান ও জোয়ার-ভাটার ভূপরিস্থ পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি ক্ষুদ্র সেচের উৎস হিসেবে বিবেচিত। ক্ষুদ্র সেচের আওতায় সর্বোচ্চ ১০০০ হেক্টর পর্যন্ত জমি নিয়ে সেচ নিয়ন্ত্রণ এলাকা গঠিত হতে পারে।
(২) সেচের গুরুত্ব
ফসলে সেচ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি। উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয় যা মূলরোমের সাহায্যে মাটি থেকে শোষণ করে। এ জন্য মাটিতে পানি অত্যাবশ্যক।
বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বিধায় এ মৌসুমে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোনো সময় হঠাৎ করে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। ফলে ফসলের খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এতে উদ্ভিদ একসময় নেতিয়ে পড়ে এবং বেশি দিন পানিশূন্যতা হলে গাছ মারা যায় বা কোনো ফলন হয় না।
নিম্ন বর্ণিত এক বা একাধিক উদ্দেশ্যে সেচ প্রদান করা হয়ে থাকে-
- উদ্ভিদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করা;
- জমির মাটি কর্দমাক্ত করা;
- স্বল্প বা দীর্ঘ খরার হাত থেকে ফসল রক্ষা করা;
- লবণাক্ত অঞ্চলে মাটির লবণ ধৌত করে এর মাত্রা কমানো:
- পরিবেশকে শীতল রাখা;
- প্রচণ্ড ঠাণ্ডার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করা।
(৩) ক্ষুদ্র সেচের আধুনিক যন্ত্রপাতি
ভূপরিস্থ বা ভূগর্ভস্থ উৎস হতে সেচের জন্য পানি উত্তোলনে যে যন্ত্রটি মূল ভূমিকা পালন করে তাকে পাম্প বলা হয়। বিভিন্ন প্রকারের পাম্প সেচকাজে ব্যবহৃত হয়।
ক্ষুদ্র সেচে সাধারণত তিন ধরনের সেচযন্ত্র ব্যবহৃত হয়-
- লো-লিফট পাম্প
- গভীর নলকূপ
- অগভীর নলকূপ
এ ধরনের সেচযন্ত্রের প্রতিটিতেই পাম্প ব্যবহৃত হয়। পাম্পকে নির্দিষ্ট গতিতে (আরপিএম) ঘুরালে পানির উৎস থেকে পাইপ-এর মাধ্যমে উপরে উঠে সেচনালায় বা জমিতে নির্গত হয়।
লো-লিফট পাম্প ও অগভীর নলকূপে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প ব্যবহৃত হয়। এ পাম্প পাইপকে বায়ুশূন্য করে বাতাসের চাপকে ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করে। ফলে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে ৩৪ ফুট এবং ব্যবহারিকভাবে ২০ থেকে ২২ ফুটের অধিক গভীর থেকে পানি উত্তোলন করা যায় না।
কিন্তু গভীর নলকূপে টারবাইন পাম্প ব্যবহার করা হয়। যা ভূগর্ভে পানির নিচে স্থাপন করা হয়। এ পাম্প পানিকে ঠেলে উপরে উঠায়। এ জন্য অনেক নিচ থেকে এ পাম্প দ্বারা পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয়।
যে সকল জায়গায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিদ্যমান সে সব এলাকায় গভীর নলকূপে বর্তমানে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহৃত হচ্ছে। সাবমার্সিবল পাম্প বৈদ্যুতিক মোটরের সাথে একসঙ্গে সংযোগ করে পানির নিচে স্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক লাইনের সুইচ অন করার সাথে সাথে পানি উপরে উঠতে থাকে, যেখানে কোনো যন্ত্র দেখা বা কোনো শব্দ শোনা যায় না।
আমাদের দেশে লো- লিফট পাম্পের সাহায্যে সাধারণত ২৮ লিটার/সেকেন্ড বা ৫৬ লিটার/সেকেন্ড পানি উত্তোলন করা হয়ে থাকে। এ দ্বারা যথাক্রমে ১০-১২ হেক্টর ও ২০-২৪ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা যায়।
অগভীর নলকূপ সাধারণত ১৪ লিটার/সেকেন্ড ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। একটি অগভীর নলকূপ দ্বারা ৫ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা যায়।
গভীর নলকূপ সাধারণত ৫৬ লিটার/সেকেন্ড ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে, যা দ্বারা ২৪ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা যায়।
(৪) সেচ দক্ষতা কাকে বলে?
সেচকাজে যে পানি উত্তোলন করা হয় তা পুরোপুরি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এ জন্য উত্তোলিত পানির এক বিরাট অংশ বিভিন্নভাবে অপচয় হয়। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পানি উৎস থেকে উত্তোলন করা হয়ে থাকে। ফলে ভূ-উপরিস্থ পানি শুকিয়ে যায় এবং ভূগর্ভস্থ পানি অনেক নিচে চলে যায়। পানি নিচে চলে গেলে তা উত্তোলন করতে অধিক শক্তির প্রয়োজন হয়। ফলে সেচ খরচ বৃদ্ধি পায়।
পানির উৎস থেকে ১০০ লিটার পানি উত্তোলন করা হলে তার মাঝে যত লিটার ব্যবহৃত হয় তাকে সেচ দক্ষতা বলে। যেমন- বাংলাদেশে বর্তমানে সেচ দক্ষতা মাত্র ৩৪ শতাংশ। ৩৪% সেচ দক্ষতা বলতে আমরা বুঝি পানির উৎস থেকে ১০০ লিটার পানি উত্তোলন করা হলে তার মাত্র ৩৪ লিটার ব্যবহৃত হয়। অবশিষ্ট পানি অপচয় হয়।
সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য সেচনালার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। নালার মাটি ভালোভাবে ঠেসে দিয়ে কাঁচা সেচনালা ভালোভাবে কম্পেকশন করে তৈরি করতে হয়। বর্তমানে পাকা সেচনালা ও ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ সেচনালায় পানির অপচয় খুবই কম হয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।